উৎসর্গ - প্রিয় মানুষ আমিনুর ভাই।খুশিতে উৎসর্গ দিয়ে দিলামউৎসর্গে এর আগে এত আনন্দ পাইনি।এবং যারা আমিনুর ভাইকে ভালবেসে আমিন গং)
সতর্কতা - গল্পে গুরুচণ্ডালী ও যবনী মিশালের উপস্থিতি বিদ্যমান।
প্রতিটা গল্পই অত্যধিক ধূসর,নয় সাদা নয় কালো।
- লিসা লিন
প্রেমিক+ পাত্রের নাম হইল গিয়া মাসুম ।
বলতে গেলে পাত্রের কোন সমস্যা নাই।
বরং চরিত্রে ভান্ডার ভরা বিবিধ রতন।রমরমা ব্যবসা করে - এখনই উচ্চ মানের শিল্পপতি বলা চলে,ব্যবসার ডিঙি যেভাবে আগাইতাছে- সামনে খালি টাকাই টাকা!সিল মারা সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ -রিনা ( পাত্রী ) ত দূরে থাক রিনার ছা পোনার সাত প্রজন্ম চড়িয়ে বড়িয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাইলেও শেষ হইবে কিনা সন্দেহ। এর বাইরেও তিনি বুদ্ধিমান দয়ালু, প্রয়োজনবোধে নির্মম,নাক - মুখ খাড়া খাড়া , উচ্চতা ৫ ফিট ৭,তার সাথে ম্যাচ করা ব্যায়ামপুস্ট বডি। কোন দিকে কমাকমি নাই কিন্তু............
যা সমস্যা
তিনি কালা, তাও কাউয়াকালা!
পুরুষ মাইনসের কালা -ধলা! ইয়া কি বাত! হা। কিছু জায়গায় ঠিকই কালার দোষে দোষী হইতে হয় ,যেমনটা রিনার পরিবারে।
সমস্যা হইতাছে রিনার পিতৃমাতৃকূলের চৌদ্ধ খান্দানে কেউ কালা নাই সবাই হইলদা - লাইলচা ধলা , চামড়ার শ্রী - ছাচে তাদের লোকে ইরানি - তুরানি বংশলতিকালেঞ্জার সংযুক্তি আছে বলিয়া ভ্রম করে।তারা কহেন ও তাই। সেই কবে তাহাদের মহাত্মা পূর্বপুরুষগণ সুদুর ইরান - তুরান হইতে ধর্মপ্রচারের নিমিত্তে এই রঙ্গেভরা বঙ্গদেশে তশরিফ আনিয়াছিলেন।চর্মবর্ণে সেই অতুল গৌরবের সাক্ষ্য বিদ্যমান এবং তাহারা সৈয়দ ও বটে।
রিনা নিজেও কি কম! ঘুরায়া ফিরায়া খুটায়া দেখিবার প্রয়োজন ব্যতিরেকেই এক বাক্যে- তিনি মারাত্মক শ্রেষ্ঠা সুন্দরী। নাক খাড়া , মুখ খাড়া , চোখ পটলচেরা,হাতে পায়ে অবিকল ঐশ্বরিয়া। চুলে মাধুরি- ভ্রুতে সুমিতা দেবী। কোকিলা কণ্ঠী , ৫ ওয়াক্ত নামাজী।লম্বায় ৫ ফিট সাড়ে ৫ পাঁচ ইঞ্চি।আচারে কোমল,নিয়ম পালনে কঠোর,রান্নায় হাতের নাম -যশ পুরো পাড়াব্যাপি, কোর্মা-কালিয়া- আচারে সিদ্দীকা কবির ও নস্যি!
এতএব,এই ডিজিটাল জামানায় ত দূরে থাক আগামি ১৪০০ বছর পরেও মাসুমের মত কারো নাম এই খান্দানে বিবাহের নিমিত্তে আলোচিত হইবে - এমন কোন সম্ভাবনার মূলে বিন্দুবৎ পসিবলিটি ছিল না। কিন্তু কালা আদমি মাসুমের সাথে সাদা মানবী রিনার ৭ বছরের চুপিচুপি প্রেম সব হিসাব - নিকাশ উল্টাইয়া দিল ।
বিয়ের উপযুক্ত সময় আসিলে রিনা মাসুমের কথা তার বড় বোনকে জানাইল + ফটো দেখাইল ।
'' এমন মেয়ে পায় কজনা ?
জিতে গেলি ভাই কাল্লু মামা !! ''
ওদের দুজনের যুগল ছবি দেখে হাসতে হাসতে রিনার বড় বোনের জামাই বলে ।
- হু ! এম্নিতে কিন্তু লম্বায় ঠিক আছে , তাই না ? রিনা থেকে মাত্র ইঞ্ছি ১।৫ লম্বা।ভালই মানিয়েছে ফর্সা হলেই একদম.....
কথা শেষ হবার আগেই জামাই হো হো করে হাসতে থাকে ।
- এ কি ! হাসির কি হল !
- তুমি বাটি আর চিকন - চাকন বলেই কিন্তু তোমাকে বিয়ে করেছি।
- কি !
- হ্যা! ভেবেছি বাটি আর চিকন - চাকন হলে খেলতে সুবিধা হবে । তখন তোমার ফিগার টা ও অবশ্য .........
জামাই চোখ টিপ মারে।
- শয়তান ! বদমাশ !!
- কিন্তু তখন কি আর .....
- তখন কি ?
- তখন কি আর জানতাম বাটি শয়তানের লাঠি!
জামাইয়ের পিঠে দুষ্টু কিছু কিল আসে। জামাই সেই কিল কুড়িয়ে চুমু দেয় আর তার পরের দিনই মাসুমের পিঠে স্নেহের হাত চাপড়ায় ।
- টেনশন মাত কর। মে হু না! বিয়ে হবেই !!
বউয়ের মুখ হতে শোনামাত্রই জামাই ''মাসুমকে হ্যা বলুন''শিবিরে,পারলে জায়গায় বিয়ে করিয়ে দেয়। দিবেই না কেন ?মাসুমের এত্ত টাকা! বাবারে!এই ব্যবসা , সেই ব্যবসা, শিপিং লাইনের রুই - কাতলা !! ভালায় ভালায় বিয়েটা করিয়ে একটা সুযোগ নিতে পারলেই কেল্লা ফতে! ঝরঝরে ভবিষ্যতের মৌমাছিটা চলে আসবে হাতের মুঠোয়! তাতে জীবনের একটা হিল্লে হয় ,গতি হয়! গতি ! গতিই ত ! ঘোড়ার গতি ! আলোর গতি ! তারপর নেচে নেচে খাও , হেসে হেসে খাও , দৌড়ে দৌড়ে খাও - মানা করছেটা কে ?
এই খান্দানি নামের ঠনঠনানি বংশে বিয়ে করে জামাই কি পেয়েছে ? ঘোড়ার আন্ডা ! হাতছানি দেয়া লাভের মওকা পেতে তাই জামাই তৎপর ।
-তলে তলে তলিয়া প্রেম !!
ছি ছি ছি ! বেটি খান্দান ডুবিয়ে দিল !!
বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে দিল !!
বাবা শুনে রেগে শর্মা, খালু হয় অগ্নিশর্মা !পারিবারিক বৈঠকে বয়ে যায় আগুনের হল্কা!
- এই যুগে এমনটাই ঘটিয়া থাকে! জামাই বলে।
- জামাই !
না থেমে একের পর এক মাসুমের ব্যবসার কথা বলে যায় জামাই, জামাই যত বলে,মুরুব্বীদের রাগ তত কমে।
কা উ রে ! এ ত খনি , মাসুম গনি!
আগা টু গোড়া লাভ!
লাভ!
- লাভ ! লাভ টা রিনার বাবার চাইতে কে বেশি বুঝে!টাইটানিক ধারে - কর্জে সবকিছু গলা ডোবা ,খান্দানি কল্লাটাই কেবল ভেসে আছে। এবং যা দিনকাল- আগে পরে ওটাও যাবে। লক্ষ্মী সোনা মাসুমের মত জামাই পেলে কপাল ফিরতে কতক্ষণ! যদি থাকে নসীবে ডাইরেক্ট আসিবে! তবু ত চট করে হ্যা বলা যায় না।একটু খটকাও লাগছে । জামাই যেভাবে দালালি করছে ........ কে জানে ঘটনা কি !
- সবই ঠিক আছে , গায়ের রংটা .....
- এই যুগে এই সব পুরানা সেন্টিমেন্ট চলে না বাবা !!
এমন হেলদি স্মার্ট জামাই কই পাবেন , এই যুগে গায়ের রঙ কে বিছরায়! বেটা মানুষই ত ! তাছাড়া জামাই খুব ভাল ,বিয়ে হলে আপনার ধার - দেনার ও একটা ব্যবস্থা অবশ্যই হবে। রাজি হয়ে যান বাবা!
রাজি !
রিনার বাবা নিজ- মনে রাজি না হইলেও তখনই বিবেচক মনে নিমরাজি ।নিমরাজি মানে না না বলিয়া পুরাই রাজি। উপায় নাই।পাত্রের টাকা!এই দুনিয়ায় টাকাই বাবা!কেবল টুপিতে পাঞ্জাবীতে কি খান্দান টিকে! তাছাড়া মেয়ে মানে অপর বংশ - তাহাদের সাথে আমার আর কি সম্পর্ক! বরং ঠিক ঠাক মত জামাইকে ব্যবহার করিতে জানিলে খান্দানকে নতুন করিয়া গড়িয়া পিটিয়া লওয়া যাইবে।
কিন্তু রাজির নাটাই রিনার খালুর কাছে।গোলজটটা ওখানেই।
ঠ্যাকা - বেঠ্যাকার সংসারে এই খালুই হাতের পাঁচ, বিশ্ব ব্যাংক।আর গুলা ত সব তক্কে তক্কে সরে আছে। অথচ মধু খাওয়ার বেলায় ঠিকই খাইছে! খালু বেটাও যেমন দিচ্ছে তেমন মাতবরি করে সব উসুল করে নিচ্ছে। শালার ব্যাটা! তুই চাস আমি সবসময় ফকির থাকি। বড় মেয়ের সময় ও ঠিক অমন টাই করেছে ।পাত্তিওলা পাত্রগুলোর এই সেই দোষ ধরে,সব ক্যান্সেল করিয়ে কোথাকার কোন হাবলুকে গছিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু যত যাই হোক খালুকে চটানো যাবে না।রিনার পরে আরো দুই বোন আছে , দুইটা ছেলেও আছে ,ওদের ভবিষ্যৎ ............তাছাড়া জামাই কেমন হয় তাও বলা যায় না আর তার উপর ভিত্তি করে খালুর মত পরীক্ষিত সৈনিককে চেতিয়ে দেয়া যায় না।এর চেয়ে যদি বুঝিয়ে - সুঝিয়ে ............।
কিন্তু কিসের কি !
ভুমিকম্প নাজেল হইল। সাথে আসা তাহার সুবোধ সুগোল মেয়ের জামাইরা ভুমিকম্পের তালে তালে রাগিণী বাজাইল !!
- আপনি বেকুব জানিতাম কিন্তু বংশগৌরব বিস্মৃত হইবেন , এমন বেয়াকেল জানিতাম না ! ছি ছি ছি! টাকা থাকিলেই সব হইয়া গেল। টাকা ত হাতের ছাতা ( ময়লা )।ও জিনিস রাস্তার ফকিরের ও থাকে।এই ছেলেকে আমরা কোথায় গছাইব! পারিবারিক ফাংসানেও ত তাকে মানাইবে না !
- ঠিকই ! রিনার বাবা ভাবিল।
সাদার মাঝে কালো আলো হইয়া ফুটিয়া থাকিবে!
মিন মিন করিয়া কেবল কহিল - আরেকটু যদি ভাবিতেন!
- ভাবিবার কি আছে! শরীফ লোক দেখিয়া আমরা রিনাকে বিবাহ দিব।তাছাড়া সব ঠিক থাকিলেও এ বিবাহ দুরুস্ত হইবে না।প্রেমের বিবাহে নাই রহমত নাই বরকত।এখনকার ছেলেপুলের যে কি হইল! চোখ পাকিলেই প্রেম! সবার আগে খান্দান বাঁচাইতে হইবে।
আবার ও মাসুম
কিছু কিছু কথা মাসুমের কানেও এসেছে এবং তাতে তার মেজাজ চড়েছে। হোক বংশ গৌরব নাই - কিন্তু বংশ গৌরবে আছে কি মুলোটা! বংশ -গৌরব দিয়ে কে কখন কোথায় কত টাকা বানাইছে! টাকাই আসল।আর আল্লাহ যারে দেয় তারে ছাপ্পড় ফুইড়া দেয়! যেমন দিছে মাসুম কে।অমন নিধিরাম সর্দার মার্কা বংশ মিনিটে মাসুম শয়ে শয়ে কিনতে পার।সের মাপা !!
শালার খালি প্রেম করছি বলে হ্যাপা ,নাইলে এই সব লোকরে কুত্তাও পুছে না!
উত্তেজিত মাসুম রিনাকে কোর্টে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু রিনা প্রেমে নিজে ডুবিলেও প্রেম সাগরে বংশ ডুবাইতে রাজি হয় না। তবে আশ্বাস দেয় - বিয়ে হচ্ছেই!সব বুঝে ও প্রেমের নিমিত্তে সিংহমাসুমকে বিল্লিমাসুম বনতে হয়।একবার বিয়েটা করি তারপর তোদের সবকটাকে আমি .. ..
মাসুম হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে আসলেই প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
তারপর ?
কিন্তু খালুর ঘাড়ত্যাড়ামিতে সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল।এতএব,বিপর্যস্ত আধমরা প্রেম কাঁদো কাঁদো মুখে চিরতরে ডুবিয়া যাইতে যখন বুড়িগঙ্গাতটে ধাবমান হইতেছিল, তখনই -
ক্লাইম্যাক্স !
রিনা ইঁদুরের বিষ খাইল( ভালো কোম্পানির)। পাশার দান উল্টিয়া গেল। তুমি মিয়া মুসোলিনির বাড়া!সব বোঝো ত প্রেম কেন বোঝো না! -উত্তেজিত রিনার মামা খালুকে কহিল। হাসপাতালের করিডরে ''ও আমার রিনা রে !'' বলিয়া রিনার মা মর্সিয়া গাহিল।ক্রন্দনে শোরগোলে নারকীয় কনসার্ট চলিল রাত্রিব্যাপি।শেষমেষ যমের সাথে দু দান খেলিয়াই ডাক্তার জিতিল।
এ যুগের মেয়ে কখন কি করিয়া বসে !দিয়া দেই বাবা দিয়া দেই।পারিবারিক বৈঠকে পুনরায় রিনার মাতা পিতা প্রস্তাব পেশ করে।খালু গজগজ করে। মেয়ে যেখানে বাঘা তেতুল আমি বুনো ওল হইয়া করিব টা কি! মরুগগে বেটি!- খালু ইহা ভাবিয়া মনে মনে আচ্ছামত বকিয়া সায় দেন। তারপর গোটা বংশের রাজি অরাজি নিমরাজি ওলাদের সক্রিয় -অসক্রিয় , নিরব - সরবের ডামাডোলে বিবাহ - প্রস্তাব পাশ।আসিল গায়ে হলুদ। বাজিল সানাই।
২) একি !
নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা রিনা । আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে কে? নিজেকে চিমটি মেরে পরীক্ষা করার পর ও সন্দেহ যায় না। গালে হাত লাগায়। আঙ্গুলে গুড়ি গুড়ি ঠেকে। গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা সারতে সারতে ক্লান্তিতে অলসতায় কাল রাতের মেকাপ তোলা হয়নি। হ্যা, আয়নায় ও তাই দেখা যাচ্ছে - ডান গালে হাত।তবে ? কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তা কিভাবে সত্যি হয়? কপাল হতে গলা পর্যন্ত রিনার ডানপাশের চামড়া পুরোই আফ্রিকান নিগ্রোদের মত কুচকুচে কালো হয়ে গেছে।বাম পাশ টা আগের মতই, সাদা। রিনার ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২ টা হয়েছে। এই ৬ ঘন্টার মধ্যে চামড়া কালো হয়ে গেল। কিভাবে ? আসলেই কি কালো দেখাচ্ছে ? নাকি ময়লা ? ময়লা হলে বামপাশ কিভাবে সাদা থাকে ? কিছু বুঝে উঠতে না পেরে রিনা তড়িঘড়ি করে মুখে ফেসওয়াস লাগায়।বার বার পানির ঝাপটা মেরেও কালো দূর হয় না,বরং যেন আরো গাঢ হচ্ছে।রিনা নয়,আয়নায় ওটা যেন রিনা নামের কোন উদ্ভট প্রাণি।কি বীভৎস বিশ্রী।এসব কি কোন জিনিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? তাহলে ত পুরো মুখই কালো হবার কথা।রিনা অস্থির হয়ে যায়। কি করবে এখন? মাকে ডাকবে ? ভাগ্যিস কাল নিজের রুমে একলা শুয়েছিল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ!মানুষে গিজগিজ করছে পুরো বাড়ি। একটু পরেই কেউ না কেউ ডাকতে আসবে। তখন? আর নিজেকে সামলাতে পারে না রিনা, বেসিনের কলটা ফুল স্পিডে ছেড়ে হু হু করে কাঁদে। হায় আল্লাহ! এ কি হল! রিনার মনে হচ্ছে এই বাড়ি ছেড়ে তাকে এখনই পালাতে হবে। এই মুখ কাকে দেখাবে? কিন্তু পালাবে কিভাবে ? পালিয়ে যাবে ই বা কোথায়? আজ না তার বিয়ে!আল্লাহ! বিয়ে কি আসলেই হবে ?ভাবতে ভাবতে রিনা মোবাইল হাতে নেয়। এ মুহূর্তে মাসুমকে তার খুবই প্রয়োজন।
৩) মাসুম আর রিনা যেখানে প্রেম করত, এখন তারা সেই প্রাইভেট রেস্টুরেন্টে ।মাসুমের চোখে মুখে এখনো ক্লান্তি , ঘুমের ছাপ ।রিনার কণ্ঠের আর্তিটা টের পেয়েই বিছানা হতে মাসুম সোজা এখানে। কিন্তু এখন? জোর করেও কথা আসছে না মুখে। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও নিশ্চুপ। চোখ দুটোর টানটান উজ্জ্বল আলো শিথিল হয়ে গেছে। রিনার চেহারা দেখার পর মাসুমের মাথা কেবল বোঁ বোঁ করছে। এ কি দেখল সে? এর চেয়ে না দেখাই ভাল ছিল। এই রিনা লইয়া সে কি করিবে?রিনা কল দেয়ার পর কিছু একটা হয়েছে এটা বুঝেছিল কিন্তু তা যে এমন ভাবতেও পারেনি।কেই বা ভাবতে পারবে?পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্যোতিষীয়ও না। একবার তাকিয়েই চোখ নামাতে বাধ্য হয়েছে মাসুম।।উফ কি অবস্থা! অথচ এই মুখের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো গেছে।এমন হলো কিভাবে?
এখন কি হবে? কি করা উচিত? কড়া মেকাপ দিয়ে কালোটা ঢেকে দিলে সমাধান ? কিন্তু তারপর ? তারপরের টা সামলানো যাবে কিভাবে?সমাজ, সংসার বন্ধুবান্ধব? সমাজের গুষ্টি কিলাই সে নিজেই বা কিভাবে ম্যাচ করবে?ঐ এক মুহূর্তের দেখাতেই এক বীভৎস অনুভূতি পেটের নাড়িভুঁড়ি হ্যাচকা টান মেরে গলা দিয়ে বের করে আনতে চাইছে। ডানপাশটা কি ভয়ঙ্কর কদাকার! ডাইনি বুড়িও এর চেয়ে সুন্দর।মাসুমের মগজ আর কাজ করে না, অস্থির হয়ে মাথা চেপে ধরে।
রিনার মাথায় ও নানা কথা খেলা করছে।কে জানত সকালে উঠেই এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে, যা সবকিছু পালটে দেবে।এটা কি কোন কিছুর প্রাশপ্রতিক্রিয়া?তা ই বা কিভাবে হয়?তা হোক আর না হোক এই মুখ সে আর কাউকে দেখাতে পারবে না।কি হল খোদা।বিয়ের দিন এমন গজব।
দুজনেই জানে কথা বলা দরকার , একটা রফায় আসা দরকার।কিন্তু কি সিদ্ধান্তে আসা যায়?
- এখন কি করবে ? অনেক্ষণ পর অবশেষে নিরবতা ভাঙ্গে রিনা ।
- জানিনা! এটুকু জানি এ বিয়ে হচ্ছেনা।অথচ কাল রাতেও বাসর ঘরের স্বপ্ন দেখেছি! - হতাশ কণ্ঠে মাসুম বলে ।
জবাব শুনে রিনা মাসুমের চোখের তারায় তাকায়। মাসুম চোখ ফিরিয়ে নেয় ।
- জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে , আমারও হচ্ছে।কিন্তু উপায় কি! এ বিয়ে ক্যামনে হবে! তোমার বংশের পাপ ভর করেছে তোমার মুখে। না হলে এমন হয়।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।বিয়ের পর এমন হলে যে কি হত!
রিনা অনেককক্ষণ কোন উত্তর দিল না।মুখ নিচু করে ২০ মিনিট নিরবে কাঁদার পর বলে - কালো হওয়া দোষের? এটা হয়ত চর্মরোগ বা কোন কিছুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
মাসুম ইতস্তত করে।
- কালো হওয়াটা অবশ্যই দোষের নয়।আমিও ত কালো। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখো।চর্মরোগ বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবার প্রশ্নই আসেনা।মাত্র কয়েক ঘন্টায় কেউ কালো হতে পারে?আমি নিশ্চিত তোমার পূর্বপুরুষের পাপ তোমার চেহারায় ভর করেছে।কে জানে কার অভিশাপে এমন হলো।আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও তোমাকে সামাল দেব কিভাবে?তুমি নিজেই বা এই মুখ কিভাবে দেখাবে? হায় আল্লাহ! এই ছিল কপালে। বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে দিতে হয়!- মাসুম কপালে হাত চাপড়ায়।
রিনার মোবাইল বেজে উঠলো।রিনার মার কল।নাম্বারটা চোখে পড়তেই এখানে আসার দৃশ্যটা যেন চোখে দেখতে পেল।নিজের ঘর হতে আপাদমস্তক নিজেকে বোরকায় ঢেকে কিভাবে চোরের মত পেছনের গেট দিয়ে এখানে চলে এলো নিজেও জানেনা।রাস্তায় মাকে ফোন করে বলেছিল খুব জরুরী কাজে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে।ঘন্টাখানেকের ভেতর চলে আসবে।কেউ যাতে না জানে।তখনো ক্ষীণ একটা আশা ছিল।রিনা অনুভব করল এই দুনিয়ায় তার কোন জায়গা নেই।ফিরে গিয়ে বাপ মাকে সে সবার কাছে ছোট করতে পারবে না।নিজের কাছেও নিজে ছোট হবে না।মাসুমের কথাই ঠিক। মানুষকে দেখানো দূরে থাক,আয়নায় নিজেই নিজেকে দেখবে কিভাবে? সার্জারি করে ভাল হবে?আদৌ কি আগের মত হবে?সবই অনিশ্চিত।সব শেষ হবার পর আগের মত হয়ে বা কি লাভ!কোন পাপে বিয়ের দিন এমন গজব ঢেলে দিল খোদা!
মোবাইল টা বন্ধ করে দিল রিনা।
- উঠবেনা?মাসুম জিজ্ঞেস করে।
- হ্যা,তুমি যাও।এখানে আরেকটু থাকি।তারপর উঠছি। রিনা বলে।
- আমি আসলেই সরি।
- আমি বুঝতে পারছি।
- বাসায় চলে যেওকিন্তু!তোমার কিছু ভাবতে হবেনা।আমি গিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছি।
- আচ্ছা।
শেষবারের মত তাকাতে গিয়েও পারলনা মাসুম,প্রথমে এসেই তাকানোর দৃশ্যটা চোখে ভাসল।ওহ আল্লাহ! একটুর জন্য জানে বাঁচছি!বিয়ের পর এমন হলে তাকে বাংলাদেশ ছেড়ে ভাগতে ত হতই,কে জানে পুরো বিশ্বই ত্যাগ করতে হত কিনা! মনে মনে খোদার কাছে শোকর গোজারী করল সে।এখান হতে দ্রুত চলে যাওয়ার একটা তাড়নাও অনুভব করল।থাকুক রিনা।আহারে! কেঁদে বেচারি হাল্কা হোক।মাসুম চলে গেল।
রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে রিনা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল।তারপর ভালভাবে মুখ মুছল।মনে মনে গাড়ির তলায় নিজের জীবন দিয়ে দেবে - ঠিক করে ফেলল।তারপর মূখ ভালভাবে ঢেকে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ধীরে হাটতে লাগল।কত সুন্দর রোদ উঠেছে আজ।এই দিন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন হবার কথা ছিল।আর কিছু ভাবতে পারল না রিনা, জলে ভরে গেল চোখ।আর সামান্য এগোলেই হাইওয়ে। এমন সময় সুন্দর সৌম্য এক যুবক তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
- এই যে ম্যাডাম শুনছেন ?
-বলুন।
-আপনি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতে চাইছেন?
রিনা থমকে দাঁড়ায়।
- আপনি জানলেন কিভাবে?আর আমি আত্মহত্যা করলেই বা কি?
- আপনাকে দেখে এমন মনে হচ্ছে।উপায় থাকতে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়।
- আমার উপায় নেই।এ দুনিয়ায় আমি আমাকে দেখতে পারব না।
-এ দুনিয়ায় নেই ত অন্য দুনিয়ায় আছে।আমি আপনার সমস্যা জানি।
রিনা অবাক হয়।কে এই যুবক?
- আপনি কিভাবে জানেন?
- কারণ আমি এ দুনিয়ার নই।
কোন দুনিয়ার তাহলে - প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলনা রিনা,যে দুনিয়ার হবে হোক তাতে আমার কি। হয়ত যুবক আমাকে কোন কারণে মেরে ফেলতে চায়!মরার পরের দুনিয়ার কথাই হয়ত বলছে।
-যাবেন আমার সাথে , আমার দুনিয়ায়?আপনার ভাল লাগবে নিশ্চিত।
ভাল না লাগলে না হয় যা খুশি তাই করবেন।
যাবেন ? যুবক হাত বাড়িয়ে দেয়।
রিনা ছেলেটির চোখ বরাবর তাকায়।যুবকের দুচোখে গভীর আস্থা,নির্ভরতা ,বিশ্বাস ও প্রত্যয়।অবয়ব ঘিরে কি যেন এক অজানা আকর্ষণ।পরানের গহীন হতে রিনা আওয়াজ পায়- হাত বাড়াও।রিনা চমকে উঠে। ভাবে - আমার ত হারাবার কিছু নেই। ছেলেটার বাড়ানো হাতে কখন যে তার হাত চলে আসল টের পেলনা সে।
ওদিকে যা চলিতেছিল
এদিকে রিনাকে না পাইয়া পুরো বাড়িতে শোরগোল উঠিল।রিনার মা সব খুলিয়া বলিল। রিনার এহেন কান্ডের কি হেতু তাহা কাহা্রো মাথাতে আসিল না।জানিতেই যা দেরী,মহল্লার বাতাসে টিটকারী মহানন্দে ঘুরিতে লাগিল, টেনশনে অস্থিরতায় সবাই ঘামিতে লাগিল। হায় হায় হায়!এই নি ভাগ্যে ছিল।খালু বলিল আমি ইহাতে নাই।ইজ্জত কা মামলা। বেতমিজ আওরাত খান্দান ডুবাইয়া দিল।খালু বলিতে বলিতেই সর্বনাশের পেরেক ঢুকাইতে -পাত্রপক্ষের ফোন।খবর পাইলাম পাত্রী নাই-ছি ছি ছি।বাঁচিলাম! আল্লাহ মেহেরবান।পাত্রপক্ষ ও মহল্লার নানা কথার ঘনঘটায় রিনার বাপ মা ফিট হইয়া মাথা বালিশে কাইত।চতুর্দিকে বজ্র গতির সন্ধানেও রিনার টিকি মিলিল না।
অবশেষে যখন সবাই রাতে বসিয়া পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণে ব্যস্ত,তখন রিনার পরহেজগার দাদি তাহার ব্যক্তিগত হুজরাখানা হইতে বাহির হইয়া আসিল।বলিল - খোঁজার আবশ্যকতা নাই।জীনের বাদশার ছেলের সাথে আমাদের রিনা কোহেকাফে ভাগিয়া গিয়াছে।
শুনিয়া বিস্ময়ে কিয়ৎকাল কাহারো রা নাই।
আপনি কিভাবে জানিলেন? - সম্বিত ফিরিয়া পাইতে সবাই একযোগে প্রশ্ন করিল।
মোরাকাবায় দেখিয়াছি। - দাদির জবাব।
শেষতক কোহেকাফ!- রিনার জামাইয়ের সাধের টাইটানিক তাহারই চোখের সামনে ডুবিতে লাগিল।
মধুরেন সমাপয়েৎ
মধুচন্দ্রিমা শেষে ডি মুন তাহার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখিল -
পাইলাম, তোমাকে পাইলাম!
এত সহজে কার্যসিদ্ধি হইবে ভাবি নাই।পৃথিবীর হুরপরীদের মোহে পড়িয়া বিউটি পার্লারে চাকরি নিয়াছিলাম।প্রতিদিন কত সুন্দরী দেখিতাম কিছুদিন রঙ্গ তামাশা করিয়া নিজ দেশে ফিরিয়া যাইব এমত ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যেদিন রিনা আসিল,চোখের মণি টাল খাইয়া গেল।মানবী এত ফর্সা সুন্দরী হয়?সূর্যও বোধ করি ইহাকে ভালভাবে দেখিবার মওকা পায় নাই।বুকের ভিতরে বুঝিলাম প্রেমে পড়েছি আমি প্রেমে পড়েছি।কিন্তুতাহার ত বিবাহ হইতেছে।মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলিল।তাহার মেকাপের দায়িত্ব নিলাম।তাহার ছটফটানি দেখিয়া বুঝিলাম প্রেমের বিয়ে।কাজের ফাঁকে কথা চালাইয়া সব জানিয়া নিলাম।রূপচর্চার ফাঁকে কোহেকাফ হইতে আনা স্পেশাল এসিড তাহার ডান গালে ও গলায় স্প্রে করিয়া দিলাম।ঘন্টাকয়েকের মধ্যে উক্ত অংশ কুচকুচ কালো হইয়া যাইবে।এইবার পেছন পেছন আমিও তাহার বাসায় আসিলাম।সারা রাত্র এখানে কাটাইলাম।আর প্রভাত প্রতিক্ষায় থাকিলাম।জানি সকালে কিছু একটা ঘটিবে।কি কি ঘটিবে তাহা কল্পনা করিয়া মনে মনে খুব হাসিলাম।কিন্তু বিধিবাম।সকালে উঠিয়াই তাহাকে চোরের মত পেছনের গেট দিয়া বাহির হইতে দেখিলাম। পিছু নিলাম।অতঃপর তাহাকে তাহার প্রেমিকের সাথে দেখিলাম।মানবীর কি সাহস কি বুদ্ধি! এমন কিছু ঘটিতে পারে ভাবি নাই। সেই মুহূর্তে আমার মনে তাহাকে হারাইবার ভয় আসিল।ইয়া পরওয়ারদেগার!কিতা করাম আমি কিতা করাম!মাসুম দিবেনি পন্ড করিয়া।পরোয়ারদেগার কামনা শুনিলেন।মাসুমকে চলিয়া যাইতে দেখিলাম।রিনার চোখে অশ্রু দেখিতেছি।
এখানে আনিয়া ক্রিম মাখাইয়া যখন মুহূর্তের ভেতর তাহার কালোত্ব দূর করিয়া দিলাম,তাহার বিস্ময় ও আনন্দ দেখে কে?ঐ মুহূর্তে সে আমায় ভালবাসিয়া ফেলিল। কিছুদিন পর আমাদের বিবাহ হইল।
এই ইতিহাস সে কখনো জানিবে না। জানিবার প্রয়োজন ই বা কি!
সর্বশেষ
মাঝে মাঝে মোরাকাবায় বসিয়া রিনার দাদি রিনার খোঁজ -খবরি নেন।সর্বশেষ জানা গেছে - রিনার দুটি খান্নাস হইয়াছে। তাহারা সুখে - শান্তিতে বসবাস করিতেছে ।
টিকা
খান্নাস - জীন ও মানুষের মিলনজাত সন্তানকে খান্নাস বলে।
মোরাকাবা - ধ্যান।