আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার নাভিমূল দেখাতে গিয়ে আমরা প্রায়ই গর্বভরে ফিরে যাই অষ্টম শতাব্দীতে , গোপাল পাল এর কাছে । শশাঙ্কর পরবর্তী ১০০ বছর- যা বাংলার ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত, তার অবসান হয় পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পালের বাংলা অধিকারের মধ্য দিয়ে ।ঐতিহাসিক গণের সুত্র ধরে বিভিন্ন আলোচনায় আমরা গোপাল পালকে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত রাজা বলে থাকি। এই কথার ঐতিহাসিক সুত্র বা ভিত্তি কি ? কেবলমাত্র ১৬০৮ ক্রিস্টাব্দে তিব্বতি ভাষায় লিখিত লামা তারনাথের লিখিত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এবং খালিমপুর লিপির শ্লোক এ গোপালের সিংহাসনে আরোহণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
তারকানাথের কাহিনীর সারমর্ম হল , দেশের বহুদিন যাবত অরাজকতার ফলে বাংলার জনগণের দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না । নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে আইনানুগ শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে একজন রাজা নির্বাচন করেন । কিন্তু নির্বাচিত রাজা প্রতি রাত্রিতে এক কুৎসিত নাগ রাক্ষসী কর্তৃক নিহত হয় । এভাবে প্রতি রাত্রিতে একজন নির্বাচিত রাজা নিহত হতে থাকেন । এভাবে বেশ কয়েক বছর পার হয়ে যায় । অবশেষে একদিন চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়ি তে আসে । ওই বাড়ির সবাই খুব বিষণ্ণ । কারণ ঐদিন নির্বান নির্বাচিত রাজা হবার ভার পড়েছে ওই বাড়িরেই এক ছেলের উপর । আগন্তুক ওই ছেলের জায়গায় নিজে রাজা হতে রাজি হয় এবং সকাল বেলা তিনি রাজা নির্বাচিত হন । সেই রাতে নাগ রাক্ষসী এলে তিনি চুন্ডাদেবীর মহিমা যুক্ত এক লাঠি দিয়ে রাক্ষসীকে আঘাত করলে রাক্ষসী মারা যায় । পর দিন তাকে জীবিত দেখে সবাই অবাক হয় । পর পর সাতদিন তিনি এভাবে রাজা নির্বাচিত হন । ফলে তার এই অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাকে স্থায়ী রাজা রুপে নির্বাচিত করে । এবং তাকে গোপাল নাম দেয়া হয় ।
অপরদিকে পাল বাজা ধর্মপালের রাজত্বকালের খালিমপুর লিপির তাম্রশাসনে আছে ,
মাৎসন্যায়ম পোহিতং
প্রকৃতি র্ভিলক্ষ ন্যাঃ করংগ্রাহিত :
শি গোপাল ইতি ক্ষিতিশ
শিরোসাং চূড়ামনিস্তৎ সূত:
(মালদহে প্রাপ্ত ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন (রাজ্যাঙ্ক ৩২,গৌড় লেখমালা,পৃষ্ঠা -৯। ) ‘
অনুবাদঃ
বপ্যট পুত্র রাজা ক্ষিতিশ গোপাল
কুলচূড়ামনি তিনি ইতি নরপাল
মাৎস ন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে
প্রকৃতি পুঞ্জ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে
অরাজকতার রাজ্য করিলেন দূর
বরেন্দ্রী-মণ্ডলে রাজা হলেন মধুর ।
(অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর অনুবাদ অবলম্বনে। )
তারকানাথ এর কাহিনীকে একপ্রকার ঠাকুরমার ঝুলির গল্প বলা যায়। এই কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মোটেও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যায় না যদি না অন্য কোন নির্ভরযোগ্য উৎস হতে এর সমর্থন না পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ খালিমপুর লিপির শ্লোকের উপর নির্ভর করেছেন । শ্লোকের ‘প্রকৃতি’ শব্দ বিশেষ অর্থে ‘জনগণ’ বা ‘প্রধান কর্মচারী ‘বুঝায় । কিন্তু তৎকালীন অরাজকতা ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে জনগণের একমত হওয়া ও নির্বাচন করার কথা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। এর আগে বা এর অনেক পরেও যেখানে বাংলায় কোন গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ আমরা দেখতে পাই না সেখানে নির্বাচন এর কথা ভাবা টা বাতুলতা। যদি ‘প্রকৃতি’ শব্দের অর্থ ‘প্রধান কর্মচারী’ ধরি তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় । কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে তারা কিভাবে নির্বাচন বা নির্বাচিত করবেন ?
‘ প্রকৃতি’ শব্দের প্রকৃত অর্থ নিয়ে মতভেদ এবং নির্বাচন প্রতিকূল রাজনৈতিক , সামাজিক পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই জনগণ কর্তৃক গোপাল নির্বাচিত হয়েছেন বলে মত প্রকাশ করেছেন । এমনকি বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার নির্বাচনের ব্যাপারটিতে সন্দেহ পোষণ করেও গোপাল জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত রায় দিয়েছেন ।
শুধু তাই নয় তিনি আর ও অগ্রসর হয়ে বলেছেন , ” এই চরম দুঃখ – দুর্দশা হইতে মুক্তি পাবার জন্য বাঙ্গালী জাতি যে চরম বিজ্ঞতা দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিল ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকিবে। এই রুপে কেবলমাত্র দেশের মঙ্গলের দিকে চাহিয়া ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন পূর্বক সর্বসাধারণে মিলিয়া কোন বৃহৎ কারযঅনুষ্ঠান যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না ।১৮৬৭ অব্দে জাপানে যে গুরতর রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়াছিল তাহার সহিত সহস্রাধিক পূর্বে গোপালের রাজপদে নির্বাচনের তুলনা করা যাইতে পারে । ” অথচ তিনি নিজেই বলেন –
” কেহ কেহ মনে করেন যে , ‘ প্রকৃতি ‘ শব্দের অর্থ কয়েকজন প্রধান প্রধান রাজ্যের সচিব বা কর্মচারী এবং তারাই গোপালকে রাজপদে নির্বাচিত করিয়াছেন । রাজতরঙ্গিনীতে এই অর্থে প্রকৃতি শব্দ ব্যবহার হয়েছে এবং বলা হইয়াছে জলোঊক নামক এক ব্যক্তি সাতজন কর্মচারী দ্বারা রাজপদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। যেখানে রাজ্যে দৃঢ় শাসনপ্রণালী বর্তমান সেখানেই এই প্রকার ব্যবস্থা হইতে পারে । কিন্তু বাংলাদেশের পূর্বোক্ত অরাজক অবস্থায় কোন কেন্দ্রীয় শাসন কল্পনা করা যায় না এবং কোন একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের সচিব বা প্রধান কর্মচারীগণ সমগ্র দেশের জন্য রাজা নির্বাচন করিবেন এবং সমস্ত দেশের লোক তা মানিয়া লইবে ইহা সম্ভবভর বলিয়া মনে হয় না।” ( বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড , পৃষ্ঠা ৪৪) এছাড়াও নির্বাচন ঘটে থাকলে পাল শাসনামলে প্রাপ্ত প্রশস্তি সমূহে নির্বাচনের মত একটি অভূতপূর্ব গৌরবময় বিষয়ের উল্লেখ অবশ্যই থাকত । এই ঘটনার কোন উল্লেখের অনুপস্থিতি ঘটনা না ঘটার ইঙ্গিতকে জোরালো করে।
তাহলে গোপাল কিভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ? খালিমপুর শ্লোকের প্রকৃত অর্থ ই বা কি হতে পারে ?
খালিমপুর শ্লোকের ‘ প্রকৃত ‘ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব না । এর রূপক বা অনাক্ষরিক অর্থ থাকতে পারে , যা আমাদের অজানা । । তবে তৎকালীন আর্থ – সামাজিক , রাজনৈতিক পরিবেশ কে সামনে রেখে এর একটা বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় । প্রকৃতি শব্দের অর্থ তার অনুসারী নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি বা কর্মচারী হিসেবে ধরলে গোপাল তাদের সাহায্যে ক্ষমতা দখল ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটানো স্বাভাবিক মনে হয় । এছাড়াও পাল বংশধররা ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত ছিলেন । খালিমপুর -তাম্রলিপিতে ও গোপালের বাবা ব্যপট কে শত্রু ধবংসকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । সুতরাং গোপাল নিজেও একজন সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এমন ধারণা করাই যায় এবং অরাজকতাময় অবস্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অপরিহার্য। তিনি শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তার যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছেন , তখনকার পরিস্থিতিতে এমন ভাবাই যুক্তিসঙ্গত ।এ ধারনার পেছনে পাল রাজাগণের বিভিন্ন তাম্রশাসনে প্রাপ্ত একটি শ্লোকের কথাও সমর্থন যোগায় ।এ শ্লোকে বলা আছে ” যে সব লোক তাদের নিজ নিজ ইচ্ছেমত কাজ করেছিল গোপাল তাদের শক্তি খর্ব করে শাশ্বত শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।” এই শ্লোকে গোপাল কর্তৃক বিপক্ষ শক্তিকে পরাজিত করার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।
গোপাল পাল জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত এমন কোন স্পষ্ট নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না থাকা ,তৎকালীন সামাজিক – রাজনৈতিক পরিবেশে এর স্বপক্ষে কোন উপাদান না থাকা সত্ত্বেও , যে সব ঐতিহাসিক এমন ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন -তারা নিঃসন্দেহে আবেগপ্রবণ হয়ে ইতিহাসের স্বাভাবিক চর্চাকে রুদ্ধ করেছেন । মনে রাখা উচিত ইতিহাস আবেগের খেরোখাতা নয় এবং নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তির নিরিখেই ইতিহাস চর্চা করা উচিত।নির্বাচনের মাধ্যমে গোপাল পাল ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন ,এরুপ মনে করার পিছনে কোন শক্ত প্রমাণ বা যুক্তি নেই। বরং উৎসসমূহের ইঙ্গিতকে তৎকালীন অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দাড় করানো যায় ।
সেটাই ন্যায় , যুক্তিসঙ্গত্ ,প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ।