সবমিলিয়ে ফারিয়ার জীবনটা ফুলের মতই কেটে যাচ্ছিল।কিন্তু নিয়তিদেবীর বোধহয় ওর সুখটা সহ্য হয়নি।এসএসসি পরীক্ষার বন্ধে ফারিয়া বাবার সাথে প্রায়ই বেড়াতে যেতো।একবার বাবা তার বন্ধুর অসুস্থ বড়ভাইকে দেখতে গেল।ডাক্তার বলে দিয়েছেন লোকটার মাথায় যে টিউমার টা হয়েছে তা অপারেশন করলে বাচার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি।ফারিয়ার মায়ামেশানো শান্তনায় লোকটার চোখ ভিজে উঠল।মেয়েটিকে দেখে তার মনে ক্ষুদ্র একটি স্বাদ জেগে উঠল।মারা যাবার আগে তার ছেলের বউ হিসাবে মেয়েটিকে পেলে তার একটা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতো।তাই তিনি ফারিয়ার বাবার হাত ধরে অশ্রুসজল চোখে আকুল অনুরোধ জানালেন।একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আকুল অনুরোধ ফেলার মতো মানসিক শক্তি ফারিয়ার বাবার ছিল না।অনেকটা emotional blackmailed হয়েই তিনি তার ১৫ বছরের মেয়ে ফারিয়ার বিয়েতে মত দিয়ে দিলেন।ফারিয়ার বাবা এককথার মানুষ।কারো কথাই কানে তুললেন না।বাবার বাধ্যগত মেয়েটা একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারন করল না।বাসর রাতেই মেয়েটি জানতে পারলো ছেলেটাকেও জোর করে বিয়েতে রাজি করানো হয়েছে।সে অন্য একটা মেয়েকে ভালবাসতো।ঘটনা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলে একটা কথা ছিল।বিয়ের একমাস পর ফারিয়ার শ্বশুরের অপারেশন হল।সবাইকে অবাক করে দিয়ে অপারেশন সাকসেসফুল হল।বিয়ের পর ফারিয়া যেমনি থাকুক ছেলেটা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না।ফারিয়া সব মুখ বুঝে সহ্য করছিল।কিন্তু ছেলেটা যখন হাত তোলা শুরু করল তখন নিজেকে মানাতে পারলো না।যে লোকটার আকুল অনুরোধে বিয়েটা হয়েছিল সেও এগিয়ে এলো না।ফলশ্রুতিতে বিয়ের মাত্র ৮ মাস ১৩ দিনের মাথায় সেপারেশন হয়ে গেল।ফারিয়ার বাবা বিয়ের কিছুদিন পরেই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন।কিন্তু বিয়ের পর মেয়ের দুরবস্থা দেখে তার ভেতরটা যেন অনুশোচনায় পুড়ে যাচ্ছিল।এই দুঃখের কথা তিনি কাকে বলবেন।কিন্তু তার মেয়ের যে সেপারেসন হয়ে যাবে তিনি তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।ডিভোর্স হবার পর একরাতে মেয়েকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন।ভোর বেলা উঠে ফারিয়াকে দেখতে চাইলেন।কেন জানি মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল।কিন্তু মাথার প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি সেটা পারছেন না।একটা সময় ফারিয়াকে বুকে নিতে পারলেন।তারপর সব যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল...... ওইদিন ভোর ৬টায় ফারিয়াকে বুকে নিয়েই তিনি মারা গেলেন।ফারিয়া টু শব্দটি পর্যন্ত করল না।অধিক শোক তাকে পাথর করে দিয়েছিল।
এরপর থেকে ফারিয়া আশ্চর্য রকমের শান্ত হয়ে গিয়েছিল।যে মেয়ে একসময় পুরো বাড়ি একাই গরম করে রাখতো এখন সে থাকলেও বাড়িটা শ্মশানের মতো নিশ্চুপ মনে হয়।যে মেয়ের এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি সেই মেয়ে কিনা ডিভোর্সড।ফারিয়া আস্তে আস্তে নিজেকে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো।অনেক ভিড়ের মাঝেও তার একাকীত্ব প্রকট হয়ে উঠল।কিন্তু জীবনতো আর থেমে থাকে না।নিয়তির নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় ছক কেটে তার জীবনটা কেটে যাচ্ছিল।এতো কষ্টের মাঝেও পড়াশুনা,কোচিং চালিয়ে গেল।এই দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়ে গেছে তারই সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী মাধবী।ও ফারিয়াকে পাগলের মত ভালবাসত।এই একটা মানুষের কাছেই ফারিয়া তার জীবনের সব কিছু শেয়ার করতো।আর এজন্যই হয়তো নিয়তি-দেবীর চোখ পরল মাধবীর উপর।একসকালে উঠে ফারিয়া শুনল বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাগ করে মাধবী সুইসাইড করেছে।
মাধবীর মৃত্যুর পর ফারিয়া অনেক ভেঙ্গে পরল।কোনকিছুতেই আর আগ্রহ পেত না।ফারিয়ার শান্ত জীবনে ঠিকতখনই ঝড়ের মত হাজির হল নাহিয়ান।উদ্ভিদবিজ্ঞানের নোট জোগাড় করতে গিয়ে তার সাথে পরিচয়।ছেলেটা দেখতে আহামরি টাইপ কিছু না।নিজেই আগ্রহ করে ওর সাথে পরিচিত হল।একটা সময় সে ফারিয়ার বেস্টফ্রেন্ডে পরিনত হল।মাধবীর পর এই প্রথম কোন বন্ধুকে জীবনের সব কাহিনী আগাগোড়া কাহিনী খুলে বলল সে।ঠিক ৩ মাস ১৪ দিন পর এক গভীর রাতে ফারিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে প্রপোজ করলো নাহিয়ান।ফারিয়া সে রাতে কোন জবাবই দিতে পারেনি।তার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিল।একটা মানুষ তার জীবনের সবকিছু জেনেও তাকে ভালবাসতে পারে তা তার ধারনা ছিল না।
ফারিয়া যেন নিজেকে নতুন করে খুজে পেল। পরের একটা বছর সে যেন স্বপ্নের ঘোরে কাটিয়ে দিল।নাহিয়ান তাকে শেখাল কিভাবে ভালবাসতে হয়।কিছুদিন পর নাহিয়ান স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন গেল।কিন্তু তাদের ভালবাসাটা নিউটনের সুত্র মানেনি।বরং দূরত্ব বেড়ে গিয়ে তাদের ভালবাসাটা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।প্রতিটা দিন তাদের কথা হতো।সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলছিল।কথা ছিল দেশে ফিরেই তাদের বিয়ে হবে।ফারিয়া সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।কিন্তু দেশে ফেরার পর অদ্ভুত কারনে নাহিয়ান আর ওর সাথে যোগাযোগ করলো না।নাহিয়ানের মত একটা ছেলে এমন কাজ করতে পারে ফারিয়া সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি।৭টা দিন কার সাথেই কথা বলতে পারল না সে।পুরনো সেই একাকী পৃথিবীতে ফিরে আসলো সে।নাহিয়ান যদি একবার তার সামনে এসে বলতো তাকে আর ভালবাসে না তাহলেও ওর কোন দুঃখ থাকতো না।যে মানুষটা তাকে নতুন পৃথিবীর সন্ধান দিয়েছিল আর সেই মানুষটাই তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নরকে ফেলে গেলো।ফারিয়া অনেক ভেবে দেখল... নাহিয়ান আসলে তাকে কখনই ভালবাসেনি।তার ভালবাসাকে ব্যবহার করে প্রেমের সুধাটাই শুধু পান করেছে।ফুলের মধুটাই শুধু খেয়ে গেছে...কিন্তু যাবার বেলায় ফুলটা ফেলে গেছে।
আর কেউ হলে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতো।কিন্তু হেরে যাবার জন্য ফারিয়া জন্মায়নি।মনের কষ্টটা পাথরচাপা দিয়ে পড়াশুনাটা চালিয়ে গেল।একটা সময় মধ্যবিত্ত পরিবারের হাল ধরার জন্য একটা পার্ট টাইম জব জোগাড় করে ফেলল।যেখানে শুধু সেই একমাত্র মেয়ে।নিজেকে বাচাতেই হয়তো সে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলল।অফিসের সবার কাছে সে একটা রুক্ষ আর খিটখিটে স্বভাবের মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেতে সময় লাগলো না।সবাই ওর সাথে দূরত্ব বজায় রাখতো।সবসময় রাগী মানুষের মুখোশ পরে থাকতে তার একটুও ভাল লাগতো না।বাসায় ফিরেই সেই মুখোশ ঝেরে ফেলে সেই আদুরে ফারিয়ার মতো মাকে জড়িয়ে ধরতো।এখন এই মা-টাই তার সব।
এখন মেয়েটা স্বপ্ন দেখে।তবে এবারের স্বপ্ন কঠিন বাস্তবের।নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে মায়ের দুঃখ দূর করার অদম্য বাসনা নিয়ে।আর ভালবাসা?ভালবাসার পিছনে ফারিয়া আর কখনই দৌড়ুবে না।বরং এবার ভালবাসারই দায়িত্ব তার পিছনে দৌড়ুনোর।জীবনের প্রতিটি ধাক্কা তাকে এখন প্রতিটা ক্ষনে উৎসাহ যোগায়।কোন বাধাই তাকে বিচলিত করে না।এখন সে স্বপ্ন দেখে একজন সুযোগ্য আর্মি অফিসার হতে।সেই স্বপ্নের কাছে পৌছুতে পথ আর বেশি বাকি নেই।জীবনযুদ্ধের সকল বাধা পেরিয়ে আসা এই মেয়েটার জন্য আমরা কি পারিনা পরমকরুনাময় আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করতে?
(কারো প্রতি মায়া থাকলেও এটা সরাসরি প্রকাশ করাটা আমার নীতিবোধের মধ্যে পরে না।এই গল্পের ২০ বছর বয়সী ফারিয়ার জন্য যথেষ্টই মায়া বোধ করছি।হয়তো এজন্যই এতো ব্যস্ততার মধ্যেও লেখাটা লিখেছি। অচেনা বালক )