বাসে উঠে টিকিট অনুসারে নিজের সিটের কাছে এসে থমকে গেলাম। আমার পাশের সিটে একজন মেয়ে বসে আছে। আমি কিছুটা বিব্রত। সাধারণত দূরপাল্লার ভ্রমণে আমি জুতা মোজা খুলে সিটের উপর পা তুলে আয়েশ করে জার্নি করি। পাশে অপরিচিত কোনো মেয়ে বা মহিলা থাকলে খুব সমস্যা। কোনো ভাবে গায়ে একটু লেগে গেলে অসভ্য ভাবতে পারে। আর এ জন্য অতিরিক্ত সাবধান থাকতে গিয়ে আরাম করে বসাই যাবে না।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম অন্য কোনো সিট খালি নেই। শুধু একদম শেষের সিট খালি আছে। সেখানে বাসের হেল্পার আরাম করে শুয়ে আছে। এমনিতেই আমার সিটটি শেষের দিকে, তাই শেষ সিটে যেতে ইচ্ছে হলো না। আবার অন্য কোনো সিটে একলা কোনো মহিলা যাত্রীও নেই যে সিট বদলে নেবো। অগত্যা এখানেই বসতে হলো।
রৌদ্রজ্জ্বল দিনের পড়ন্ত বিকেল। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছি। বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নন এসি বাসের জানালায় পর্দার ফাঁক গলে যে রোদ আসছে, তার তেজও কম নয়। বোরকা পরা মেয়ের মুখটি কালো মাস্কে ঢাকা। চোখের মাঝে কেমন যেন অস্থিরতা। একটু পর পর ফোনে চাটগাঁইয়া ভাষায় কী যেন কথা বলছে, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। বাস চলতে শুরু করায় জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস বইতে লাগলো। দমকা বাতাসে মেয়েটির মাথার স্কার্ফের বাঁধন আলগা হয়ে চুল বেরিয়ে আসছিলো। সে কয়েকবার তা আগলে রাখার চেষ্টা করে পরে হাল ছেড়ে দিলো।
বাসের সুপারভাইজার টিকিট কালেক্ট করতে আসলে মেয়েটি তার টিকেট খুঁজে পাচ্ছিলো না। এ ব্যাগ ও ব্যাগ করে সব হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। শেষে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "টিকিট কাটার সময় আপনার মোবাইল নম্বর নিয়েছিলো?"
জি, নিয়েছিলো।
তাহলে সমস্যা নেই। আমি সুপারভাইজারকে বলে দিচ্ছি?
মেয়েটি পুনরায় স্বগতোক্তি করলো, আসলে বাসা থেকে রাগ করে কিছু না বলে চলে এসেছি তো, তাই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটির এ কথায় আমি রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। মনে একসাথে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো। টুকটাক লেখালেখি করি বলে, মনে মনে গল্প শোনার আগ্রহও বেড়ে যাচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেনো রাগ করেছেন?
বাবা আমাকে চড় মেরেছেন। এতো বড় মেয়েকে কেউ চড় মারে?
এ কথা শোনার পর আমার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। এখনকার জেনারেশনের কি যে হয়েছে! বড্ড অসহিষ্ণু। বাবা একটি চড় মেরেছে তো কি হয়েছে? তাই বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে? আমরাও তো আব্বা আম্মার কাছে কতো মার খেয়েছি, তাই বলে তো কখনো কাউকে কিছু না বলে দূরে কোথাও চলে যায়নি। মেয়েটির যে অবস্থা, তাতে আরো প্রশ্ন করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
এদিকে পশ্চিম আকাশে সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে। আকাশ রঙিন হতে শুরু করেছে। রাস্তার দু'ধারে এখন আর আগের মতো খোলা প্রান্তর বেশি দেখা যায় না। দোকানপাট, বাজার ছাড়িয়ে একটু দূরের দিকে দৃষ্টি দিলে যতটুকু সবুজ দেখা যায়, তাতেই আমাদের শহুরে চোখ মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ মুগ্ধতা আমাকে বেশিক্ষণ আবেশিত করে রাখতে পারলো না। পুরো ঘটনা জানার জন্য মনটা তৃষিত হয়ে আছে। তাই বিস্তারিত জানার জন্য আবারও প্রশ্ন করলাম, আপনার বাবা চড় মেরেছিলো কেনো?
মেয়েটি যেন আমার প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলো। তাই প্রশ্ন পাওয়া সাথে সাথে অনেক কথা বললো। মনে হয় সব কথা বলে মনের ভার কমাতে চাইছিলো। কিন্তু মুখে মাক্স থাকার কারণে তার অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক পড়তে পারছিলাম না। তাছাড়া বাসের ভেতরের বাতিগুলোও বন্ধ থাকায় তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। বাইরের আলো যখন মাঝে মাঝে তার চোখে পড়ছিলো শুধু তখনই যা একটু চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছিলো। তার কথা থেকে ঘটনা যা জানা গেলো তা অনেকটা এমন-
পাঁচ বোন দুই ভাই আর বাবা-মার নিয়ে তাদের সংসার। বোনদের মধ্যে সে সবার ছোট। আর দুই ভাই, তারও ছোট। বাবার বয়স হয়েছে। এখন তেমন কিছুই করেন না। কয়েকটি দোকান আছে, তার ভাড়া তুলেই তাদের সংসার চলে। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। তারও বিয়ে হয়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। ছোট্ট একটি মেয়েও আছে, বয়স সাত। স্বামী ছিলো প্রবাসী। বিদেশ থেকে এসে আবারও বিয়ে করে। স্বভাব চরিত্র ভালো নয়। তাই তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তাও সাত বছর হলো। এখন একটি পার্লারে কাজ করতো। তার নেশা করা ভাইটি নিজেও কিছু করে না আর তাকে এ চাকরি করতে দিতে চায় না। বলে, পার্লারে নাকি ভালো মেয়েরা কাজ করে না। এ নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বাবা এসে তাকে চড় দিয়েছে।
এমনিতেই ডিভোর্সের পর থেকে নিজের বাবার বাড়িতে বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে। কথাবার্তা ব্যবহারে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কী করবে বুঝতে পাছে না। নিজের চেষ্টায় একটা ছোট চাকরি জোগাড় করেছে, তাও করতে দেবে না। বাবার চড়ের ব্যাথার চাইতে মনের কষ্টটা অনেক বেশি। মনে হচ্ছে, এ জীবনে কোথাও কোনো আলো নেই, কোথাও কোনো আশা নেই, কোথাও যাওয়ার একটু জায়গা নেই। বুক ভরে শ্বাস নেয়ার মতো একটু বাতাস নেই। তাই সইতে না পেরে সে বেরিয়ে এসেছে। চিন্তা করেছে এখন ঢাকায় বোনের বাসায় যাবে।
এতো কথা শোনার পর আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। তাক সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। তাছাড়া মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেয়ার আমি কেউ না। তার মতো এমন বহু মেয়ে আমাদের চারপাশে আছে। যারা একবার স্বামীর ঘর ছেড়ে এসেছে বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অথবা বিধবা হয়েছে, এ সমাজে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে যায়। পুনরায় ভালো বিয়ে হতে চায় না। হলেও নানান জনের নানান কথায় জীবনে শান্তি পাওয়া যায় না। এর তো একটি সুন্দর সমাধান হওয়া উচিৎ। নয় তো দিনে দিনে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।
বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে। বাসের চলার গতিও বেড়েছে। গুগল ম্যাপে দেখলাম ফেণী পার হয়ে গেছি। মনের অবশিষ্ট কৌতুহল মেটানোর জন্য সাহস করে মেয়েটিকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আবার বিয়ে করেননি কেনো?
মেয়েটি আমার দিকে ফিরে, একটু সময় নিয়ে কেমন যেন হাহাকার মেশানো কন্ঠে বললো, যেসব সম্বন্ধ আসে, তার বেশিরভাগই আমার বাবার বয়সী। কারো কারো অনেক বাচ্চাকাচ্চা থাকে। আমার পছন্দ হয় না, অথচ বাসা থেকে নানানভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সম্বন্ধটা ভালোই।
এ বলে মেয়েটি বাসের জানালার সাথে মাথাটি ঠেস দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে রইলো। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে চোখ মুছছে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, চোখের জলের ধারাটি কেমন। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। বুঝতে পারছি না, আমি এতো কথা বলে তার দুঃখ আরো বাড়িয়ে দিলাম কিনা। নাকি আমাকে বলতে পেরে তার মনের ভার কিছুটা কমলো। আমি আর কথা বাড়ালাম না। মেয়েটির জায়গায় আমি থাকলে হয়তো ভাবতাম, এ গাড়িটি এমনি চলতে থাকুক। এ রাত যেন রাতই থাকুক। আর কখনো যেন ভোর না হয়।।
আবদুল্লাহ আল মামুন
রচনাকাল- ২৩ আগস্ট ২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৯:৫৮