বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা গত ১লা জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে “বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ” শিরোনামের এক কলাম লিখে বাংলাদেশী পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অনেকেই জনাব মজীনাকে সাধুবাদও জানাচ্ছেন। তো বাংলাদেশ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারে জনাব মজিনার মত হচ্ছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের একই স্বার্থ ও একই মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অনেক বছরের পুরোনো বন্ধুত্ব রয়েছে, বাংলাদেশের প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ, এর উন্নয়নমূলক অর্জন, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এর সাফল্য বিশ্বের জন্য মডেলে পরিণত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্ধু এবং এ দেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একই লক্ষ্য পোষণ করে। মজিনা চান বাংলাদেশ এশিয়ার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক টাইগার হয়ে উঠুক। কিন্তু চলমান সহিংস রাজনীতি বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এজন্য দুই বিবদমান জোট এর কাছে মজিনার দাবি তারা যেন অবিলম্বে সহিংসতা পরিহার করে একটা শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হন। ব্যক্তি মজিনা বাংলাদেশের উনয়ন ও সমৃদ্ধি চাইতেই পারেন, এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতে আমরা কসুর করব না। কিন্তু কূটনৈতিক মজীনা সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকা চাই। বাংলাদেশ ও দক্ষিন এশিয়া নিয়ে মার্কিন পলিসি সম্পর্কে যদি আমাদের বিন্দু মাত্র ধারণা থাকে তাহলে “বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ” কেন এ ব্যাপারে মজীনা যা বলেছেন তা সুগার কোটেড বয়ান ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না আমাদের। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বাংলাদেশ নিয়ে এত আগ্রহের কারণ হচ্ছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত নতুন জিওপলিটিক্স এবং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রান্তিক বাজার হিসেবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব।
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত এই বেল্টে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাংলাদেশের ভু-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে পরাশক্তি হিসেবে চীনের অগ্রগতি ঠেকানো এবং এ অঞ্চলের গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি যেমন জরুরি তেমনি বাংলাদেশের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিবর্তনের ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কর্তৃত্ব নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব বর্তমানে নতুন রূপ পেয়েছে । আমেরিকার নতুন সামরিক প্রতিরক্ষানীতি সম্পর্কে সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা সিঙ্গাপুরে সাংগ্রিলা ডায়ালগে বিষয়টি স্পষ্ট করেন। এসম্পর্কে চীনা পত্রিকা “ চায়না ডেইলি’র ৯/১৩/২০১২ সংখ্যায় বলা হয় “This year has seen a great change in Washington's military strategy. On Jan 5, 2012 the US Defense Department released a non-classified version of its strategic defense guideline, “Sustaining US Global Leadership: Priorities for 21st Century Defense", which announced the shift in US strategic focus from the Middle East to Asia-Pacific. Speaking at the Shangri-La Dialogue in Singapore on June2, 2012 Panetta outlined details of the US plan for its "rebalance" toward Asia-Pacific, saying the US Navy will reposition 60 percent of its warships in Asia-Pacific by 2020 as part of its new military strategy”. আমেরিকার সামরিক নীতিতে এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত-মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব বর্তমানে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার ওয়ার অন টেরর প্রকল্পে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে অনেক আগেই। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা যা এই অঞ্চলের উপর মার্কিন পলিসি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে । এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে কোন রেডিক্যাল রাজনীতির উত্থান ঠেকানোর জন্যই সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। এজন্য ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সাথে হানা (হিউম্যানেটারিয়ান এসিস্ট্যান্ট নিডস এগ্রিমেন্ট) চুক্তি, সোফা চুক্তি (Status of Forces Agreement /US Serviceman Protection Agreement) ও টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। সামনে স্বাক্ষর হবে আকসা চুক্তি এবং এফটিএ ( Free Trade Agreement)। যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় ও চাপে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ পাস করা হয়েছে এবং তা সংশোধন করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০১৩ প্রবর্তন করা হয়েছে এবং গত বছর স্বাক্ষর করা হয়েছে ঢাকায় এফবিআই এর স্থায়ী প্রতিনিধিসহ স্থায়ী অফিস বসানোর চুক্তি ও দ্বিপাক্ষিক সন্ত্রাস বিরোধী সহযোগিতা চুক্তি। অ্যাকুইজেশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) স্বাক্ষরের লক্ষ্যে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্কট এইচ সুইফট এর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যেই দুই দফা বাংলাদেশ সফর সম্পন্ন করেছেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থানকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোতেই সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এসব চুক্তির মূল লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নাম করে আর বাংলাদেশের নিরাপত্তার নাম করে এদেশকে ওয়ার অন টেরর এর পরবর্তী যুদ্ধ ক্ষেত্র বানানো! সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও সহযোগিতা চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশের যে কোন মার্কিন বিরোধী বিপ্লবী শক্তিকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে তাকে দমন করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক খাতকে পুরাপুরি মার্কিন বলয়ে নিয়ে এসে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার উপর চলমান সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা আরও জোরদার করাই যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ বিষয়ক পলিসি। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে হেজিমনিক নানান চুক্তি স্বাক্ষর করায় এদেশের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এজন্যই জনাব মজীনা তাঁর কলামে উল্লেখ করেন, “ আমি আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উদ্যাপনের জন্য কলম হাতে নিয়েছি। এই সম্পর্ক এর আগে এত বিস্তৃত, গভীর ও শক্তিশালী ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আছে বলে আমি আজ এই লেখা লিখছি”।
জনাব মজিনা চান বাংলাদেশ এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক টাইগার হয়ে উঠুক এবং বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতা এবং আনুষঙ্গিক অমানবিক সহিংসতা অর্থনীতিকে বিনষ্ট করছে বলে তিনি এর অবসান চান। তাঁর সাথে আমরা একমত বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা এদেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে কিন্তু বাংলাদেশকে এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক টাইগার হয়ে উঠার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কি বাংলাদেশ এর জন্য কোন সহায়ক ভূমিকা পালন করছে? আমরা লক্ষ্য করে আসছি গত দুই দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রভাবাধীন আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশের উৎপাদনমুখী অর্থনীতির বিকাশ না ঘটিয়ে উল্টো বাংলাদেশকে বহুজাতিক কোম্পানির গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রান্তিক বাজারে পরিণত করেছে। এসব সংস্থার সমস্ত নীতি ও শর্ত যেমন কাঠামোগত সংস্কার, অবাধ বিনিয়োগ ও অবাধ বাজারব্যবস্থা, নিওলিবারেল পলিসি- এসবের লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুজাতিক কর্পোরেশনের অবাধ বাণিজ্য নিরঙ্কুশ করা। জনাব মজিনা যদি বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি চান তাহলে তাঁর উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের উপর বৈষম্যমূলক শুল্ক কমিয়ে আনার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি কিংবা শুল্কমুক্ত প্রবেশধিকার পেলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বাড়বে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী অনুন্নত সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে উন্নত দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার/ জিএসপি সুবিধা এমনিতেই পাওয়ার অধিকার রাখে। চুক্তি অনুযায়ি আমেরিকা বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের যে চার দশমিক আট বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে তার মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে জিএসপি সুবিধার বাইরে রেখেছে। বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিয়ে এ পণ্যটি রফতানি করে থাকেন অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩%। জনাব মজিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি চান বলে দাবি করলেও এই বিষয়ে তাঁর কোন পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়েনি। মজিনা যদি সত্যিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি চান তবে তিনি মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল (পরবর্তীতে ইউনোকল এবং বর্তমানে শেভ্রন) এর কাছ থেকে মাগুড়ছড়া গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণজনিত কারনে বাংলাদেশের পাওনা হাজার হাজার কোটি টাকা আদায় করে দিতে সচেষ্ট হতেন। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের শীর্ষ বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানি শেভরনের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩ কোটি ডলার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এই ৩ কোটি ডলার রাজস্ব ফিরিয়ে দিতে মজিনা শেভরনকে চাপ প্রয়োগও করতে পারেন, এতে বাংলাদেশ বিপুল আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়াও বাংলাদেশের তেল গ্যাস উত্তোলনের জন্য মার্কিন কোম্পানিগুলোর সাথে যে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি বা পি,এস,সি-২০১২ স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। পিএসসি-২০১২ অনুসারে বহুজাতিক তেল কোম্পানির কস্ট রিকভারি লিমিট ৫৫% থেকে বৃদ্ধি করে ৭০% করা হয়েছে। এর মানে বিদেশি তেল কোম্পানি কস্ট রিকভারির নামে দেশের ৭০% উত্তোলিত তেল ও গ্যাস পুরাটাই নিজের মালিকানায় নিয়ে যাবে! এছাড়া বিদেশি কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্স এর ৩৭.৫% পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে এবং বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুট ৬.৫ ডলার দামে কিনে নিতে হবে কোম্পানির কাছ থেকে যার মূল্য পিএসসি-২০০৮ এ ছিল ২.৯ ডলার। এভাবে বাংলাদেশের তেল গ্যাসের উপর মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানির নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে পিএসসি ২০১২ (সংশোধিত)স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে- এতে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা মোটেই মজিনার কাছে উদ্বেগের বিষয় নয় বরং তাঁর কাছে এটা বিশাল কূটনৈতিক সফলতা হিসবেই পরিগণিত হচ্ছে! এখন আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা) এর মাধ্যমে এদেশের বাজার পুরাপুরি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে নিয়ে যেতে। ফলে মজিনার তরফ থেকে বাংলাদেশে চলমান ভায়োলেন্স কেন্দ্রিক রাজনীতির ব্যাপারে উদ্বেগের কারণ অর্থনৈতিক নয় বরং বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন পলিসি বাস্তবায়ন করাই মজেনার উৎকণ্ঠার বিষয়। বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে কোন রেডিক্যাল রাজনীতির উত্থান ঠেকানোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সময়ের লক্ষ্য। বাংলাদেশের চলমান অস্থির রাজনীতির কারনে যেন কোন রকম নতুন গণশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেটা সুনিশ্চিত করাই এই কূটনীতির লক্ষ্য। কারণ চলমান শাসকগোষ্ঠী গত কয়েক দশক যেভাবে পরাশক্তির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাংলাদেশকে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও ইম্পেরিয়ালিজমের প্রান্তিক বাজারে পরিণত করেছে তা বাধাগ্রস্ত হবে যে কোন বিপ্লবী রাজনীতির উত্থান হলে। লিবারেল রাজনীতির স্কোপ না থাকলে দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে বিপ্লবী রাজনীতি ঠেকানোর জন্য মজীনারা তৎপর। রাজনীতি যেন লিবারেল বুর্জোয়াদের হাতেই থাকে সেজন্যই এতো এতো মার্কিনী আর জাতিসঙ্ঘীয় তৎপরতা। ফলে ভায়োলেন্স থেকে বাংলাদেশের শান্তিকামী জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর যুক্তরাষ্ট্রের ভায়োলেন্স বিরোধিতাকে এক করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের চলমান ভায়োলেন্স নিয়ে মার্কিন উৎকণ্ঠার কেন্দ্রে আছে এই দেশে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যেন লিবারেল বুর্জোয়া রাজনীতির বলয়ের মাঝে পুঁজিতান্ত্রিক গ্লোবাল অর্ডার এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণি ও শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে। ক্ষমতার রাজনীতিতে মার্কিন আনুকূল্য পাওয়ার আশায় বর্তমান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী নানান চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চলমান সহিংস রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই সরকারের বেপরোয়া অগণতান্ত্রিক আচরণে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ কেননা বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন এমন এক রূপ ধারণ করেছে যে তা লিবারেল রাজনীতির স্পেসও রাখতে রাজি নয়। সমাজের নানান গ্রুপ ও শক্তিকে দমন নিপীড়ন করে রাষ্ট্র নিজেই যখন সন্ত্রাসের অপর নাম হয়ে উঠে তখন সমাজে হাজির হয় বিরোধী সন্ত্রাস। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে দীর্ঘকালীন সহিংসতা সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি করে তাতে রাজনীতিতে যে কোন রেডিক্যাল ফোর্স/ এলিমেন্ট এর উত্থান ঘটতে পারে যা এই অঞ্চলে মার্কিন পলিসির বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পরিচালিত বাংলাদেশ বিষয়ক দুই দফা শুনানিতেও সহিংস রাজনীতির সুযোগে রেডিক্যাল শক্তির হাজির হওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সহিংস রাজনীতি বন্ধের যে আহবান আমরা মজিনার কণ্ঠে শুনি তার কূটনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে সম্ভাব্য রেডিক্যাল রাজনীতির আবির্ভাব ঠেকানো। এই ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি হচ্ছে বিএনপির মত উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন জোটের মাঝে সম্ভাব্য ‘রেডিক্যাল এলিমেন্টগুলোকে’ ডিসলভ করে দেয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষক গৌতম দাসের মতে, “ মার্কিন উদ্বেগ নিরসন ও ভারসাম্য বজায় রাখার দিক থেকে আওয়ামি লীগের চেয়ে বিএনপিই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছের মিত্র হতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘রেডিক্যাল এলিমেন্টগুলোকে’ আঠারো দলীয় জোটের মধ্যে ধারণ বা আটক রেখে, জোটকে সামনে রেখে দেশে একটা নির্বাচনী লিবারেল রাজনীতি টিকিয়ে রাখা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ ‘রেডিক্যাল এলিমেন্ট’ সামলানোর এটা খুবই উপাদেয় ও কার্যকরী উপায় হতে পারে।“
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে মার্কিন আগ্রাসী পলিসির বাস্তবায়নে মজেনারা তৎপর তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন গোষ্ঠীকে সজাগ থাকতে হবে। জনগণের তরফ থেকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির অভিমুখ হবে দুইটি। প্রথমত দুই বিবদমান পক্ষকে অবিলম্বে নিজেরাই দেশের অভ্যন্তরেই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে বাধ্য করা যেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভবপর হয়। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদের সুযোগে বাংলাদেশের উপর পরাশক্তির নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করা। পরাশক্তির আধিপত্য বাংলাদেশকে এতো বেশি গ্রাস করার মূল কারণ হচ্ছে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা এখনো নিজেদের তৈরি করতে পারি নাই। ফলে এখনও একদিকে চলছে গণরাজনীতি বিবর্জিত কূটনৈতিক রাজনীতি যার ভিত্তিতে দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট পরাশক্তির কৃপা লাভ করে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর। অন্যদিকে এই নতজানু রাজনীতির বাইরে গণশক্তির বিকাশও সম্ভবপর হয় নাই যে রাজনৈতিক শক্তি পরাশক্তির হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত। ফলে পলিটিক্যাল কমিউনিটি আকারে নিজেদের পুনর্গঠন করাই এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।গণমুখী রাজনীতির বিকাশ ছাড়া বিদ্যমান সংকটের কোন স্থায়ী সমাধান নাই! বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে গণমুখী রাজনীতির অভিমুখ হওয়া উচিত নয়া উপনিবেশবাদ , ইম্পেরিয়ালিজম এবং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম এর মোকাবিলার জন্য নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সমাজপরিবর্তনের রাজণৈতিক-সামাজিক শক্তিকে অবশ্যই গ্লোবাল ইম্পেরিয়ালিজম এবং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম এর দেশিয় এজেন্সির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। আরও সোজা কথায় বললে বাংলাদেশে চলমান ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেমন আমাদের দাঁড়াতে হবে একইরকম ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। তো এই বৈশ্বিক আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যারা লড়বে তাদেরকেই মজিনারা অনিয়মতান্ত্রিক এবং ননলিবারেল বলে নিন্দা করবেন, নিয়মতান্রিকতা রক্ষা না করলে যে পরাশক্তির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে!