মনটা আমার অনেক ভাল থাকার কথা।অনেক কষ্টে ৭ দিনের ছুটি পেয়েছি।ভেবেছিলাম লাবনীকে নিয়ে বেড়াতে যাব নীলগিরিতে।কিন্তু ওর হঠাৎ ওর কার্ড-ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিয়ে দেয়ায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।বেচারি অনেক কান্নাকাটি করলো।ওর ছুটির অভাব হয় না আর আমি ছুটিই পাই না।অথচ এবার হয়েছে উল্টো।অগত্যা ঢাকায় পুরনো দোস্তদের সাথে দেখা করার জন্য রওনা দিলাম।যেয়ে দেখি সবাই এত ব্যস্ত যে দেখা মেলাই ভার।অতএব শেষ সম্বল ইন্টারনেট।ইনবক্স খুলে দেখি একজন ছেলে খুব করে অনুরোধ করেছে তার বিরহের কাহিনী লিখে দিতে।মেজাজ এমনিতেই খারাপ...তার উপর এসব বিরহের কাহিনী লিখে মন খারাপ করতে চাইলাম না।একটু পর দেখি সে তার কাহিনীর জিস্ট টা লিখে পাঠিয়েছে।কাহিনীটা ইন্টারেস্টিং মনে হওয়াতে তাকে ফোন নম্বর দিলাম।তার কাহিনীটা তার মুখেই শুনুন......
‘’’’পিয়াকে আমি সেই ছোট বেলা থেকেই চিনি।খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকায় আমরা থাকতাম।ওর বাবা আর আমার বাবা দুজনেই মংলা পোর্টে চাকরি করতেন। আশেপাশে সমবয়সী কোন ছেলে না থাকায় ওই ছিল আমার খেলার সাথী। সারাদিন মারামারি,খুনসুটি লেগেই থাকতাম।ও ছিল বন্ধু আবার শত্রুও।দুজনে একসাথে দোলনা চলতাম।দুপুরে মারামারি আবার রাতে মিটমাট।একবার ওর চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দেয়াতে ও আমার শার্টে চুলকানির পাউডার লাগিয়ে দিয়েছিল।আমাদের দুই বাসার সবাই আমাদের টম এন্ড জেরি ডাকতো। একবার ওকে শাঁকচুন্নি বলাতে আমার সাথে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল।তখন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ভাইভার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।শত চেষ্টাতেও ওর রাগ আর ভাঙ্গাতে পারলাম না।এরমধ্যে আমি ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে গেলাম।যাওয়ার আগের দিন খুব কান্না পাচ্ছিল পিয়ার কথা ভেবে।আমি ক্যাডেট কলেজে চলে যাচ্ছি,অথচ ওর কোন বিকার নেই।সারাটা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারলামনা।পরদিন ভোরে বাসার সামনে দোলনায় গিয়ে বসলাম।হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে দেখি পিয়া দাড়িয়ে আছে।আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ও এমন ভাবে কেদে উঠল যে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।পিয়া আমাকে কাদতে কাদতে বলল...তোমার সাথে আর কখনো খারাপ ব্যবহার করব না...তুমি ওখানে ভর্তি হইয়ো না।সেদিনই টের পেয়েছিলাম পিয়া আমাকে কতটা ভালবাসে।
ক্যাডেট লাইফের জন্য পিয়াকে কখনও ঠিকমতো সময় দিতে পারিনি।অল্প কদিন ছুটি কাটিয়ে কলেজের ফেরার সময় ওর ছলছল চোখ আমার মনটাকে বিদ্রোহী করে তুলত।ছুটিতে এসে দু-একবার ওকে নিয়ে বেরুনোর সুযোগ হতো ।তখন সে একনাগাড়ে বকবক করতে থাকতো,আর আমি মুগ্ধ নয়নে তার কাজলকাল চোখগুলোর মাঝে হারিয়ে যেতাম।এইচএসসির পর ক্যাডেট কলেজের কারাগার থেকে মুক্ত হলাম।দুজন একসাথে ঢাকায় কোচিং করতে আসলাম।এর পরের ২ মাস আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা সময় কাটিয়েছি।৫ বছরের প্রেমে যা করিনি এই দুমাসে তা করে ফেললাম।ঢাকার টিএসসি,আশুলিয়া সহ সব জায়গা চষে ফেললাম।ফলাফল যা হবার তাই হল।দুজন কোথাও চান্স পেলাম না।শেষপর্যন্ত আমার ক্যাডেট কলেজ ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় আর্মিতে চান্স পেয়ে গেলাম।আর ও ভর্তি হল ইব্রাহিম মেডিক্যালে।
আর্মিতে লং কোর্সে ঢুকে আবার জীবনটাকে পুনরায় কারাগারে বন্দী করতে ইচ্ছা করল না।কিন্তু আর কোথাও না চান্স না পাওয়াতে আর্মিতেই যেতে হল।বিএমএতে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় ৩ মাস ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না।পরবর্তী সময়ে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে ৪-৫ মিনিট কথা বলার সুযোগ হতো।ওকে সময় দিতে না পারলেও ও আমার কষ্টটা পুরোটাই অনুভব করতো।পুরো সপ্তাহ জুড়ে বিএমএ এর কঠিন ট্রেনিং এর তাণ্ডবলীলায় যখন হতাশ হয়ে পরতাম,তখন পিয়ার ৫ মিনিটের অল্প কিছু কথাই আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতো।
একবার ভ্যালেন্টাইন ডের দিন ফোন করে পিয়ার সেকি কান্না।ভেবে দেখলাম ওর কান্না অর্থহীন নয়...ওর সাথে আমার ৭ বছরের প্রেম অথচ একবার ওর সাথে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করিনি।৩ মাস পরের ৭দিনের ছুটি যেন নিমিষেই পার হয়ে যেত।ফিরে যাবার বেলায় ও আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে একটু পরেই ভাইয়ার ফোনে আমাকে চাইত।ফোনে আমার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলত কিন্তু আমি ঠিকই টের পেতাম তার নিঃশব্দ কান্নাটা।শুধু টের পেতাম তার কাদতে কাদতে তার কণ্ঠস্বর ‘নাকি’ হয়ে গেছে।
ট্রেনিং এর এক বছরের মাথায় ২১ দিনের ছুটি পেয়ে ওকে নিয়ে হাজারটা প্ল্যান করলাম।ঢাকা এসেই রাতে এক্স-ক্যাডেটদের পুনর্মিলনীতে গেলাম।পিয়ার জ্বর থাকায় যেতে পারল না।দুদিনপর আমার হাঁটুর চিকিৎসার জন্য বাবা জোর করে কলকাতায় নিয়ে গেলেন।দুদিনপর ট্রেনিং এ চলে যাবার সময় ওকে ফোন দিলাম।ফোন ধরল না।কিছুটা অবাক হলাম।কিন্তু আমাকে বিদায় দিতে যখন বাস ষ্টেশনে আসলো না,তখন বুঝতে পারলাম...সামথিং ইজ রং।কিন্তু বিএমএতে গিয়ে প্রতি সাপ্তাহে ওকে কতো ফোন দিলাম।আমার কণ্ঠ শুনেই ফোন রেখে দিতো।বিএমএ ট্রেনিং এর ওই সময়টাই সবচেয়ে কঠিন। আর ওই কঠোর দিনগুলোতেই পিয়াকে কাছে পেলাম না।পুরো ৩টা মাস আমি ওর রাগের কারন খুঁজতে খুজতে দিশেহারা হয়ে গেলাম। ৩মাস পর ছুটিতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম।কিন্তু ও দেখা করল না।পরে আমার কাজিনের কাছে শুনলাম আসল কাহিনী।আমি যে এক্স-ক্যাডেটদের পুনর্মিলনীতে গিয়েছিলাম সেখানে অনেক ছবি তুলেছিলাম।অনেক ভিড়ের মাঝে গার্লস ক্যাডেটের একটা মেয়ে আমার সাথে কিছু ছবি তুলেছিল।মেয়েটা আমাদের রেটিনায় আমাদের ব্যাচেই কোচিং করতো।দুদিন পর সে ছবিগুলো ওয়াশ করে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এখানে বলে রাখি আমাদের বাসায় সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জানত।ফুপ্পি আমার ছবিগুলো সব ওর কাছে পাঠিয়ে দিল।ছবিগুলো দেখে পিয়া হয়তো কিছুটা মাইন্ড করল।ঘটনাটা এতোটুকু হলে সমস্যা ছিল না।আপনারা অনেকেই জানেন বিএমএতে ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যবহার করা যায় না।তাই আমার নিজের মোবাইলটা পিয়ার কাছেই থাকতো।সেই মেয়ে ছবি পাঠানোর ৩ দিন পর আমার মোবাইলে ফোন করে আমাকে চাইল।এরপর থেকে বিভিন্ন রোম্যান্টিক ম্যাসেজ পাঠাতো।একদিন মেসেজে লিখেই ফেলল...আমি জানি তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো...।সেদিনই পিয়া আমার এন৯৫ সেট টা আছাড় দিয়ে নষ্ট করে ফেলল।
২০১০ সালের জুন মাসে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে কমিশন পেলাম।ওইদিন সবাই যখন অফিসার হবার আনন্দে ভরপুর,তখন আমার দুচোখ খুজে বেড়াচ্ছিল পিয়াকে।এখন সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকি যে নিজের কথাই ভাবার সময় পাই না।তবুও রাতের বেলা যখন ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেই তখন আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ওকে অনুভব করি।চোখের সামনে ভেসে উঠে দোলনায় বসা পিয়ার ছবি...পিয়ার পিছনে আমি দাড়িয়ে দোলনায় দুলুনি দিচ্ছি...অথচ বাস্তবের দোলনায় পিয়াই আমাকে পেছন থেকে দুলুনি দিত।ওর ধাক্কা না পেলে কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারতাম না।এসব সবই এখন শুধুই স্মৃতি।পিয়া হয়তো তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে।কিন্তু তাতে কি?সেতো আর আমার নয়।অথচ কতবার তার ভুলটা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছি।
২০১১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমি ছুটি পেয়েছিলাম।ক্যাডেট কলেজ আর বিএমএ এর জন্য কোন ভ্যালেন্টাইনই পিয়াকে দিতে পারিনি।আজ ভ্যালেন্টাইন ঠিকই পেলাম,কিন্তু পিয়া আজ পাশে নেই...আমার নিয়তি বোধহয় অনেক রসিক...এজন্যই হয়ত এভাবে আমার সাথে রসিকতা করল...’’’’
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
গল্পের নায়কের কাছে এতটুকুই শুনেছি।কিন্তু এই কাহিনী লিখে সবার মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে করছিল না।ঢাকার উত্তরার গ্রিনল্যান্ড হাসপাতালে ১ বছর চাকরী করেছিলাম।ছুটিতে ঢাকা গেলে প্রায়ই এখানে আড্ডা মারি।ওই ছেলেটিকে ওখানে আমার সাথে দেখা করতে বললাম।ওখানেই ছেলেটির কাহিনি বিস্তারিত শুনলাম।ছেলেটার মুখটা দেখে সত্যি মায়া লাগছিল।হয়তো এজন্যই ওর জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছা হল।সেই ইচ্ছা থেকেই একটা উপায় বের করলাম।ছেলেটার কাছথেকে নম্বর নিয়ে পিয়াকে ফোন করে বললাম......গ্রিনল্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউ থেকে বলছি।এখানে একটা ছেলে ভর্তি আছে।ওনার পকেটে আপনার নম্বর ছিল।আপনি জরুরী ভিত্তিতে আসুন...। নিজের চাপায় নিজেই মুগ্ধ হলাম...কতটুকু কাজে দিবে কে জানে।ছেলেটাকে সত্যি সত্যি আইসিইউ রুমে পাঠিয়ে দিলাম।
ঠিক ২২ মিনিট পর একটা হলুদ ক্যাব থেকে একটা মেয়ে নামলো।দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী...অনেকটা সোহা আলি খানের মত দেখতে।মেয়েটা হতদন্ত হয়ে চোখ মুছতে মুছতে জরুরী বিভাগে ঢুকে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো।এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।সেটা বুঝতে পেরেই ডিউটি ডক্টর মারুফ ভাই এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন...কাকে চাই?এরপর আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম রোগী আপনার কি হয়,তখন সে যেন শক খাবার মত চমকে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।মারুফ ভাই গম্ভীর মুখে বললেন যে আইসিইউতে রোগীর আত্মীয়স্বজন ছাড়া কাউকে রোগী দেখতে দেয়া হয় না।মেয়েটি হাউমাউ করে কেদে উঠে আমাদের চমকে দিয়ে বলে উঠল… আমি ওকে ভালবাসি।মারুফ ভাইতো কম জাননা...তিনিও মুখটা বাঁকা করে বললেন...সত্যিই ভালবাসেন?পিয়া তখন কেদেই যাচ্ছিল।এরকম নিস্পাপ চেহারার একটা মেয়ে কান্না সহ্য করা পৃথিবীর কারো পক্ষেই সম্ভব না।আমি তখন বিড়বিড় করে বলে উঠলাম...পিয়া রাফিকে এতোটা ভালবাস্...তারপরও কষ্ট দিলে কেন...।পিয়া আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।ধরা খাবার ভয়ে তাড়াতাড়ি পিয়াকে নিয়ে আইসিইউর দিকে পা বাড়ালাম।আইসিইউর ভিআইপি রুমে পিয়াকে প্রবেশ করিয়েই আমরা বাইরে চলে এলাম।পুরো একটা মিনিট কোন সাড়াশব্দ পেলাম না।একটু পর পিয়ার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনে আমি আর মারুফ ভাই ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলাম।গ্রিনল্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউআর ভিআইপি কেবিনটা এখন শুধু পিয়া আর রাফির... পৃথিবীর কোন মানুষের অধিকার নেই তাদের বিরক্ত করার।আজ শুধু ওরা দুজনই প্রেম দেবতার পুজো করবে...
আজ ১৩ই ফেব্রুয়ারি।৭ দিন ছুটি কাটিয়ে কুমিল্লা যাচ্ছি।ঢাকা এসেছিলাম মন খারাপ নিয়ে আর ফিরছি অমিয় প্রশান্তি নিয়ে।ভাবছি পিয়া আর রাফির কথা।ওরা আগামীকাল তাদের ১ম ভ্যালেন্টাইন পালন করবে।৩-৪ মাস পর তাদের এনগেজমেন্ট হবে।পিয়া সাফ বলে দিয়েছে আমি আর মারুফ ভাই ছাড়া নাকি অনুষ্ঠান হবে না।আমিও ঠিক করেছি,পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিনা কেনো...এই জুটির বিয়েতে আমি ছুটে আসবই!