সুইসাইড করলে আগের দিনে স্কুল লাইফে সপ্তাহে একবার একেক জনকে সুইসাইড করতে হতো। স্যারদের বেতের বাড়িতে প্রতিদিন পশ্চাৎদেশ লাল হওয়া। আবার, স্যারদের বিচার দেয়ার পর বাসায় এসে আরেক দফা পিঠের উপর বিছানা ঝাড়ু, বাঁশের কঞ্চি, রুটি বানানোর বেলন, কত কি ভাঙ্গা
আর এসবের কারনে ছেলেপুলে যদি সুইসাইড করতো তাহলে দেশে আর কোন পরবর্তী প্রজন্মই থাকতো না।
.
এখন তো ক্লাসে বেত আনা নিষেধ... কিন্তু এক সময় স্যার ম্যাডামের চাইতে তাদের বেত থাকতো লম্বা... তারা ক্লাসে ঢুকার আগে তাদের বেত আগে ক্লাসে ঢুকতো... সেই বেতে তেলও মাখা হতো, এমনটিও দেখেছি। কোন স্যারের বেত দেখতে কেমন? কোনটার পিটানির স্বাদ কি রকম? কোন স্যারের মারার স্টাইল কেমন? কোন স্যার কোথায় ধরে মারে এসব ছিল আমাদের নিত্যদিনের টিফিনের গল্প।
.
প্যান্ট এক হাতে টান টান করে, বেত বা স্কেল দিয়ে যখন পশ্চাৎদেশে ঠাস ঠাস পরতো তখনই আমাদের সুইসাইড করার কথা ছিল। ক্লাসে পড়া শিখেনি বা হোমওয়ার্ক করেনি এজন্য কান ধরে ১০০ বার উঠবস, টেবিলের উপর উঠে সারা ক্লাস কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, ক্লাসের বাইরে কখনোবা খোলা মাঠে ,সমস্ত স্কুলের ছেলেমেয়েরা যখন দেখে কেউ কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরও গুরুতর ছিল মুরগী হওয়া বা কুমড়া চেঙ্গি বলা হতো আমাদের এলাকায়। এসবের পর হাজার হাজার ছেলের সুইসাইড করার কথা ছিল।
এক সাব্জেক্টে খারাপ করার পরে ডেকে হেড স্যার যখন গার্জিয়ানকে বলতো বাসায় করে টা কি? ছেলে পেলে কিচ্ছু পারেনা। এ রকম ছেলেপুলে স্কুলে পাঠান কেন? ছেলেগুলো তখনই সুইসাইড করার কথা ছিল। অবশ্য ছেলেকে এটাও বলতো যে, দেখেছো আজকে তোমার জন্য তোমার বাবাকেও কথা শুনতে হচ্ছে। বাবা ও বাসায় এসে ওই একই কথা শিক্ষার্থদের বলতেন যে, ভাল করে পড়, আজ তোর জন্য আমাকে কথা শুনতে হলো। আর যেন এরকম না হয়।
.
এগুলো চোখের দেখা। তবে আমার জন্য স্কুল লাইফে কখনো বাবা মাকে এমন পরিস্থিতিতে খুব কমই পড়তে হয়েছে।(লক্ষী ছেলে )। ছোটখাটো মারামারি আর দুষ্টুমি ছাড়া।
আমি বলছি না স্টুডেন্টদের মারতেই হবে, তাদের অপমান করতেই হবে... এগুলো খুব ভাল কাজ নয়। কিন্তু আমি এটাও মানি একদম শাসন ছাড়া কেউ মানুষ হয় না। আজকে একটা অপরাধ করবে, পরীক্ষায় নকল করবে, তারপরও কিছু বলা যাবেনা, আজ করবে, কাল করবে, এভাবে অভ্যাসে পরিনত হবে.. এটাও তো কোন শিক্ষার বৈশিষ্ট্য নয়।
.
এক সময়ে বাবা-মায়েরা বলতো, "স্যার, মাংস গুলা আপনার, হাড্ডি গুলা আমার... মাইরা পিডাইয়া শিখাইবেন"... এই সময়ে এমন গার্জিয়ান নেই বললেই চলে। পরিবর্তনটা ভাল, স্টুডেন্টদের জন্যই ভাল। কারণ পিটিয়ে সব শিখানো সম্ভব না।
কিন্তু আমি বলতে চাই আজকালকার ছেলে-মেয়েদের অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে...
.
যে বয়সে আমাদের পড়াশোনা আর ঘুমানোর বাইরে গাছের ফল, পাখির বাসা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এসবেই দিন কেটে যেত। সেই বয়সে ছেলে মেয়েরা এখন প্রেমে পড়ে, প্রেম করে, ব্রেকাপ করে, প্যাচাপ করে! এই পার্টি, সেই পার্টি, কত কি.... ওদের কথাবার্তা বা আচরন দেখলে মাঝেমাঝে নিজেকেই বাচ্চা মনে হয়।
.
তাদের আজকাল বাইরে খেলতে না দিয়ে বিকাল বেলাতেও বাসায় আটকে রাখা হয় মোবাইল-ট্যাব এর মত প্রযুক্তি হাতে ধরিয়ে দিয়ে... ছেলে-মেয়ে নাকি বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে যাবে বাইরে গেলে। অথচ এই ছেলেমেয়েগুলোই খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়। বান্ধা গরু ছাড়ার মত অবস্থা হয়।
.
দিন দিন খুব বাজে রকমের একটা সুইসাইডাল ফ্রিক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যাদের মেন্টালিটি হয়ে যাচ্ছে সংকীর্ণ এবং নেগেটিভ... কিছু হলেই যারা পজেটিভটা চিন্তা করার আগে নেগেটিভটা ভেবে সুইসাইডাল এটেম্পট নেয়...
.
এসবের জন্য দায়ী শুধু স্যারদের অপমান বা অন্য কিছু না... দায়ী আগে থেকেই তৈরী তাদের সংকীর্ণ মানসিকতা, যার জন্য এসব ঘটনা তারা সুইসাইডাল ভাবে... এই সংকীর্ণ মানসিকতা জন্মের পর থেকেই তাদের ভেতর গড়ে উঠতেছে, খুব বাজে ভাবে তিল তিল করে গড়ে উঠতেছে...
.
সত্যি বলতে, সুস্থ কোন মানুষ যে সুইসাইড করে,এমন কারো প্রতি আমার মায়া কাজ করে না, বেশি হলে করুণা হয়... দশ মাস কষ্ট করে গর্ভে রাখা, আজীবন সেবা করে যাওয়া মা, চাইতেই কষ্টের উপার্জনের টাকা তোমাকে দিয়ে দেয়া বাবার ভবিষ্যত এর কথা চিন্তা না করে সুইসাইড করা ছেলে-মেয়ের জন্মই হওয়া উচিত ছিল না, একদমই না...একবারও ভাবেনা যে আমার চলে যাওয়ায় কার কি হবে? কিছুই হবেনা বরং বেশিরভাগ মানুষই তিরস্কার করবে।
ইসলাম ধর্মমতে আত্মহত্যাকারীকে গোসল,জানাজা এবং দাফন করাও নিষেধ। কেবল গর্ত করে রেখে আসতে হবে। কারন একটাই এরকম মুল্যবান জীবন যেন কেউ বিসর্জন না দেয় ,সে ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা। এটা দেখে অন্যরাও যেন শিক্ষা নেয়।
.
কোন শিক্ষক যদি মাত্রাতিরিক্ত কিছু করে সেটার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত, তেমনি একজন শিক্ষার্থীও গুরুতর অপরাধের পর যদি বলা হয়, আপনি তাকে শাসন করতে পারবেন না, । তাহলে এমন আদুরে বাচ্চাকাচ্চা স্কুলে না পাঠালেই বোধহয় ভাল। কারন তার দেখাদেখি আর পাঁচটা বাচ্চাও খারাপ হওয়ার আশংকা থাকে।
.
আত্মাহুতির এই প্রবনতাকে সমর্থন না করে আসুন ছোটদের বুঝাই। আত্মাহুতি সমাধান নয়। সমাধান হচ্ছে বেঁচে থাকা। বেঁচে থেকে প্রমান করা যে আমি নির্দোষ ছিলাম। কিংবা আমার মাঝেও যোগ্যতা আছে।
শেষ করছি আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে। কলেজ লাইফে একবার একজন সম্মানিত শিক্ষক প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ভাইভায় আমাকে একটা প্রশ্ন করেন। আমি উত্তর দেই। তখন আমি আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন (নির্বাচিত) । উত্তরটা স্যারের মনমত হয়নি, উনি আমাকে সবার সামনে যা তা বললেন, "নেতামি করো, পড়াশোনায় নাই, ........... যা এখান থেকে। আমি প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম। কারন শেষ উক্তিটা ছিল আমার বাবাকে তুলে।
এর প্রায় চার বছর পর স্যারের সাথে গাজীপুরে আমার দেখা। স্যার একটা বাসায় উঠেছেন। শুনেই স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে স্যার বললেন "মাইনুল তুমি বোধহয় আমার উপরে এখনো অভিমান করে আছো।"বললাম স্যার কেন? বললেন "কলেজে থাকতে তোমাকে একবার খারাপ ভাষায় বকা দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আসলে ঠিক ওইভাবে বলতে চাইনি বা ওটা বুঝাতে চাইনি। আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। আমি একেবারে লজ্জায় পড়ে গেলাম। শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসলো। আমি সজোরে বলে উঠলাম, না স্যার, ছি! কি যে বলেন আপনি। আপনি আমার শিক্ষক, আপনি শাসন করতেই পারেন। আর কিছু মনে রাখলে কে আর আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসি?
,
গল্পটা বলার উদ্দেশ্যে একটাই। মরে গিয়ে নয় বেঁচে থেকে আমাদের সমাধান করতে হবে। হয়তোবা আপাত দৃষ্টিতে যেটাকে এখন আমি খারাপ মনে করছি, অপমানবোধ করছি, হয়তো এই শিক্ষার হাত ধরেই আমি জীবনে ভাল কিছু অর্জন করতে পারবো। ভাল থাকুক সবাই। তরুন প্রজন্ম গড়ে উঠুক সুস্থ মানসিকতা নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:০০