ঘুম ভাঙ্গার পরই যেন একটা ফুড়ফুড়ে অনুভুতি বয়ে যাচ্ছে শরীর-মন জুড়ে । বিভ্রম হচ্ছে, কোন শ্বেত-শুভ্র বরফঘেরা ঈগলু ঘরে শুয়ে আছি কিংবা সাদা কাফনে মোড়া কবরে । আচ্ছা, কবরেও কি এই রকম শীতল আনন্দের অনুভূতি হয় ? কিংবা ঈগলু ঘরে ? ইচ্ছে রইলো কোনদিন বরফের ঈগলু ঘরে রাত কাটিয়ে অনুভুতি পরখ করার । কিন্তু কবরে আদৌ কোন অনুভূতি বোধ থাকবেনা কিনা নিশ্চিত নই । তবে হোটেলের যে কক্ষে শুয়ে আছি তার পুরোটাই সাদা রঙে মোড়ানো- সাদা দেয়াল, জানালায় সাদা রঙের পর্দা, বালিশ-চাঁদর এমনকি সোফার কভারও সাদা ।
ফ্রেশ হয়ে চা-নাশতা খেয়ে নিচে নামলাম । অফিসের কাজে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চিটাগাং আছি, আজ এক বেলার জন্য একটু অবসর সময় পেলাম । যাই একটু আগ্রাবাদ ঘুরে আসি, ইউনি বন্ধু পাপন কয়েকদিন ধরে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছে । আজকের এই একবেলা অবসর সময়টা কাজে লাগিয়ে আসি ।
চকবাজার মোড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সিএনজি'র জন্য দাঁড়িয়ে আছি । আগে কখনো আগ্রাবাদ যাইনি, তাই জানিনা ভাড়া কত নিবে । আমারও তাড়া নেই, আয়েশে সিগারেট ফুকছি আর সিএনজি ওয়ালাদের ভাড়া জিজ্ঞেস করছি । সিগারেট শেষ হতে হতে যেটা পাব সেটায়ই উঠে পড়বো । আশেপাশে অসংখ্য চলমান মানুষ আর যানবাহন, কেউ কারো দিকেই তেমন দৃষ্টিপাত করছেনা । হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এক নজর দেখেই দৃষ্টি সিএনজি'র দিকে দিলাম, তার দিকে ফের তাকানোর কোন আগ্রহ পেলাম না । আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা, সাথে কালো নেকাব, কালো স্কার্ফ আর বাদামী রঙের রোদচশমা পড়া একজন মহিলা হয়ত আমার মতই, কোন বাহনের অপেক্ষায় । একটা ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে সাগরের দিক হতে । চিটাগাংয়ের আবহাওয়া আর্দ্র আর ভ্যাপসা বলেই জানি, কিন্তু মার্চের এই সকালবেলার ঝিরঝিরে বাতাস দারুন উপভোগ্য ।
একটা সিএনজি ঠিক করে উঠতে যাব, এমন সময় পেছন দিক থেকে কে যেন ডাক দিলো, মাহমুদ শোন.. ! আশেপাশে সবাই চলমান, শুধু নেকাবধারিনী আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে । জায়গায় দাঁড়িয়েই বললাম, আমাকে কিছু বলছেন ? রোদচশমাটা এক হাত দিয়ে নামিয়ে মুচকি হেসে বললো, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি !! ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস হঠাৎ যেন লু হাওয়ার রুপ নিয়ে আমার গায়ে গরম ছ্যাক দিলো । গলার স্বরের সাথে চোখ-মুখ পরখ করে নিশ্চিত হলাম, এ যে রুচিতা !! আড়ষ্ট পায়ে হেটে কাছে গেলাম, রুচিতা তখনও মিটমিট করে হাসছে । লং কোটের মতো ডিজাইন করা বোরখা আর রেশমী কাজ করা নেকাব-স্কার্ফে তাকে ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে ।
অবাক হওয়ার ব্যাপারটা দ্রুত সামলিয়ে কন্ঠ নামিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম, 'তুমি এখানে ? কিভাবে সম্ভব ??' রুচিতা চোখ নাচিয়ে উত্তর দিলো, 'অসম্ভব হবে কেন ? তোমার সাথে যেকোন জায়গায়ই দেখা হতে পারে । এখানে হয়েছে, তাতে সমস্যা কি ?' রুচিতার কথার কৃত্রিম দৃঢ়তা দেখে হেসে ফেললাম । মজা করে বললাম, 'অবগুন্ঠনে আবদ্ধ রেখে পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে নিজেকে বন্চিত রেখেছো কেন ?' রুচিতা খিক খিক করে হেসে দিলো, সেই আগের মতোই প্রাণখোলা দীর্ঘ হাসি । হাসতে হসতেই বললো, 'তোমার সাথে দেখা হবে এই আশায় চোখ দুটি এখনো খোলা রেখেছি ।' তার এই কথাটি তীব্র শ্লেষ হয়ে যেন আমার বুকে বিঁধলো । প্রসংগ পাল্টিয়ে বললাম, 'কোথায় থাকো ? কি করো ?' আমার গলার স্বরের পরিবর্তন রুচিতা মনে হয় ধরতে পেরেছে । সেও গলা নামিয়ে বললো, 'আমরা জুরিখে থাকি । কিছুদিন আগে দেশে এসেছি । আমার একজন মামা থাকেন চিটাগাংয়ে, মা তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়েছিলেন । কালকেই ঢাকা ফিরবো ।' তারপর রোদচশমাটা চোখে দিয়ে বললো, ' কিছু মনে করোনা মাহমুদ, তোমার সাথে বলার মতো অনেক কথা জমে আছে । কিন্তু এখন কিছুটা তাড়া আছে, প্লিজ তোমার সেল নাম্বারটা দাও ।'
সিএনজিতে আগ্রাবাদ যাচ্ছি, কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছে । ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসটা আবার গায়ে এসে লাগছে । মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছি, গায়ে কাঁটা দিলে যেমন হয় । রুচিতার সাথে এভাবে কখনো দেখা হয়ে যেতে পারে চিন্তাই করিনি । রুচিতার সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা কি পাপন কে জানাবো ? আচ্ছা, রুচিতার দেশে আসার খবরটাতো পাপনের জানা থাকা উচিৎ । রুচিতার সাথে ক্যাম্পাসে আমার দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেম ছিলো, পাপনও প্রেম করতো । প্রায় সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের কোন নির্জন স্থানে আমি-রুচিতা আর পাপন-তিথী পাশাপাশি বসে প্রেম করতাম । ক্যাম্পাস জীবন শেষে একটা ছোট চাকরি নিয়ে ঢাকায় আসার পর রুচিতার মা আমার বাবা-মায়ের সংগে কথা বলতে চাইলেন । পাপনই তখন দুই পক্ষের মাঝে মিডিয়া হিসাবে আবির্ভুত হয় । আমার মা কথা দিয়েছিলেন ছয় মাসের মধ্যে রুচিতাকে ঘরে তুলে নিবেন । তারপর থেকে পাপনকে নিয়ে আমি প্রায়ই যেতাম রুচিতাদের বাসায় । রুচিতার মা তার হবু মেয়েজামাইকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতোই মনে করতেন । মাঝেমধ্যে চুপিসারে রুচিতার ঘরেও চলে যেতাম । সেই একান্ত মুহুর্তগুলো আজো স্মৃতিপটে ভেসে উঠে হৃদয়ে রক্তক্ষরন ঘটায় । এমনি এক একান্ত সময়ে রুচিতার ডায়েরীর ভাঁজ থেকে বেরিয়ে পড়ে সেই চিঠি । তার অলক্ষ্যেই পড়ে নিয়েছিলাম । জুরিখ থেকে তার এক কাজিন লিখেছিলো, প্রয়োজনে সে সারাজীবন অপেক্ষা করবে । যে কোন অবস্থায়, এমনকি রুচিতার বিয়ে হয়ে গেলেও সে তাকে পেতে রাজি ।
রুচিতাকে এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে কোন সদুত্তর পাইনি, এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগতে থাকে রুচিতা । আর আমি নিরবেই সড়ে এসেছিলাম তার জীবন থেকে । এর পরের ঘটনা প্রবাহে পাপন আর রুচিতার মা অনেক চেষ্টা করেছিলো দুজনকে মিলিয়ে দেয়ার । এতে রুচিতার মায়ের সাথে পাপনের সম্পর্ক আর যোগাযোগটা থেকে যায় ।
পাপনের সাথে আমার দেখা বছর দশেক পর । আমাকে পেয়ে তার উচ্ছাসের শেষ নেই । তিথীর সাথে তখনই ফোনে আলাপ করিয়ে দিলো । ইউনির বন্ধু, যাদের সাথে আমার যোগাযোগ নেই তাদেরকেও ফোন দিলো । একসাথে ঘন্টা দুই আড্ডা দিয়ে ওর অফিস থেকে নামছি ফেরার জন্য । সিএনজিতে উঠার আগ মুহুর্তে পাপনের কাছে জানতে চাইলাম রুচিতার মায়ের সাথে তার যোগাযোগ আছে কিনা । পাপন একটা উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো, 'শ্বাশুড়ীর কথা এখনও মনে আছে তাহলে ?' আমি বললাম, ফাজলামী রাখ, যোগাযোগ থাকলে বল ।' পাপন বললো, 'হ্যাঁ, সপ্তাহ খানেক আগে ফোনে কথা হয়েছে । রুচিতা আর তার মা আগামী মাসে দেশে আসবে । আমি চিটাগাং আছি শুনে উনিও বললেন চিটাগাং আসবেন ।'
পাপনের শেষ কথাগুলো আমি যেন ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছিনা, সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আছড়ে পড়ছে আমার কানে । আর কথা না বাড়িয়ে পাপনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোন রকম সিএনজিতে উঠে বসলাম । সেই ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসটা আবার বইতে শুরু করেছে, আর আমিও সমানে ঘেমে যাচ্ছি । সকালে আমি কার সাথে কথা বললাম ? কোন অশরীরি কি রুচিতা সেজে আমার সংগে কথা বলেছে ? নাকি এটা আমার মনের অন্তরালে নীরবে বয়ে চলা রুচিতা দুঃখগাঁথা ? কোন কিছুই ভাবতে পারছিনা । টাইগার পাস পার হবার সময় মনে হচ্ছে দুপাশের পাহাড়ে কালো বোরখা, কালো নেকাব-স্কার্ফ পড়া রুচিতা হিহি করে হাসছে.. । আর হাসির তরঙ্গ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন করে ধেয়ে আসছে আমার দিকে ।
************************************
সামুতে লেখা এই জাতীয় আরেকটি গল্প,
কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায় :-< :-&