হঠাৎ একদিন ফেসবুকে লগইন করে দেখি, আমার দেড় হাজার বন্ধুর মধ্যে পাঁচশ জন অনলাইনে। ব্যাপারটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হইলো। বুঝলাম সিস্টেমে কোনো গোলমাল হইতে পারে। বিন্যাস-সমাবেশের যে অংক স্কুলে শিখছিলাম সেই নিয়মেই জানি, এটা সম্ভব না। আরও অসম্ভব ব্যাপার এই যে, ৫০০ অনলাইন বন্ধুর মধ্যে এক সাথে ত্রিশজন আমাকে নক করতে থাকে। অনলাইন বন্ধুদের হাইয়ের জবাব দিতে গিয়া আমার হাই উঠতে থাকলো। এরই ফাঁকে দেখলাম নোটিশে দেখাচ্ছে আমার একটা নতুন মেইল এলো ইনবক্সে। ছদ্মনামের বন্ধু। লিখেছে, লোকাল টককে আপনি চিনেন? আপনাকে কিছু ক্লু দেই। চেইন স্মোকার। সিগারেটের ব্র্যান্ড বেনসন। আগে চট্টগ্রামের একটা কাগজে কাজ করতো। এখন বের করে নেন। আমি উত্তর লিখলাম, লোকালের পরিচয় বের করে আপনার কী লাভ? আমারই বা কী লাভ। ছদ্মনামে ব্লগিং করে এমন অনেকেই তো আছে। তারা লোকালের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। উনি অনলাইনে থাকলেও আর উত্তর দেন না। কখনোই আর উত্তর দেন না। এর মধ্যেই লোকালটক আমাকে ফোন করে।
ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত। সাহিত্যিক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম আছে। কিন্তু সাহিত্যের চেয়ে গেম প্ল্যানিং করতেই তার ভাল লাগে। একেকটা প্লেগ্রাউন্ড বানিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। খেলাটা বেশ পছন্দ হয় আমার। আমি তার সাথে কথা বলতে শুরু করি। ফোন ধরি। ব্লগিংয়ের চেয়ে সাহিত্য নিয়েই তার সঙ্গে বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু দেখি যে ব্লগিং নিয়েই তার আগ্রহ বেশি। ব্লগ পড়েন। জানেন। তবু আমার মতামত জানতে বিশেষ আগ্রহী। আমি ঝেড়ে কাশি না। বলি বস, আসেন একদিন। আলাপ করি। উনি আসেনও। লম্বা চেহারা। বেনসন অ্যান্ড হেজেস খান। শুধু একটা বিষয়েই ক্লিয়ার হওয়া যায় না। ক্যাডেট কলেজে উনি কখনো ছিলেন কি না। চেইন স্মোকার। চিটাগাংয়ে মেলাদিন ছিলেন। সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি ক্যাডেট কলেজেই পড়েছেন তো?
উনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান। কথা ঘুরান। বলেন, ব্লগের গল্পকারদের কেমন মনে হয় আপনার? আমি বলি ভীষণ পটেনশিয়াল। ভাল। অনেকের গল্প আমার পছন্দ। লোকালটক তার চশমার ফ্রেমের ভেতর থেকে আমাকে দেখেন। একটা গল্প সংকলন করার আইডিয়া তার মাথায় খেলে যায়। আমি তাকে বলি, অন্য একটা সংকলন করেন। ডিবেট তৈরি করতে পারে এমন কিছু। কিন্তু গল্পই তার মাথায় এঁটে থাকে। দেখা হলেই বলতে থাকেন, ব্লগারদের গল্প নিয়ে একটা সংকলন করতে চাই। বুঝতে পারি সাহিত্যের নতুন রণক্ষেত্র হিসাবে তিনি ব্লগকে কৌশলগতভাবে নির্বাচিত করেছেন।
লোকালের সাথে টানা তিনটা চা তিনটা সিগারেট খাওয়া শেষ হলে উনি বিদায় নেন। এর মধ্যে কৌশিকের ফোন আসে। ব্লগের তাৎক্ষণিকভাবে ঘটা কোনো একটা ব্যাপর নিয়ে কুশিলের সাথে তার প্রয়োজনীয় আলাপ হয়। উনি হন্তদন্ত হয়ে সাইবার ক্যাফের দিকে হাঁটা দেন।
উনি চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর আমি আবার বারান্দায় যাই আরেকটা সিগারেট খেতে। দেখি লোকালটক তার অস্বাভাবিক অস্থিরতা নিয়ে পায়চারি করছেন। একটার পর একটা গোল্ডলিফ ধ্বংস করে চলেছেন। হালকা গড়নের চেহারা, তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমাদের দুজনের ব্র্যান্ড গোল্ড লিফ হলেও কখনও সিগারেট বিনিময়ের সম্পর্ক হয়নি। কারণ প্যাকেট ভর্তি সিগারেট আর কাঠি ভর্তি ম্যাচ নিয়ে আমরা দুজনেই ঘুরি। কথাও তেমন হয় না। কারণ যতক্ষণ সিগারেট খাই ততক্ষণ মাথাভর্তি আইডিয়া আমাদের ব্যস্ত রাখে। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে তার খুব বেশি আগ্রহ দেখি না। ফটোশপের কাজ তেমন জানেন বলেও মনে হয় না। তবে প্রচুর আইডিয়া আছে। সাংগঠিনিক অভিজ্ঞতা ভাল। আমার সাথে শত্রুতার প্রচুর কারণ আছে। কিন্তু আমি বুঝি, একটা নিরাপদ দূরত্বই ভাল। হয়তো তিনিও বুঝেন। মাঝে মাঝে লিকলিকে চেহারার এই ভদ্রলোকের সাথে হঠাৎ লিফটে কথা হয়। একটা দুইটা।
বুঝতে পারি লোকালটক নেটে সময় তেমন দিতে পারছেন না। মিটিং নিয়ে খুব ব্যস্ত। তখন তার হয়ে আরেকজন ব্লগিং করছে। ফেসবুকে দেখলাম তাকে অনলাইনে। ব্লগেও আছেন। হিসাব মিলিয়ে সোজা গিয়ে তার টেবিলে হাজির হলাম। দেখি, ফিরে দেখা একাত্তর নিয়ে কী যেন করছেন। না ফেসবুক খোলা নেই। ব্লগও খোলা নেই। শুধু ফিরে দেখা একাত্তর ঘাঁটছেন। আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট। হলিউডের নায়কদের মতো চেহারা। আমাকে দেখে হতচকিত হয়ে গেলেন। বললেন, লোকলটককে আপনি খুঁজছেন দেখেই তার সম্বন্ধে খোঁজ করছিলাম। ফিরে দেখা একাত্তর পড়ে দেখছি।
এরপর থেকে যখনই দেখা হয়, তখনই লোকালটকের খবর জানতে চান আমার কাছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসি। খুব কনফিউজিং জবাব দেই। আইপি অ্যাড্রেসগুলো আমার চোখের সামনে খেলে যায়।
শুনতে পাই, লোকালটক আমেরিকায় এক ব্যবসায়ীর সফরসঙ্গী হয়েছেন। বিকাল তিনটায় তার সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয় আমার। আমি বলি, এত রাতে জেগে আছেন? উনি বললেন, আপনি কি দেশের বাইরে নাকি? ওনার প্রশ্নে আমিই অবাক হয়ে যাই। শান্ত একটা নাম বলেন, আমি সে অনুসারে লোকালটককে খেয়াল রাখি। তার গণযোগাযোগ পদ্ধতিটা খেয়াল করার চেষ্টা করি। ২২এর সঙ্গে তার দেখা হবে জানতাম। সেদিনই আমি তার পিসি অরক্ষিত অবস্থায় পাই। অদ্ভূত এই লোক। সবিতাভাবির ভীষণ ভক্ত। পর্নহাবের মতো সফিসটিকেটেড সাইটে যান। কিন্তু তার ছয়মাসের হিস্ট্রিতে ব্লগ বলতে কিছু নাই। শান্তকে আমি না বলি। তবু, তাকে দেখলে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলি। ক্যাডেট কলেজের সাথে তার সম্পর্ক জানতে চাই। তার ভাই আর্মিতে কাজ করে কি না জিজ্ঞেস করি।
আমেরিকা থেকে লোকালটক ফিরলে আমি গিয়ে বলি, বস কী আনলেন? উনি আমাকে চকলেট দেন। আর আবশ্যিকভাবে এমএসএন চ্যাট উইন্ডো মিনিমাইজ করে বসে থাকেন। ওনার পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করি। বলি, বস লোকালটক তো বিএনপি। কলেজে বিএনপি করতো। আপনি আওয়ামী লীগ হয়ে তাকে সাপোর্ট দিতেছেন কেন? উনি আরও কিছু জানার আগ্রহে আমার সাথে নিচে নামেন। একসাথে চা খাই আমরা। সিগারেট সাধি ওনাকে। উনি বলেন, সিগারেট? না। তার সাথে নানা বিষয়ে কথা হয়। পরদিনই লোকাল আওয়ামী লীগের সরকারকে সমর্থন দিয়ে একটা পোস্ট দেয়।
লোকালের এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে আমি তার খোঁজ নেই সেদিন। ব্লগার্স মিট ছাড়া তার সঙ্গে দেখা হয় না। লোকাল কেমন আছে? উনি বলেন, লোকাল এখন লন্ডনে। আমি বলি, ওখান থেকেই যে জ্বালাময়ী পোস্টগুলো লিখতেছে তথ্য পায় কই? উনি বলেন, ভোরের কাগজ থেকেই তার অনেক বন্ধু যারা প্রথম আলোর সিনিয়র বলতে গেলে তারে অর্ধেকই তার বন্ধু। আমি মত দেই, বলি, কিন্তু তাই বলে কর্মী পরিচয় দেয়া তো ঠিক না। উনি বলেন, হু হা কিছু না বলে ফোন রেখে দেন। কন্সপিরেসি থিওরি উনি জানেন কিন্তু ওই পরিমাণ ধৈর্য নাই। আমি জানি কোনো না কোনোভাবে লোকাল নিয়মিত আমার খবর রাখছেন। আমি রাখছি।
আমি ব্লগের চাকরি ছেড়ে দিলে ওনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে তার প্রস্তুতিও চলছে। আমার কাছ থেকে ব্লগের কিছু রহস্য জেনে নিচ্ছেন। আমিও বলছি।
নানা কথা প্রসঙ্গে একদিন আমি তাকে আমি বলি, আসেন না। আমার সাথে। কাজ করেন। উনি রাজি হন না। সত্যি কথা বলতে আমার বস লেবেলেই তাকে মানায়। তবু একটা ব্লগ চালানোর ব্যাপারে খুব আগ্রহ তার। তার সংকটটা বুঝতে পারি আমি।
যখনই দেখা হয় উনি জিজ্ঞেস করেন, লোকালরে খুঁজে পাইলেন?
আমি জবাব দেই, না বস পাই নাই। খুঁজে বের করে কী করবো? ফাইন করবো না মামলা করবো?
উনি কন, হ সেটাও একটা কথা।
কিন্তু চেনা থাকলে ভাল না?
হ। চেনা থাকলে ভাল, না চেনা থাকলেও ভাল।
সে তার মতো আছে থাকুক না।
তবু একদিন লোকালটক আমারে ধইরা বসেন। বলেন, বলেন না। কী কী পাইলেন তার সম্পর্কে।
আমি তারে কয়টা ক্লু দেই।
১. লোকালটক, ফিউশন ফাইভ, ব্রিগেড সিক্সটিন একজন ব্যক্তি হইতে পারে। তার মানে তার কয়েকটা মেইল অ্যাড্রেস আছে। কিন্তু সে জিমেইল ব্যবহার করতে পছন্দ করে। কিন্তু আমারে সে জিমেইলে মেইল করে না। কারণ আমার জিমেইল তার কাছে নাই। যাদের লোকাল বলে আমি সন্দেহ করি তাদের একজনের কাছে আমার জিমেইল অ্যাড্রেস নাই।
২. লোকালটক সচলায়তন থেকে বহিষ্কৃত বা সচলায়তন ছাইড়া দিছিলেন। সচলায়তনের পক্ষ অবলম্বনের কারণে তিনি ফারুক ওয়াসিফের বিরুদ্ধাচারণ করছিলেন। এবং আমার সচলায়তন বিরোধী মনোভাবের কারণে আমার লগে ঐক্য করছিলেন। তখন পল্লব মোহাইমেন সচলায়তনের পক্ষে লেখালেখি করার পরও তিনি তার বিরোধিতা করেন নাই। কৌশল হিসাবে তার লেখার লিঙ্ক মাঝে মাঝে দেন।
৩. ব্লগে তার নিক ১৮টা হইতে পারে আবার নাও হইতে পারে। তিনি নিজের নামে ব্লগিং করতে পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই ব্লগ প্রতিদিন পড়েন। তিনি সাহিত্যিক হিসাবে স্বনামধন্য হইতে পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু সাহিত্য নিয়া তার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। কিন্তু তিনি টেকনলজি বিষয়ে তেমন জানেন না। পেজ মেকআপ বিষয়ে তার ধারণা ভাল। ইলাট্রেশন বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু তিনি প্রথম আলোর কেউ নন। প্রথম আলোর যে পাঁচজনকে লোকালটক বইলা সন্দেহ করা হয় তাদের পরিচয় তিনি নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। তারাও লোকালের ফাঁদে পা দিয়েছেন। রহস্যকে এনজয় করেছেন। কিন্তু তারা কেউই লোকালটক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সন্দেহ ঘনীভূত করতে পারেন নাই। কিন্তু যে পাঁচজন বা চারজনকে তিনি টার্গেট করেছেন তাদের সম্পর্কে তিনি জানেন। এই জানার মধ্যে একটা ঐক্য আছে।
৪. প্রথম আলোর বাইরে যে চারজনকে লোকালটক বলে সন্দেহ করা হয়। তাদের দুইজনের পক্ষে প্রথম আলোর ভেতরের খবর লোকালের মতো করে জানা সম্ভব। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তিনি সামহয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একজনই কাজটা করতে পেরেছেন।
৫. লোকাল কৌশলগতভাবে অ্যান্টি আওয়ামী অবস্থান নিলেও সম্প্রতি তিনি তার অরিজিনাল মনোভাব ব্যক্ত করছেন। তিনি পাড় আওয়ামী লীগার।
৬. সম্প্রতি তার মনে হইতেছে যে পর্দার আড়াল ভাল না। লোকালটকের ক্রেডিটটুকু তিনি নিজের নামে ট্রান্সফার করতে চান।
ছয়টা ক্লু বলার পর লোকাল আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়।
আমি বলি, বস আপনেই লোকাল।
কিন্তু একটা কথা বলি?
আপনে পর্দার অন্তরালেই থাকেন। আপনেরে দিয়া সাহিত্যের আরও কিছু উপকার হউক। দেন কোনো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়া যাইয়েন।