উৎসর্গ - (ছোটবেলার বন্ধুদের, যারা হারিয়ে গেছে।এবং ব্লগিং করতে এসে একজন পজিটিভ হাসিমাখা মুখের মানুষটি - মাইনুদ্দিন মইনুল ভাই।)
সময়ের দূরত্বে সাধারণ কথাই রুপকথা হয়ে যায় - শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।
দুনিয়াটাই দেখার। সবকিছু দেখার পরে লেখার কাজটা সোজা না কঠিন, না ভেবে দরকার শুধু লিখে যাওয়া। - ফজলুল কাশেম
সেই সময়ে পাড়ায় পাড়ায় হিরো।মানে মাস্তান।পকেটে নিজস্বী পিস্তল।ভাড়াও পাওয়া যেত। বাংলা ও হিন্দি মুভিতেও একশান,মার্শাল আর্ট। নায়কদের কি জাঁদরেল বাহাদুরি ভাব, জিদ্দি চেহারা ও কি মাসল! বড় ভাইদের ও।এসব দেখে শুনে আমাদের মনে হচ্ছিল বীরভোগ্যা বসুন্ধরা এবং একদিন আমিও!
তাই কিনা বন্ধু গতম বলেছিল,চল! পিস্তল ভাড়া নিয়ে ডাকাতি করি। স্বর্ণের দোকান।অনেক অনেক টাকা পাবো!
রোমাঞ্চের সাথে ভয়ও পেলাম।
কিভাবে ?
সবার আগে ওষুধ খেয়ে চোখ লাল করতে হবে।খাওয়ার ৩০ মিনিট পরে শরীরের সব রক্ত চোখে চলে আসবে।তারপর দোকানে গিয়ে পিস্তল বের করা মাত্রই খেল হুয়া !হাতের তর্জনী পিস্তলের নলের মত সোজা করে গতম আওয়াজ দিল - টিসাও টিসাও!
ওর চোখ দেখে কেন জানি ভয় ধরেছিল।
ভাল হবে না দোস্ত ! এসব বাদ দে।
গতম উত্তেজিত।গলার রগ কেপে উঠলো।
নেহি !অনেক টাকা দরকার।অপমানিত বাবা। বাড়ীওলা শাসিয়ে গেছে।ভাল লাগে না আমার। তুই হলে কি করতিস?
আমি !
ভালো খাই, ভালো পরি, ভালো থাকি। জেল - পুলিশের কথা ভাবতেই টাটকা রোমাঞ্চ উবে গেল। গতমে নাস্তি - এক ঝটকায় তাই পিছটান। কিন্তু প্রাকৃতিক স্বাধীনতার ফর্দাফাই ঘটিয়ে কল্পবিলাসী প্রবৃত্তি হিরো হবে। ক্যাপ্টেন কমান্ডো,আলিফ লায়লা,মোস্তফা,ডবল ড্রাগন প্রভৃতি ফাইটিং গেমে আমিই রাজা।এখানেই শাহরুখ খান আমায় চমকে দিল।
তুম কো হামিছে চুড়ালো
এসব কোন খেলা হল?
খেলা হলো এইটা! শাহরুখ খান লাভ গেমসের দিকে ইশারা করলো। এটা হলো একটা বাক্সে নানা রঙের হার্ট শেপ মেলানোর খেলা।
- এটা খেলা হলো! বাচ্চাদের খেলা একটা!
- কেন নয়? এটা হলো প্রেম ভালবাসা খেলা।
তখন জানতাম প্রেম বড় লজ্জার জিনিস। সিনেমার নায়ক নায়িকা ওসব করে। হুযুরও বলেছিল - সিনেমা না জায়িজ। বেপর্দা মর্দ ও আওরাত কি বেতমিজি!
আমি বললাম -ওসব বড় লজ্জার!
শাহরুখ খান হো হো করে হেসে উঠলো।
দুনিয়ার সব বস্তুতে প্রেম ভালোবাসা থাকে। ভালবাসা না পেলে ও ভালোবাসা না দিলে সবাই মারা যায়। তোমার মার কথাই ধরো। তুমি কি তোমার মাকে ভালবাসো না?
হ্যা।অনেক ভালবাসি।তাই বকা খেলে কান্না পায়।মার মন খারাপে মনে মনে মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
শাহরুখ কে আমার যথার্থই প্রাকৃতিক শিক্ষক মনে হচ্ছিল। ঘোলাটে ধূসর মণির শাহরুখ কে প্রাজ্ঞ দেখাতো। আমার অনেক বন্ধু কিন্তু ইতিপূর্বে শাহরুখের মত কাউকে দেখিনি।সবকিছুতে শাহরুখ ভালবাসা খুজে পেত।
তুমি কি জান দুপুরে অনেক কাক করুণ সুরে বিলাপ করে?
না ত !
তাদের সঙ্গীর কথা মনে করে কাঁদে।আহা! সামান্য কাক,মানুষের ত আরো দয়ামায়া ভালোবাসা থাকা উচিত। সবাই যদি শাহরুখের মত করে ভালবাসতে পারত!
এভাবে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল।দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে , কয়লা ,পরদেশ,দিল ত পাগল হ্যায়,কুচ কুচ হোতা হ্যায়,কাভি খুশি কাভি গাম।ততদিনে গতম রিয়েল হিরো।
বুঝলি,কেউ কাকে কিছু দেয় না। ছিনিয়ে নিতে হয়। মাও সেতুং বড় খাঁটি কথা বলেছে। বন্দুক ক্ষমতার উৎস। হাহাহা। বুকে পিস্তল ঠেকা,বাপ বাপ করে সব দিয়ে দেবে।
একদিন তুই মারা পড়বি গতম! এসব ছেড়ে দে।শান্তিতে থাক।অনেক ত হলো।
শান্তি! চুপচাপ সাইড কেটে এককোণে পড়ে থাকবি,নেহি মিল গেয়া।শান্তি ভঙ্গ করার শক্তি থাকলেই কেবল তুই শান্তিতে থাকতে পারবি।
গতমের কথা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল।
এ সময় কিছু বন্ধু নিখোঁজ সংবাদে পরিণত হয়েছিলো।যইক্কার(পানিতে বাস করা দেও)টানে সাতারে পটু বন্ধুরা তলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠছিল।কারো বাবাদের টাটকা লাশ বিলে পাওয়া যাচ্ছিল।বুম বুম বুম হরহামেশাই।কিন্তু আইন অসহায়।আমরা আতঙ্কিত।খেলার মাঠ তছনছ।অভিশাপে জর্জরিত পুকুরগুলো ভরাট হয়ে বিল্ডিং।কিছু মরা বন্ধু ভুতের গল্প হয়ে ফিরে এলো।এসব বুকে দাগ কাটছিল। পাড়ার নেতা একদিন খেলার ব্যাট কেড়ে নিলো।রাতে কষ্টে কাদছিলাম।বাবা বললেন,এনে দেবেন।দিন কতেকেই বাবার দৌড় স্পষ্ট।অথচ বাবাদের ক্ষমতাশালী ভাবতাম।ক্ষোভ দানা বাধার পর পিস্তলে মুক্তি নেবো ভাবছিলাম।
এমন সময়ে শাহরুখের ম্যা হু না।
মানে ?
আমি আছি না! প্রেম ভালবাসা শিখিয়ে দেব।
তোমার মাথা ভর্তি কি প্রেম ভালবাসা?
হ্যা।ভালবাসাতেই জয়ী হওয়া যায়।কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে দেখো, জীবনের মানেই পালটে যাবে।
তাই?তুমি কি কাউকে ভালবাসো?শাহরুখ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল- হ্যা।
হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে শাহরুখ খান চিৎকার করে বলল,তুমি প্রেম কর! তুমি প্রেম কর!
শাহরুখের এটা না বললেও হয়।এসময় বুকে চৈতালি হাওয়ার ঘূর্ণি চলছিল।সুন্দরী মেয়েদের চোখে পৃথিবীর রুপ রস গন্ধ পাচ্ছিলাম।কারো দীঘল কালো চুলের মৌতাতে ডুবে যেতে ইচ্ছে হত। মনে হত পৃথিবীটা আসলে মেয়েদের।মা হয়ে বোন হয়ে বউ হয়ে ওরাই ছেলেদের জীবনভর আগলে রাখে।ভরিয়ে দেয়।অর্থবহ করে।এসময় মেয়েরাও আরেঠারে তাকাচ্ছিল।বইয়ের ভেতর চিঠি পাচ্ছিলাম।কিন্তু অন্য আরেক জগতের হাতছানিতে এসব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।
যেমন আকাশ।রাতাকাশে মন ডুব দিত।তাতে অনেকক্ষণ তলিয়ে থাকার পর ভয়ঙ্কর সুন্দর ভাবনা কুঞ্জে যাওয়া যেত।আকাশের সাথে মানুষের কোটি কোটি বছরের মিতালি।চাঁদ-সূর্য-গ্রহ - তারা বর্ণিল মনোহরী পিকাসীয় আকাঝোকা ও স্বপ্নকল্পমেঘমালা পুঁজি করে আকাশের এই মহাঘোর মহামায়া।তাতে আটকে যাওয়া আপনাত্মার ক্ষুদ্রতা,অর্থহীনতা করুণ সুরে বেজে উঠত।তখন এর আড়ালে থাকা কারিগরকে উদ্দেশ করে অদ্ভুত দলাপাকানো কষ্টসুখে কাঁদতে ইচ্ছে হত।
এ কথা কাউকে বলা যাবেনা জানি। কাউকে না।শাহরুখ ও নয়।ও কেবল দু জিনিসে ধ্যানী - ভালবাসা, অভিনয়।তাই হাল্কা হতে নদীতে যাই।তার ছলাত ছলাতে ভাঙ্গে নদীর পাড়।জলে বিলীন হওয়ার আগের সময়টুকুর ভেতর পৃথিবীর সুর মুঠোবন্দী করতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে ঘরে ফিরি। সফলতায় মোক্ষলাভ হবে জানি বলেই বারবার এসবে ঘুরে ফিরে যাই আসি।
শাহরুখ ও হয়ত এভাবে তার জগতে ঘুরে ফিরে মরত।নয়ত শাহরুখ কেন?নয়ত অভিনয় কেন?অনেক দূরে কোন খালি ময়দানে গিয়ে সিনেমার ডায়ালগগুলো দুর্বল ম্যাড়ম্যাড়ে কণ্ঠে আওড়াবার পর কেন জিজ্ঞাসা কেমন হলো? হবুহু শাহরুখের মত ,তাইনা? মনে মনে হেসে বলেছিলাম,সময় লাগবে। আরেকটু সময় হলে নিশ্চয়ই হবে।
সময়!
সময় নদীতে বেশ কিছুকাল অবগাহনের পর পাড়ায় সাইবার ক্যাফে দেখি।নিজেকে শাহরুখের চেয়ে লম্বা সুগঠিত ফর্সা দেখছিলাম।ততদিনে গতম রবিনহুড হয়েছে।লুটের টাকা গরীবে বিলায়।ফলে সবার জিগড়ি দোস্ত।ওকে দেখা ও খোঁজা দুটাই বিপদজনক।এতকিছুর পর ও দেখা হল।
গতম আগের মতই হাসে।আমিও আগের মতই বলি - ছেড়ে দে!
গতম হো হো করে হাসে।
কাভি নেহি।তাও আবার এতদিন পর।এখন যেই পাবে,তার চুলাতেই ফ্রাই।
বড় ভুল করেছিস গতম।এসব কেন করলি?
গতম হাসে। জীবনটাই ভুল রে! কারো কম কারো বেশী।আমিও প্রেম করতে চেয়েছি। বিয়ে হোক। ছেলেপিলে হোক। কিন্তু অন্যায় সইতে পারিনি।তুই বল বিচার করার কি কেউ আছে?
গতম থামে।পিস্তল বের করে বলে,আমিও মানুষকে ভালবাসি।রক্ত ঝরিয়ে যতটুকু পারি মানুষের কল্যাণ করে যাবো।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
একদিন তুই মারা পড়বি গতম।
গতম হাসে। সে জানি। মরে ত সবাই। মরার আগে কে কি করে গেল সেটাই আসল।
গতমের চোখে চোখে তাকাই। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবি,তুই কোন অন্যায় করিসনি ?
গতম মুচকি হাসে।
না,অন্যায় করিনি। আমার সবকিছুর পেছনে কার্যকারণ আছে। দর্শন আছে। যুক্তি আছে। অবশ্য এসব শয়তানের ও থাকে। তবে বুকের কাছে আমি নিস্পাপ। এতটুকু দ্বিধা নেই।
অনেক কিছু বলতে গিয়েও আর বলা হলনা। কারণ মস্তিষ্কের সত্য আর হৃদয়ের সত্য এক নয়। সমাজ ও ব্যক্তিকে সামনে রেখে কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন সত্যকে বেছে নেবো,তার ফায়সালা করা মুশকিল।কখনো কখনো ব্যক্তিই ব্যক্তির সুবিচারক হয়ে দাঁড়ায়।আমি শুধু জানি,মানুষ দ্বান্দিকতায় এগোয়।তার চারপাশটাও। তাই গতমদের জন্য হৃদয়ের গহীন কোণে ভালবাসার একটা নিদিষ্ট খোপ রাখতে হবে।সমাজে এমন রক্তস্নাত বালক খুব দুর্লভ।
গতম বলল,আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করিস না।তোর সমস্যা হবে।একটা ই মেইল আইডি দিচ্ছি।ওটাতে যোগাযোগ রাখিস।
গতমের সাথে মেইলে যোগাযোগ চলছিল।একদিন পুলিশের হাতে কট খাবার পর গুলি করে পালালো।মনে কু ডাকছিল।গতমের বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে।
মেইল দিলাম - পুলিশের হাতে ধরা দে।নয়তো দেশ ছেড়ে পালা।
উত্তর এল- জীবনে দুটো কাজ করিনি।পালাইনি। চুপচাপ অন্যায় মেনে নেইনি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইবার ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসতেই শাহরুখ খানের সাথে দেখা।
আচ্ছা,শাহরুখ খানের ই - মেইল আইডি কি জানা আছে?
না ।
ওহ! শাহরুখ কে বিষণ্ণ দেখালো। আইডি জানা থাকলে শাহরুখ খানের সাথে যোগাযোগ করা যেত।
তা যেত। আচ্ছা, দুনিয়ার এত নায়ক থাকতে শাহরুখ খান কেন?
কারণ শাহরুখ খান ভালবাসার বেদনা দেখতে পায়।ভালবাসার সুখকষ্টনহর ভেতর থেকে দেখাতে জানে।দেবদাস মুভির শেষ সিনটা মনে আছে তোমার?কিভাবে চোখের পানির ফোঁটাটা নামছিল।আসল কথা হচ্ছে,শাহরুখ খান পারে।বাস্তবেও দেখো গৌরিকে সেই যে ধরেছে,ছাড়েনি।শাহরুখ খানের মনে যে অনেক মায়া!
যাই হোক এবার দেখতো। শাহরুখ খান মুভির কিছু ডায়ালগ অভিনয় করে দেখালো। কেমন হল?
আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।অভিনয়ে নামলেই পারো।কৌতুক করে বললাম।শাহরুখ তা টের পেল না, তার চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।অভিনয় ই ত করতে চাই।তোমার কি মনে হয়? পারবো?
হ্যা,পারবে। কথাটা বলার জন্য বলেছিলাম।অথচ তাতেই....
ঘটনাটা জানলাম মাস দুয়েক পরে শাহরুখের মুখে।
আমার বাসায় চলো। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।
অবাক হলাম। শাহরুখ খান কখনো তার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলেনি।আমিও জিজ্ঞেস করিনি।আর আজ সোজা বাসায়।
কিছু হয়েছে? শাহরুখকে জিজ্ঞেস করলাম।
আরে না।অনেক দিন ধরে আমার মুখে তোমার নাম শুনতে শুনতে মা অস্থির।কাল বলল - ওকে নিয়ে আসিস।
শাহরুখ একটু থামল, তারপর উল্লসিত সুরে বলল, জানো,ঢাকা গিয়েছিলাম।দু ডিরেক্টর অলরেডি পটে গেছে। বলল,তুম ত কামাল কার দিয়া। কয়েকমাস পর আবার যেতে বলেছে।তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম ভাই। তুমি না বললে নিজের ক্ষমতা টের ই পেতাম না।
শাহরুখ খানের বাসায় ঢোকামাত্রই মন খারাপ হয়ে গেল।শাহরুখের মা অন্ধ।অথচ পায়ের আওয়াজ শুনেই বলে ফেললেন,এসো বাবা।তোমার কথা অনেক শুনেছি।
মা অন্ধ -শাহরুখ খান একথা কখনো বলেনি।অথচ দেখা হলে আমার মার কথা জিজ্ঞেস করত।খালাম্মা কেমন আছে?কি আশ্চর্য! আমি কোনদিন ভদ্রতার খাতিরেও জিজ্ঞেস করিনি।তবে কি আমি শাহরুখ কে আমার চেয়ে নিচু ভাবতাম?নাকি শাহরুখের কথার কল্পফানুসে এতগুলো বছর বুঁদ হয়ে রইলাম?শাহরুখ এমন জরাজীর্ণ বাসায় থাকে!জামা কাপড়ে দারিদ্র্যতার সঙ্কেত পাওয়া গেলেও এতটা করুণ?না,শাহরুখ দক্ষ অভিনেতা বটে।কথার ধুম্রজালে সব আড়াল করে দিয়েছিল।
এই শাহরুখ আবার ফকির ভুখা দেখলেই ভিক্ষা দেয়।
শাহরুখের মা বললেন,তোমার কথায় সে বিনা টিকিটে ঢাকা গিয়েছিল।কি খেয়েছে না খেয়েছে ঠিক নেই।আবার যাবে বলছে।ওকে বোঝাও,সে আমার বড় ছেলে।এরকম পাগলামি করলে কি হবে? ছোট দুটো ভাই বোন তারা খাবে কি! জানলাম আমার সাথে পরিচয় হবার আগ থেকেই সে শাহরুখ খান হয়ে বসে আছে।
শাহরুখের মা আমার চোখের সামনে জীবনের নির্মম দিকটা খুব সহজে,সহজ ভাষায় উম্মোচিত করে দিলেন। ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে থেকে চাঁদের আলোর বন্দনা আসলেই মানায় না। ছেড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার প্রবাদটা পড়েছিলাম কেবল,আজ উপলব্ধি করলাম।টেনেটুনে ৫ ফিট উচ্চতার জাহাঙ্গীর কখনোই শাহরুখ খান হতে পারে না।এই ভাঙ্গা ঘর,ম্রিয়মাণ চেহারার প্রতিটা সদস্যই ত যা বলার বলে দিচ্ছে, আশ্চর্য!
স্যার জাহাঙ্গীর ওরফে মিছে শাহরুখ কোন দুনিয়ায় থাকে।!সে কালো,সে বেটে,সে কদর্য,সে আন্ডার মেট্রিক , তার গলা ভাল নয়।।সে কোন যোগ্যতায় কোন যাদুবলে শাহরুখ খান হয়ে যাবে!
জাহাঙ্গীরের চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে মুখটা নিচু করে রেখেছিল।এমন কিছু হবে সে হয়তো ভাবতেও পারেনি।শাহরুখের প্রলেপ সরে যাওয়ায় তাকে বাস্তবিকই ক্ষুদে লাগছিল,একদম র মেটেরিয়াল! রাগে অধীর হচ্ছিলাম। সে দায়িত্বকর্তব্যহীন উড়নচণ্ডী ভ্যাগাবন্ড।পরিবারের দুঃখ! হঠাৎ জাহাঙ্গীর ঘর থেকে দৌড়ে কয়েক বছরের জন্য আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে গেল।
গতমও দূর হতে বেশী সময় নেয়নি।পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে সে প্রচণ্ড আহত হলো।হাসপাতালের বেডে আমার হাত ধরে মরার আগে গতম বলেছিল,অনেক লাল! বড় কষ্ট!থমকে গিয়েছিলাম।সে সময়ে শাহরুখ খান মুভিতে বলেছিল,আই এম নট এ টেরোরিস্ট।
গতম লাল কালিতে সবুজ আঁকতে চেয়েছিল।লালে সবুজ চাওয়া ব্রতীবালকদের আত্মত্যাগ কি আসলেই তুচ্ছ?হেরে গেলেই কি হেরে যাওয়া হয়?কাঁচা তাজা বেপরোয়া রক্তে বিশ্বসভ্যতা অনেকবারই পরিশুদ্ধ হয়েছে।
আসলে এর কোন গণিত, বিজ্ঞান, ভুল শুদ্ধ হয় না।
তারপর আরো অনেকদিন কেটে গেছে।এসময় বহু বট যেমন ঝড়ে নুয়ে গেছে,তেমনি অনেকে বলবান হয়েছে।আমি কেবল সময়ের সাক্ষীগোপাল হচ্ছিলাম।আর তাতে পৃথিবীটা ক্রমশ কুৎসিত বুড়ি মনে হচ্ছিল।টের পাচ্ছিলাম মানুষ জন্মেই পরাধীন।পিতা - মাতা,বংশ,গোত্র,বর্ণ, জাত , নাগরিকত্ব ও আরও অনেক কিছু না চাইতেই শরীরে জূড়ে বসা।ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নাঙ্গা হওয়াও অসম্ভব।সবাই মিলে আরো চাপিয়ে দেবে।একজন মানুষ সবসময়েই কোন না মানুষের,প্রতিষ্ঠানের,সৃষ্টিকর্তার দম দেয়া পুতুল।তাহলে মানুষের মুক্তি কিসে?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শাহরুখের দর্শন টের পেলাম।শাহরুখের খোলসে জাহাঙ্গীর আসলে ভালবাসা দর্শনের প্রচারক।সে বলেছিল,ভালবাসলেই সত্যিকারের জয়ী হওয়া যায়।কিন্তু সে জয়ী হতে ভালবাসেনি।তেমন কোন বাসনা তার ছিলনা।মাথাই ঘামায়নি।তার ভালবাসা স্বতঃস্ফূর্ত।মহাবিশ্বজূড়ে যে অনন্ত জীবন প্রবাহ,তাতে অবদান রাখতে সে তার ক্ষুদ্র জীবন সত্তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অল্প বয়সেই প্রকৃতির পাঠশালায় সে প্রাজ্ঞ,সে ঋদ্ধ।সে বুঝে গেছে একমাত্র ভালবাসার মাধ্যমেই বিশ্বচরাচরে সংযোগ স্থাপন করা যায়।এবং তাতে জীবনের পরিপূর্ণতা আসে।জীবনকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করা যায়।রবীন্দ্রনাথের'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়,আমার মুক্তি ঘাসে ঘাসে কথাটি জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে আমার মানসপটে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।আসলে ভালবাসা ছাড়া মানুষের আর কি বা করার আছে?
সত্যিকারের অসাধারণ মানুষরা সাধারণের cut your coat according to your cloth এর পথে না হেটে kill your tailor and make your own coat এর পথে হাটেন।শাহরুখ খান কিলিং পাথ বেছে নিয়েছিল। প্রকৃত শিল্পীর পথ যে এটাই। জাহাঙ্গীরও ত তাই।তাহলে তার কেন শাহরুখ নামক মুখোশের প্রয়োজন?অনেকদিন পর মনটা জাহাঙ্গীরে আকুল হয়ে গেল।
বহু ঝূটঝামেলা ডিঙিয়ে একদিন জাহাঙ্গীরের দেখা পেলাম।সেই চিপা রাস্তায়,সেই দোকান- যেখানে প্রথম শাহরুখের সাথে দেখা হয়েছিলো। চেহারা অনেক বদলে গেছে।ছোট্ট এক মেয়ে তার গলা ঝুলে আছে।জিজ্ঞেস করল - কেন এসেছি?কেমন আছি?
শাহরুখ খানকে দেখতে এসেছি। - আমি বললাম।
এফডিসিতে প্রোডাকশন বয়। সেদিন জীবনে প্রথম প্লেনে চড়লাম।
এখানে না এলে এটা হত?কথার সমর্থনে জাহাঙ্গীর চোখ নাচালো।
আর অভিনয়? আমিও পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম।
দুয়েকটা ছোট খাট রোলে।আশায় আছি।আচ্ছা আমার কি....
ওঁর গলা ধরে এল।কোনদিন যা করিনি - জাহাঙ্গীরকে কে বুকে নিলাম।
আরে ভাই! শাহরুখ রা ভালবাসার জিনিস ছাড়ে না।
পাশের দোকানের টিভিপর্দায় দয়াল বাবা শাহরুখ খানকে দুই মেয়ে সমেত আইপিএলের খেলা দেখতে দেখা যাচ্ছে।নাইট রাইডারস ব্যর্থ হবার পর ও শাহরুখ খান আশা ছাড়েনি।গৌরী ও শাহরুখ কে ছেড়ে গিয়েছিল।কিন্তু শাহরুখ খান সমুদ্র সৈকতে আবার গৌরীকে জয় করেছিল।শাহরুখ তার ভালবাসার জিনিস কিছুই ছাড়েনি।
তোমার মেয়ে ? - জিজ্ঞেস করলাম।
না। বোনের।বাচ্চা ফেলে আরেকজনের সাথে ভেগেছে।
তোমার মা?
আছে।
বিয়ে করনি?
না।আমার ছোট ভাই করেছে।
সে কোথায়?
চলে গেছে।একা থাকে।
সুখের নেশায় দরদী জাহাঙ্গীরের ঘাড়ে ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে উধাও হয়েছে সবাই।কিন্তু তোমার কি এসবে খারাপ লাগে না?জিজ্ঞেস করতেই জাহাঙ্গীর সেই অনেকদিন আগের মত নাটকীয় গলায় বলল -ম্যা হু না!
হঠাৎ রাস্তায় বিদ্যুৎ চলে গেলো।সব অন্ধকার।এতক্ষণের আড়ালে থাকা পূর্ণিমা চাঁদ স্বমহিমায় বেড়িয়ে আসার সুযোগ পেল যেন।তার মায়াবী ছোঁয়ায় বহুদিন আগে শাহরুখের সেই ভালবাসাময় অনন্ত অক্ষত মূর্তি চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হল।সমগ্র মহাবিশ্ব তার দুচোখে ভালবেসে পরম মমতায় ঠাই নিয়েছে।চাঁদের আলোয় তার মুখের রেখাগুলো আশ্চর্য বলিষ্ঠ দ্যুতিময়।স্বপ্ন - কল্প বাস্তবতার কিশলয়ে এ যে বুদ্ধ শাহরুখ খান!একের ভেতর সবাই।তাই নামে কি বা আসে - যায়!শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল।যা বলতে এসেছিলাম - বলা হলনা।দরকারও নেই যে!
পৃথিবীতে আসার সময় যেসব মহামূল্য উপহার বয়ে নিয়ে এসেছিলাম,তার অনেক কিছুই জ্ঞাতে- অজ্ঞাতে আমায় ছেড়ে গেছে।শাহরুখ খানকেও অনেকে।কিন্তু শাহরুখ খান কিছুই ছাড়েনি।শাহরুখ খানের মনে যে অনেক মায়া!