তখন ভাইয়া বাসায় নেই । উনার বালিশের তলায় '' আমিই রানা '' নামের একটা বই ।তখন ক্লাস সিক্সে ।এর আগেই অবশ্য বন্ধু মারফত ''রানা টানে কিন্তু বাধনে জড়ায় না ''জানা হয়ে গেছে । গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম । পড়তে পড়তে জুলি যখন .......... কান লাল হয়ে গেল !
আর সেই মুহূর্তেই ভাইয়া কিনা বাসায় ...
আমি ভাইয়ার বালিশের তলায় বই চালান দিতে ব্যর্থ হলাম । ফলে হাতেনাতে কট । ভাইয়া বলল - আর যদি তোর হাতে এই বই দেখি তোর কান আমি ...........
পরাজয়ে ডরে না বীর । কয়েকদিন পর আমার হাতে '' শকুনের ছায়া'' !! আর ও কিছুদিন পর এমন একটা বই হাতে এল যেটা আমার পুরো বালকবেলা বিস্মিত করে রেখেছিল ।
যার আঁচ এখনো গায়ে লাগা । কুয়াশা সিরিজের কথা বলছি । ভলিউম -১৭ প্রফেসর ওয়াই এর কাহিনী । এবারো ভাইয়া মারফত । এবারো চুরি । এবারো ধরা । কিন্তু কানমলা
নেই । বুঝলাম কয়াশা হালাল !! নেশায় পেয়ে গেল আমাকে । নুপুর মার্কেটে ৩০ টাকা দিয়ে কিনলাম ১৭-১৮ নাম্বার ভলিউম ।পাঠ্য বইয়ের পেটের ভেতর জম্পেশ উত্তেজনায় কুয়াশা পড়া ।
এদিকে আসল পড়া বাসি হয়ে যাচ্ছে । হলে হবে । মার খেলে খাব । এমন একটা ভাব। কুয়াশা হজম করা চাই ই চাই ।
আমার শুধু বিস্ময় । একেক বই একেক রকম । শেষ না করে উঠা যায় না । আমি বিমুগ্ধ । মাদকতায় আচ্ছন্ন । তারপর কুয়াশা হয়ে গেল আমার নায়ক । কাজিদা হল আমার লেখক । ভাবতাম ইস ! সেগুনবাগিচায় গিয়ে যদি লেখক কে ছুয়ে দিতে পারতাম ! কুয়াশা কুয়াশা !! কোথায় পড়তে বাকি রেখেছি !
বাসায় - বাসে - ক্লাসে সব জায়গায় । একদিন ''ছুটির দিনে'' পড়লাম - গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ এর ছোটবেলায় কুয়াশা হবার স্বপ্ন ছিল ! পড়ে কি যে ভাল লাগল ! একটা বই কত প্রজন্ম ধরে মানুষ টানছে - কি অসাধারণ !
মাসুদ রানা সবচেয়ে বেশি পড়েছি এইচ . এস সি দেবার পর।
অবশ্য মাসুদ রানার সবচেয়ে ভাল লাগার বইগুলো আগেই পড়া হয়ে গেছে । যেমন - আই লাভ ইউ ম্যান ।ল্যাম্পনির বোহেমিয়ানা , রডরিকের সেই কথাটা এখনো মনে ভাসে। কতবার ঐ লাইন টা পড়েছি !
আই লাভ ইউ ম্যান , রানা ! আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালবাসি তোমাকে !!
কিংবা ''মুক্তবিহঙ্গ'' তে মাইকেলের বলা -আমি বোধ হয় এতটা খারাপ নই এনি , কি ?
চাই সম্রাজ্যের ভিলেন আল দাউদ যখন বলল - আমার আর কোন আশা নেই । আল দাউদের জন্য তখন খুব খারাপ লাগছিল ।
দারুণ একটা স্বাদ পেয়েছি '' সংকেত পড়ে । আমার খুব পছন্দের বই । প্রতিটা চরিত্রের আকর্ষণীয়তা , আলেকের হিউমার বুদ্ধিমত্তা , রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ , সেক্স সব মিলিয়ে বইটা দুর্দান্ত এক ককটেল।আলেকের ঐ সাইকোলজিটাও ভাল লেগেছিল ।
আলেক মরতে রাজি কিন্তু জেল খাটতে নয় ! আলেক এক হিসেবে বলতে গেলে আরেক মাসুদ রানা । আমার নির্বাচিত মাসুদ রানার সেরা তিনে তাই সঙ্কেত আছে ।
আর হ্যা অগ্নিপুরুষটাও ভাল লেগেছিল ।
মাসুদ রানার প্রথম বই '' ধ্বংসপাহাড় '' এর কাহিনি চট্টগ্রাম বেইজড । এই জন্য আমার গর্ব আর অহঙ্কারের সীমা নাই !! এই বইটা মাসুদ রানার ৫ টা মৌলিক বইয়ের মধ্যে একটা ।
এখানে ষ্টেশন রোডে অবস্থিত হোটেল মিশকার কথা লেখা আছে । বিখ্যাত মাসুদ ভাই এই হোটেলেই উঠেছিলেন !! এখনও হোটেল মিশকার পাশ দিয়ে গেলে অন্যরকম একটা ভাল লাগার
পরশ ছুঁয়ে যায় । ওদের রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে -হেই তোরা কি জানিস তোরা কত বিখ্যাত !! কতজনকে বলেছি এই হোটেল মিশকার কথা !
অনেকদিন পর মুগ্ধ আমি গেলাম কাজিদার সাথে দেখা করতে । সংগে আমার বন্ধু । উনার বাসার দারোয়ান বলল - আপ্নারা বিকালে আসেন ।কিন্তু বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না । ঠিক করলাম পরের দিন আবার আসব ।
হঠাৎ আমার বন্ধু বলল - দোস্ত একটা কথা বলি !
- বল !
- তুই দেখা করিস না ।
- কেন ? আমি অবাক ।
- প্রিয় লেখকের সাথে দেখা করতে নেই । দেখবি দেখা করার পর কষ্ট পাবি ।
কথাটা মনে লাগল । তাই পরে আর ও অনেক বার সেগুনবাগিচা মাড়ালেও তীব্র ইচ্ছেটা নির্মমভাবে পিষে দিতাম । বন্ধুর কথা সেদিন পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন পারি। বাস্তবতার করাত ঘাড়টা কাটার পর ।
আমার প্রিয় লেখক কি জানে একদিন আমি ভাবির সাথে তর্ক জুড়েছিলাম- মাসুদ রানার চেয়ে কুয়াশাই বেস্ট । এর উপরে কিছু নাই !! তখন এস এস সি দিয়ে ফেলেছি ।
পরে ভাইয়া বলল - কুয়াশা হল সুপারম্যান তাই তোর ভাল লাগে । আর কুয়াশার ব্যাপারটা মাসুদ রানাতেও আছে । কবির চৌধুরী ই হল কুয়াশা ।
এখানে নায়ক - ওখানে ভিলেন ।
ভাইয়া হঠাৎ বলল - আমি প্রথম কুয়াশা/ মাসুদ রানা পড়েছি আব্বার সুটকেস থেকে চুরি করে । আব্বা যখন ট্রিপে যেত তখন এসব বই উনার সুটকেসে থাকত ।
ট্রেনে বসে বসে উনি পড়তেন। বাসায় আসায় পর আমি সুযোগমত চুরি করতাম । পড়ে আবার রেখে দিতাম ।
তখন কোন ক্লাসে ছিলেন ? - জিজ্ঞেস করলাম ।
ক্লাস ফোর । ভাইয়ার জবাব ।
হতবাক হয়ে গেলাম । কল্পনাও করিনি -বাবা এসব পড়েছেন !! কি অবস্থা ! সবসময় বাবাকে দেখেছি ইমাম গাজ্জালি , হাফিয , রুমি , গালিব এদের বই পড়তে ।
দুজন একই পিতার সন্তান - অথচ দুইভাইয়ের দেখার কি পার্থক্য !
উড়ে যায় দিনলিপি । মাতাল হাওয়ায় কত উলটপালট । অনেকদিন হল - তিন গোয়েন্দা , মাসুদ রানা , কুয়াশা পড়া হয় না । কুয়াশা সিরিজের সব বই আমি প্লাস্টিক কাভারে মুড়িয়ে ড্রয়ারে রেখেছিলাম । মাঝে মাঝে বইগুলা নিয়ে নাড়তাম - চাড়তাম ।
এবার অনেকদিন ধরা হয়নি । বছরখানেক পর মাস তিনেক আগে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি সব বই বিস্কিটের গুড়ো হয়ে গেছে । জায়গায় জায়গায় প্লাস্টিক ছেঁড়া। কোন ফাকে ইঁদুর সব নাশ করে দিল ।চোখ ফেটে পানি বেরোল।
হায় ! কতবার ভাইয়া বলেছিল - এখন এসব রেখে কি লাভ ! বেচে দে ।
আমি বিক্রি করিনি । কৈশোর বিক্রি করা যায় না । মুখ বুজে থাকতাম - ভাইয়াকে মুখ ফুটে এই কথাটা কখনো বলা হয়নি । খুব হৈ - চৈ করলাম ইঁদুর কিভাবে ঢুঁকে !
তারপর বারান্দায় গিয়ে নীল আকাশের দিকে ......... কিছুক্ষণ পর মা পিঠে হাত রাখলেন ।
- কিরে কিনে নিতে পারবিনা ?
কেনাটা বড় কথা নয় , মা ! - কেবল এটুকু বললাম ।
প্রতিটা বইয়ের পাতায় কভারে আমার কত শত স্মৃতি আঁকড়ে ছিল । সব শেষ । কারেন্ট বুক সেন্টারে কুয়াশা নেই , নুপুর মার্কেটে কুয়াশা নেই । সব শেষ । সব শেষ । একটা সময় পর
কেন সব শেষ হয়ে যায় ! সময়ের চেয়ে বড় নিষ্ঠুর খাদক আর নেই । কারেন্ট বুক সেন্টারের যেখানটায় সেবা প্রকাশনীর বই রাখা হত - সেখানে একটাও সেবার বই নেই । এখন ।
নিষ্ঠুর সময় সব স্মৃতি করে দেয় । স্মৃতিরাও একসময় বাসি হয় । তার উপর ধুলো পড়ে । ধুলো সরালে দেখা যায় কিছু অংশ একদম শুন্য হয়ে গেছে । ফাঁকা ।
ওরা বোধ অচিন পাখি হয়ে উড়াল দেয় ।অসীমে চলে যায় । থেকে যায় দীর্ঘশ্বাস , হাহাকার । তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো .......
যেমন- বাবার কথা মনে পড়লে একটা সাদা দেয়াল দেখি । সফেদ দেয়ালে মিশে বাবা আমার একলা বাবা ।