বহুদিন পর ব্লগে সিরিয়াস বিষয় নিয়া আলোচনা হইতেছে। শুধু সিরিয়াস না, বিষয়টা স্পর্শকাতরও বটে। ব্লগাররা কীভাবে আলোচনা করতেছেন এইটা বিশেষভাবে খেয়াল করলাম। দেখে, পড়ে বেশ একটা ম্যাচিউরড ব্লগের আভাস পাওয়া গেল। আমিও কিছু কইতে চাইতেছিলাম। তাই এই পোস্টের অবতারণা।
আধুনিক রাষ্ট্রের উত্থান বিষয়ে মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট থিওরির সঙ্গে পরিচিত লোকমাত্রই জানেন, রাষ্ট্রের অস্ত্রধারী বাহিনীগুলোর কাজ রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অস্ত্র ধারণ করা। রাষ্ট্রের স্বার্থ বলতে জনগণের জানমাল, রাষ্ট্রে ঐক্য ও সংহতি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্র ইত্যাদি মোরাল বা নীতির কথা বলা হইলেও মূল লক্ষ্য শাসকশ্রেণীর অর্থনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের নিরাপত্তা বিধান করা। ভ. ই. লেনিন রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে দেখাইছেন কেমনে আদিম কৌমী ব্যবস্থা থেকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উত্থানের নানা প্রক্রিয়ায় সংগঠিত সশস্ত্রবাহিনীর ভূমিকা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হইছে। এবং এই বাহিনীগুলো রাষ্ট্রের প্রধান খুঁটিতে পরিণত হইছে। নামে, উদ্দেশে এবং নীতিতে যাই বলা হউক সংগঠিত সশস্ত্রবাহিনীর মূল কাজ শাসক শ্রেণীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মিশেল ফুকো বলতেছেন, আধুনিক কালে রাষ্ট্রগুলা সশস্ত্র বাহিনীকে সামনাসামনি দেখাইতে চায় নাই অনেক সময়। তাই সশস্ত্র বাহিনী ও নাগরিকদের মধ্যে কিছু পর্দার ব্যবস্থা করছে। প্রয়োজন হইলে পর্দা সরাইছে। কিন্তু, প্রয়োজন না হইলে পর্দা রাখছে। আইন-শৃংখলা রক্ষা, সীমান্ত রক্ষা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার নানা বিভাগগুলা তৈরি হইছে। সশস্ত্র বাহিনী নাগরিক সেবামূলক কাজে অংশ নিছে। শুধু সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী নয়, রাষ্ট্রের বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সংসদ, নির্বাচনী কাঠামো, আইন-বিচার বিভাগ ক্ষমতাসীন শ্রেণীর পক্ষেই কাজ করে। নাগরিকদের অধিকার সর্বত্র ততোটুকুই রক্ষিত হয় যতটুকু রক্ষিত হইলে শাসকশ্রেণীর স্বার্থে আঘাত না লাগে।
উন্নত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিষয়গুলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নাগরিক, শাসকশ্রেণী, সেনাবাহিনী সেইখানে নির্বিবাদে নিজের নিজের জায়গা থিকা অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন চালায়। অস্ত্রধারী বাহিনী পর্দার আড়াল থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তারা পর্দার আড়াল কেন কোনো পর্দার বালাই রাখে না যখন তাদের জাতির শাসকশ্রেণীর স্বার্থে আউটসোর্সিং করে। অর্থাৎ ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উন্নত বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলাতে এমন এক স্থিতাবস্থা তৈয়ার করছে যে নিজের দেশে কোনো চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা করতে হয় না। তারা অন্য দেশে নিজের দেশ ও অন্য দেশের শাসক শ্রেণীর পক্ষ থিকা অস্ত্র ধারনের জন্য প্রস্তুত থাকে।
এইখানেও সত্য পুরাটা বলা হইলো না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নির্বাহী কাজেকর্মে যারা সামরিক বাহিনীর তদারকি ও হস্তক্ষেপে বিরক্ত বোধ করেন ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তাদেরকে রাষ্ট্রপরিচালনায় ও রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে কেমনে হয় তা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। পার্থক্য খুব বেশি না। গণতন্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা মেনে নেওয়া হইছে। আমাদের এখানে সেইটা অপ্রাতিষ্ঠানিকই রয়া গেছে। কিন্তু ঘটনা লেনিন ও ফুকোর ধারণা থেকে খুব বেশি আগাইছে বইলা আমার মনে হয় না। একথা ঠিক, রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি ও সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বোঝাপড়া স্পষ্ট না বইলা অনুন্নত গণতন্ত্রে মাঝে মাঝে যত্রযত্র হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। রাজনীতি/সংসদের সঙ্গে সামরিক স্বার্থের সংঘাত লাগে। সেইটা যাতে না ঘটে, সেইজন্য বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতিকদের সচেতন হইতে হবে। যিশুরটা যিশুকে সিজারেরটা সিজারকে দিয়ে স্থিতাবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সংসদ ও রাজনীতির সীমিত পরিসরে সিভিলিয়ানদের কাজ করতে দিতে হবে।
যাই হউক, প্রয়োজনের সময় অস্ত্র ধারণ করতে সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী সদা প্রস্তুত থাকবে বইলাই আশা করা হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে শাসক শ্রেণী, তার রাষ্ট্রকাঠামো ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। বিশেষ করে কেউ যদি ঘোষণা দিয়া বা না দিয়া এইসব স্বার্থের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে এই ব্যবস্থার উৎখাত চায় তাইলে তাদের ধ্বংস করা সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর কাজ। সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা বা বিচারের মাধ্যমে আদালতের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেওয়া। মূল লক্ষ্য তাদের নির্মূল করা। সভ্যতা ও আধুনিকতা কিছু পর্দা চায়। বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও বিচারের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এই সামান্য পার্থক্য ছাড়া আর কিছু নাই। হ্যাঁ আত্মপক্ষ সমর্থন, পক্ষত্যাগ, শোধরানোর সুযোগ আছে। কিন্তু প্র্রকৃত অর্থেই যে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ কইরা অস্ত্র ধারণ কইরা ব্যবস্থা উৎখাত চায়। সে আর নিজের পক্ষে এই রাষ্ট্রের আদালতে দাঁড়ায়া কী বলবে?
বাংলা ভাই, আবদুর রহমান, মোফাখখার, তপনের তো বুর্জোয়া গণাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন-কানুন মানার কথা না। ফলে, বিচারের মাধ্যমে, বা বিচার বাহির্ভুত হত্যা দুইই তাদের জন্য সমান। রাষ্ট্রও সেইভাবে দেখে বইলা মনে হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো আমাদের রাষ্ট্রও পর্দা প্রথায় বিশ্বাসী হওনের বাসনা রাখে। আইন-আদালত, বিচার, মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন হইতে চায়। ফলে, এইখানকার সভ্য বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পক্ষপাতি লোকেরা বিচারের অধিকারের প্রশ্ন তোলেন। রাষ্ট্রও কিছুটা আড়াল করতে চায়। মিডিয়া ইনভার্টেড কমা দিয়া খবর ছাপে। বিদেশী মানবাধিকার কর্মী ও কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে তদারক করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু সময়টা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের। এইসময় এইসব ক্ষেত্রে উদ্বেগের চাইতে সন্তোষ বেশী দেখা যায়। রাষ্ট্র বলে, তারা মারতেছে না। আসলে বন্দুকযুদ্ধ হইতেছে। দুই পক্ষের গোলাগুলিতে সন্ত্রাসী মারা যাইতেছে। অনেক ক্ষেত্রে অবিশ্বাসযোগ্য হইলেও এইটুকু পর্দাপ্রথা সভ্যরাষ্ট্র হওয়ার বাসনাকেই সামনে আনে। বিদ্রোহীর হত্যাকে জায়েজ করার জন্য তারা মাঝে মাঝে সন্ত্রাসীকেও মারে। রাষ্ট্রের মধ্যে, রাষ্ট্রের বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে, তাদের দেশীয় পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যেটুকু লাজলজ্জা দেখা যায় সেটুকু কিন্তু অনেক নাগরিকের মধ্যে দেখা যায় না। কথা আছে, নাগরিকরা যেমন, তারা তেমনই শাসক পায় বা ব্যবস্থা তেমনই হয়।
বিদ্রোহী আর সন্ত্রাসী এক নয়। সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে না। রাষ্ট্র উৎখাত করতে চায় না। ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষমতাধরদের সমর্থন নিয়া তারা জনগণের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ করে। ক্ষমতাসীনদের অপ্রাতিষ্ঠানিক রক্ষক হিসাবেও কাজ করে। আইন-রাষ্ট্র-নাগরিকের মধ্যে ফাঁকফোকরের মধ্যে বইসা কাজ করে। ফলে, এদের দ্বারা রাষ্ট্র সরাসরি চ্যালেঞ্জ বোধ করে না। তারপরও যখন এরাও বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় তখনও সরকারের সভ্য রাষ্ট্রগঠনে পর্দাপ্রথা চালুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা এইগুলা বুঝেন না। কালা ফারুক মরলে তারা উৎসব পালন করে, অভিযানের পক্ষে মিছিল করে। কেহই বলে না, কালা ফারুকের বিচার পাওয়ার অধিকার আছিল। জনগণের এই সমর্থন এতদিন ধইরা বিচারবাহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ডে শক্তি যোগাইছে আগামীতেও যোগাইবে। জনগণ আসলে, কালা ফারুক, বাংলা ভাই আর দাদা তপনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। রাষ্ট্র পারে। আর বুদ্ধিজীবীরা পারে।
রাষ্ট্র পাইরা কী করতেছে সেইটা আমরা দেখতেছি। আর বুদ্ধিজীবীরা কী করতেছে সেইটা দেখার বিষয়। কালা ফারুক মরলে বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকে। কিন্তু বইপড়া মোফাখখার চৌধুরী মরলে তাদের বুকে চিনচিন ব্যথা করে। ডা. মিজান মরলে নীতিজ্ঞান উসকে ওঠে। প্রথম দিন কালা ফারুক মরার সময় যদি তাদের মনে ব্যথা উঠতো তাইলে আর এই ব্যথা পর্যন্ত হয়তো তাদের আসতে হইতো না। একটা পর্দা-পুসিদার মধ্যেই সবকিছু হইতে পারতো।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে নৃশংতাটুকু আছে নাগরিকরা কোনো না কোনো ভাবে সেই নৃশংসতাকে ন্যায্য মনে করেন বইলাই তা টিকে আছে। যদি ন্যায্য মনে না করতো তাইলে শাসকশ্রেণীর লগে তারা আলোচনা করতো, দাবি জানাইতো আন্দোলন করতো।
আমেরিকা থেকে, ভারত বাংলাদেশ পর্যন্ত বিচার বাহির্ভুত হত্যা, গ্রেফতারের কোনো ব্যত্যয় তো ঘটতে দেখি না।
সমস্যা অন্য জায়গায়, বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন পর্দার আড়াল না রাইখা এই ধরনের কাজ চালায় তখন কাউন্টার-অ্যাকশন হিসাবে কোনো নিয়ম-নীতির আড়াল ছাড়াই বিদ্রোহীদের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর বৈধতা দেয়। ফলে, এক ধরনের সীমিত যুদ্ধাবস্থা জারি থাকে। যুদ্ধাবস্থা জারি থাকা কোনো কাজের কথা নয়। ফলে, স্থিতিশীল হইতে চাওয়া যেকোনো রাষ্ট্রের উচিত প্রয়োজনীয় পর্দাপুসিদার ব্যবস্থা করা।