পর্দার ফাঁক গলে শেষ বিকেলের এক টুকরো সোনালী আলো এসে পড়েছে ঘরের দেয়ালে । সেখানে চিকচিক করে উড়ছে শত-হাজার ধুলিকণা । অন্ধকার গুমোট ঘরে জানান দিয়ে যাচ্ছে যেন জীবন এখানে এখনো চলমান । অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাতের উপর ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলো আহনাফ । মাথাটা ঘুরছে ভন ভন করে । অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে এমন হতেই পারে । কিন্তু আহনাফের মাথা ঘোরাটা আলোর জন্য নয় । অনাহার তাকে ক্রমশ নির্জীব করে দিচ্ছে ।
এটা আহনাফের স্বেচ্ছা নির্বাসন, নিজেরই ফ্ল্যাটে । সে হাইবারনেশনে কাটাতে চায় কিছুদিন । কিছুদিন মানে হলো ততদিন, যতদিনে সে তার সকল অতীত স্মৃতি ভুলে যেতে পারবে । এক সপ্তাহের হাইবারনেশন প্রায় সফল । শুধু অতীতের একটা ঝাঁপসা ছবি এখনো তার চোখে বারবার ভাসছে । আহনাফের বয়স তখন ছয় বা সাত । বাবা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাবে, সে বায়না ধরলো সাথে যাবে বলে । ফিরে আসার পর মা তাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না । আহনাফ তখন বলেছিলো, 'মা আমি না থাকলে তুমি কি ভয় পাও' ? মা আঁচলে চোখ মুছে বলেছিলেন, 'না রে বাবা, তুই কাছে না থাকলে আমার কিছুই ভালো লাগেনা' । আহনাফ তখন বলেছিলো, 'এরপর তুমি ভয় পেলে আমাকে ডাকবে' ।
হাইবারনেশনের প্রথম দিনটা মোটামুটি বিছানায় শুয়েই পার হয়েছিলো । দিনশেষে মনে হলো সব কাজের জন্যই প্রস্তুতি দরকার । প্রাণীরা শীতনিদ্রায় যাওয়ার আগে শরীরে পর্যাপ্ত চর্বি জমিয়ে রাখে । উপবাসকালে শরীর তার প্রয়োজনীয় শক্তি ঐ চর্বি থেকেই সংগ্রহ করে । কিন্তু আহনাফ এতোটাই হাড্ডিসার, অনাহারে সে একদিনও টিকতে পারলোনা । বাধ্য হয়ে তাকে ফ্রীজে সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্যের খোঁজ নিতেই হলো । এক প্লেট বাসি ভাত, এক পিরিচ সবজী, অর্ধেক বাটি ডাল, পাঁচটা ডিম, এক বোতল টমেটো সস আর কয়েকটা আপেল- এই দিয়ে আরো তিনদিন পার করতে পেরেছে । এগুলি শেষ হবার পর কিচেনে অনুসন্ধান চালিয়ে কেজি খানেক চাল আর কয়েকটা আধ-পঁচা আলুর সন্ধান পায় । সাদাভাত আর সিদ্ধ আলু দিয়ে আরো তিনদিন ।
আজকে সারাদিন ধরে না খেয়েই আছে আহনাফ । তেষ্টা পেলে ট্যাপে মুখ লাগিয়ে পানি পান করে নিচ্ছে । বিছানার স্ট্যান্ড ধরে উঠার চেষ্টা করেও বসে পড়লো সে । মাথাঘোরা নিয়ে তবুও উঠতে হলো, দরজায় কে যেন নক করে চলেছে । এই কয়দিনে পরিচিত কেউ তার কোন খোঁজ নেয়নি । এমনকি একটা ভিখিরিও এসে দরজায় নক করেনি । পাঁচতলায় ফ্ল্যাট বলে এমনিতেই ভিখিরি বা সবজীওয়ালারা উপরে উঠেনা ।
হোম অ্যাপেয়ারেন্স কোম্পানীর একজন সেলসম্যান মাল্টিপল ইউজার ব্লেন্ডার বিক্রি করতে এসেছে । এমনিতে অপরিচিত কেউ বাসায় নক করলে আহনাফ বিরক্ত হয়, ঠাস করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় । কিন্তু আজকে দরজা বন্ধ করারও শক্তি সে পেলোনা, সেলসম্যানের দিকে নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো । সেলসম্যান এটাকে 'বায়িং সিগনাল' ধরে নিয়ে দ্বিগুন উৎসাহে ব্লেন্ডারের ফিচার-এডভান্টেজ-বেনেফিট গড়গড় করে বলে যেতে থাকে । এক পর্যায়ে নাছোড়বান্দা সেলসম্যান আবিষ্কার করে, তার প্রসপেক্ট কাস্টমার মাছের চোখের মত রক্তশুন্য দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে । আর কথা না বাড়িয়ে ঝটপট ব্লেন্ডারখানা ব্যাগে চালান দিয়ে 'নেক্সট কল ফাউন্ডেশন' না করেই সে বিদায় নেয় ।
ট্যাপের পানিটা বড়ই বিস্বাদ লাগছে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে গেছে । তবু সে বাতি জ্বালাল না, হাইবারনেশনে যাওয়ার পর এই ফ্ল্যাটে বাতি জ্বলেনি । এমনকি জানালাগুলোও ঢাকা রয়েছে গাঢ় নীল পর্দায় । পা টিপে টিপে কোন রকম বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো আহনাফ । অনেকক্ষন চিন্তাশুন্য সময় পার করার পর তার ভাবনা এলো, না এভাবে হবেনা । আর মাত্র কয়েকটা দিন পার করতে পারলে হয়তো মায়ের স্মৃতিটাও ভুলে যাওয়া যাবে । আর এটা করতে হলে তাকে নতুন করে হাইবারনেশনে যেতে হবে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ।
পূর্ণ প্রস্তুতিতে হাইবারনেশন, ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আহনাফের মন চনমন হয়ে উঠলো । তখনই বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ইচ্ছেমত শরীরটা ভিজিয়ে নিলো । শীতল জলের স্পর্শে তার প্রতিটি কোষ যেন জেগে উঠছে নব আনন্দে । তারপর চটপট রেডি হয়ে নিচে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে ছুটলো শহরের সবচেয়ে ইয়াম্মি রেস্তোরার দিকে । পুরানো রাস্তাঘাট তার কাছে নতুন বলে ভ্রম হতে থাকে, যেন বা এই শহরে সে এক আগুন্তুক । এমনিতে আহনাফ স্বল্পাহারী, কিন্তু আজ সে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি খেয়েছে । বেশি সময় ধরে হাইবারনেশনে থাকার প্রয়োজনে কিংবা ক্ষিধে পেটে খাওয়াটা এমনিতে বেশি হয় বলে । আর সাথে বেশ পরিমান খাবার সাথে করে নিয়ে এসে ফ্রীজবন্দী করলো ।
কয়দিনের অর্ধাহার-অনাহারে ক্লান্ত শরীর স্নান-খাদ্য পেয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই নেতিয়ে পড়তে থাকে । ঘুমঘুম চোখে সে প্ল্যান করে নেয় এবারের শীতনিদ্রায় আট-দশদিন থাকতে পারলেই হয়ত মায়ের সেই আবছা স্মৃতিটুকুও ভুলে যাওয়া যাবে চিরতরে । আর অতীত বিস্মৃত একটা মানুষ আবার নতুন উদ্যমে নতুন উৎসাহে নিজের পূণর্জন্ম ঘটাবে, এই হাইবারনেশনের মাধ্যমে ।
একরাত্রি গভীর নিদ্রার পর কাকডাকা ভোরে আহনাফের ঘুম ভেঙ্গে যায় । শরীরের এই ক'দিনের ক্লান্তিটাও আর নেই । পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদো আলো আসছে । বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করার পর আহনাফ বুঝতে পারে তার সম্ভোগের ইচ্ছে জাগছে । ইচ্ছেটা শুধু তার মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃস্বরণই বাড়াচ্ছেনা, গোপন অঙ্গটাকেও ক্রমশ জাগিয়ে তুলছে । একটা বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে ভরে যায় তার প্রান মন । এবং হঠাৎই তার সোমার কথা মনে পড়তে থাকে । শেষ কয়েকমাস তার এই বিশেষ অঙ্গ কোন কিছুতেই প্রণোদনা পেতো না । সোমা অনেক চেষ্টা তদবির করেও জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে স্নানঘরে গিয়ে ঢুকতো ।
আহনাফ এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা খুলে দেয় । গত এক সপ্তাহ ধরে মুলত যাকে ভুলে যাওয়ার জন্য সে হাইবারনেশনে থেকেছিলো, সেই সোমা আরও তীব্রভাবে তার স্মৃতিতে আসতে থাকে । অনেকক্ষণ ধরে এঘর ওঘর পায়চারি করার পর সে নিচে নেমে আসে ।
ঝিরঝিরে নির্মল হাওয়া বইছে ভোরের আলো ফোঁটা নির্জন রাস্তা জুড়ে । যে ক'জন মানুষ রাস্তায় আছে তারা প্রায় সবাই প্রাতঃভ্রমনে ব্যস্ত । সোজা রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে অনেকটুকু হাটার পর একটা খালি প্লটের কাছে এসে থামে আহনাফ । দুটো ফুটফুটে বাচ্চা একটা রাবারের বল নিয়ে খেলছে । এই বাচ্চাদের সাথে তার খেলতে ইচ্ছে হয় । কিন্তু বাচ্চা দুটো এই অদ্ভুত লোকটাকে দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে । তবু তিনজনে এক সময় ভাব হয়ে যায় । এক পর্যায়ে একজন ভদ্রলোক আসেন বাচ্চাদের নিয়ে যেতে । যাবার সময় তিনি আহনাফের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করেন । এত জোড়ে হ্যান্ডশ্যাক যে আহনাফ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে, আর বাচ্চাদুটো আবারও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে থাকে । ভদ্রলোক তার হাতে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, গোএহেড ম্যান ।
আহনাফ ফিরে চলে তার নিজের বাসার দিকে । এক সময়ের শান্ত নিরীহ আহনাফ সোমার প্রেমে পাগল হয়েছিলো । সোমার সাথে অবশেষে তার ভালোবাসা হয়, এমনকি বিয়েও । কিন্তু তার পাগলামোটা আর বন্ধ হয়নি । কোন কারণ ছাড়াই একটার পর একটা চাকরি ছেড়েছে আহনাফ । সোমা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও তাকে স্থির করতে পারেনি । শেষে সোমা নিজেই একটা চাকরিতে যোগ দেয় । সোমা চাকরি নেয়ার পর আহনাফ আরও ছন্নছাড়া হতে থাকে । বাসার দিকে ফিরতে ফিরতে আহনাফ ভাবে, অনেক অনেক অন্যায় সে করেছে সোমার সাথে । কিন্তু আর না, এইবারই সে শেষ বারের মতো ফিরিয়ে আনবে সোমাকে । সরি সোমা, আমার লক্ষ্নী সোমা, এবারের মত তুমি আমাকে ক্ষমা করো ।
ঘরে ফিরেই আহনাফ সিদ্ধান্ত নেয়, আজই সে সোমাকে চিঠি লিখবে । তারপর কাল ঐ চিঠি সোমাদের বাড়িতে পৌছানোর পর সেও গিয়ে হাজির হয়ে সোমাকে চমকে দিবে । প্রেমের প্রথম দিকে আহনাফ সোমাকে চিঠি লিখতো, আজও সে লিখবে । চিঠি লেখার জন্য আহনাফ তখনই রিডিং রুমে চলে যায় । একটা কাগজ বের করে কি লিখে চিঠি শুরু করা যায় ভাবতে থাকে । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় টেবিলের এক কোনে পড়ে থাকা ফিকে হলুদ রঙের একটা কাগজের দিকে । মাছের চোখের মতো নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে সে কেবলই তাকিয়ে থাকে টাইপ করা সেই কাগজটির দিকে ।
গত সপ্তাহে কাগজটি এসেছিলো রেজিস্টার্ড ডাকে, সোমার পাঠানো ডাইভোর্স লেটার ।
**************************************
আরো কিছু গল্প:
দি হেলো ইফেক্ট
কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায় :-< :-&
ছবি: গুগল ।