সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্করী দুর্ঘটনায় আমার পরিবার পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । এরকম একটা আঘাত আমাদের উপর আসতে পারে, এটা আমরা কেউ কস্মিনকালেও ভাবিনি । ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বউ নির্বাক, হতভম্ব হয়ে গেছে । সাথে এসে যোগ দিয়েছে তার দুই ছোট বোন, তাদের জামাই সহ সপরিবারে । তিন বোন কখনো একসাথে ভূমিকম্পের মত আগ্নেয় লাভা উদগিরণ করে যাচ্ছে, আবার কখনো বিপর্যয় পরবর্তী আফটার শকের মতই কবরের নীরবতা তৈরি করছে । আমার শ্যালিকাদ্বয়ের বরেরাও সেই রকম পত্নী ভক্ত । বউয়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে সমান তালে চিক্কুনি দেয়, আবার বউরা চুপসে গেলে নিজেরাও গর্তে ঢুকে যায় । কিন্তু এই ঘটনায় আমি বেশ ফুরফুরে আনন্দ পাচ্ছি । রাগতো হচ্ছেইনা, বরং ওদের কান্ডকারখানা দেখে মোচের নীচে শুধু মুচকি হেসেই চলেছি । যদিও ঘটনাটি হাসির নয় মোটেও । ঘটনাটি আমাদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর, অনাকাঙ্ক্ষিত । আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর সাহেব তার প্রিয় ছেলেমেয়েদের অথৈ কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে দিব্যি আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছেন ।
আমার শাশুড়ী মারা যান বছর দশেক আগে, তিন কন্যা আর ছোট একটি ছেলে রেখে । পত্নী বিয়োগে শ্বশুর সাহেব কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পড়েন নি । বাবা-মা যৌথ ভূমিকায় রোল প্লে করে তিন কন্যাকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন । আর ছোট ছেলেটিকে স্টুডেন্ট ভিসায় ইউকে পাঠিয়েছেন বছর খানেক আগে । মেয়েদের বিয়ে আর ছেলে প্রবাসী হওয়ার পর শ্বশুর সাহেব একা হয়ে যান । পঞ্চাশ উত্তীর্ণ শক্ত পোক্ত মানুষটিকে হঠাৎ একাকিত্বের যন্ত্রনায় পেয়ে বসে । মেয়ে তিনটেই তার বাবা অন্তঃপ্রান । সবাই উনাকে নিজের বাসায় রেখে দিতে চায় । কিন্তু শ্বশুর সাহেবের মেয়েদের বাসা ভালো লাগেনা, কেমন যেন হীনমন্যতা আর অস্বস্থিতে ভোগেন । মেয়েরা যত্নআত্বির অভাব না রাখলেও তিনি কারো বাসায়ই বেশীদিন থাকতে চান না । এইবার মাস খানেক নিজের বাড়িতেই ছিলেন, তারপর হটাৎ করেই একদিন আমরা দুঃসংবাদটা পাই ।
আমার বাসায় সপ্তাহ খানেক ধরে থেমে থেমে ভূমিকম্প চলছে ।
বাবা এটা করতে পারলো ??
বাবা এই বয়সে এতটা নীচে নামতে পারলো ??
আমাদের কথা একবারও ভাবলোনা ??
ইত্যাদি ইত্যাদি । সাথে শীত লাগা রাতে শেয়ালের মত দলবেঁধে কান্না সঙ্গীতের আয়োজন, শ্যালিকাদের জামাইরা বায়া তবলা নিয়ে সেই সুর সংহত করে চলেছে সমান তালে । আমার মুচকি হাসিও দিনকে দিন পাংশুটে রুপ নিচ্ছে । আর সহ্য করতে না পেরে সবাইকে একদিন ডাকালাম । বিজ্ঞের মত ভাব নিয়ে ওদের বুঝাতে শুরু করলাম,
-দেখো, যা হবার হয়েছে । বাবাতো আমাদেরই, তাকে তো আর আমরা ফেলে দিতে পারবো না । উনার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে দশ বছর আগেই তা করতে পারতেন । কিন্তু তা না করে তোমাদের বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন এবং শেষে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছেন । তোমরা যখন উনার পাশে ছিলে তখন কোন সমস্যা ছিল না । এখন এই বয়সে উনার একাকীত্ব ভর করেছে । আমি বলি, তোমরা সবাই বাবার ভুলকে ক্ষমা করে দাও । বাবা তোমাদের সব ভাইবোন কে তার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসেন ।
যাক, গত দুদিনে মনে মনে প্র্যাকটিস করে সময় মত ভালোই একটা বক্তৃতা ঝেড়ে দিলাম । বক্তৃতা দেয়ার সময়ই নিজেকে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছিলো । অফিসে বসের সামনে আর বাসায় বউয়ের সামনে সারাক্ষন তো মুখ কাচুমাচু করেই রাখি । আজকে আমি ডায়াসে বীরদর্পে লেসন দিচ্ছি, সামনে আমার সদা মুখরা বউ সহ পাঁচজন মুখ কাচু মাচু করে বসে আছে । আহা, জীবনে এরকম বিমল আনন্দ আর দুর্লভ সম্মান খুব কমই পেয়েছি । তবে বক্তৃতা দেবার সময় ভয় পাইনি, এটা হলফ করে বলতে পারবো না । বরং আশন্কা হচ্ছিলো, তিন বোন তেড়েমেরে না আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিন্তু সব আশন্কা দূর হয়ে গেলো যখন দেখলাম তিন বোনই অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বসে আছে আর নীরবে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুচছে । এই দৃশ্য দেখে শ্লাঘা বোধ হচ্ছিলো, আমার জীবনের সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজটি এই মাত্র করতে পেরেছি বলে । আমার বক্তৃতাকালীন সময়ে শ্যালিকা জামাইরা বুঝে উঠতে পারছিলো না আমাকে সাপোর্ট দিবে না কি বিরোধিতা করবে । বারবার অসহায়ের মত তারা তাদের বউদের দিকে তাকিয়ে ছিলো, নিজ নিজ বউয়ের মনোভাব বোঝার জন্য । পরিস্থিতি আমার দিকে অনুকুল দেখে এক পর্যায়ে তাদের মুখেও খোল তবলার বোল বাজতে থাকলো ।
আমার বক্তৃতা সফল হওয়ায় নিজেকে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সমঝদার জ্ঞানী লোক বলেই মনে হচ্ছে । নিজের শ্বশুরের পুনর্বিবাহের ঘটনায় মুচকি হেসে কয়েকবার বউয়ের রক্তচক্ষুর সামনেও পড়েছিলাম । কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকুল থাকায় আমার বউ এই মিচকে হাসির হিসাব নিকাষ ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছিলো । আজকের এই সফল বক্তৃতায় আমার মিচকে হাসিটাকে সার্থক করে দিলাম । সারাদিন তাই বুক ফুলিয়ে এ ঘর ও ঘর ঘুরলাম । শালীদের বস্তাপচা কিছু জোক শুনিয়ে কাতুকুতু হাসানোর চেষ্টা করলাম । আর শ্যালিকার জামাইদের সামনে এমনি ভাব নিলাম যেন ছাগ সম্প্রদায়ের সামনে সিংহ পুরুষ !
রাতে বিছানায় ওপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া বউয়ের পাশে চুপচাপ শুয়ে আছি । সারাদিন মনের ভেতর বয়ে চলা চিত্তচাঞ্চল্যের রেশ তখনো কিছু পরিমাণে রয়ে গেছে । এর প্রভাবে ঘুম আসতে দেরী হচ্ছিলো, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে এপাশ হয়ে শুয়ে রয়েছি । হঠাৎ বউ ওপাশ থেকে এপাশ হয়ে ঘুরে আমার বুক গলায় হাতড়ে কি যেন খুঁজতে থাকে । আহা, আমি বেশ পুলক অনুভব করতে থাকি । শ্বশুর সাহেব যেদিন থেকে নতুন বিয়ে করে আনন্দ ফুর্তি করে চলেছেন, সেদিন থেকে আমার সংসারে নিরানন্দ এসে ভর করেছে । তাই বউয়ের বুক গলা হাতড়ে বেরানোতে অনেকদিন পর আমার রোমান্টিক অনুভুতি হতে থাকে । আজকের এই সফল বক্তৃতায় আমার সংসারে শুধু শান্তিই আসেনি, পুরানো রোমান্সটাও ফিরে এসেছে । আমিও আমার বউয়ের হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছি আর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য নিজেকে ধন্য ধন্য করছি ।
নাক মুখ হাতড়াতে হাতড়াতে বউ মাথার পেছনে থাকা টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টাশ করে অন করে দিলো । হটাৎ তীব্র আলোর ঝলকানি চোখে পড়ায় হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বিরক্ত হয়ে বললাম, লাইট জ্বালিয়েছো কেন ?? ‘তোমাকে দেখার জন্য’- বলেই আবার টাশ করে লাইটের সুইচ অফ করে দিলো । এত সুন্দর একটা রোমান্টিক বাক্য আমার বউ এমনই শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো, আমার কর্ণগুহরে প্রবেশ মাত্রই যেন আত্মারাম খাঁচা ছেঁড়ে পালাতে চাইলো । ভয়ঙ্কর বিপদের গন্ধ টের পেয়ে আমি হিম হয়ে কুঁচকে যেতে থাকি । এই সময়ে আবার লাইট জ্বেলে সে শুয়া থেকে বিছানার উপর উঠে বসলো । তার চোখের রক্তচাহনী দেখে আমিও শুয়া থেকে উঠে গুটিসুটি মেরে বসে করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে ??’
-কি হয়েছে তুমি জানোনা ? বাবার বিয়ের পক্ষে উকালতি করে তুমি কি বুঝাতে চাইছো ?? নিজে আরেকটা বিয়ে করার সব বন্দোবস্ত পাকা করে রাখছো, তাইনা ?? আমি কিছু বুঝিনা মনে করেছো । তোমার মিচকে হাসি দেখেই তোমার ভিতরের মিনমিনে শয়তানিটা ধরতে পেরেছিলাম ।
-আহ কি বলছো এসব । আমি আমি কেন আবার...
-একদম চুপ । একটা কথাও বলবা না । কোন সিন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবা না...
আমতা আমতা করেও কোন কথা বলার সুযোগ না পেয়ে হা করে চোখ বড় করে বউয়ের কথা শুনতে থাকলাম । এর আগে কারো সামনে নিজেকে কখনো এতটা অসহায় এতটা নার্ভাস এতটা বোকা লাগেনি । জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামির শাস্তিটা আমি পেতে চলেছি...