কয়েকদিন আগে টুটুলের মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিলো ইউকেবেঙ্গলির বিশেষ প্রতিনিধির। আলাপচারিতার বিবরণ পড়ূন নিচেঃ
ইউকেবেঙ্গলিঃ আপনি কেমন আছেন?
নভেরা খাতুনঃ আমার বয়স হয়েছে। বিভিন্ন রোগে ভুগছি। বুড়ো বয়সে এতোটা আঘাত পাবো ভাবিনি। আমার ছেলের মৃত্যু নিয়ে কথা বলার মতো বাকশক্তি এখন আর নেই। কোথায় আগে মরবো আমি, সে-মরা মরলো ও। আমি আল্লাহ'র কাছে রাত-দিন কাঁদতাম - আল্লাহ, ও মরার অন্ততঃ একদিন আগে আমাকে নিয়ো। কিন্তু আল্লাহ আমার ফরিয়াদ শুনলো না।
ইউকেবেঙ্গলিঃ আমরা সংবাদ-মাধ্যমে জানতে পারলাম ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুলকে রাব ২৫ জুলাই রাতে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করেছে। পরে আবার ২৭ জুলাই সংবাদ-মাধ্যমেই জানলাম তার মৃত্যুর খবর। পুলিস-রাব গ্রেফতারের খবর অস্বীকার করে আসছিলো। প্রকৃত ঘটনা কী?
নভেরা খাতুনঃ ঢাকার উত্তরা থেকে সে গ্রেফতার হয়নি, গ্রেফতার হয় মিরপুর থেকে। মিরপুরের ৮ নং রোডে ডি ব্লকের ৬ নং সেকশনের একটি বাড়ী থেকে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানতে পেরেছি। ওকে ২৫ জুলাই রাতে গ্রেফতার করা হয়নি, ২৫ জুলাই সকালে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরের দিন সকালে অর্থাৎ, ২৬ জুলাই সকালে আমাদের বাড়ী পুলিস আসে। পুলিস ওর বাবার সঠিক পরিচয় যাচাই করে। তখন আমার সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে পুলিসই আবার টুটুলকে গ্রেফতারের খবর আমাদেরকে দেয়। তখন আমি আমার আত্মীয়-স্বজন ও নিকট-জনদের নিয়ে ঝিনাইদহ ডিসি অফিসে স্মারকলিপি দিতে যাই এবং ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করি। রাব ও পুলিস তখন পর্যন্ত সংবাদ-মাধ্যমের কাছে টুটুলের গ্রেফতারের তথ্য গোপন করে। তারা হয়তো ভেবেছিলো গ্রেফতারের খবর গোপন রেখে খুব সহজে তাকে হত্যা করা যাবে। যে-ভাবে আর সব ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে ও-রকম কিছু একটা করে ফেলবে। কিন্তু যখন দেখা গেলো টুটুলকে বিনা-বিচারে হত্যা করার আগেই অনেকে কথা বলছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তখনই কর্তৃপক্ষ টুটুলের গ্রেফতারের খবর অস্বীকার করতে শুরু করলো। তবে আরও প্রতিবাদ হবার আগেই হত্যা করা হয়।
ইউকেবেঙ্গলিঃ ডাঃ টুটুল গ্রেফতার হবার পর বিনা বিচারে হত্যা ঠেকানোর জন্য আপনি জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারক-লিপি নিয়ে গিয়েছিলেন। আপনি আপনার সন্তানকে প্রচলিত আইনের মুখোমুখি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক আপনার স্মারক-লিপি গ্রহন করেননি। কেনো তিনি স্মারক-লিপি গ্রহন করেননি?
নভেরা খাতুনঃ আমরা জেলা প্রশাসকের বাসায় ২৬ জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় স্মারক-লিপি দিতে যাই। কিন্তু তার পিএ স্মারক-লিপি নিতে অস্বীকার করেন। পরের দিন সকাল ৯টায় অফিস খুললে স্মারক-লিপি দিতে বলেন। আমাদের পক্ষ থেকে বারবার স্মারক-লিপি গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। তবু স্মারকলিপি নেয়া হয়নি। পরের দিন স্মারক-লিপি দেয়ার কোনো প্রয়োজনও ছিলো না। স্মারক-লিপি না-নেয়াটা ছিলো পূর্ব-পরিকল্পনা-প্রসূত। স্মারক-লিপি গ্রহণ না-করার ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, আমার ছেলেকে হত্যা করার পরিকলপনা আগেই করে ফেলা হয়েছিলো।
ইউকেবেঙ্গলিঃ জেএমবি-হরকাতুল জেহাদ, বাংলা ভাই-আব্দুর রহমান সারা দেশে বোমা ফাটিয়ে দেশকে ফেলার পরেও তাদেরকে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আওতায় আনা হয়েছিলো। কিন্তু আপনার ছেলেকে সে-সুযোগ দেয়া হয়নি। এ-ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
নভেরা খাতুনঃ কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের আইনানুযায়ী আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেই কেবল তিনি শাস্তি পেতে পারেন। জেএমবি একটি নাটক ছিলো বলে আমার মনে হয়। এ-সব নাটক বিদেশীদের দ্বারা ঘটানো হয়। কিছু মানুষ আছে, যারা এ-নাটকে না বুঝেই অংশগ্রহণ করে। আমি কোনো প্রকার বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করি না। তবুও এটা বলবো যে, জেএমবির প্রতি সরকারের আচরণ পক্ষপাতমূলক।
আর একটা কথা বলতে চাই। তা হলো, সশস্ত্র ধারার বামপন্থী কমিউনিস্ট আন্দোলন ঠিক-না-বেঠিক তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তবে এদের সততা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মিথ্যাচার করা হবে।
ইউকেবেঙ্গলিঃ বিনা-বিচারের হত্যাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
নভেরা খাতুনঃ এটা যার করছে তারা এক অর্থে রাষ্ট্র রাষ্ট্রদ্রোহীতার কাজ করছে। প্রত্যেকটি মানুষের আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। তা না হলে আমরা আর সভ্য হলাম কী-করে? যারা বিনা-বিচারের হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তাদের বিচার হওয়া উচিত - তারা রাষ্ট্রদ্রোহী।
ইউকেবেঙ্গলিঃ আপনার ছেলের সম্পর্কে কিছু বলুন।
নভেরা খাতুনঃ একেবারে ছেলেবেলায় ও খুব দুষ্টু ছিলো। তবে মেধাবীও ছিলো। হাইস্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে সে ধীর-স্থির হতে থাকে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে পড়া-কালীন সময় সে কমিউনিস্ট রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মেডিক্যাল কলেজে পড়া শেষ না করেই সে পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে চেয়েছিলো। ওর বাবা তখন ওকে বললো, তোমার পিছনে এতো টাকা খরচ করলাম, তুমি অন্ততঃ ডাক্তারী পাসটা করো। ডাক্তারী পাস করার পর টুটুল একদিন ওর বাবার সামনে এসে বললো, 'এই নাও তোমার ডাক্তারী পাশের সার্টিফিকেট।' এরপর ওর বাবা ওকে চাকুরীতে ঢোকার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। টুটুল মাত্র ১ মাস সরকারী চাকুরী করে। এরপর থেকে পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটা মাস্টার্স পাস করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-কালে তার বিয়ে হয়। আর টুটুল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে। আমাদের আশা ছিলো, ও প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার হবে। আমাদের একটি সুখী পরিবার হবে। কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতিতে ঢুকে চাকুরীতো করলোই না, উপরন্তু গরীব মানুষের উপকার করতে গিয়ে আমাদের বেশির-ভাগ জায়গা-জমি বিক্রি করে দিলো। এখন আমি একাই থাকি। বাজারে ঘর আছে; সেখান থেকে ভাড়ার কিছু টাকা পাই। মাঠে অল্প কিছু জমি অবশিষ্ট আছে, সেখান থেকে কিছু পরিমাণ শষ্য আসে।
টুটুল খুলনার ফুলতলায় আমাদের এক এক দূর-সর্ম্পকীয় আত্মীয়ের লুসিকে বিয়ে করে। বিয়ের পর লুসি বেশ কয়েক বছর পার্টির সাথে জড়িত ছিলো। ওদের একটি সন্তান হয়। নাম রাখে পিতুল। পিতুলকে লালন পালনের জন্য লুসি পার্টি করা থেকে বিরত থাকে। পরে একটি বেসরকারী সংস্থায় চাকুরী নেয়। প্রায় ১২ বছর বিবাহিত জীবন কাটানোর পরে লুসি- টুটুলের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। পিতুল গত বছর এইসএসসি পাশ করেছে।
টুটুল একটি শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলতো। আমি বলতাম বড়োলোকেরা তাদের সম্পদ ত্যাগ করবে না। তুই তাদের শত্রু হয়ে যাবি। সরকারও বড়োলোকদের পক্ষে থাকবে। ওরা তোকে বাঁচতে দিবে না। শহীদকে (মোফাখকার চৌধুরী) ক্রসফায়ারে হত্যা করার পর পুলিস এসে খবর দেয় টুটুলকে হত্যা করা হয়েছে। পরে জানা যায়, ওটা ছিলো ভুল খবর। এরপর ওর সাথে যোগাযোগ হলে বলি, শহীদকে ওরা হত্যা করেছে এবার কিন্তু তোকে খুঁজে বের করবে। তোকে বাঁচতে দেবে না। আমি জমি বেঁচে তোকে টাকা দিচ্ছি; তুই বিদেশে চলে যা। আমার কথা শুনে ও চুপ করে থাকতো আর মিটমিট করে হাসতো।
ইউকেবেঙ্গলিঃ আপনারা কি দেশের প্রচলিত আদালতে এ-হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো আইনী লড়াইয়ে যাবেন?
নভেরা খাতুনঃ এ-বয়সে আমার পক্ষে দৌড়াদৌড়ি করাটা বেশ কষ্টকর। আমার সে-শারীরিক ক্ষমতা নেই। ছেলে বেঁচে থাকলে তার জন্য তবুও ছুটতাম, শেষ সময় পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি। ঝিনাইদহ আদালতে কেইস করা হলে আমি দৌড়াতে পারবো। কিন্তু ঢাকায় যেয়ে আমার পক্ষে দৌড়ানোটা খুব কঠিন। তবে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি এ-হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য এগিয়ে আসে তবে আমি তাদের স্বাগত জানাবো।
ইউকেবেঙ্গলিঃ ডাঃ টুটুলের সংগঠন জনগণের উপরে নির্যাতন চালায় ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে বলে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এ-ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
নভেরা খাতুনঃ পত্রিকায় লাল পতাকা সর্ম্পকে বানোয়াট রিপৌর্ট করানো হতো। পত্রিকাতো ওদের দলের মতামত প্রকাশ করতো না। টুটুল দুনিয়ার মানুষের উপকার করে বেড়াতো। ওর মুখের দিকে তাকালে, ওর চেহারা দেখলে কেউই বলতে পারবে না ও কোনো খারাপ কাজ করতে পারে। যে-মানুষটা ডাক্তারী পাস করার পর নিজের সুখ-সাচ্ছন্দ্য না দেখে গরীব মানুষের জন্য কাজ করতে গেলো, সে-খারাপ লোক হয় কী-করে?
ইউকেবেঙ্গলিঃ ডাঃ টুটুল সম্পর্কে এলাকাবাসীর ধারণা কী?
নভেরা খাতুনঃ এলাকাবাসীর কাছেই জিজ্ঞেস করুন তারা টুটুল সম্পর্কে কী ধারণা করে। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে - শুধু এটা বলতে পারি।
সূত্রঃ ইউকেবেংগলি ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১২:১৩