******
সোহাগ ভাই দুরন্ত এক ঝড় বৃষ্টির রাতে শেফাদের বাড়িতে এসে হাজির হল। গত ফাল্গুনে শেফারা এই নতুন বাড়িটায় উঠেছে। এর আগে পূর্ব দিকে মাটির দোতলা বাড়িটায় থাকতো ওরা। মোটা মোটা হাতির পায়ের মত দেয়াল। উঠোনে ইঁট সুরকি ফেলে রাস্তা করা। উঠোন পেরিয়ে পুকুর ঘাটে যাওয়া যায়। শেফার বড় ভাই বাবু। বাড়ির সব বড় ছেলে, ছোট ছেলে, একমাত্র ছেলেদের নাম বাবু হবে এটা অলিখিত নিয়ম। বাবুর বাপকেও তাদের দাদী বাবু বলেই ডাকতো।
মজার ব্যাপার শেফাদের দুটো দাদী। ছোট দাদী বেশিই ভাল। শেফা আর বাবুকে দুপুরে খাওয়ার পর নিজের বিছানায় লাফালাফি করতে দেয়। বালিশ দিয়ে মারামারি খেলার সুযোগ দেয়, তারপর মাঝে মাঝেই মিষ্টি জর্দা দিয়ে একটুকরা পান ছোট্ট গালে ঢুকিয়ে দেয় দাদী। ইশ সেদিন যে কি ভাল কাটে শেফাদের!
দাদীর খাট টা অনেক বড়। দুটো চারটা শেফা বাবু ইচ্ছেমত উলোট পালট করে শুলেও একটু জায়গাও কমবেনা। গাঢ় জাম রঙের খাট, মাথার দিকে বিশাল এক আয়না লাগানো। আয়নার পারদ প্রায় চটা চটা হয়ে উঠে গেছে।
বাবুর মাথায় চুলকানী হওয়া ধরেছিল, সারাদিন সময় নেই অসময় নেই খালি ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথা চুলকাতে দেখে শেফার মা রেহালা বেগম দু'টাকায় নতুন ব্লেড কিনে জোর করে মাথা কামিয়ে দিয়েছেন। তবে মাথায় এখনো কোনো কোনো জায়গায় খাবলা খাবলা চুল। বাবু পুরো চুল ঠিকভাবে কাটতে দেয়ার মত সুশীল ছেলে না!
বেগুনী রঙের ওষুধ গুলিয়ে বাবুর মাথায় লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ছোট দাদীর খাটের সাথে লাগানো আয়নায় বাবু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে তার নতুন চেহারার মাথাটকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়েও খুব একটা সুবিধে হচ্ছেনা।
শেফার আবার উপর পাটির বাম কোনার একটা দাঁত কদিন থেকেই নড়ছিল। মা কে ভয়ে বলে নাই। এখন নাকি দুটো দাঁত বের হবে। আশঙ্কায় শেফার সারাদিন মাটি হয়ে গেছে। কুকুর দাঁত বাহির হলে তাকে কেমন অদ্ভুত দেখাবে তা একটু আগেই নাক মুখ বাঁকিয়ে বাবু বুঝিয়ে বলেছে।
দু'জন মিলে আয়নায় ঠেলা ঠেলি করে নিজেদের দেখতে ব্যস্ত।
খাটের ঐ কোনায় বসে ছোটদাদী সুপারি চিকন করছে।
- ও বাবুলাল তোর মাথার চুলগুলা কি করলি দাদা? তোর মায়েরে একখান কাম করতে ক!
- কি কাম দাদী?
- চুল গুলারে ছায়ের গাদার ধারে পুঁইতা দিতে ক। দেখবি চুলের গাছ বাইরাইবো। তখন পুঁই শাকের লাহান তোর মাথাত চুল গজাইবো। হি হি..
- হাসবানা তো দাদী। এরাম কইরা হাসলে তোমারে শাকচুন্নী লাগে।
- কি কইলি হারামি? খাড়া আইজ তোর বাপে বাড়িত আসুক খালি।
শেফা খিল খিল করে হাসছে।
- ও দাদী আব্বারে ঠিক কইয়ো, আইজ হেই আমার চুল ধইরা টানছে, আম্মারে কইছে যেন আমারো চুল কাইটা হের মতন নাড়া বানায় দেয়। দেখতো দাদী।
ঠোঁট উল্টায়া দাদীর কোলের কাছে গিয়া বসে শেফা।
- ঐ ছেঁড়ি তুই বেশি হাঁসিস না। কুকুরদাঁত বারাইতে পারে। তর মায়ে দাঁত তুইলা কি করছে ক দেখি?
- এই যে আম্মায় আমারে দিয়া দিছে।
- হু ঐ দাঁত ইন্দুরের খোপর দেইখা তার মইদ্যে ফেলবি। বুঝলি? তাইলে দেখবি কি সুন্দর ইন্দুরের লাহান টুকি টুকি দাঁত বাইর হইব। কুট কুট কইরা সব কামড়াইতে পারবি।
-ইন্দুরের খোপর কই পামু। ও দাদী, সুলেমান নবীর গল্পটা কওনা।
- ঐ এক গফ কয়বার কইরা শুনস তরা।
মুখ ঝামটায়া দাদী এই কথা বললেও তার মুখ দেখলে যে কেউ বুঝবে গল্প বলতে বললে তিনি খুশিই হন।
দাদী ঘাড় মাথা দুলাইয়া গল্প শুরু করে সুলেমান নবীর। জীন প্রেত দেও দানো সব ছিল সুলেমান নবীর হাতের সুতলী। সে যেমনে সুতলি নাড়াইতো দেও দানো তেমনেই নড়তো। একবার তো রাগ কইরা বাতাসের নড়ন চড়ন বন কইরা দিছিল নবী। পশু পক্ষীগো কথা শুনতে পাইতেন তিনি। সাপ খোপ সক্কলেই নবীরে বড় ডরায়। রাইতের আন্ধারে বাইর হইলেই হাতে তালি দিবি আর মুখে কইবি
'সালামুন আলা ইলিয়াসিন' । কি কইতে হয় কও দেখি সোনার পুতলারা?
- সালামুন আলা ইলিয়াসিন। বাবু লাফাইয়া জবাব দেয়।
- হ এইটা খালি কইলেই দেখবি সাপ খোপ সব ডরে পলাইব।
-ওরাম ড্যাবড্যাবায়া তাকাই থাকলে কি ঘুম আসবো নাকি? তাকায়া থাকিস না। এইহানে বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া থাক। আমি গফ কমু তরা চক্ষু বন্ কইরা শুনবি।
সুখের দিন শেষ হয়ে গেল শেফাদের। ছোটদাদী একদিন পান চিবাইতে চিবাইতে রেহালা বেগম কে বললেন, ও বৌ জলদি আসো, বুকটা কিরাম জানি করছে। ও বৌ শেফার বাপেরে খবর দেও। ও বৌ বাবু কই, শেফা কই? ও বৌ?
শেফা বাবু সে সময় স্কুলে।
রেহালা বেগম উঠানের উল্টা দিকের রান্নাঘরে। তার হাতে ছোট মাছের ভুঁড়ি টেপা কাঁই। মলা , ঢেলা, পুঁটি, খয়রা, চিংড়ী সব পাঁচ মিশালী মাছ। রাহেলা বেগমের হাত মাছের নাড়ী ভুড়িতে মাখানো।, কপালের ঘাম মুছতে পারছেন না হাত বন্ধ থাকায়। একবার এক ফোটা ঘাম নাকের মধ্যে ঢোকায় এখনো তার নাক জ্বালা করছে।
মাছ বেছে রান্না চাপাবেন বলে দ্রুত হাতে মাছের পেট টিপছেন তিনি। কোন কোন মাছের পেট ফেঁসে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মাছে পচন ধরবে। আল্লার কি আজব সৃষ্টি কই, চ্যাং,গটি এইগুলা জিওল মাছ দুই একদিন ঘরে রাখলেও পানি দিয়া দিলেই দিব্যি বাঁইচা থাকে। আর মলা ঢেলারে পানি থাইকা উঠাইলেই ফুস!
ছোট মাছ পেঁয়াজ বেশি দিয়া রানতে হয়। কোনো মসলা না দিলেও স্বাদের হেরফের নাই। তেল, কাঁচামরিচের ফালি, লবন আর দু চিমটি হলুদ। নামানোর আগে তেল উঠে আসলে দু'ফাঁক কাগজি লেবুর রস চিপে দিয়ে সাথে সাথে বাটিতে ঢাইলা দিতে হবে। তাইলেই কাম শেষ।
খাওনের সময় হালকা লেবুর গন্ধ নাকে আসে। শেফার বাপের খুব পছন্দ এই রান্না। রেহালা বেগম কে তার ছোট শাশুড়ি নিজ হাতে শিখিয়েছে এই রান্না।
সেই সাথে বলেছেন বুঝলা বৌ মাছের স্বাদ জিওনে।
'যত বেশি টাটকা তত স্বাদ মটকা।'
ছোট মাছ বাড়িত আনলে সব কাজ ফালায়া আগে মাছ কুটা বাছা শুরু করবা। রাইন্ধা বাটিতে ঢালনের পর অন্য কাম।
ছোট দাদী ছটফট করে দু একবার তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচিয়েছে। রেহালা বেগমের কানে এসে পৌঁছায়নি সে ডাক। স্কুল থেকে ফিরে শেফা যখন দাদীর ঘরে তখন সব শেষ। দাদীর মুখের একপাশ দিয়ে পানের পিৎ গড়িয়ে পড়ে কালো হয়ে গেছে।
এ সময় ছোট্ট একটা দূর্ঘটনা ঘটলো। গন্জে বিরাট কাপড়ের দোকান শেফার বাপের। কথা নাই বার্তা নাই ক্যাশবাক্স খুলতে গিয়া শেফার বাপ তমিজ সাহেব দেখেন যে চাবি নাই। চাবি সবসময় তার ঘুনশিতে বাঁধা থাকে লাল সুতায়। এই সুতো যেন তেন সুতা না। শাহ পীর চিশতির দরগায় মানত করা সুতা।
তমিজ সাহেবের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, ঢোক গিলতে পারছেন না তিনি। এক মনে ইন্নালিল্লাহ পড়ছেন তিনি। জিনিস হারাইলে এ দোয়া পড়ার নিয়ম।
মানুষ মরলেও পড়তে হয়। মরা আর হারানো কি এক জিনিস হইল! ধুর! মেজাজ খারাপ হইতে থাকে তমিজ সাহেবের।
গতকাল এক চালান মাল দোকানে উঠাইছেন তিনি। আজ টাকা নিতে আসবে। ক্যাশবাক্সে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। ভেবেছিলেন তাই দিয়ে বিদায় করবেন। ব্যবসার এইটাই নিয়ম। একবারে সব টাকা দিতে নাই। ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া টাকা পয়সার লেনদেন করতে হয়। নাইলে শত্রুপক্ষের নজর লাগে। তমিজ সাহেবের চাবির কথা মনে পড়তেই বুক ধ্বকধ্বক করতে থাকে। সাবানে চাপা দিয়া সেই ছাপে নতুন চাবি বানানোর কথা জানেন তিনি। কাজের সময় ঝামেলা ভাল লাগেনা তার। মুখে থুথু জমতে থাকে তমিজ সাহেবের।
******
ছোট দাদীর মৃত্যুর পর বাড়ির বাঁধন কেমন আলগা হয়ে গেল। বড়দাদী আগেও চুপচাপ থাকতেন আর এখন তো তসবি নাড়ানো ছাড়া আঙ্গুলটাও নাড়ান না। সতীনের সাথে তার গত বিশ বছরে কোন কথা হয়না। মুখ দেখাদেখি হয়ে যাবে ভেবে বড় দাদী কোনার একটা ঘর বেছে নিয়েছিলেন সেই কবে! শেফার বাবা তার নিজের পেটের ছেলে। ঐ ডায়নী তুকতাক যে জানে এ ব্যাপারে বড় দাদী নিশ্চিত। ডায়নীর বাপে কবিরাজ ছিল। স্বামী বশীকরন তাবিজ কবজ তার বাপের কাছে থেকে কতজনে নিয়া গেছে। নিজের মেয়েরে যে তিনি এই তাবিজ বিনা চাওয়াতে দিবেন তা তো ঠিক।
বাড়িতে ঢোকার ক'দিনের মধ্যে পেটের ছেলে পর হয়ে গেল। আম্মা বইলা কতদিন যে ডাকে নাই। এসব কথা কাকে বলবেন তিনি। আর বিশ্বাস ই বা কে করবে। স্বামী সন্তান সংসার সব গুছায়া নিয়া বসছিল ছোট দাদী।
তবু বড় দাদী কেমন ম্যান্দা মেরে গেছে, তার আগে ছোট মরে যাওয়ায় একটা ধাক্কাও খেয়েছেন।
যমের টাট্টু ঘোড়া রওনা দিয়ে দিয়েছে। বাড়ির দরজায় পৌঁছালেই সব ফেলে তাকেও সওয়ার হতে হবে। অবশ্য মাঝখানে ঘোড়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে আগায়া আসলে এখনো তার মেলা টাইম আছে হাতে।
যে জগতের যে নিয়ম! ডায়নী সব খাইলেও তার আয়ু খাইতে পারে নাই এটাও কিন্তু কম বড় কথা না।
******
পাকা বাড়িটা তমিজ সাহেব খুব শখ করে তুলেছিন। মাটির দোতলার পাশেই দুটা ঘর বানিয়েছেন উপরে ছাদ দিয়ে।
এক রাতে পালঙ্কে শুয়ে তিনি আয়েশ করে পান মুখে জাবর কাটছিলেন। হাতে পানের বোঁটা , মাথায় চুন মাখানো। একবার করে জিবে ঠেকাইতে ঠেকাইতে তিনি রেহালা বেগম কে বললেন,
- পানদানীটা দিও বৌ। পিক ফেলুম।ভাবতেছি ব্যবসাটা বাড়ামু। মানিকতারাবু'র বড় পোলাটা বিয়ে পাস দিসে। ব্যবসাপত্র ভাল বুঝবে। পোলায় চালাক আছে। নতুন আরেকখান ব্যাবসা শুরু করব ভাবতেছি। তারে আসতে লিইখ্যা দি। কি কও তুমি? আর বাড়িত থাকলে বাবু শেফারেও পড়ালেখা দেখায়া দিব ।
- কিসের ব্যবসা শুরু করবেন ভাবতেছেন? আপনে যা ভাল বোঝেন তাই তো করবেন! আমি আবার কি কমু!
- কিসের ব্যবসা সে তোমার না জানলেও চলব! হাতের কাম শেষ কইরা জলদি আইসো। পা খান টিপ্যা দিব। সারাদিন গদিত বইসা পায়ে রস নামসে মনে হয়। বিষায়া কামড়াইতেছে। সরিষার তেল গরম কইরা নিয়া আসবা।
- অত বড় পোলা বাড়িত থাকবে?
-বাড়িত থাকবে নাতো কি ছাদের উপরে থাকার ব্যবস্থা নিব? মূর্খের মত কথা বলবানা তো? যত্তসব আজগুবি আলাপ। সোহাগে বাড়িত থাকলে বাজার ঘাট কইরা দিতে পারব। পোলা মাইয়াটার লেখাপড়া দেখাইতে পারব।
- হু! আম্মারে দেখার লাইগা একটা সমর্থ মেয়ে মানুষের দরকার। রাইতের বেলায় ঘরে পেশাপ কআরা দিতেছেন কয়দিন যাবত। সারাদিন আমি রান্ধনের কামে থাকি খেয়াল নিতে পারিনা। ছোট আম্মা মরতেছে একটুও টের পায় নাই। পানি খাইতে চাইছিল কিনা আল্লায় জানে। মরনের সময় শয়তানে মুখে পেশাব কইরা দেয়।
- কও কি! বিষুর মায়েরে রাইতে থাকতে কইয়া দাও। বলবা আমি তার বেতন পঁচিশ টেকা বাড়ায়া দিমু।
এখন লাইট বন্ধ কইরা কাছে আসো দেখি!
*****
সন্ধ্যার আলো তখন প্রায় নিভে গেছে।আকাশ ভীষন কালো। দুপুর থেকে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। সোহাগ অনেকক্ষন বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করেছে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে রওনা হয়েছে। কড়কড়কড়াৎ করে শব্দ হল। কাছেই কোথাও বাজ পড়ল মনে হয়। সে মুহূর্তে হাতে ছেটো একটা ব্যাগ নিয়ে সোহাগ বাঁশের বেড়া ঠেলে শেফাদের বাড়িতে ঢুকলো। সামনের বেশ খানিকটা জায়গা পার হয়ে তারপর সে আমলের কাঠের মুল দরজা। দরজা ভেড়ানোই ছিল। ঢুকে গিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো সোহাগ। ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে তার শরীর।
সোহাগের থাকার জায়গা হয়েছে ছোট দাদীর ঘরটাতে।
মাটির ঘরগুলোয় জানালা হয় কবুতরের খোপের মত। কিন্তু এ ঘরটার জানালা বেশ বড়। সোহাগ জানালার কাঠের পাল্লা খুলে দিল। সামনে তাকিয়ে গাঢ় অন্ধকার আর বৃষ্টির ঝাপটা ছাড়া কিছু নেই। মামি গরম পানি করে দিয়েছিল। সাবান ডলে গোসল সেরে এখন শরীর ঝরঝরে লাগছে। শেফা আর বাবু দরজার ওপাশে অনেকক্ষন উঁকি ঝুকি দিয়েছে। সোহাগ দেখেও না দেখার ভান করেছে।
তার মন ভাল নেই। মায়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছে সে। মামার চিঠি পাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে অশান্তি শুরু করেছে মা। কেবল পরীক্ষা শেষ করেছে একটু এদিক সেদিক ঘুরবে ফিরবে। সেসবও ঠিক কারন না, মিলির সাথে প্রেমটা কেবল জমছে আর এমন সময়! কানের কাছে সারাদিন বকরবকর! মামা ডাকছে তরে। বইসা থাকস সারাদিন বাড়িত। একটা কোন কামে না লাগলে কেমনে হয়। মা তো আর জানেনা তার ঘরের জানালা খোলা রাখলে কেমন জীবন্ত হাওয়া ঘরে ঢোকে। মাঝে মাঝে মিলির বাঁকা চোখের কটাক্ষ আর মুচকি হাসি আলো হয়ে জানালার চারপাশে খেলা করে।
ভাল ই লাগছেনা ধুর!
একবার পিছন ফিরে সোহাগ হালকা গলায় বলল। কিরে! কি খবর? আছিস কেমন তোরা?আয় ঘরের মধ্যে আয়।
বিরক্তির সীমা নেই। বাবুতো প্রায় মুখ ফসকে বলেই ফেলছিল, তুই তুই করবানা তো। এখন আমি বড় হয়েছি।
বাবু তৎক্ষনাৎ মুখ গম্ভির করে ফেলল। শেফা অবশ্য মুখে কিছুই বলেনি। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো। বাইরেটা মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ এর ঝলকানীতে ফকফকা , আর তারপরই গাঢ় নিকষ অন্ধকার!
কদিনেই অবস্থা বদলে গেল। সে কি আর জানতো ক'দিনের মধ্যেই শেফা আর বাবু তাকে এভাবে দখল করে ফেলবে।
সেদিন ছুটির দিন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে যথারীতি শেফা বাবু সোহাগ ভায়ের ঘরে।
-যাদু দেখবি?
- হু।
- হু কি রে? ঠিক মত কথা বলতে শিখিস নি?দেখিস আমি কাগজের গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারব কাগজে কি লেখা।
-তাই হয় নাকি?
অবিশ্বাস নিয়ে দুজন তাকিয়ে আছে।
সোহাগ টুকরো টুকরো করে কাগজ ছিঁড়ে সব কটা কাগজে ওদের কে ফুলের নাম লিখতে বলল।
-শোন প্রথম টা শুধু আমি দেখব বুঝলি? তোরা কিন্তু কি নাম লিখছিস মনে রাখ।হুম..
হাতে একটা ভাঁজ করা টুকরা নিয়ে অনেকক্ষন নাকের কাছে ধরে সোহাগ ভাই বললো বেলিই মনে হচ্ছে। কি রে বেলি লিখেছিস?
প্রবল বিস্ময়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে তখন বাবু। কি আশ্চর্য্য!
দৌড়ায়া দুজন ঘর থেকে বের হল। আম্মা জানো? সোহাগ ভাই গন্ধ শুঁকে কাগজে লেখা ফুলের নাম কয়া দিতে পারে। কি আজব না আম্মা কও?
দুজনে পাল্লা দিয়ে জালাতন করে । কদিন ধরে নতুন উৎপাত। রাতের পড়ালেখা শেষে ইচ্ছে করে সোহাগের খাটে ঘুমিয়ে পড়ছে দুজন।
বাবু তো সেদিন মশারীতে ঝুলছিল। ভাগ্যিস পড়ে যায়নি!
তার ভালই লাগতে থাকে নতুন এই জীবনটা।
******
তমিজ সাহেবের ঘুনশি থেকে আবারও চাবি হারিয়েছে। মুখ দেখে মনে হয় কূল হারিয়ে দিশেহারা তিনি। কর্মচারীদের একে ধমকাচ্ছেন তাকে ধমকাচ্ছেন। কিন্তু চাবি হারানোর কথা মুখ ফুটে বের হচ্ছেনা তার। মানুষের দূর্বল জায়গার কথা জানাতে হয়না, এ ব্যাপারে তমিজ সাহেবের জ্ঞান টনটনে।
কি হতে পারে! গতবার চাবি হারানোর শোক টের পাবার আগেই চাবি ফিরে পেয়েছিলেন । ঘন ঘন এসব যন্ত্রনা আর ভাল্লাগেনা। সোহাগ সোহাগ..
-জ্বি মামা?
-তোমারে কতবার বলেছি সবসময় আমার লগে লগে থাকবা। কি কথা কানে ঢোকেনা?
লেখাপড়া শিখছো দেইখা কি মুরুব্বিগো মান্য করা ভুইলা গেছো?
শেফা বাবুরে যে পড়া দেখায়া দিতে বলছিলাম মাশাল্লাহ সেসব বাদ দিয়া তো নাকি প্রায়ই যাদু টোনা শিখাইতেছো।
তোমারে কি জাদুগর হইতে বলছে কেউ?আসছে জুয়েলাইচ বাবাজি। ধইরা খালি থাপড়াইতে মন চায়।
আদব লেহাজ নাই? জামার কলার উচায়া রাখছো কেন? কলার নামাও। বেয়াদব ছেলে। শুনলাম ধোঁয়া টানা শিখছো? আমার এখানে থাকলে এসব চলবেনা বুঝছো?
কি আশ্চর্য্য! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সোহাগ। কোন কথায় মাথার ভেতরে আর যাচ্ছেনা। কানের কাছে মিলির হাসি ভাসছে। বহুদিন পর এমন হচ্ছে। হ্যা কত দিন ধরে মিলির হাসি কেমন ছিল মনে করতে চেয়েও পারেনি। আজ হঠাৎ করে! কি আজব ঘটনা।বাড়ি ফিরে সোহাগ ব্যাগ গোছাতে থাকে।
- আজ কি রান্নারে শেফা?
- কি জানি! ঠোঁট উল্টায়ে শেফা জবাব দেয়।
- আয় কাছে আয়। মাকে জালাবিনা বেশি বুঝলি? আর বাবুর সাথে ঝগড়া করবিনা।বাবু কই গেছে?
- গুলতি খেলতেছে। তুমি কই যাও ভাইয়া? ডাক দিব অরে?
-হু? আচ্ছা ডাক দে। বাড়ি যাইতেছি রে আপু। মামীরে বলিস। চিন্তা না করতে।
- কেন যাইতেসো? কবে আসবা?
-মায়েরে মনে পড়তেছে । দেখি কবে আসি। আর আসি কিনা। কি রে পাকনি বুড়ি এত কথা জিগাস কেন! যা বাবুরে ডাক দে। গন্ধ শোঁকার যাদুটা শিখায়া দিয়া যাই।
প্রথমে যে নামটা দেখবি সেটাই গন্ধ শুঁকে বলবি। যে লিখছে নাম গুলা সেতো আর দেখতেছেনা। তুই খুইলা ভান করবি হু ঐ নামই তো আছে। কিন্তু আরেকটা নাম দেখে বন্ধ কইরা দিবি কাগজ। পরের কাগজের গন্ধ শুঁকে একটু আগে দেখা নামটা কয়া দিবি । মজা না?
******
সোহাগের একই সাথে আনন্দ আবার বেদনা দুটোই প্রবল আকারে ভেতরটা নাড়া দিচ্ছে। কি অদ্ভুত! মা অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করবে। সেটা ব্যাপার না। কিন্তু মামা? বিপদ আপদ কিছু হয়নিতো?
বাস আসেনি এখনো। ভীষন গরম পড়েছে আজ। ঘামে শরীর চিটচিট করছে। গন্জে একটা দোকানে ছায়ায় বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে সোহাগ। পেটের মধ্যে ক্ষুধার জানোয়ারটা লাফাচ্ছে। মানুষের মন ভাল না থাকলেও ক্ষুধা লাগে। শরীরে কঠিন অসুখ হলেও ক্ষুধার অসুখটা সারেনা। কি অদ্ভুত খোদার ইচ্ছা!
''ও তার বিচ্ছেদে প্রান কেমন করে
ও রে দেখনা তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি
যার প্রেমে জগৎ সুখি...
তারে যে দেখেছে
সেই মজেছে
ছাই দিয়ে সংসারে!
মরি হায় হায় রে!....''
পাশের দোকানে উঁচু আওয়াজে গান বাজছে।মামীকে বলে আসা উচিৎ ছিল বোধহয়। বাস এসে গেছে।
- বাবা সোহাগ!
-মামা!
- কই যাও? ব্যবসা খারাপ যাইতেছে বাবা। তাই মেজাজ খারাপ ছিল। উল্টা পাল্টা কথা বলছি। আমারে মাফ কইরা দাও। বাড়ি চল। আইজ তোমার মামী ভুনা কইরা গরুর গোশ রানছে। চল একলগে খামু।
হা হা এমন হলে মন্দ হতনা। নিজের মনেই হাসতে থাকে সোহাগ। বাস চলতে শুরু করেছে। ভ্যপসা গরমটা কেটে যাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ । কাছেই কোথাও বৃষ্টি হল হয়ত।