উৎসর্গের চাইতে বেশি কিছু- প্রিয় প্রবাসী ভাইকে ভালবাসাসহ
লিখব - টিকব তাই কখনো ভাবিনি,বই - আরো পরের কথা। কেমন করে কি হলো - আজ সে কথা বলবো।
গল্প সঙ্কলন করতে গিয়ে মামুন ভাই ও প্রবাসী ভাইয়ের সাথে পরিচয় হল। একসময় তারা আমার সাথে গল্প সংকলনে যুক্ত হলেন। হাসি ঠাট্টায় আনন্দে শ্রমে ঘামে আমরা সংকলন চালিয়ে যেতে লাগলাম। আর এটাকে সামনে রেখে কিভাবে কিভাবে যেন একসময় আমাদের মধ্যকার রসায়ন ঘন হয়ে উঠল।সে আরেক কথা।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে বই করার কথা মাথায় এল।জয়েন্ট বই।দুইজন কি তিন জন মিলে।এর মধ্যে একজন ব্লগার কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন,বই করলে যেন তাকে জানাই।জানালাম।তিনি সময় চাইলেন।পরে নানা সীমাবদ্ধতায় তার পক্ষে তখন এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। মাঝের সময়ে মামুন ভাইকেও হিন্টস দিয়ে রেখেছিলাম। যা হোক,উনি সময় বের করতে না পারায় মামুন ভাই আর আমি বই বের করব -পাকাপাকি হয়ে গেল।
এদিকে সময় ও তখন কাছাকাছি হয়ে এসেছে।অক্টোবর।কোরবানির ঈদের বন্ধে মামুন ভাইয়ের বাসায় গেলাম।মামুন ভাই যে গল্পগুলা আমরা বইতে দেবো বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি তার প্রিন্ট করে রেখেছেন।দুজনে আবার পড়লাম।তারপর কিভাবে কি করব তার কিছু সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমাদের প্রথমে পরিকল্পনা ছিল,বই ৮০ পাতার বের হবে। দাম হবে ৬০ - ৭০ টাকার মত। ৫০০ কপি ছাপাবো।২০১৪ সালে মোয়াজ্জেম আজিমের একটা ছোটগল্পের বই বেরিয়েছিল।বালুনদী ও গরুরহা্টের গল্প। আমরা চেয়েছিলাম ঠিক ঐ সাইজের বই বের করতে। বইটি বের করেছিল লেটার প্রেস।প্রথমে তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। লেটার প্রেসের পক্ষ হতে রাখাল রাহা এলেন।
ত প্রথমেই জিজ্ঞাসা।কোথাও লেখাটেকা বাহির হইছে কিনা।মামুন আর আমার দুজনেরই অল্প কিছু মেটেরিয়াল ইতিমধ্যে কিছু জায়গায় গেছে।বললাম। তিনি হুম বললেন।আমি মনে মনে হুম হুম বললাম। তারপরের কথা- কয়টা গল্প বইতে দেব কেন দেব এটা কেন দেব অইটা কেন দেবনা? তার কোন হিসেব আমাদের আছে কিনা? জানালাম আছে।
যাই হোক আমদের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না বোঝা গেল। তার পর বললেন, এখন বই বের করা যাবে না।কারণ বইয়ের এডিটিং করতে সময় লাগবে ৬ মাস। মোয়াজজেম আজিমের ও নাকি এরকম সময় লাগছে। তারপর বইয়ের প্রসেসিং।এডিটিং করার পরও বই বের হবার নিশ্চয়তা নেই। যদি মানসম্মত হয় তাইলেই। মামুন ভাই জিজ্ঞেস করলেন এডিটিং করতে কত খরচ? তিনি বললেন ৩০ হাজার। আর বইয়ের খরচ ৩০ -৪০ -৫০ হাজার। মোট কথা ৬০/ ৭০/ ৮০০০০ টাকার মামলা।
বয়স্ক লোকেরা বাচ্চা ছেলেদের যে ভঙ্গিতে পিঠ চাপড়ায়, তিনি আমাদের সাথে সেভাবেই আচরণ করেছিলেন।আগেই জেনেছেন একজন চিটাগাং একজন রাজশাহী।ত অইভাবেই মফঃস্বলী লোকের সাথে খাটি শহুরে আচরণ।
হাবে ভাবে কথায় তিনি তখন কেওকারাডং।একসময় চূড়ায় উঠে গেলেন।লেখালিখি এত সোজা নয় ইয়ার। তারা একটা কর্মশালা করান- কিভাবে লিখতে হয়।আমাদের যোগ দিতে বললেন,ফি ১০০০ নাকি ১৫০০। জিজ্ঞেস করলেন,আমরা তার বই পড়েছি কিনা? উনার গল্পের বইয়ের নাম - চাষাড়ে গল্প।
পুরো সময়টা উপভোগ করছিলাম। দুজনেই বোকাসোকা ভাব নিয়ে গুটিসুটি মেরে আছি।লেকচার চলছেই।এদিকে বেদম হাসি এসে গেছে। না পারছি হাসতে না পারছি গিলতে। মামুন ভাই আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।আমি তাকাচ্ছিলাম না। জানি তাকালেই মুখের ঝোলা হতে রাশি রাশি হাসি উপচে পড়বে। একসময় লেকচার টর্নেডো শেষ হল। তারপর দুজনে প্রাণ ভরে হাসলাম।
এরপর আরো দু একটা ঘাট ঘুরে টুরে পারভেজ রানার রাইটার্স গিল্ডে।সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রায় সব প্রকাশকই লেখকদের জবাই করে খায়।পার্থক্য কেবল কে কোন জায়গার মাংস খাবে এটা নিয়ে। পারভেজ রানা ভাই নিজেও লেখালিখি করেন।লেখালিখি করলেও আমি এটা জানি, প্রকাশকের জায়গায় সবাই রাম লক্ষণ (রাবণ ভালো লোক তাই উনার নাম নিলাম না) তবে আমার ধারণা ছিল,যেহেতু লেখক, তিনি মাংস খেলেওঅন্যদের চাইতে কম খাবেন। এবং উনার সাথে কিছুটা ডিল করা যাবে।পরে আমার ধারণা মিলে গেছে।তিনি সবার চাইতে কম টাকা অফার করেছেন। অন্য সবার চাইতে উনার কথাবার্তা ভাল লেগেছে। ঠিক হল ৫০০ কপি ছাপানো হবে। ১০০ কপি উনি রেখে দিবেন। বাকি ৪০০ কপি আমরা নিয়ে নেবো। আমরা বললাম যদি আমাদের আরও এডিশন বের করতে হয় তাহলে রেট কেমন পড়বে? উনি বললেন, আগে যা ছাপাইবেন তা বিক্রি হয় কিনা দেখেন। তারপর এক প্রফেসরের কথা বললেন , উনার ধারণা ছিল, উনার বই ৩০০০ কপি যাবে। ৫০ কপিও যায় নাই। এরকম আর কয়েকজন ধরা খাওয়া পাব্লিকের কথা বললেন। মামুন ভাইকে দিয়ে জিজ্ঞেস করালাম,উনি যে ১০০ কপি রেখে দিবেন তার কোন রয়ালিটি আমরা পাবো কিনা? তিনি মহাদেব সাহা আর নিরমলেন্দু গুণের কথা বললেন। মনে মনে হাসতেছি -
মহাদেব সাহা গেল তল
মাহমুদ বলে কত জল!
হাহাহা।
এছাড়াও তিনি আরেক ধরণের লেখকের কথা বললেন। প্রবাসী লেখক। যারা বইয়ে আগেই ডলার ছিটে দেন। এরা থাকতে কোন দুঃখে প্রকাশক সাহেব রয়ালিটি ফয়ালিটি নামক নচ্চার জিনিসপাতির কথা ভাবতে যাবেন। মনে মনে বলতেছি,লিক্ষা নাস্তা খাওনের আশা ছাইড়া দেও, মাহমুদ! আমাদের বই কখন বের হচ্ছে? রানা ভাই বললেন , আগে আগেই বের করতে হবে।প্রথম
ডেডলাইন ছিল ডিসেম্বরের ২২ তারিখ। তারপর জানুয়ারির মাঝামাঝি।
বইয়ের ভূমিকার ব্যাপারে আসি। ভূমিকা আর ফ্ল্যাপ হইল বইয়ের গয়নাগাটি। যত ভাল গয়না পরান যায় ততই ওজনে ভারি। পাঠক - সমালোচকের কাছে আহ্লাদ ও বাড়ে।না,তাইলে মনে হয় বই কিছু একখান হইছে। ভূমিকা কাকে দিয়ে লেখানো যায়। ২ জনের নাম চিন্তা করলাম নাজিব ওয়াদুদ ভাই ও ব্লগের মামুন রশিদ ভাই। আর বইয়ের পেছনে নাট্যকার মোঃ আজমল হুদা মিঠু সংক্ষেপে কিছু বলবেন। এর মধ্যে মামুন ভাই তখন নানাবিধ ব্যস্ততায় ব্লগ থেকে স্লো হয়ে যাচ্ছেন। তারপরও রাজি হলেন। রাজি হলেন নাজিব ওয়াদুদ।এর পরেই কাহিনী শুরু হল।নাজিব ভাই অসুস্থ হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলেন। উনি তখন ঘাড় ফেরাতেই পারছেন না। কি আর রিভিউ টিভিউ দিবেন। মামুন রশিদ ভাইয়েরও ত্রাহিরাহি অবস্থা। জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি মেনে নিলাম।
প্রচ্ছদ নিয়ে আরেক কাহিনী। ঠিক হল মুস্তাফিজ কারিগর প্রচ্ছদ করবেন। মুস্তাফিজ কারিগরকে ফোন দিতে দিতে রানা ভাই নাকি কানা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কখনো ঢাকায় পান না। কখনো ফোন ধরে না। আর মুস্তাফিজ কারিগর ইতিমধ্যেই হট কেক হয়ে গেছেন।তখন রানা ভাই বললেন আরেক জনকে ধরি কি বলেন? আমরা রাজি হলাম। নভেম্বরে শামিম জামানকে প্রচ্ছদের দায়িত্ব দেয়া হল। মামুন ভাই ডিরেকশন দিয়ে দিলেন কি করতে হবে না করতে হবে।আমাদের বইয়ের পান্ডুলিপি পড়তে বললেন। ঠিক হল কিছুদিনের মধ্যে দিয়ে দিবেন।কিসের কি জানুয়ারি চলে এল আমাদের প্রচ্ছদের খবর নাই। প্রথম প্রথম দুয়েকবার আমাদের কল ধরলেও শামিম ভাই আর কল ধরেন না।রানা ভাইও যথারীতি কানা হয়ে আছেন। আগে প্রচ্ছদ হবে তারপর বই।এদিকে সবাই প্রচ্ছদ দিয়ে বইয়ের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। যারা পরিচিত যারা বইয়ের কথা জানেন তারা জিজ্ঞেস করছেন কিরে বই কবে বেরুচ্ছে? মামুন ভাইকে উনার আব্বাও জিজ্ঞেস করছেন। মামুন ভাই আর আমার একই উত্তর হবে হবে। আর এদিকে শামিম ভাই ফস্কালে যে কি হবে কার কাছে যাবো
এসব ভেবে ভেবে মরছি।সজীব ভাইকে প্রচ্ছদ শিল্পী দেখতে বললাম।এইসব ডামাডোলের মধ্যে অবশেষে জানুয়ারির ১২ তারিখ শামিম ভাই প্রচ্ছদ দিলেন। মামুন্ ভাই ফেসবুকে আপলোড দিলেন।
একদিন বইকেন্দ্রিক আলোচনা করার সময় আমার রুমমেট ফোনের কথা শুনে বুঝতে পারল আমার বই বের হচ্ছে।তিনি অবাক।আর আপ্নে যে লেখেন এটাই জানতাম না। ঘরের ভিত্রে রাইটার লইয়া ঘুমাই। তিনি গিয়ে যে মুদি দোকান হতে সদাই নিই তাকে বললেন।ত পরের দিন ওই লোক জিজ্ঞেস করল,আমার বই বের হচ্ছে কিনা? আমি বললাম আপনি কিভাবে জানেন?তখন উনি আমার রুমমেটের কথা বললেন।বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন।আমি বললাম, ফাঁদ ও সমতলের গল্প।উনি বললেন, বাহ! ফাঁদেও পরতে হইব, সমতলেও থাকতে হইব!
এরপরের ধাপ হল বই কবে বের হচ্ছে। রানা ভাইয়ের কথা হবে হবে।এই হবে হবের মধ্যে একদিন রানা ভাইকে ফোনে পাই না।
এর পরের দিন একই অবস্থা। এর পরের দিন ও। ঘটনা হল প্রকাশক সাহেব সৃতিসৌধ দেখতে গিয়ে ছিনতাই এর স্বীকার হয়েছেন।
এই ঘটনায় রানা ভাই বেশ আপসেট হয়ে গেলেন।ফলে বই প্রকাশের কার্যক্রম বেশ পিছিয়ে গেল। শেষ মেষ ঠিক হল ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ বই আসবে।তারপর ৫ তারিখ আসার কথা। ৫ তারিখ শুক্রবার। সেদিনও আসেনি।
ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ মামুন রশিদ ভাই মেলা থেকে ফোন দিলেন।বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখন চিন্তা করছি বই আসলে কয় তারিখ বের হবে। রানা ভাই এবার বললেন শনিবার বিকালে বই মেলায় পৌঁছে যাবে। শনিবার আমরা দুজন মেলায় হাজির হলাম।বিকালের কিছুটা সময় মেলায় অপেক্ষা করে বের হয়ে গেলাম। বই তখনো মেলায় আসেনি। মেলার বাইরে সন্ধ্যায় হাটছিলাম মামুন ভাই,আমি, সবুজ ভাই, সজীব ভাই। হঠাত পারভেজ রানা ভাইয়ের দেখা মিললো।আমাদের দেখে হেসে দিলেন রানা ভাই।
কি আপনাদের বই দেখছেন ?
কই ? দেখলাম না ত ! - আমি বললাম ।
রানা ভাই বললেন, বিকালে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসছি। ঘটনা হল আমরা যখন বের হয়ে আসছি রানা ভাই তখন স্টলে বই রেখে আসছেন।তারপর উনার ব্যাগ হতে আমাদের বইয়ের কপি বের করলেন। এই প্রথম আমাদের বই আমরা দেখতে পেলাম।তারপর জিজ্ঞেস করলাম আমাদের বই কোথায় রেখেছেন ? তিনি প্রেসে আছে বললেন। আমি , মামুন ভাই, আর বন্ধু সবুজ ভাই প্রেসে গেলাম।দেখি আমাদের বই সারি করে সাজানো আছে । আর ব্লগার মহান অতন্দ্র এর বইয়ে প্রচ্ছদ লাগানো হচ্ছে।
আমরা আমাদের বই বুঝে নিলাম। আমরা রানা ভাইকে আমাদের বইয়ের বাইরেও ২০০ কপি বাড়তি প্রচ্ছদ করার কথা বলেছিলাম। প্রচ্ছদ গুণে দেখি ২০০ র জায়গায় ১৩৮ টা! রানা ভাইরে দিলাম কল। রানা ভাই বললেন ২০০ কপি দেয়ার কথা ওদের। বুঝে নিন। এবার প্রেসের লোকেরা বলল আমাদের কিছু প্রচ্ছদ তারা ব্যবহার করে ফেলেছেন।এবং এটা যাতে মালিক বা রানা ভাই কাউকে না বলি! কি আর করা! বইতে ইম্প্রেশান দেয়ার কথা ছিল।কিন্তু শেষতক বইয়ের পাতা সাদা। সত্যি বলতে কি রানা ভাইয়ের কথায় রাজি হবার অন্যতম কারণ ছিল এই ইম্প্রেশান। উনার এখান থেকে বের হওয়া বইয়ের ইম্প্রেশান ভাল লেগেছিল। রানা ভাই বললেন, প্রেসের লোকেরা ইম্প্রেশান দিতে ভুলে গেছেন।এই বাবদে পারভেজ ভাই আমাদের কাছ হতে কিছু টাকা কম নিয়েছিলেন।
প্রেসে থাকতেই বইয়ের বিসমিল্লাহ হয়ে গেল।প্রিয় বন্ধু সবুজ ভাই ১ কপি কিনে নিলেন।আমাদের বই উনার এখানে রাখার ব্যবস্থা করলাম।সবুজ ভাই টাকা দিয়ে বললেন,এই টাকা যত্ন করে রেখে দিতে।আমি মুখে কিছু না বল্লেও মনে মনে ভাবছিলাম এই টাকা প্রথমেই খরচ করতে হবে। প্রেসের লোকদের বললাম কার্টুনে করে বই প্যাক করে দিতে।কিন্তু উনাদের কাছে কার্টুন এবং কসট্যাপ নাই। ৪ টি কার্টুন আর একটি ট্যাপ(প্রতি কার্টুন৫০ টাকা আর কসট্যাপ ৯০ টাকা) কিনলাম।তাদের বকশিশও দিলাম। মামুন ভাই আঙ্কেল কে ও মিঠু ভাইকে কল দিলেন।তারা আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। নিজের বই দেখার পর অনেকের নাকি আনন্দ হয় শুনেছি।প্রায় এসব শুনি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস ও দেখি।আমার কোন অনুভূতি কাজ করল না।আমি জানি না মামুন ভাইয়ের কেমন লেগেছিল সেদিন।জিজ্ঞেস করিনি।আমাদের বই নিয়ে সবুজ ভাইয়ের আবেগ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। জানি এই ভালবাসার প্রতিদান আমার দেয়া সম্ভব হবে না।সবুজ ভাই একটা প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছেন যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত। তিনি আমার দ্বিতীয় বইয়ের ২য় কপি নেবেন। ৩য় বইয়ের
তৃতীয় কপি এভাবে।
আগে বইমেলায় পাঠক হিসেবে গেছি চুপি চুপি বই কিনে চলে এসেছি।বইয়ের সুত্র ধরে এবারের অভিজ্ঞতার ব্যত্যয় ঘটল।১)অটোগ্রাফ দিতে হয়েছে।২)হেটেছি ঘুরেছি আড্ডা দিয়েছি -সবসময় কেউ না কেউ ছিল।একটা সময় মনে মনে হাস ফাস করতে লাগলাম। মেলা প্রাঙ্গন বার বার ঘুরলেও মনে হচ্ছিল কিছুই ঘুরিনি, দেখিনি। আগে চুপি চুপি লং টাইম বই পড়তাম। নেড়েচেড়ে দেখতাম।নিজের মত করে সময় ব্যবহার করতাম। পেছন থেকে কারো কোন ডাক শুনতে হতনা। আমি আমার আগের আমিকে মিস করছিলাম।ঠিক করলাম একদিন নিজের মত করে ঘুরব কাউকে জানাবনা মেলায় আসছি। একদিন এভাবে নিজের মত করে ঘোরার পর মনে তৃপ্তি এল।
এর মধ্যে ১৪ তারিখ কবি আল মাহমুদকে আমরা দুজন দেখতে যাই।প্রায় ঘন্টা দেড়েক কথা হয় উনার সাথে। উনার একটা কথা ভাল লেগেছে।সাহিত্যের সেবা করলে সাহিত্যও তোমার মন কে পরিপূর্ণতা দেবে। পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে কত কথা কত সৃতি।একদিকে বইমেলা একদিকে বোমাবাজি।মেলার বাইরে বোমা ফুটছে,মেলায় লোকেরা ফুর্তি করছে।একদিন বাসে উঠে মিরপুরে আমিন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। রাতে শুনি যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম,আমি বাসে উঠার ১৫ মিনিট পরেই সেখানে পেট্রোল বোমা ফুটেছে।৮ জন দগ্ধ।
হায়রে মনে যে কেমন লাগছিল।আমিও ত দগ্ধ হতে পারতাম।একদিকে মানুষ মরছে,একদিকে শিল্প সাহিত্য চাষ বাস। মানুষের জন্য নাকিই শিল্প। কিছু কথা কি এই প্রাঙ্গন থেকে বলা যেত না? ভাবতে গেলে,বলতে গেলে, কত কথা এসে যায়।সেদিকে নাই বা গেলাম /
মেলায় আদনান শাহরিয়ার ভাইকে দেখে খুশি হয়েছি। একদিন মেলাপ্রাঙ্গনের কাছাকাছি এসে কল দিলেন।আমাদের বই নিয়ে এক সেকেন্ডও দাড়ালেন না,চলে গেলেন।বললেন, কেবল আমাদের বইয়ের জন্যই বইমেলায় এসেছেন।আরণ্যক রাখাল ভাইকে ব্লগে তখন তেমন চিনতাম না,উনার টাকা বিকাশে প্রথম এসেছে।এক দাগে ১৫ কপি নিলেন মোহন ভাই।নারায়ণগঞ্জে ২৬ তারিখ বইয়ের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে সবাই যেভাবে আমাকে শুভকামনা জানাচ্ছিলেন,সত্যিই অভিভূত হয়ে গেছি। আমাদের বইয়ের গল্প পড়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব আমাকে নিজ থেকে খোঁজ করছিলেন।পরে যখন তার সাথে যোগাযোগ করলাম- তিনি বললেন,তুমি দেখি একদম বাচ্চা ছেলে,এখনই বই লিখে ফেলছ? তারপর ক্রিম বিস্কিট আনিয়ে খাওয়ালেন।তারপর বললেন,এইবার বইতে একটা অটোগ্রাফ দাও, অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য বইটা হাতে করে রেখেছি।তখন কি যে বলব বুঝতে পারছিলাম না।যেমন বুঝতে পারিনি মাহমুদুল হাসান ভাইয়ের কান্ড।জীবনে কোনদিন রিভিউ না লেখা লোকটি আমাদের বই পড়ে রিভিউ লিখতে বসে গেলেন।
আমার এক শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের ওয়াইফ বই পড়ে আমাদের পরবর্তী যত বই বের হয় কিনে নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।ভাবছিলাম
বাংলার ঘরে ঘরে এমন ভাবী থাকিলে লেখককূলের কোন চিন্তাই থাকিত না।
এহসান সাবির ভাই থেকে আরেক অভিজ্ঞতা পাওয়া গেল।উনার ৯০ বছর বয়েসি নানা আমাদের বই পড়ে দোয়া করেছেন, আমাদের দেখার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। এমন কি কিছুদিন আগে ঈদের বকশিশ হিসেবে আমাকে আর মুন ভাইকে ১০০ করে ২০০ টাকা পাঠিয়েছেন।গুণী কথাসাহিত্যিক ফজলুল কাশেম,জাকির তালুকদার,নাজিব ওয়াদুদ,আহমদ জসিম বইটি সম্পর্কে তাদের ভাল লাগা ব্যক্ত করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। কড়া সমালোচক বাদল ভাই কিছু জায়গায় এমন প্রশংসা করেছেন যে লজ্জাই পেয়ে গেলাম।এসব কিছু আমাদের লেখালিখির জন্য প্রেরণা সন্দেহ নেই।এত মানুষের শুভাশিস কপালে জুটবে সত্যি ভাবিনি।
বইকে কেন্দ্র করে কত আনন্দ, কত খুনসুটি হল। অনিক,এন্টি আমিন ভাই, মামুন ভাই, মহাভাই, মোহন ভাই, তুষার ভাই পার্থ ভাই অভি ভাই সজীব ভাই দুর্জয় ভাই সবার সাথে দেখা আডডা হয়েছে। এসবই ত জীবনের বড় ক্ষীর। মেলায় হামা ভাই,প্লিওসিন ও গ্লসিয়ার ভাই,শেখ রানা ভাইদের প্রথম দেখলাম।কেউ কেউ - যারা বই কিনবে বলে আশা করেছিলাম,তারা আমাদের বই নেননি, তেমনি কাউকে কাউকে - যারা বই নিবে বলে মনে হয়নি তারা আমাদের বই নিয়েছেন।লেখক মোজাফফর হোসেনের একটি ঘটনা ভাল লেগেছে।মামুন ভাই আমাদের বইটা উনাকে গিফট দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু উনি আমাদের বইটা কিনে নিলেন।বললেন,আমি বই কিনে নেই।শুধু কিনে নেয়াই নয়,পরে তিনি আমাদের তার পাঠ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।
একটা দুঃখ আছে। আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড আশা করেছিলাম সে আমার বই প্রকাশের কথা শুনলে খুশি হবে।সে খুব বই পড়ুয়া।রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমায়।কিসের কি এটা নিয়ে সে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না আজতক। কি লিখলাম সেটা চোখ বুলানোর মত আগ্রহও দেখালনা।অথচ ভেবেছি কত খুশি হবে সে।কিন্তু বই কত কপি সেল হল সেটা ঠিকই জিজ্ঞেস করতে পারছে।
যার কথা না বললে এই পোস্ট পূর্ণতা পাবে না, তিনি হলেন প্রবাসী ভাই।সোনাবিজ ভাইয়ের বই কেন্দ্রিকএকটা পোস্ট আছে। ওখানে একটা লাইন আছে, আপনারা নতুন লেখকের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারেন।ওটা পড়ে মনে মনে হাসছিলাম।এরকম কেউ আজকাল আছে নাকি! তখন কি জানতাম এরকম কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।আমাদের বাইরে প্রথম যে ব্যক্তির কাছে বই প্রকাশের কথা বলেছি তিনি হলেন প্রবাসী ভাই।তিনি বললেন,আমাদের বই ৫০ কপি নিয়ে নেবেন।কথাটা শোনার পর কি বলব,হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম।বলে কি লোকটা। আমার মুখে কথা যোগাচ্ছিল না।পরে বললাম, এত বই নিয়ে আপনি কি করবেন?প্রবাসী ভাই বললেন,
আপনাদের যে সব বই গিফট আর লাইব্রেরীতে দিতে হবে, এখান থেকে দিয়েন।
যদি বলি প্রবাসী ভাইয়ের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ,মিথ্যে বলা হবে। তিনি কৃতজ্ঞ হবার কোন সুযোগ রাখেননি। বিষয়টি নিয়ে আমরা যাতে কখনো মাথা না ঘামাই/ না ভাবি তিনি সবসময় তেমন আচরণ করেছেন।আমাদের বই নিয়ে তিনি যে অপরিমেয় উচ্ছ্বাস ও উল্লাস দেখিয়েছেন, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বইটা আমাদের নয়,উনার।প্রচ্ছদ আসা মাত্রই তিনি ফেসবুকে এটাকে প্রফাইল পিকচার করে ফেলেছেন।ব্লগে পোস্ট দিয়েছেন।আমাকে বার বার বলেছেন,আপনি এখনো চিটাগাং বসে আছেন কেন? ঢাকায় তাড়াতাড়ি যান।ফেব্রুয়ারী মাসে বার বার বই কয় কপি সেল হলো জিজ্ঞেস করছেন।এটা ওটা করতে বলছেন।একসময় বললেন, যদি না বিক্রি হয় আমি আরো বই কিনব। মন ভিজে গেল।বললাম,ইনশাল্লাহ বই বিক্রি হবে। আপনার চিন্তা করতে হবে না। প্রবাসী ভাইয়ের টাকা আমরা বই বের করার আগে পেয়ে গেছি।তিনিই একমাত্র লোক যিনি আমাদের বইটির এক কপিও এখনো চোখে দেখেন নি।
পারভেজ রানা ভাই যখন আমাদের বই বিক্রির বাস্তবতা বোঝাচ্ছিলেন,তখন একপর্যায়ে হাল্কা একটু ভয় ও পেয়েছিলাম।মনে হচ্ছিল,৫০০ কপি বের করে রিস্ক নিচ্ছি না ত? বা বই যদি বিক্রি না হয়? মামুন ভাই বলল, আর যাই হোক আমাদের বই ৫০ কপি ত সেল হইছে! কি হয় পরে দেখা যাবে ইনশাআল্লাহ্।পরম করুণাময়ের রহমতে আর আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের চিন্তাগ্রস্থ হতে হয়নি। আমাদের হাতে থাকা ৪০০ কপির মধ্যে ৩৬০ কপির মত বই এই এক বছরে চলে গেছে।রানা ভাইয়ের হাতে যে ১০০ কপি বই ছিল, তার মধ্যে গতবছর বেশ কিছু বই সেল হয়েছে,যার আনুমানিক একটা হিসেব আমাদের কাছে আছে।রানা ভাইকে জিজ্ঞেস করা হয় নাই ওখান থেকে কয় কপি গেছে।
প্রবাসী ভাই আমাদের প্রতি যে অসামান্য ভালবাসা দেখিয়েছেন, দেখিয়ে যাচ্ছেন তার কণা তুল্য প্রতিদান আমরা কেউ দিতে পারব না, দিতে চাইও না।কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতে ভাল লাগে। যদিও একারণে প্রবাসী ভাইয়ের সমস্যা হবে,ভবিষ্যতে আরও দিরহাম খরচ করতে হবে।হাহাহা।প্রবাসী ভাই কেমন মাপের মানুষ তা তিনি নিজেও জানেন না।
প্রবাসী ভাইয়ের জন্য খেলা করা বুকের অনেক গোপন অনুভূতি শব্দের অক্ষরে প্রকাশ করা গেলনা। কেন যে মনের খাঁটি অনুভূতিগুলো যথার্থ শব্দে প্রকাশ করতে পারিনা। তবে কোন খেদ নেই। প্রবাসী ভাই আমাদের কৃতজ্ঞতা, খেদ, আক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়গুলো বহন করার কোন স্কোপ দেন না। আমাদের কখনো মনে হয়নি,প্রবাসী ভাইকে খুশি করার জন্য এই কাজটা করা উচিত।বড়ভাই,বন্ধুর মত হয়ে তিনি যেভাবে আমাদের নানা বিষয়ে পরামর্শ/ ছায়া দেন তার কোন তুলনা হয় না। বিদেশ - বিভূঁইয়ে পরে থাকা লোকটাকে দেখার জন্য মন কেমন যেন করে। ফোনে যখন তার কণ্ঠ শুনি তখন আনন্দে বুকের জল কলকল করে।
ধন্যবাদ জানাই প্রকাশক পারভেজ রানা ভাইকে। তিনি সজ্জন লোক। আমাদের বইটা দেখানোর সময় পারভেজ রানা ভাইয়ের মুখে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি,তা ভুলব না।গতবার ছিনতাই হওয়া এবং আরো কিছু নানাবিধ কারণে আমাদের সহ আরও কিছু বই প্রকাশ করতে তাকে বেশ কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আমাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি তার নিজের উপন্যাস ছাপাতে পারেননি।যা প্রতিনায়ক নামে এইবার প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি অন্যদের মত ঠিক কড়ায় গন্ডায় প্রফেশনাল নন, লেখালিখি নিয়ে কথা বলার সময়
তার চোখেও স্বপ্ন ভাসতে দেখেছি।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সামু প্ল্যাটফর্ম ও এর সকল ব্লগারদের।আরো অনেক ব্লগ আছে, কিন্তু সামু সামুই।এখানে ইমন জুবায়েরের মত সন্ত লিখে গেছেন।তাকে মনে করেই ত ব্লগে এসেছি।সবসময় মনে মনে বলি -কোথাও,কোথাও না কোথাও যেন তার মত হই।হতে পারি। আমি সামুর একজন নগণ্য ব্লগার,এটা নিয়ে মনে অল্প করে হলেও অহংকার আছে।
আজ,হয়তো আগামীতেও আমার যেটুকু প্রাপ্তি,তার সবই সামু নামক এই হলদে নীলা মায়াজালের দান। এখানে যদি না আসতাম, এত এত এত ভালমানুষগুলার সাথে দেখা কোথায় পেতাম? কোথায় মিলত এত ভালবাসা? আজো প্রথমদিককার কথা ভেবে শিহরিত হই।প্রথম পোষ্টেই এত মানুষের মন্তব্য, যাদের কাউকেই আমি চিনিনা - জানিনা, ভালমন্দ বলে তারাই আমার মত একজন অলস মানুষকে দিয়ে সাপ ব্যাঙ যাই লিখি, লিখিয়েছেন।পাশে থেকেছেন,প্রেরণা দিয়েছেন। আপনাদের আমি নমি।
আজ পেছন ফিরে মনে হয় এটা একটা সুন্দর গল্প।আপনাদের কারণেই এ গল্প বলা সম্ভব হল।