বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং গৌরবময় । ঢাকার নবাব পরিবারের তরুনদের পৃষ্টপোষকতায় এদেশে প্রথম সিনেমা নির্মিত হয় সেই ১৯২৭ সনে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক ছবি 'সুকুমারি' । প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক সিনেমা 'দা লাস্ট কিস্' মুক্তি পায় ১৯৩১ সনে । আর বাংলাদেশের প্রথম সবাক সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ' মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালে, আব্দুল জাব্বার খানের পরিচালনায় ।
১৯২৭ থেকে ২০১২, এই ৮৬ বছরে এদেশে নির্মিত হয়েছে শতশত সিনেমা । যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে দর্শক-নির্মাতাদের চিন্তা-রুচি-কৌশলে পরিবর্তন এসেছে । এর ভিতরে আমরা দুইবার স্বাধীনতা অর্জন করেছি, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্থানীদের কাছ থেকে । সময়ের সাথে তাই সমাজ পরিবর্তনের পাশাপাশি রাষ্ট্রিক পরিবর্তনও আমাদের সিনেমার উপর প্রভাব ফেলেছে । এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় আমরা যেমন জহির রায়হান আর এহতেশামের মত গুনী পরিচালক পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি দর্শক নন্দিত আর কাল উত্তীর্ন অনেক ছবি ।
আর এই বিশাল চলচ্চিত্র সম্ভার থেকে সেরা দশ নির্বাচন করা যেমন দূরুহ তেমনি বিতর্ক সাপেক্ষ । আমি চেস্টা করেছি ছবির গল্প, দর্শক প্রিয়তা, সংগীত আর আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কে বিবেচনায় নিতে ।
তাহলে দেখা যাক আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশী সিনেমার সেরা দশ সিনেমার এক ঝলক । আজ থাকছে প্রথম পর্ব, আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা দশটি সিনেমার প্রথম পাঁচটি সিনেমা ।
******************************************
সেরা দশ ০১ : জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
পরিচালক : জহির রায়হান
'জীবন থেকে নেয়া' ছবিতে জহির রায়হান তৎকালীন বাংগালী স্বাধীনতা আন্দোলনকে চমৎকার রুপক আর স্যাটায়ারের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ।
"একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন..."
একসাথে দুইটি সমান্তরাল কাহিনী । ঘরের বাইরে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ঘরের ভেতর পরিবারের সদস্যদের উপর গৃহকর্ত্রীর(রওশন জামিল) অত্যাচার । পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে এবং একপর্যায়ে তিনি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন । একই সাথে ছবিতে বাংগালীর মুক্তি আন্দোলনও চলতে থাকে । 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাংগানো' গানটি জহির রায়হান একুশের প্রভাত ফেরি থেকে সরাসরি ধারন করেন । আর প্রথমবারের মত 'আমার সোনার বাংলা' গানটি কোন ছবিতে দেখানো হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার গৌরব অর্জন করে ।
সংগীত পরিচালনায় ছিলেন খান আতাউর রহমান । এই সিনেমায় তার গাওয়া এবং অভিনীত সেই বিখ্যাত গানটা শুনুন, 'এ খাঁচা ভাংগব আমি কেমন করে...'
************************************
সেরা দশ ০২ : পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩)
পরিচালক : গৌতম ঘোষ
'পদ্মা নদীর মাঝি' বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত উপন্যাস । বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় কৃতি পরিচালক গৌতম ঘোষ এটিকে চলচ্চিত্রে রুপ দেন । আবহমান কাল থেকে বয়ে চলা পদ্মা পাড়ের গরীব জেলেদের জীবন, সংগ্রাম, প্রেম আর তাদের উপর মহাজনদের অত্যাচার এই সিনেমার উপজীব্য ।
'পদ্মা নদীর মাঝি' ছবিতে অভনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রুপা ব্যানার্জী, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ প্রমূখ ।
***********************************
সেরা দশ ০৩ : সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭)
পরিচালক : আলমগীর কবির
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে এক জোড়া তরুন-তরুনী ভাসতে ভাসতে একটা নির্জন দ্বীপে এসে পৌছায় । জনমানবহীন এই দ্বীপে এসে উচ্চশিক্ষিত ধনী পরিবারের আদুরে মেয়েটি ভড়কে যায় । তারপর বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই দুজনের শুরু করতে হয় সংগ্রাম, এক পর্যায়ে দুজনের মাঝে রোমান্টিক সম্পর্কের সূচনা হয় । এইভাবেই এগিয়ে যায় কাহিনী ।
এই সিনেমায় বুলবুল আহমেদ আর জয়শ্রী কবিরের অভিনয় মনে রাখার মত । সংগীত পরিচালনা করেছেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক ভূপেন হাজারিকা । জলোচ্ছাসের প্রেক্ষাপটে তার 'মেঘ থম থম করে' গানটি এপিক পর্যায়ে পড়ে । আর 'বিমূর্ত এই রাত্রী আমার' গানটি বাংলা ভাষায় অন্যতম সেরা রোমান্টিক গানের স্বীকৃতি পেয়েছে । শুনুন তাহলে গানটি...
***********************************
সেরা দশ ০৪ : ছুটির ঘন্টা (১৯৮০)
পরিচালক : আজিজুর রহমান
পত্রিকায় আসা একটা মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা নিয়ে ছবিটি নির্মিত । ঈদের ছুটি ঘোষনার দিন স্কুলের বাথরুমে সকলের অজান্তে আটকে পড়ে একটি বারো বছর বয়সের ছাত্র । আর তালাবন্ধ বাথরুমে ছুটি শেষ হওয়ার প্রতীক্ষার মধ্যদিয়ে হৃদয়বিদারক নানা ঘটনা ও মুক্তির কল্পনায় অমানবিক কস্ট সহ্য করার পর কিভাবে একটি নিষ্পাপ কচি মুখ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এমনই একটি করুন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে ।
ছবির মূল ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী সুমন আর সাথে রাজ্জাক, শাবানা । সত্য সাহা'র সুরে এই সিনেমার বিখ্যাত গান, 'একদিন ছুটি হবে, অনেক দুরে যাব..'
**********************************
সেরা দশ ০৫ : দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬)
পরিচালক : মোরশেদুল ইসলাম
বাংলাদেশে শিশুদের নিয়ে বানানো সর্বকালের সেরা সিনেমার একটি । পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, নৈতিকতা সহ আরও অনেক কিছু ছবিতে পাওয়া যায় । 'দীপু নাম্বার টু' প্রখ্যাত লেখক ডঃ জাফর ইকবাল রচিত একটি জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস । আর গুনি পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় 'দীপু নাম্বার টু' বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা শিশুতোষ সিনেমা হিসাবে দর্শক প্রিয়তা পায় ।
দীপু'র ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন শিশুশিল্পী অরুন । সাথে ছিলেন বুলবুল আহমেদ এবং ববিতা ।
(পরের পর্বে আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা দশ সিনেমার বাকী পাঁচটি তুলে ধরার চেস্টা করব।)
************************************
বাংলাদেশের সিনেমা : সর্বকালের সেরা দশ । ২য় পর্ব ।
বাংলাদেশের সিনেমা : সর্বকালের সেরা দশ । শেষ পর্ব ।