লেখকের নাম- আহমদ জসিম
প্রকাশনী- তেপান্তর
প্রচ্ছদ- অঞ্জন সরকার জিমি
বইটি নিয়ে বলার আগে দুচারটি বাড়তি কথা বলতে চাই। হালফিল সময়ের বেশ কিছু গল্প পড়ার সুযোগ হয়েছে। সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য জানি না, বেশিরভাগ গল্প তত্ত্ব, তথ্য, দুর্বহ দর্শনের ভারে ভারাক্রান্ত। নানা তত্ত্বকথায় ফুলানো, ফাপানো। দর্শন, তথ্য বা তত্ত্ব থাকা দোষের তা বলছি না। তবে গল্পের সাথে তার সুষম মিশ্রণ থাকা চাই। নচেৎ ভার ভার বা শ্লোগান ঠেকে। ‘যেভাবে তৈরি হল একটি মিথ’ এ এসব ব্যাধির লক্ষণ না পেয়ে স্বস্তি পেয়েছি। সাহিত্যে ইদানিং ‘সরসতা’ নামক বস্তুটির দেখা পাওয়া দুর্লভ হয়ে গেছে। আহমদ জসিমে তা দেখতে পেয়ে ভাল লেগেছে। গল্পে লেখকের আলাদা কোন স্বর বা উপস্থিতি নেই। লেখক এখানে কেবল প্রত্যক্ষদর্শী, বর্ণনার সাথে লেখক ঘনিষ্ঠভাবে লেপ্টে আছেন।
গল্পগ্রন্থে মোট ৭ টি গল্প রয়েছে। প্রথম গল্প নরবানিজ্য। বস্তির লোকের ধনীদের কাছে শিশুসন্তান বিক্রির কাহিনী। লেখকের করণকৌশলে ঘটনাটি নাটকীয় হয়ে পড়ে। ধনী নিঃসন্তান দম্পতি জামশেদ সাহেবের সন্তান চাই। সন্তান যোগাড় করে দেয়ার ভার পড়ে তার ফাইফরমাশ খাটা লোক ধুরন্ধর শুক্কুর মিয়ার উপর। মোটা টাকার গন্ধে শুক্কুর এই কাজ লুফে নেয়। শুক্কুর ভেবে রেখেছিল, একই বস্তিতে থাকা রেখার শিশুসন্তানকে বেছে নেবে। রেখার শিশুটি জন্মের আগেই এক ধনী লোকের কাছে বিক্রি করবে বলে বন্দোবস্ত হয়েছিল। তবে শেষতক লোকটি সন্তান কিনে না নেয়ায় রেখা বিপাকে পড়ে। অর্থের সন্ধানে কোলের শিশুকে নিয়ে সে মাজারে গিয়ে লোকের কাছে হাত পাতে। এবং ভালোই আয় রোজগার হতে শুরু করে। তাই শুক্কুরের প্রস্তাবে এবং প্রতিবেশী রফিকের বউয়ের বুদ্ধিতে সে রাজি হয় না। শুক্কুর নানা ছলাকলা করে তাকে রাজি করাবার তালে থাকে। একসময় শুক্কুর ভাবে সে তার নিজের সন্তানকেই বা বিক্রি করছেনা কেন?জোয়ান বয়েস তার, এমন আরো কয়েক ডজন সন্তান সে জন্ম দিতে পারবে। কিন্তু শুক্কুর উদ্যোগী হবার আগেই রেখা শুক্কুরের সাহেবের কাছে তার সন্তান বিক্রি করে আসে!
দ্বিতীয় গল্প ‘দেখে নেয়ার দিন’ বেশ বিনোদনধর্মী। গল্পের চরিত্র মাহতাব তার এলাকার কাছাকাছি ছিনতাই এর শিকার হয়। এলাকার কাছাকাছি ছিনতাই এর শিকার হওয়ায় মাহতাবের গর্বে টান লাগে। মাহতাব সিদ্ধান্ত নেয় এ ঘটনার কড়া শোধ নেবে। সে কারাতে শেখা শুরু করে। একটা চাকু সঙ্গে রাখে। যে জায়গায় সে হেনস্তা হয়েছিল, মাহতাব তার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু কোথায় ছিনতাইকারী! অবশেষে .. পাঠকের মজাটা নষ্ট না করার জন্য দাড়ি টেনে দিচ্ছি। এ গল্পটি অবলম্বনে কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম ‘প্রতিশোধ পর্ব’ নামে একটি টিভি নাটক নির্মাণ করেছেন।
তৃতীয় গল্প ‘রহিম বাদশার টি স্টল’ পোক্ত, চমৎকার অনুধাবনমূলক, জীবনরসে দ্রবীভূত গল্প। পাশাপাশি বিপরীতে রহিম ও বাদশার চা নাস্তার দোকান। রহিম মিয়ার দোকানে ডিশ লাইন যুক্ত টিভি থাকায় লোকের অভাব হয় না। অপরদিকে বাদশার দোকানে তেমন লোক হয় না বললেই চলে। আয় বেশি হবার বিষয়টিকে রহিম মিয়া খোদার রহমত হিসেবে দেখে। রহিম মিয়া নিজে ধর্ম – কর্ম করে এবং বউ – মেয়েকেও ধর্ম পালন করতে জোর খাটায়। একদিন বাদশাহ মারা যায়। দোকান চালানোর দায়িত্ব নেয় বাদশার স্ত্রী -কন্যা। এবার পাশার দান উল্টে যায়। বাক্সের নারীর চেয়ে জীবন্ত নারীর আকর্ষণ বেশি – এ কথাটির প্রমাণ স্বরূপ যেন লোকে বাদশার দোকানে ভিড় জমাতে শুরু করে। এবার অস্তিত্বের প্রয়োজনে রহিম মিয়া তার বউ মেয়েকেও চায়ের দোকানে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। পুঁজিই ঈশ্বর-ব্যাপারটি গল্পের শুরুতে চোরাস্রোতে থাকলেও গল্পের শেষে এসে সম্মুখে সগৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। চরিত্রের ব্যাপ্তির দিক দিয়ে এ গল্পটিকে গল্পগ্রন্থের সেরা গল্প বলব। রহিম মিয়ার চরিত্র শুধু সাদা কালোয় বিভক্ত নয়, তার মাঝে গ্রে শেডেরও চলাচল আছে। গল্পবর্ণনায় লেখক সেদিকে ইঙ্গিত দিতে পেরেছেন। পরিবেশের সাপেক্ষে রহিম মিয়ার মনস্তত্ত্ব পাঠক মনোযোগের দাবী রাখে।
‘আদম ও আদিম’ গল্পটি পড়তে গিয়ে অনেকের হয়ত কিশোরবেলার কথা মনে পড়বে। কিশোরকালে উত্তেজক চটি বই সংগ্রহ ও পড়ার বিষয়টি নিয়ে গল্প শুরু হয়েছে। দারুণ চমকানো শেষ। হাতেনাতে একজনকে চটি বই সহ ধরার পর ধর্মশিক্ষক নিজেই ছেলেটির কাছে আরো চটি বই আছে কিনা জানতে চান এবং পরে আরো এনে দেবার অনুরোধ করেন। শিক্ষকের এই রূপে ছাত্র হতবাক হয়ে যায়।
রূপালি আর দিলুয়ারা এ দুজনকে কেন্দ্র করে ‘সোনার কাঠি অথবা রূপালি মেয়ে’র গল্পকাহিনী আবর্তিত। ১৭ বছরের কিশোরী রুপালি ৩৮ বছরের দিলুয়ারার সাথে লেসবিয়ান সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরিবার, সমাজকে থোরাই কেয়ার করে তাদের প্রেম চলতে থাকে। একদিন রিক্সায় চড়ে দুজনে বেড়াতে যাওয়ার সময় দিলুয়ারা রিক্সাওলায়ার কাছে একটি সোনার কাঠি দেখতে পায়। সোনার কাঠিটি রিক্সাওয়ালা রিক্সায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। দিলুয়ারা সোনার কাঠি কিনতে আগ্রহ দেখায়। রিক্সা ঘোরাতে বলে। রুপালি বুঝে যায় দিলুয়ারা দামী কিছু খুঁজে পেয়েছে। সেও সোনার কাঠির মূল্যের অর্ধেক তার – বলে জানিয়ে দেয়। রিক্সাওলাকে সোনার কাঠির দাম দেয়ার সময় দিলুয়ারা কাঠিটি হারিয়ে যাবার অভিনয় করে। কিন্তু রূপালি বিশ্বাস না করায় দুজনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। রূপালির ধারণা কাঠিটি কমপক্ষে ১০ ভরি হবে। রাতে দিলুয়ারা বস্তি হতে পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ভোরে জুয়েলারির দোকানে গিয়ে দিলুয়ারার সপ্নভঙ্গ ঘটে। এখন কোথায় ঠাঁই নেবে দিলুয়ারা?
‘জাদুঘর’ গল্পে ডঃ ইউনুসের নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদে স্থানীয় এলাকাবাসী শুক্রবারে মিছিল ও দোয়া মাহফিল করার ঘোষণা দেয়। শুক্রবারে মিছিল শেষ হয়ে দোয়া মাহফিলের মুনাজাতের সময় খবর আসে এলাকার ফইরার বাপ ঋণের কিস্তি দিতে না পারার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে।
‘যেভাবে তৈরি হল একটি মিথ’ যার নামে গল্পগ্রন্থের নামকরণ, সবার শেষে আছে এই গল্পটি। বস্তির তিনটি ঘরের জন্য একটি অন্ধকার টয়লেট। এই টয়লেটে রাতের অন্ধকারে চলে রাবেয়া মন্টুর প্রণয়লীলা। এ স্থান বেছে নেয়ার কারণ একটাই – সাধারণত রাতে এখানে কেউ আসে না। সবাই কলগোড়ায় প্রয়োজন সারে। কিন্তু একরাতে প্রেম চলার সময় হঠাৎ রাবেয়ার মা এসে উপস্থিত হয়। রাবেয়া টয়লেট হতে দ্রুত বেরিয়ে যায়। ভয়ে অন্ধকারে টয়লেটের দেয়ালের গায়ে সিটিয়ে থাকে মন্টু। রাবেয়ার মা মন্টূর ছায়া দেখে মূর্ছা যায়। মৌলভি ঘোষণা দেয় জীন আছে। দু’চারজন যাও টয়লেটে যেত তারাও এবার ভয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। মন্টু – রাবেয়ার তাতে পোয়াবারো। একসময় গর্ভবতী রাবেয়া বিয়ের চাপ দেয়। গ্যাড়াকলে পড়া মন্টু মৌলভির স্মরণ নেয় এবং মৌলভি তাকে উদ্ধার করে। আসলেই কি? না, মন্টু নিজেই নিজেকে মিথের মাধ্যমে উদ্ধার করে। মৌলভি তার করণিক উপায় মাত্র।
অসংযমী পষ্টাপষ্টি বক্তব্যের জন্য কোথাও কোথাও গল্পের শিল্পমান ব্যাহত হয়েছে। যেমন-‘জাদুঘর’ গল্পে হাইস্যা পাগল্পের বলা ” ইউনুচ বদ্দার দরিদ্রমুক্ত স্বপ্নের জাদুগরর প্রথম যাত্রী জোবরা গ্রামর আরার ফইরার বাপ, আল্লাহু আকবর।” গল্পের শরীর জুড়ে হাইস্যা পাগলের এরকম অতিরিক্ত দু’একটি মন্তব্যে হাইস্যাকে জাতে মাতাল তালে ঠিক টাইপের পাগল মনে হয়। অন্য গল্পগুলোর মত স্রেফ ঘটন বর্ণনার মধ্য দিয়েও লেখক তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারতেন, অভিঘাত ও তীব্র হত। এছাড়াও রহিম বাদশার টি স্টলে রহিমের তার বউকে বলা – ‘তুমি পড়বা পাতলা শাড়িখান যাতে শাড়ির ফাঁক দিয়া পেটের ভাঁজ দেখা যায়’ কথাটি বেহুদা, দৃষ্টিকটু, খাপছাড়া মনে হয়েছে। না থাকলেও চলে।
সমাজের কুসংস্কার, মনোবিকৃতি, মনোবিকলন, দ্বৈত ব্যক্তিস্বত্বা, সুবিধাবাদী চরিত্র, বৈচিত্র্যময় আবেগীয় আচরণ প্রভৃতি অনুষঙ্গে ভরপুর আহমদ জসিমের গল্পজগত। চলিত শব্দ প্রয়োগে, বর্ণনায়, কথোপকথনে, চলতি প্রবাদ বাক্য ব্যবহারে মানুষের অভিব্যক্তি আচরণের স্বতঃস্ফূর্ততা বড় জীবন্ত, প্রাণময় হয়ে ফুটে উঠেছে। গল্পের চরিত্রগুলোর নাড়াচাড়া তাই যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। এটাই গল্পকারের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এবং তার চাদরে খুঁটিনাটি দুর্বলতা চাপা পড়ে যায়। খুব কম লেখকের এমন জীবন্ত প্রকাশক্ষমতা থাকে। আহমদ জসিমের লেখা দ্রুতগতির। বর্ণনা, চরিত্রের ভাবনা ও কথোপকথনের এক অনুপম মিশ্রণে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল দাড় করিয়েছেন। অনভ্যস্ততার দরুণ- গল্পশরীরে প্রচলিত গল্পবয়ানের কিছু পরিচিত কৌশলের অনুপস্থিতি, দ্রুত ও কোথাও কোথাও চটপটে ভাবের জন্য এই শৈলী কাউকে কাউকে সন্তুষ্ট করতে না পারলেও সন্দেহ নেই, এই স্টাইলটি খুব কমিউনিকেটিভ এবং তা আহমদ জসিমের নিজস্ব চিহ্ন ও স্বর বহন করে। এটি আহমদ জসিমের তার মত করে সিদ্ধি লাভের যথাযথ কৌশল, ইতিমধ্যে তিনি তার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা স্মরণে রাখলে মনে হয় ভাল হবে। শহুরে বস্তির নিম্মশ্রেণির মানুষজন তার লেখার প্রধান উপজীব্য। জীবনঅস্তিত্বের সঙ্কটে, হাতছানিতে এই শ্রেণির মানুষের জীবনধারা নিজগুণে বৈশিষ্ট্যময় ও যথেষ্ট নাটকীয়। এ জীবনের বিশ্বস্ত অনুসরণে তাই লেখা বিস্তারে না গিয়ে দ্রুত চলাচল করে, নাটকীয় বাঁক পায়। বিষয়বস্তুর সাথে লেখকের নিজস্ব রচনাশৈলী তাই খাপে খাপে মণিকাঞ্চন হয়ে গেছে। আজকালকার অনেক লেখকের লেখার সাথে জীবনের যোগ নেই। জীবন থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে,দূর থেকে দেখে, তার সাথে নিজের ভাসা ভাসা ধারণা যোগ করে বানানো গল্পগুলো তাই পাঠক স্নায়ুতে আলোড়ন তুলতে পারে না। গল্প লিখতে আহমদ জসিমকে আরোপিত কিছু করতে হয়নি, বিদেশ বিভূঁইয়ের গল্পমশলায় হানা দিতে হয়নি। আমাদের চারপাশের বয়ে চলা প্রবহমান জীবনধারার কড়ি আনা পাই তিনি তার গল্পে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেছেন। বর্ণিত জীবনের সাথে লেখক একা হতে পেরেছেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। আহমদ ছফা বলেছিলেন,’জনগণের মধ্যে যে জীবনপ্রবাহ তার মধ্য থেকে প্রাণ আর রস আহরণ করতে না পারলে সাহিত্যে সজীবতা আসবে না।’গল্পপাঠে গল্পকারের প্রাণ-রস আহরণ প্রয়াসের চিহ্ন মিলেছে। তার গল্প খাঁটি দেশি গল্প।
পাঠকের প্রসাদ পাওয়ার মত যোগ্যতা গল্পগুলোর আছে। বহুল প্রচারে বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে বিশ্বাস করি।