somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ বোকা মানুষ ।

১০ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্করী দুর্ঘটনায় আমার পরিবার পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । এরকম একটা আঘাত আমাদের উপর আসতে পারে, এটা আমরা কেউ কস্মিনকালেও ভাবিনি । ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বউ নির্বাক, হতভম্ব হয়ে গেছে । সাথে এসে যোগ দিয়েছে তার দুই ছোট বোন, তাদের জামাই সহ সপরিবারে । তিন বোন কখনো একসাথে ভূমিকম্পের মত আগ্নেয় লাভা উদগিরণ করে যাচ্ছে, আবার কখনো বিপর্যয় পরবর্তী আফটার শকের মতই কবরের নীরবতা তৈরি করছে । আমার শ্যালিকাদ্বয়ের বরেরাও সেই রকম পত্নী ভক্ত । বউয়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে সমান তালে চিক্কুনি দেয়, আবার বউরা চুপসে গেলে নিজেরাও গর্তে ঢুকে যায় । কিন্তু এই ঘটনায় আমি বেশ ফুরফুরে আনন্দ পাচ্ছি । রাগতো হচ্ছেইনা, বরং ওদের কান্ডকারখানা দেখে মোচের নীচে শুধু মুচকি হেসেই চলেছি । যদিও ঘটনাটি হাসির নয় মোটেও । ঘটনাটি আমাদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর, অনাকাঙ্ক্ষিত । আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর সাহেব তার প্রিয় ছেলেমেয়েদের অথৈ কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে দিব্যি আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছেন ।

আমার শাশুড়ী মারা যান বছর দশেক আগে, তিন কন্যা আর ছোট একটি ছেলে রেখে । পত্নী বিয়োগে শ্বশুর সাহেব কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পড়েন নি । বাবা-মা যৌথ ভূমিকায় রোল প্লে করে তিন কন্যাকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন । আর ছোট ছেলেটিকে স্টুডেন্ট ভিসায় ইউকে পাঠিয়েছেন বছর খানেক আগে । মেয়েদের বিয়ে আর ছেলে প্রবাসী হওয়ার পর শ্বশুর সাহেব একা হয়ে যান । পঞ্চাশ উত্তীর্ণ শক্ত পোক্ত মানুষটিকে হঠাৎ একাকিত্বের যন্ত্রনায় পেয়ে বসে । মেয়ে তিনটেই তার বাবা অন্তঃপ্রান । সবাই উনাকে নিজের বাসায় রেখে দিতে চায় । কিন্তু শ্বশুর সাহেবের মেয়েদের বাসা ভালো লাগেনা, কেমন যেন হীনমন্যতা আর অস্বস্থিতে ভোগেন । মেয়েরা যত্নআত্বির অভাব না রাখলেও তিনি কারো বাসায়ই বেশীদিন থাকতে চান না । এইবার মাস খানেক নিজের বাড়িতেই ছিলেন, তারপর হটাৎ করেই একদিন আমরা দুঃসংবাদটা পাই ।

আমার বাসায় সপ্তাহ খানেক ধরে থেমে থেমে ভূমিকম্প চলছে ।
বাবা এটা করতে পারলো ??
বাবা এই বয়সে এতটা নীচে নামতে পারলো ??
আমাদের কথা একবারও ভাবলোনা ??

ইত্যাদি ইত্যাদি । সাথে শীত লাগা রাতে শেয়ালের মত দলবেঁধে কান্না সঙ্গীতের আয়োজন, শ্যালিকাদের জামাইরা বায়া তবলা নিয়ে সেই সুর সংহত করে চলেছে সমান তালে । আমার মুচকি হাসিও দিনকে দিন পাংশুটে রুপ নিচ্ছে । আর সহ্য করতে না পেরে সবাইকে একদিন ডাকালাম । বিজ্ঞের মত ভাব নিয়ে ওদের বুঝাতে শুরু করলাম,

-দেখো, যা হবার হয়েছে । বাবাতো আমাদেরই, তাকে তো আর আমরা ফেলে দিতে পারবো না । উনার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে দশ বছর আগেই তা করতে পারতেন । কিন্তু তা না করে তোমাদের বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন এবং শেষে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছেন । তোমরা যখন উনার পাশে ছিলে তখন কোন সমস্যা ছিল না । এখন এই বয়সে উনার একাকীত্ব ভর করেছে । আমি বলি, তোমরা সবাই বাবার ভুলকে ক্ষমা করে দাও । বাবা তোমাদের সব ভাইবোন কে তার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসেন ।

যাক, গত দুদিনে মনে মনে প্র্যাকটিস করে সময় মত ভালোই একটা বক্তৃতা ঝেড়ে দিলাম । বক্তৃতা দেয়ার সময়ই নিজেকে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছিলো । অফিসে বসের সামনে আর বাসায় বউয়ের সামনে সারাক্ষন তো মুখ কাচুমাচু করেই রাখি । আজকে আমি ডায়াসে বীরদর্পে লেসন দিচ্ছি, সামনে আমার সদা মুখরা বউ সহ পাঁচজন মুখ কাচু মাচু করে বসে আছে । আহা, জীবনে এরকম বিমল আনন্দ আর দুর্লভ সম্মান খুব কমই পেয়েছি । তবে বক্তৃতা দেবার সময় ভয় পাইনি, এটা হলফ করে বলতে পারবো না । বরং আশন্কা হচ্ছিলো, তিন বোন তেড়েমেরে না আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিন্তু সব আশন্কা দূর হয়ে গেলো যখন দেখলাম তিন বোনই অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বসে আছে আর নীরবে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুচছে । এই দৃশ্য দেখে শ্লাঘা বোধ হচ্ছিলো, আমার জীবনের সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজটি এই মাত্র করতে পেরেছি বলে । আমার বক্তৃতাকালীন সময়ে শ্যালিকা জামাইরা বুঝে উঠতে পারছিলো না আমাকে সাপোর্ট দিবে না কি বিরোধিতা করবে । বারবার অসহায়ের মত তারা তাদের বউদের দিকে তাকিয়ে ছিলো, নিজ নিজ বউয়ের মনোভাব বোঝার জন্য । পরিস্থিতি আমার দিকে অনুকুল দেখে এক পর্যায়ে তাদের মুখেও খোল তবলার বোল বাজতে থাকলো ।

আমার বক্তৃতা সফল হওয়ায় নিজেকে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সমঝদার জ্ঞানী লোক বলেই মনে হচ্ছে । নিজের শ্বশুরের পুনর্বিবাহের ঘটনায় মুচকি হেসে কয়েকবার বউয়ের রক্তচক্ষুর সামনেও পড়েছিলাম । কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকুল থাকায় আমার বউ এই মিচকে হাসির হিসাব নিকাষ ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছিলো । আজকের এই সফল বক্তৃতায় আমার মিচকে হাসিটাকে সার্থক করে দিলাম । সারাদিন তাই বুক ফুলিয়ে এ ঘর ও ঘর ঘুরলাম । শালীদের বস্তাপচা কিছু জোক শুনিয়ে কাতুকুতু হাসানোর চেষ্টা করলাম । আর শ্যালিকার জামাইদের সামনে এমনি ভাব নিলাম যেন ছাগ সম্প্রদায়ের সামনে সিংহ পুরুষ !

রাতে বিছানায় ওপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া বউয়ের পাশে চুপচাপ শুয়ে আছি । সারাদিন মনের ভেতর বয়ে চলা চিত্তচাঞ্চল্যের রেশ তখনো কিছু পরিমাণে রয়ে গেছে । এর প্রভাবে ঘুম আসতে দেরী হচ্ছিলো, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে এপাশ হয়ে শুয়ে রয়েছি । হঠাৎ বউ ওপাশ থেকে এপাশ হয়ে ঘুরে আমার বুক গলায় হাতড়ে কি যেন খুঁজতে থাকে । আহা, আমি বেশ পুলক অনুভব করতে থাকি । শ্বশুর সাহেব যেদিন থেকে নতুন বিয়ে করে আনন্দ ফুর্তি করে চলেছেন, সেদিন থেকে আমার সংসারে নিরানন্দ এসে ভর করেছে । তাই বউয়ের বুক গলা হাতড়ে বেরানোতে অনেকদিন পর আমার রোমান্টিক অনুভুতি হতে থাকে । আজকের এই সফল বক্তৃতায় আমার সংসারে শুধু শান্তিই আসেনি, পুরানো রোমান্সটাও ফিরে এসেছে । আমিও আমার বউয়ের হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছি আর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য নিজেকে ধন্য ধন্য করছি ।

নাক মুখ হাতড়াতে হাতড়াতে বউ মাথার পেছনে থাকা টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টাশ করে অন করে দিলো । হটাৎ তীব্র আলোর ঝলকানি চোখে পড়ায় হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বিরক্ত হয়ে বললাম, লাইট জ্বালিয়েছো কেন ?? ‘তোমাকে দেখার জন্য’- বলেই আবার টাশ করে লাইটের সুইচ অফ করে দিলো । এত সুন্দর একটা রোমান্টিক বাক্য আমার বউ এমনই শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো, আমার কর্ণগুহরে প্রবেশ মাত্রই যেন আত্মারাম খাঁচা ছেঁড়ে পালাতে চাইলো । ভয়ঙ্কর বিপদের গন্ধ টের পেয়ে আমি হিম হয়ে কুঁচকে যেতে থাকি । এই সময়ে আবার লাইট জ্বেলে সে শুয়া থেকে বিছানার উপর উঠে বসলো । তার চোখের রক্তচাহনী দেখে আমিও শুয়া থেকে উঠে গুটিসুটি মেরে বসে করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে ??’

-কি হয়েছে তুমি জানোনা ? বাবার বিয়ের পক্ষে উকালতি করে তুমি কি বুঝাতে চাইছো ?? নিজে আরেকটা বিয়ে করার সব বন্দোবস্ত পাকা করে রাখছো, তাইনা ?? আমি কিছু বুঝিনা মনে করেছো । তোমার মিচকে হাসি দেখেই তোমার ভিতরের মিনমিনে শয়তানিটা ধরতে পেরেছিলাম ।

-আহ কি বলছো এসব । আমি আমি কেন আবার...

-একদম চুপ । একটা কথাও বলবা না । কোন সিন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবা না...

আমতা আমতা করেও কোন কথা বলার সুযোগ না পেয়ে হা করে চোখ বড় করে বউয়ের কথা শুনতে থাকলাম । এর আগে কারো সামনে নিজেকে কখনো এতটা অসহায় এতটা নার্ভাস এতটা বোকা লাগেনি । জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামির শাস্তিটা আমি পেতে চলেছি...



সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:৫১
৫০টি মন্তব্য ৫০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×