অফিসের মিটিং শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো । ডিনার সাজিয়েছে, কিন্তু মাহমুদ সাহেবের ক্লান্তি লাগছে । একটানা মিটিং করে যাওয়া খুবই বিরক্তিকর । এখন আবার রিচফুড খেতে হবে । রাতে এমনিতে সবজি দিয়ে দুইটা রুটি ছাড়া কিছু খান না, কিন্তু কোন বিশেষ উপলক্ষ হলে রিচফুড এভয়েড করতে পারেন না ।
ডিনার শেষে অফিসের গাড়ি যখন বাসায় পৌছে দিলো তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে । বাসায় আজ কেউ নাই । সবাই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে । মাহমুদ সাহেবেরও যাওয়ার প্রোগরাম ছিলো, কিন্তু অফিসের এই জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি । ড্রাইভারকে দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন, আগামিকাল সকালে চলে আসবে । এমনিতে দুই মেয়ে আর বউ নিয়ে তার সাজানো সংসার । বড় মেয়ে সোহা এবার ১২ তে পড়লো আর ছোট মেয়ে রাহা সোহা'র চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট । মাহমুদ সাহেবের মিসেস রিয়া । যথেষ্ট রুপবতী, স্মার্ট আর প্রাণখোলা আড্ডাবাজ হিসাবে বন্ধুমহল আর স্বজনদের কাছে তার খ্যাতি আছে ।
বাসায় এসেই মাহমুদ সাহেব ফ্রেশ হয়ে নিলেন । বাচ্চারা বাসায় থাকলে তাদের হইহুল্লোর, বউয়ের খবরদারি আর টিভিতে সারাক্ষন চলতে থাকা উদ্ভট সব সিরিয়াল মিলিয়ে বেশ জমাট থাকে । আজ বাসায় পিন পতন নিরবতা বিরাজ করছে, এটা মাহমুদ সাহেবের ভালো লাগেনা । অভ্যাস বশত তিনি ল্যাপ্পি অন করে নেটে ঢুকলেন । এদিক ওদিক সামান্য ঘুরাঘুরি করে আর বসে থাকতে ভালো লাগছেনা । তাই ল্যাপ্পি শাট ডাউন দিয়ে শুয়ে পড়লেন, কিছুক্ষনের মাঝেই হারিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে ।
রাত তিনটার দিকে বজ্রপাতের বিকট শব্দে তার ঘুম ভেংগে যায় । জানালার কাঁচে আতশবাজির মত বিদ্যুত চমক । তিনি উঠে উইন্ডস্ক্রীন টেনে দিলেন । এমন সময় বিদ্যুত চলে গেল, কোন রকম হাতড়ে মোবাইলটা খুজে বের করলেন । তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লেন । এমন সময় তীব্র আলো এসে তার চোখে পড়লো, ভালভাবে তাকাতে পারছেন না । আস্তে আস্তে চোখ খুলে বুঝলেন বিদ্যুত চলে এসেছে । বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন ।
কিছুক্ষন পরেই মোবাইলটা বেজে উঠলো । ধুস্, এতো রাতে ফোন করলো কে ? তিনি আধো চোখ খুলে নাম্বারটা দেখলেন, না পরিচিত কারো নয় । ডিজিটগুলোও অপরিচিত, ভাবলেন দেশের বাইরে থেকে কেউ হয়ত কল করেছে । ফোন রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন, হ্যালো.. । ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ নাই, হঠাৎ নারী কন্ঠের একজন বললো, মাহমুদ কেমন আছো ??
অপরিচিত কন্ঠ, মাহমুদ সাহেব গলার স্কেল নামিয়ে এনে বললেন, 'জ্বী ভালো আছি । কে বলছেন প্লীজ..' ।
"গলা শুনেও আমাকে চিনতে পারো নি ? আচ্ছা, একটু চিন্তা করেই বলো ।"
মাহমুদ সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, "আমি সত্যিই দুঃখিত, দয়া করে বলবেন আপনি কে ?"
ওপাশ থেকে জবাব এলো, " হুম ঠিক আছে । আমি রুচিতা, ফাইজা হক রুচিতা । এবার নিশ্চয়ই চিনতে অসুবিধা হচ্ছেনা । হা হা হা ।
মাহমুদ সাহেব নাম টা শুনেই চমকে উঠলেন । সারা শরীরে যেন একটা শিহরন বয়ে গেলো । আমতা আমতা করে বললেন, "রুচিতা...!! তুমি কোথা থেকে ? আমার নাম্বার কোথায় পেলে ? তাছাড়া এই গভীর রাতে তুমি ফোন দিয়েছো কেন ? তুমিতো জান আমি বিবাহিত ।"
রুচিতা- "আমি জানি আজকে তোমার বউ বাসায় নেই । হিহিহি.. ।
মাহমুদ- "তুমি জানো ? কিভাবে জান ?
রুচিতা- না না, আমার মনে হলো আজকে তুমি হয়ত বাসায় একাই আছো ।
মাহমুদ- (হাঁপ ছেড়ে) বলো এতদিন পরে ফোন দিলে কেন ?
রুচিতা- তুমি এত কঠিন করে কথা বলছ কেন মাহমুদ ? আমি কি তোমাকে ফোন দিতে পারি না, তোমার সাথে কথা বলার অধিকার টুকুও আমার নেই ? এতটাই ঘৃনা কর তুমি আমাকে ?
মাহমুদ- না না, তা ঠিক নয় । কি দরকার বলো, আমরা যে যার মত করে গুছিয়ে নিয়েছি আমাদের জীবন । এখন আর দুঃখ টেনে আনার দরকার কি ?
রুচিতা- তুমি দেখি আগের মতই কথা বলছ । কথায় কথায় কাব্য করা, কথায় কথায় অভিমান । আচ্ছা তোমার মনে আছে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলে, সেই যখন তোমার সাথে প্রথম পরিচয় ।
মাহমুদ- কেন এসব কথা বলছ ? আমার কিছু মনে নেই ।
রুচিতা- তুমি লিখেছিলে, "প্রিয়তমাষু, যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, সেদিনই বুঝলাম পৃথিবীতে আমারও অস্তিত্ব আছে । আমার অস্থিত্ব তোমার মাঝে ।
...জানো, আমি একটা নদীকে খুব ভালোবাসি । ছোট্ট শীর্ন নদী কিন্তু তার প্রতিটা বাঁক এমনই মোহনীয়, যেন কোন দেবীর শরীর ।
...জানো, আমি একটা মানবী কে ভালোবাসি । তার মুখ মুখের মত, তার হাত হাতের মত, তার চিবুক চিবুকের মত, আর তার হৃদয় তোমার মত । ঐ নদীর বাঁকের মতই তুমি আমার কাছে দেবী, মানবী নও ।
...জেনো, যদি ভালবাসা না পাই, লন্ডভন্ড করে চলে যাব যেদিকে দুচোখ যায় ।" হাঃ হাঃ হাঃ ।
মাহমুদ- আমি এরকম করে লিখেছিলাম ? তুমি এখনো মনে রেখেছো ??
রুচিতা- তুমি পাগলের মত আমাকে চাইতে । আমি ছিলাম কিছুটা দ্বিধান্বিত । যে মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় রজস্বলা হয়, সাত-আট বছর পরে সে মেয়ে শক্ত সামর্থ একটা স্বামীই চাইবে । আনকোরা তরুনের উচ্ছল প্রাণশক্তি দেখে সে মেয়ে মুগ্ধ হয়, কিন্তু তার চাই আরও বেশি কিছু ।
মাহমুদ- (হেসে দিলেন) কি বলছো এসব ? কই তখনতো এমন কিছু বলোনি ? মানছি ইউনিতে আমরা ব্যাচমেট হলেও তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচিউরড ছিলে । ক্যাম্পাসে ঘুরতাম দুজন মিলে, কখনওবা নির্জন মেঠো পথে । এইভাবে হন্টনে হন্টনে চলছিলো জীবন, যেমন তেমন । একদিন সন্ধ্যাবেলা লাইব্রেরীর পাশে বসে গল্প করছি । খুব লোভ হলো তোমার হাত দুটো ধরার, কেন যানি সাহস পাচ্ছিলাম না । তবু সাহস করে চেপে ধরলাম তোমার হাত, তুমি মুচকি হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখলে । হঠাৎ তুমি আমাকে জাপটে ধরে বললে, 'মাহমুদ প্লীজ.. আমাকে চুমো খাও' । এক স্বর্গীয় পুলকে শিহরিত হলো আমার প্রতিটা রক্ত কনিকা ।
রুচিতা- হাহাহা, শেষে একটা আস্ত শয়তান হয়ে গেলে..
মাহমুদ- মনে পড়ে প্রথম তোমার হাত ধরা, প্রথম চুমু । ক্রমে আরো ঘনিষ্টতা । তারপর একদিন কোন এক ছায়া ঘেরা নির্জনে, বুনো পাখির ঝাপটায় সন্ধ্যা নামে । নিজেদের আবিষ্কারের বিহবলতায় উন্মত্ত দুটি প্রাণ । ডাহুকের বিষন্ন ডাক আর জোনাকের থোকা থোকা আলো । আমি ক্রমে প্রবেশ করি পাতালপুরির যক্ষের ধনে । হন্যে হয়ে ছুটছি যেনো এক কুঠুরি হতে আরেক কুঠুরিতে । স্বর্ন-রৌপ্য-হিরে-কান্চন-নীলকান্তমনির প্রাগ্গ আলোয় । তারপর সব অন্ধকার । আমি ডুবে যেতে থাকি, ডুবতে ডুবতে হারিয়ে যাই কোন এক অসীমের কালো গহবরে ।
রুচিতা- হ্যা, তুমি চেতনাহীন হয়ে গিয়েছিলে । আমিও ভড়কে গিয়েছিলাম । তোমার শরীর দিয়ে ঝরঝর করে ঝরছিল ঘাম । আমি ওড়না দিয়ে তোমার শরীর মুছি, ওড়না দিয়ে বাতাস করি । পরের দিন থেকে তুমি হয়ে উঠলে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সাহসি পুরুষ, সবচেয়ে বেপোয়ারা । মাস খানেক পর ছুটিতে বাড়ি যাই । একদিন বিকেলে প্রচন্ড খারাপ লাগছিল, লুকিয়ে বাথরুমে বমি করছিলাম । কিন্তু আমার মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারিনি, তাকে সবকিছু খুলে বলি । পরেরদিন বাবা গোপনে একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে অ্যাবরশন করান । বাবা-মা'র কাছে নিজেকে এতই অপরাধী লাগছিল, মনে হচ্ছিলো জীবনটা শেষ করে দেই । খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু একটা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার মত শক্তি আমার ছিলনা ।
মাহমুদ- মাস খানেক পরে ক্যাম্পাস খুললো । সবাই এসেছে, তুমি আসোনি । রোজ ইউনি গেইটে দাড়িয়ে থাকি, কখন তুমি বাস থেকে নামবে । সপ্তাহ কেটে গেলো তুমি আসছ না, কোন সমস্যা হলে চিঠি লেখার কথা তাও লিখছ না । একদিন নিজেই চলে গেলাম তোমাদের শহরে, অনেক কৌশলে তোমার সংগে দেখা করলাম । সবকিছু শুনে আমিও বাকরুদ্ধ । তোমার হাত দুটো ধরে বলেছিলাম, পাশে আছি আজীবন । কিছুদিন পরে তুমি ক্যাম্পাসে ফিরে এলে । নিষ্প্রান, বোধহীন এক পাথর মানুষ হয়ে ।
রুচিতা- আমার প্রাণটুকু কেড়ে নিয়ে প্রানচান্চল্য আশা কর কিভাবে ? জানি বেশিরভাগ সময়ই আমি বিষন্নতায় ডুব দিতাম । কখনোবা ক্ষেপেও যেতাম । তুমি পাশে থাকতে, কখনও রাগারাগিও করতে । এইভাবে আমাদের প্রেম বয়ে চললো, কিন্তু আর কখনও 'রচি মম ফাল্গুনি' হলোনা ।
মাহমুদ- তারপর চারটে বছর তোমায় নিয়ে ক্যাম্পাস জীবন । ফাইনাল এক্সামের পর দুজন বন্ধুকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি গেলাম । তোমার মায়ের কাছে ছয়মাস সময় চাইলাম । তিনি বললেন, 'ছয়মাস পরে এসে তুলে নিয়ে যেয়ো বাবা, এসেছো যখন বিয়েটা হয়েই যাক' । আমি তার কথা ফেলতে পারিনি, ঐদিনই আমরা বিয়ে করলাম ।
রুচিতা- হুম,আমাদের বিয়ে হলো । বিয়ের পরই তুমাকে চাপাচাপি করি আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য । তুমি মাস তিনেক পর তোমার মা কে সাথে নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে গেলে ।
মাহমুদ- তারপর মাত্র এক সপ্তাহের সংসার জীবন । এর মধ্যে ভালোবাসা হলো, ঝগড়াঝাটিও । একদিন তোমার ভাই এলো আমাদের দেখতে । তুমি বললে কয়েকদিনের জন্য তার সাথে বাড়ি যাবে । প্রথমে আমি যেতে দিতে চাইনি, তুমি অনেকটা জোড় করেই চলে গেলে । কিছুদিন পর তোমার দেয়া ডিভোর্স লেটার পেলাম । আমি ছুটে গেলাম, শত অনুনয় অনুরোধেও তুমি অবিচল । ফিরে এলাম রিক্ত হাতে । তোমার অভিযোগটাও জানতে পারলাম না কোনদিন । কোন সুযোগই তুমি আমাকে দিলেনা ।
রুচিতা- থাক মাহমুদ এসব । বছর খানেক পরে আমি আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি ততদিনে আবার বিয়ে করে সংসার করছিলে । কি আর করা, দুর্বিসহ নিয়তিই আমি মেনে নিলাম । ঠিক আছে, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে কি লাভ বলো ? তুমি ভালো থেকো মাহমুদ, অনেক ভালো থেকো... ।
সকালে এক নাগারে কলিংবেল বাজার শব্দ আর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে মাহমুদ সাহেবের ঘুম ভাংগলো । দরজা খুলে দিতেই রিয়া বললো, " কি ব্যাপার ? এত সময় ধরে ডাকাডাকি করছি, আর তুমি সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ ? এ কি ? তোমাকে এরকম লাগছে কেন ? কি হয়েছে তোমার ?? মাহমুদ সাহেব কিছু বলতে পারছেন না । হঠাৎ করে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, মেয়েদের মাথায়, চুলে চোখ মুছলেন অনেকক্ষন । রিয়া এসে পিঠে হাত দিয়ে বললো, " কি হয়েছে মাহমুদ ? এনিথিং রং ? প্লীজ, খুলে বলো আমাকে ।
মাহমুদ সাহেব স্থির হয়ে বললেন, না কিছু হয়নি । "আচ্ছা ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি নাশতা নিয়ে এসেছি", রিয়া বললো ।
মাহমুদ সাহেব ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেলেন । তারপর এক কাপ চা হাতে নিয়ে ল্যাপ্পি অন করলেন । ফেসবুকে ঢুকা হয়না অনেকদিন । লগইন করেই দেখলেন তিরিশ'টার মত নোটিফিকেশন জমে আছে, আর ইনবক্সে একটা মেসেজ । মেসেজ অন করেই দেখলেন অষ্ট্রিয়া প্রবাসী বন্ধু এনায়েতের নাম । তিনি মেসেজ পড়তে লাগলেন, "ফ্রেন্ড, এ স্যাড নিউজ ফর ইউ । রুচিতা তার হাজবেন্ড সহ একটা গাড়ি একসিডেন্টে পড়েছিলো । গতকাল রাত দশটায় ভিয়েনা'র এক হাসপাতালে রুচিতা মারা গেছে । ডোন্ট ওরিড ফ্রেন্ড, প্রে ফর হার..." ।
মেসেজ পড়তে গিয়ে মাহমুদ সাহেবের মনে হলো গত রাতের বজ্রপাত আর বিদ্যুত চমক শুরু হয়েছে । চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে । শুধু বিদ্যুত স্ফুলিঙের মত স্পার্ক করছে রুচিতার বিষন্ন মুখ ।
*****************************************************
গল্পটি ব্লগে আমার অসম্ভব প্রিয় গল্পকার ব্লগার 'হাসান মাহবুব' ভাইকে উৎসর্গ করলাম ।
একই থিম আর ফরম্যাটে আমার আগের গল্প..
গত কাল রাতে ইলেকট্রিসিটি ছিলো না ।