তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ
ইসলাম একটি প্রাকৃতিক ধর্ম। অতএব ইসলামের বিবেচনায় এ বিষয়টি রয়েছে যে স্বামী স্ত্রীর মাঝে কখনো মীমাংসা-অযোগ্য দুরত্বের সৃষ্টি হতে পারে। এরূপ হলে ইসলাম তাদেরকে তালাকের মাধ্যমে বিয়ের পরিসমাপ্তি ঘটানোর অনুমতি দেয়। যদিও অন্যান্য সমাজ ও ধর্মে এই বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমোদন রয়েছে। তবে ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের পন্থা খুব স্বতন্ত্র। তা খুব মানবিক ও স্বাভাবিক পন্থায় সমস্যার সমাধান দেয়। প্রথমত, এটি স্বামী ও স্ত্রীকে তাদের বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য বহু সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। দ্বিতীয়ত, যদি তালাক অপ্রত্যাখ্যানযোগ্য হয় তবে তা স্বামী ও স্ত্রী উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
কোরান মাজিদের নির্দেশনা
আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন। (আন-নিসা, ৪:১৯)
প্রত্যেক পুরুষেরই কিছু মানবিক দুর্বলতা রয়েছে। নারীর ক্ষেত্রেও তা সমান সত্য। এই আয়াত আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যদি একজন স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে কিছু দুর্বলতা অপছন্দ করে তবে তার নিজের দুর্বলতাগুলির দিকে তাকানো উচিত। এতদসংক্রান্ত কিছু আয়াত ও হাদিস ইতোপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। এসব কিছুই আমাদেরকে আমাদের স্ত্রীদের সাথে ভালবাসা ও হৃদ্যতার সাথে বাস করার এবং তাদের মানবিক দুর্বলতাসমূহকে গ্রহণ করে নেয়ার শিক্ষা দেয়। যদি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে দুরত্ব খুব বেশি হয়, কোরান মাজিদ আমাদেরকে চুড়ান্ত তালাক প্রদানের পূর্বে সালিশ নিয়োগের মাধ্যমে তা সুরাহা করার উদ্যোগ নিতে আদেশ প্রদান করেছে।
আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।
পারিবারিক অসঙ্গতি নিরসনের জন্য ইসলাম পুরুষের মত নারীদেরকেও সমান অধিকার প্রদান করে। তাদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে সালিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে উভয়ের সমান অধিকার রয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, এই সালিশ বা মধ্যস্ততাকারী নিয়োগ নারীদের ঋতুচক্র শেষ হওয়ার পর করতে হবে। যদি স্ত্রীর ঋতুচক্র চলাকালীন সময়ে দুরত্ব সৃষ্টি হয় তবে উভয়কে তার চক্র শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তা উভয়ের মধ্যে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার একটি অবকাশ প্রদান করে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের একজন নিজের ভুল বুঝতে পারে। এতে করে নিজে নিজেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা সৃষ্টি হয়।
যদি উভয়ের মধ্যে দুরত্ব বাড়তে থাকে কিংবা স্বামী নরম না হয়, তবে কোরান মাজিদ তালাকের একটি দীর্ঘমেয়াদী কার্যপ্রণালী অনুসরণের নির্দেশনা দেয়। তা এটি নিশ্চিত করার জন্যে যে, যাতে স্বামী অসুবিধায় পড়ে কিংবা রাগান্বিত অবস্থায় তালাক প্রদানের পথ বেছে না নেয়।
হে নবি! (বল), তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তাদের তালাক দাও এবং ইদ্দত হিসাব করে রাখবে এবং তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় করবে। (আত-তালাক, ৬৫:১)
এই আয়াত থেকে একথাটি পরিষ্কার হয় যে, তালাক কেবল নির্দেশিত সময়ের পরেই প্রদান করা যেতে পারে। অন্য কথায়, স্ত্রীকে তালাক প্রদানের পূর্বে স্বামীকে অপেক্ষা ও শান্ত হওয়ার জন্যে একটি সংক্ষিপ্ত সময় পার করতে হবে। কোরান মাজিদ অপেক্ষার এই সময়কে খুব পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে- আর তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন কুরূ (ঋতুচক্র কাল) পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবে। (আল বাকারা, ২:২২৮)
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা ঋতুবর্তী হওয়ার কাল অতিক্রম করে গেছে, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা যদি সংশয়ে থাক এবং যারা এখনো ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি তাদের ইদ্দতকালও হবে তিন মাস। আর গর্ভধারিনীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন। (আত-তালাক, ৬৫:৪)
সকল ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, স্ত্রীর ঋতুচক্র চলাকালীন সময়ে তালাকের ঘোষণা দেয়া যাবে না। স্ত্রী পবিত্র হওয়া পর্যন্ত স্বামীকে অপেক্ষা করতে হবে। স্ত্রী পবিত্র হওয়ার পর স্বা, যখন সে তাকে তালাক দিতে পারবে। সে তখন তালাকের ঘোষণা দিতে পারে। এখন তাকে অবশ্যই স্ত্রীর সাথে তিনিটি মাসিক ঋতুচক্র শেষ হওয়া পর্যন্ত যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে হবে। আর এই সময়কালে উভয়েই একই ঘরে বসবাস করা আবশ্যক। ইসলাম এভাবে তালাকের প্রক্রিয়াকে একটি দীর্ঘমেয়াদী, শ্লথ ও মানবিক রূপদান করেছে। এমনটি সম্ভব যে, যখন স্ত্রী একটি কিংবা দুটি ঋতুচক্র পার করবে স্বামী তার প্রতি নরম হবে এবং তার সাথে যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে। এটি উভয়ের মাঝে একটি স্বয়ংক্রিয় সমঝোতা নিয়ে আসবে এবং তাদের বিয়েকে রক্ষা করবে। অধিকন্তু, যদি স্বামী এই ঋতুচক্রকালীন সময়ের মধ্যে যে কোন সময় স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চায় তবে সে ফিরিয়ে নিতে পারবে। যদি একবার তিন চক্র শেষ হয়ে যায় তবে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং একজন আরেক জনের সাথে বাস করতে পারবে না। এর পরে যদি সে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে নিতে চায় তবে তাকে নতুনভাবে আকদে নিকাহ করতে হবে। কোরান মাজিদ দুই বারে তালাক দেয়ার সুযোগ প্রদান করে, তৃতীয়টি হবে চুড়ান্ত তালাক।
তালাক দুবার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে অথবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। (আল বাকারা, ২:২২৯)
যদি স্বামী তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয় তবে সে তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারে না। স্বামী তার এই বিগতা স্ত্রীকে বিয়ে করার একমাত্র উপায় হল যে, এই নারী অন্য কোন পুরুষের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং এই দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তালাক প্রদান করবে। তখনই কেবল পূর্বের স্বামী তাকে বিয়ে করতে পারবে। এধরনের পরিস্থিতি নিতান্তই দুর্লভ। এভাবে ইসলাম তালাক প্রদানকে জীবনের একটি গুরুতর বিষয়ে পরিণত করেছে। তা একজন স্বামীকে তার স্ত্রীর সাথে সমঝোতা করার সকল সম্ভাব্য সুবিধা প্রদান করে। তা তার মেজাজ শীতল করার এবং একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যাপ্ত সময়ও প্রদান করে। একজন স্বামীকে তালাকের গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে সচেতন থাকতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি তালাক প্রদানের জন্যে চরমভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তাকে সঠিক ও বৈধ তালাক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য একজন বিজ্ঞ মুফতির সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।
নারীদের অধিকার আরও বেশি সুনিশ্চিত করার জন্যে কোরান মাজিদ বলে যে, তালাকের শব্দ কমপক্ষে দুজন স্বাক্ষীর সামনে উচ্চারণ করতে হবে।
অতঃপর যখন তারা তাদের ইদ্দতের শেষ সীমায় পৌঁছবে, তখন তোমরা তাদের ন্যায়ানুগ পন্থায় রেখে দেবে অথবা ন্যায়ানুগ পন্থায় তাদের পরিত্যাগ করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ন দুজনকে স্বাক্ষী বানাবে। (তালাক, ৬৫:২)
কোরান মাজিদ আমাদেরকে আরও শিক্ষা দেয় যে, তিক্ততা, ক্রোধ ও বিদ্বেষের মধ্যে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিৎ নয়। যা বর্তমানে পশ্চিমা সমাজে খুবই সাধারণ ব্যাপার।
উপরোল্লেখিত আয়াতটি খুব পরিষ্কারভাবে বর্ণনা দেয় যে, স্বামীদের উচিৎ তাদের স্ত্রীদেরকে কৃপা ও অনুগ্রহ সহকারে যেতে দেওয়া। অন্য আয়াতে এই নির্দেশনাটি পূণর্ব্যক্ত হয়েছে:
আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছবে তখন তোমরা তাদেরকে বাধা দিয়ো না যে, তারা তাদের স্বামীদেরকে বিয়ে করবে যদি তারা পরস্পরে তাদের মধ্যে বিধি মোতাবেক সম্মত হয়। এ উপদেশ তাকে দেয়া হচ্ছে, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এটি তোমাদের জন্য অধিক শুদ্ধ ও অধিক পবিত্র। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। ( )
কোরান মাজিদ আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে বলে যে, স্বামীরা সেসব সম্পদ স্ত্রীদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। যা তারা তাদের স্ত্রীদেরকে প্রদান করেছিল। এই কাজকে হারাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে:
আর তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেবে। তবে উভয়ে যদি আশঙ্কা করে যে, আল্লাহর সীমারেখায় তারা অবস্থান করতে পারবে না। (আল বাকারা, ২:২৩৫)
হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিস হবে। আর তোমরা তাদেরকে আবদ্ধ করে রেখো না, তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে কিছু নিয়ে নেয়ার জন্য, তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে বসবাস কর। আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যান রাখবেন। (নিসা, ৪:১৯)
মূল : ড. মাজহার ইউ কাজি
বাংলা অনুবাদ : মাওলানা ফয়জুল্লাহ মুজহিরি
সম্পাদনা : ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক