বীজ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির যে রাজনীতি তার নিষ্করুণ শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য! জিএম বিটি বেগুন চাষের অনুমোদন দেয়ার পর এবার জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) তুলাও আনার প্রক্রিয়া চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন বহুজাতিক এগ্রো করপোরেশনের জিএম বাণিজ্যের উর্বর ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষিতে কর্পোরেট মনোপলি প্রতিষ্ঠার যে মিশন নিয়ে নেমেছে বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্তো/ মাহিকো এদেশের কৃষি মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করে চলেছে একের পর এক। মার্কিন ভারতীয় কোম্পানির পেটেন্ট করা বীজ এদেশে এনে বাজারজাত করে এদেশের সমস্ত কৃষি বীজের নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির হাতে নেয়ার যে আগ্রাসী তৎপরতা শুরু হয়েছে তার সমস্ত কাজে এই মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা দুঃখজনক। যেখানে বিটি তুলার চাষ করতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে ভারতে শত শত কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং তারপর খোদ ভারত সরকার এই বিটি তুলা নিষিদ্ধ করেছে সেখানে বাংলাদেশে এই বিটি তুলার চাষের চক্রান্ত কেন করছেন এদেশের দেশপ্রেমিক মন্ত্রীরা?
বিটি তুলা কি?
Bt অথবা Bacillus thuringiensis হচ্ছে একধরনের বায়ো পেস্টিসাইড ব্যাক্টেরিয়া যার Cry জিন এক ধরনের ক্রিস্টাল প্রোটিন (Cry প্রোটিন) প্রস্তুত করে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তুলায় বিটি'র এই জিন ঢুকিয়ে বিটি তুলা তৈরি করা হয়। মার্কিন এগ্রো কর্পোরেশন মনসান্তো এই বিটি প্রযুক্তির মালিক। বিটি'র ওই ক্রিস্টাল প্রোটিন যখন cotton bollworms পোকার অন্ত্রে প্রবেশ করে তখন অন্ত্রের ক্ষারীয় পরিবেশে এক ধরনের জৈব রসের (protease enzyme) উপস্থিতিতে ক্রিস্টাল প্রোটিনটি ভেঙ্গে গিয়ে ডেল্টা-এন্ডোটক্সিন প্রস্তুত হয় যা পোকার অন্ত্রের রিসেপ্টরএর সাথে যুক্ত হলে পোকার অন্ত্রে ছিদ্র তৈরি হয়। এক পর্যায়ে পোকার মৃত্যু হয়।
চলছে বিটি তুলা চাষের জন্য তোড়জোড়
জেনেটিক্যালি মোডিফাইড বিটি বেগুন চাষের প্রক্রিয়া শুরু করার পর এবার নতুন করে জিএম বিটি কটন এর চাষ অনুমোদন করতে যাচ্ছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী! উৎপাদন বৃদ্ধির গল্প শুনিয়ে বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কর্পোরেট আগ্রাসন তরান্বিত করতেই এই পদক্ষেপ। এই জিএম তুলা কৃষক পর্যায়ে ছাড়ের অনুমোদন লাভের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে (নিউ এজ, ২৪ মার্চ, ২০১৪)। জাতীয় জৈব নিরাপত্তা কমিটি ছাড়পত্র দিলেই সীমিত পর্যায়ে বিটি কটনের ফিল্ড ট্রায়াল শুরু হবে।http://newagebd.net/14102/govt-to-introduce-cultivation-of-gm-bt-cotton/#sthash.q3du8ZhI.dpuf
বিটি তুলার পক্ষে কোম্পানির যুক্তি
বিটি তুলার পক্ষে কোম্পানির যুক্তি হচ্ছে বিটি টক্সিন বায়োপেস্টিসাইড আকারে কাজ করবে ফলে
১] পোকা প্রতিরোধে কীটনাশক ব্যাবহার কমে যাবে,
২] উৎপাদন খরচ কমবে এবং
৩] তুলার উৎপাদন বাড়বে।
পেস্ট রেজিস্ট্যান্সঃ বিটি কটনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
অনেক বিজ্ঞানী দাবি করেন বিটি কটনের কার্যকারিতা নাই কেননা যে পোকা মারার জন্য এই বিটি প্রযুক্তির উদ্ভাবন সেই পোকাই রেজিস্টান্ট হয়ে গেছে অর্থাৎ বিটি টক্সিন আর বায়োপেস্টিসাইড হিসেবে কাজ করছে না। ফলে উল্টা প্রচুর কীটনাশক ব্যাবহার করতে হবে যা বিটি কটনের প্রায়োগিক সাফল্যকে নাকচ করে দেয়।
Click This Link
Click This Link
বিটি তুলার চাষ করতে গিয়ে ভয়াবহ ফলন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ভারতের কৃষকেরা
মনসান্টো-মাহিকোর বীজ কিনে বিটি তুলার চাষ করতে গিয়ে ভয়াবহ ফলন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ভারতের কৃষকেরা। অর্থাৎ কোম্পানির দাবির বিপরীতে ভারতের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে বিটি তুলার ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাড়বে। মার্কিন এগ্রো কর্পোরেশন মনসান্তোর ভারতীয় অংশীদার মাহিকো কোম্পানির বিটি কটন বীজ ব্যাবহার করে ভারতের কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, হাজার হাজার একর তুলার ফলন নষ্ট হয়েছ। চড়া দামে কোম্পানি থেকে ভারতীয় কৃষকরা বিটি তুলার বীজ কিনতে বাধ্য হয়েছেন। ফলন বৃদ্ধি দূরের কথা মহারাষ্ট্র রাজ্য এবং কর্ণাটক রাজ্যের হাজার হাজার একর তুলায় ব্যাপক পোকার আক্রমণ হয়। যেখানে পোকার আক্রমণ দূর করার জন্যই বিটি টক্সিন ব্যাবহার করা হয়েছে সেখানে উল্টা পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি কৃষকদের হতাশ করে। পরে গবেষণায় দেখা যায় গুজরাট, কর্ণাটক , মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন জায়গায় পোকা বিটি কটনের প্রতিই প্রতিরোধী হয়ে উঠে। এই পেস্ট রেজিস্ট্যন্সের ফলে বিটি টক্সিন কার্যকারিতা হারায় এবং পোকার আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের আরও অধিক পরিমাণ কীটনাশক ইউজ করতে হয়।
সরকার, মাহিক কোম্পানি এবং কৃষি বিজ্ঞানিদের দ্বারা পরিচালিত ফিল্ড লেভেল এসেসমেন্ট এ জানা যায় শুধু কর্ণাটক রাজ্যেই ৫৪ হাজার হেক্টর তুলা নষ্ট হয় যার আর্থিক মূল্য ২৩০ কোটি রূপী। এই বিপুল ফসল নষ্ট হওয়ায় কর্ণাটক রাজ্য সরকার বিটি তুলার বীজের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে। এমনকি রাজ্য সরকার মাহিক কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে ঐ রাজ্যের কৃষিতে যে কোন ধরণের বিটি টেকনোলজির বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ( দৈনিক বাঙ্গালোর মিরর, ২২ মার্চ, ২০১৪; বিজনেস ষ্ট্যাণ্ডার্ড , ৩০ মার্চ, ২০১৪)।
এক দিকে মনসান্টো-মাহিকোর বিটি কটন বীজ চড়া দামে কিনে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন ভারতের কৃষকগণ , অন্যদিকে পরবর্তীতে পোকার আক্রমণে জর্জরিত ক্ষেতে প্রচুর কীটনাশক ইউজ করতে বাধ্য হয়ে আরও ঋণের বোঝা মাথায় নিতে হয় কৃষকদের, তারপরও ক্রপ ফেইলিউর হওয়ায় শত শত কৃষক শুধু মহারাষ্ট্রেই সুইসাইড করেন। মনসান্টো-মাহিকোর বিটি কটন বীজকে তাই অনেকে সুইসাইড বীজ বলেও অভিহিত করেন। বাংলাদেশের কৃষিতে এই সুইসাইড বীজ আমরা দেখতে চাই না!
ম্যানিপুলেটেড ডাটা আর গল্প শুনিয়ে আমাদের কর্পোরেট আগ্রাসনের শিকারে পরিণত করা হয়ঃ
বাংলাদেশে বিটি তুলা চাষের জন্য এখানকার বিজ্ঞানী/ কৃষিবিদদের সম্মতি আদায়ের জন্য এইতো কিছু দিন আগে (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪) বহুজাতিক এগ্রো-কর্পোরেশনগুলোর প্রমোটার ISAAA বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক)অডিটোরিয়ামে আয়োজন করে এক সেমিনার। যেখানে বিটি তুলার চাষ করতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে ভারতে শত শত কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে সেখানে এই সেমিনারে ভাগিরাথ নামক এক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ আমাদের শুনালেন ভারত বিটি কটন চাষ করে কিভাবে লাভবান হয়েছে তার গল্প, এক বারের জন্যও বললেন না ভারতে পোকার প্রতিরোধী হয়ে উঠার কাহিনী, বিটি কটনের ফলন বিপর্যয়ের গল্পও তাঁর বক্তৃতায় পাওয়া গেল না। জিএম শস্য যে বহুজাতিকের বায়োপাইরেসির হাতিয়ার, প্যাটেন্ট আগ্রাসনের মাধ্যমে যে বীজ মালিকানা কোম্পানির দখলে যায় তা ভাগিরাথ সাহেবরা আলাপ করতেও ভুলে যান। এভাবেই ম্যানিপুলেটেড ডাটা আর গল্প শুনিয়ে আমাদের কর্পোরেট আগ্রাসনের শিকারে পরিণত করা হয়। বাংলাদেশের কৃষি আর এদেশের বীজের উপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষেই জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রচার প্রোপাগান্ডায় নেমেছেন ISAAA এর ভাড়াটে জ্ঞানবাগীশরা।
বিটি কটনে কি লাভ?
১] বিটি তুলার পেটেন্ট মনসান্তোর, ফলে চড়া দামে এই বীজ কিনতে হবে কোম্পানির কাছ থেকে, এতে করে বীজ মালিকানা হারাবে কৃষক! ভারতের কৃষকদের মত কোম্পানির নানা শর্তের ফাঁদে আটকা পড়লে তা কৃষকদের মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করবে। এ বীজ স্থানীয় কৃষকদের পথে বসাবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
২] ভারতের মত এখানেও পেস্ট রেজিস্ট্যান্স দেখা দিলে এই বিটি তুলা চাষে ব্যাপক কীটনাশক ব্যাবহার করতে হবে, ফলে বিটি প্রযুক্তির কার্যকারিতা থাকবে না।
৩] ২০০৫ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে বিটি কটন এলারজির জন্য দায়ি এবং ভারতে শত শত বিটি তুলা চাষি তুলা চাষ করতে গিয়ে মারাত্মক এলারজিতে আক্রান্ত হন।
৪] পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর বিটি কটনের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ চিন্তিত। বিটি কটন জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
আমরা মনে করি, এই বিটি তুলা কৃষি, কৃষক, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। শুধুমাত্র কোম্পানির স্বার্থে এই তুলা চাষের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ এখন পুরাই একটা ডাম্পিং স্টেট হয়ে গেল। পৃথিবীর যেখানে যা নিষিদ্ধ করা হয় তাই বাজারজাত করে এদেশ থেকে মুনাফা লুটে নেয় বহুজাতিক কোম্পানি।সরকারের জিএম বিটি তুলা চাষের যে কোন তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানাই। বাংলাদেশের কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানির চলমান আগ্রাসন রুখে দাঁড়াতে হবে এখনই।