একদিন আকাশ ছোঁব । গাঢ় নীলে ভাসাবো স্বপ্ন খেয়া । বোধের অতল থেকে ডুব সাঁতারে তুলে আনি একেকটি শব্দ । চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা সুতোয় গেঁথে বানাই কবিতা । ছোপ ছোপ সাদা মেঘের পাপড়ি উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি । আমার কবিতা ছোঁয় আকাশ! আর আমি ছুঁই তোমাকে, পারমিতা..
পারমিতার আঙুল ছুঁয়ে হেটে বেড়াই বুনো ঘাস ছাওয়া নির্জন মাঠ । কাঁটা ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে আসা কুহকের ডাক বিদীর্ণ করে স্তব্ধ দুপুর । লোমকুপে হর্ষ জাগায় চেপে ধরা হাতের মিষ্টি আলিঙ্গন । আলপথের ঝুড়ঝুড়ে এঁটেল মাটি ভেঙ্গে পড়ে তার কোমল পায়ের আলতো চাপে । সামনে ঝুঁকে পড়া পারমিতার শরীর খুঁজে সাম্যাবস্থা, আমার পিঠের উপর । আমি ভূলুন্ঠিত হই, পারমিতার প্রেমে!
-ধ্যাত্তেরি! পা ব্যাথা হয়ে এলো..
পারমিতা আমাকে টেনে হিঁচড়ে এনে বসায় সিমেন্টের পাটাতনে, নাগরিক পার্কে । নাগরিক ইট কাঠ ঘিরে রাখে আমার আকাশ । আমার কবিতা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে হাইড্রলিক হর্ণ হয়ে । দেয়াল ঘেরা ছোট্ট পার্কটি হয়ে উঠে আমাদের প্রেমের নিত্য বসত ।
-এভাবেই কি চলবে?
-কেন চলবে না? হাতে হাত রেখে দিব্যি কাটবে জীবন!
-হেয়ালী রাখো! কিছু একটা না করলে বিয়ে করবে কিভাবে?
-তোমার আমার প্রেমে বিয়ে কোন বাধা ই নয়!
পারমিতার মুখশ্রী পাণ্ডুবর্ণে রুপ নেয় সহসাই । একরাশ শাপ শাপান্ত ছুটে আসে আমার দিকে । ভালোবাসার বোধ গভীরতার সাথে আয় উপার্জনের তুলনা কবি মনে বিবমিষা জাগায় । জাগতিক মোহের কাছে আমার ভালোবাসাকে হারতে দিতে পারি না । আমার ভালোবাসা যেমন গভীর তেমনই বিনাশী । আমি তাকে শুনাই সেই মোহময় কবিতা, জগত সংসার তুচ্ছ করে যেখানে শুধু ভালোবাসারই জয়গান ।
পারমিতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয় সব । সেই হাসি ছুড়ির ফলার মত বিদ্ধ করে আমার আজন্ম বিশ্বাস । তিলে তিলে গড়ে তোলা আমার স্বপ্নসৌধ মুহূর্তে ছারখার হতে দেখে আমিও পারমিতাকে চুড়ান্ত সাবধান করে দিই । নিকারাগুয়ান কবি আর্নেস্টো কার্দেনালের কবিতা আমি গেয়ে উঠি কবির সুমনের সুরে,
"সাবধান হও পারমিতা! হেসোনা এসব কথা শুনে
সময় খাজাঞ্চীর মত, হিসেব রাখছে গুনে গুনে.."
আমার সাবধান বানী মুহূর্তে তাতিয়ে দেয় পারমিতাকে । এক ঝটকায় পাটাতন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রণরঙ্গিনী সাঁজে ঝাপিয়ে পড়ে সে,
-একটাও বাজে কথা বলবা না! কবিতা খেয়ে পেট ভরবে? সকালে কবিতার পরোটা কবিতার অমলেট, দুপুরে কবিতার বিরিয়ানি, বিকেলে কবিতার চা-বিস্কিট, রাতে কবিতার সবজী-ভাতের ডিনার, বাহ!
আর শোন, আমি তোমার স্বপ্নের পারমিতা নই । আমি পাতা, এই ব্যস! তোমাকে তিনদিন সময় দিলাম, এর ভিতরে আমাকে বিয়ে করবা আর না হয় পাতা'কে চিরতরে ভুলে যাবা! দিস ইজ ফাইনাল!
অবাক বিস্ময়ে দেখে যাই স্বপ্নকণ্যার ক্রম বিবর্তন, পারমিতা এখন শুধুই 'পাতা' । আর তাই বিবর্তিত আমিও আজ শুধুই এক গৃহী । ককশ্য রমনীকন্ঠে কান ঝালাপালা সকাল নিয়ে আসে কাঁচা বাজারের বার্তা । ওয়াসার দুর্গন্ধময় পানি ছিটিয়ে দেয়া সবজীতে খুঁজি সতেজতা । সন্দিগ্ধ হাতে কানকা টিপে টিপে মাছে খুঁজি রাসায়নিক । তের নাম্বার বাসের বাদুর ঝোলা নিত্য অফিস যাত্রী । কবিতার বদলে দিনভর লিখি ডেবিট ক্রেডিটের লেজার জার্নাল ।
কোন এক অবসন্ন দুপুরে ভুলে যাওয়া কবিতারা আবার ফিরে আসে চুপিচুপি, ফিরে আসে পারমিতাও । সেই বেড়ে যাওয়া হৃদস্পন্দন, সেই স্বপ্ন খেয়ায় ফানুস উড়ানো । পারমিতাকে নিয়ে লেখা কবিতায় ভরে যায় প্রাইভেসি সেটিংস দেয়া অফিস ফোল্ডার । কে যেন শুনিয়ে গেল অফিসে নতুন সিইও আসছে! ইংল্যন্ড থেকে এমবিএ করা, মাল্টিন্যাশনালে ক্যারিয়ার গড়া শার্প প্রফেশনাল এক লেডি! কি এসে যায় তাতে, নাম যে তার 'পারমিতা বোস!'
ইনট্রোডিউসিং মিটিং উইথ পারমিতা বোস!
উত্তেজনার ঝড়ো হাওয়া পুরো হলরুম জুড়ে, আমি ধীর স্থির । এমডি স্যারের সাথে এলেন এক অপরুপা রমনী । নিটোল চাহনী, যেন শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তি । চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে মায়াবী আলো, যেন বা বনলতাসেন! জামদানী শাড়িতে অতি সাধারণ সাজগোজ । শরীর জুড়ে মধ্য চল্লিশের বাঁধ না মানা ভরাট যৌবন! যাদুময় কথা বলার ভঙ্গী, অদ্ভুত সুন্দর গলায় ব্যক্তিত্ব আর কর্তৃত্ব ঝরে পড়ছে । আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছি, চোখের সামনে পারমিতার কবিতারা কথা বলছে যেন..
-হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিতীয় সারির মাঝখানে আপনি...??
পাশে বসা কলিগের মৃদু ধাক্কায় আত্মস্থ হলাম । পারমিতা বোস আমাকে উদ্দেশ্য করেই কি যেন বলছেন! আমি বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে দাঁড়ালাম..
-অনেকক্ষন ধরেই দেখছি আপনি এবসেন্ট মাইন্ডেড! কি নিয়ে ভাবছিলেন এত? কবিতা টবিতা লেখা হয় নাকি!
পুরো হলরুম জুড়ে একটা মৃদু হাসির তরঙ্গ বয়ে যায় । বিব্রতকর অবস্থা কোনরকম সামলে শুধু বলি,
-না সরি ম্যাম প্লিজ..
-কোন ডিপার্টমেন্ট?
-ম্যাম.. একাউন্টস..
-ওকে, বি এটেন্ডটিভ! প্লিজ সিট ডাউন ।
দিন কতক পর পারমিতা বোসের সাইন করা বদলিপত্র পেয়ে প্রাণে পানি ফিরে আসে, চিত্তে ফিরে চাঞ্চল্য । পারমিতার প্রেমিক আজ পারমিতা বোসের ব্যক্তিগত সচিব । মিরর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নট মোটা করে বাঁধি । আড়চোখে পাতা'র জ্বলেপুড়ে যাওয়া অবয়ব দেখে মুচকি হাসি । বদলিপত্র দেখার পর থেকেই পাতা রহস্যজনক ভাবে নিশ্চুপ । সন্দেহ দানা বাঁধা শকুনি চোখের তীর্যতাকে তোড়াই পাত্তা দিয়ে বেড়িয়ে পড়ি ।
পাতা'র জব্ধ হওয়া পানসে মুখের উপর বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে ফুরফুরে মেজাজে অফিসে আসি । বিজয়ের রেশ আর থাকলো কই? সুন্দর মুখশ্রীর আড়ালে এ যে আরেক সিংহী নারী । বিজয়ের আতিশয্যে সামান্য কটা টাইপো মাত্র! কড়া স্বরে শুনিয়ে দিলে, মনযোগ না দিতে পারলে জব করার দরকার নেই! হু..
যে নীরবতাকে জব্ধ ভেবেছিলাম, বুঝিনি তা ছিল টর্নেডোর পূর্বাভাস! সামান্য ছুতোয় পাতা এখন দ্বিগুন তেজে তেড়ে আসে । সেই কর্কশ শব্দগুলোর সাথে যোগ হয় পারমিতা বোস কে নিয়ে অশ্রাব্য ইংগিত । ঝালাপালা কান আর রক্তপিনিক উঠা মাথাকে নিস্তার দিতে বেরিয়ে আসি বাসা থেকে ।
অফিসেও দুদন্ড শান্তি নেই । বোর্ড মিটিং এর প্রস্তুতি চলছে, রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করেছি এক নাগাড়ে । তবুও রেহাই নেই । কলিগদের সামনেই পারমিতা বোস খিচিয়ে উঠলো, ইউ বুলশিট!
আর সম্ভব নয়! ঘরে-বাইরে পুরো বিষিয়ে গেছি । এই দুই খন্ডারনীকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে । হ্যাঁ, আজই দিব । মতিঝিল থেকে ১৩ নাম্বার বাসে না উঠে হাটতে থাকি বঙ্গবন্ধু এভ্যিনিউ'র দিকে । রুচিতা বারে আজ চিবিয়ে চিবিয়ে খাব এই দুই পিচাশ নারীর হাড় মাংস ।
ওয়েটার কড়া দু'পেগ হুইস্কির গ্লাস আর সোডার বোতল দিয়ে যায় । গ্লাস হাতে নিয়ে চুকচুক করে ঢেলে দিলাম অনেকটুকু । একটা তীব্র ঝাঁজ হঠাৎ চোখমুখ ঝাপসা করে দিলো । শয়তান ওয়েটার পাশে এসে মুচকি হেসে বলে, স্যার সোডা মিশিয়ে নিন । একটা কড়া চাহনী দিয়ে ইশারায় আরো দু'পেগ অর্ডার দিই ।
হুইস্কির গ্লাসটার দিকে চোখ পড়তেই দেখি, তরলের রঙ পরিবর্তিত হয়ে টকটকে লাল হয়ে গেলো । পাতা'র লাল রক্ত যেন মিশে গেছে সোডার বদলে । আর থিকথিক করা ঐ জিনিসটা পারমিতা বোসের মগজ । রক্ত আর মগজ মেশানো হুইস্কি পান করি দুনিয়ার তাবৎ নিপীড়িত কবিদের স্বাস্থ্য প্রার্থনা করে ।
বদমাশ ওয়েটার বলে কিনা আমি ওভার ড্রান্ক হয়ে গেছি! ওর চৌদ্দগুষ্ঠিকে শাপশাপান্ত করে নেমে আসি বার থেকে । একাকী রাস্তায় আমি ছাড়া আছে কয়েকটা নেড়ি কুকুর । ওদের অতিক্রম করে এগিয়ে যাই নির্জন আব্দুল গণি রোডের দিকে ।
ঐ যে আকাশের বিশাল চাঁদ মোহময় হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আজকে চাঁদ এত কাছে এলো কিভাবে? চাঁদের বুকে আসন গেড়ে বসে পারমিতা আমায় আহবান করছে । আমার কবিতার পারমিতা, আমার স্বপ্নের পারমিতা ফুলেল বাসর সাজিয়ে আমার অপেক্ষায় । পারমিতার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তরতর করে ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে উঠে যেতে থাকি চাঁদের দিকে..
চোখ খুলতে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকরে যাই । অনুভব করতে চেষ্টা করি, আমি কোথায় আছি! আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি একটা ঘরে ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছি । জানালায় সাদা পর্দা ঝুলছে । সাদা গাউন পড়া নার্স সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো আমার হাতের কবজি ধরে আছে ।
'পেশেন্টের সেন্স ফিরেছে' বলেই নার্সটা দরোজার দিকে হাটা ধরে । ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা ভালো করে দেখতে গিয়ে দুই জোড়া চোখের তীব্র দৃষ্টিতে বিদ্ধ হই । আমার স্ত্রী 'পাতা' আর বস 'পারমিতা বোস' শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।
।।.........................................................................।।
যারা আমার বোধ কে নাড়ায় সতত, কবিদের প্রতি উৎসর্গীত!