আমার সকাল হয় ১০ থেকে ১২টার মধ্যে। নয়টায় ঘুম ভাঙলে মনে হয় ভোর। এক সকালে টানা ঘুম দিয়ে উঠেই প্রতিদিনকার অভ্যাস মতো টিভির সুইচটা অন করি। সম্ভবত এগারোটার ছোট খবর হচ্ছে চ্যানেল আইতে। বীরশ্রেষ্ট হামিদুর রহমানের মরদেহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। আমার বাসা থেকে অফিসে যেতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড পার হয়ে যেতে হয়। ভাবলাম একটু দেরিতে বের হবো। জাতীয় ব্যক্তিরা রাস্তা গরম করে রেখে যান। একটু থাণ্ডা হোক। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র, বিজয় স্মরণী আর রাঙস ভবন কয়েক মিনিটে পার হয়ে যেতে হয় প্রতিদিন। রাঙস ভবনে তখনও অজানা সংখ্যক লাশ। উদ্ধারের জন্য মিনিমাম কোনো উদ্যোগ সেদিন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অদ্ভূত ব্যাপার, বাতাসে লাশের গন্ধ ছিল না। অন্তত বাসের যাত্রী হিসেবে পাইনি। অথচ চারপাঁচদিন কেটে গেছে। প্যারেড গ্রাউন্ডে ৩৬ বছর আগে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমানের মরদেহ ঘিরে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা পাশে একটা বিল্ডিংয়ে টাটকা লাশের গন্ধ। ভেবেছিলাম এই কনট্রাস্ট বিষয়ে কিছু লিখবো। কোথায় আর? ব্লগে। লিখতে পারলাম না। মনে হলো এই যে ভাবনাটা আমার মধ্যে এলো এটাই একটা অপরাধ। রাঙস ভবন পার হতে হতে ভাবলাম, বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি সম্মান দেখানো নিশ্চয়ই ভাল। মহৎ ব্যাপার। কিন্তু এটাই কি সেই দেশ যার জন্য হামিদুর যুদ্ধ করেছিলেন? যুদ্ধে যিনি শহীদ হন তিনি কি কয়েকটা নাম না জানা শ্রমিকের লাশ পঁচতে দিয়ে নিজের আনুষ্ঠানিকতা অনুমোদন করতেন? আমার ভুল হতে পারে, সম্ভবত এই দেশটার জন্য হামিদুর যুদ্ধ করেননি।
ভিএস নাইপলের আত্মজীবনীর নাম হাফ এ লাইফ। ১৯৭১কে আমার মনে হয় হাফ এ ওয়ার। অর্ধেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শেষ হয়নি। কেন শেষ হয়নি, কে শেষ করেনি। কে ক্ষমা করেছে কাকে এ প্রশ্ন মাঝে মাঝে অবান্তর মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় খুব প্রাসঙ্গিক। বাকী যুদ্ধটা পেন্ডিং পড়ে আছে। আমাদের প্রজন্মকে হয়তো সেটা শেষ করতে হবে। ২০০৭ জুড়ে একটা স্লোগানই শুধু শুনেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। ১৯৭১ সালে অবশ্যই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা যুদ্ধাপরাধ করেছে। তারা প্রথম রাত থেকেই নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা করেছে। শুধু ২৫ মার্চ রাতের হিসাব নিলেই তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে বাঁচানো কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। আর তাদের যখন ধরা হবে তখন তো রাজাকার-আলবদরদের হিসাবও বেরিয়ে আসবে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে যদি না পারা যায় তবে নিশ্চয়ই দোসরদের পারা যাবে। তাদের বিচার করতে অসুবিধা থাকার তো কথা নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার করা কি খুব বড় কূটনৈতিক সমস্যা, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ? তাহলে তো অন্তত স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার করা যায়। যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসে এই রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব বিষয়ে প্রশ্ন তোলে তাদের বিচার করা তো কঠিন কিছু না। সেটা অন্তত হোক। সহব্লগার ও সহনাগরিকদের মতো আমিও চাই সেটা হোক। যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতা বিরোধিতার বিচার হোক।
টিভির টক শোতে এ বিষয়ে যখন ড. কামাল হোসেন, শাহরিয়ার কবীরের মতো ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার শুনি খুব ভাল লাগে। তারা বলেন, রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ ট্রাইবুনাল করতে হবে। সব যুদ্ধাপরাধী না হোক কিছু বড় যুদ্ধাপরাধীর বিচার হতে হবে। বাহ। দেশে এরকম ঐক্যমত্য তো এই ইস্যুতে আগে তৈরি হয়নি। জামাত, শিবির রাজাকার ছাড়া বিরুদ্ধে কেউ নাই। কিন্তু তারপরও বিচারের দাবির পক্ষে সরকারকে আনা যাচ্ছে না। আজ পর্যন্ত আনা যায়নি। তবে কি একাত্তরের পরাজিত শক্তিই ক্ষমতায়? দৃশ্যত ক্ষমতার শোকেসগুলোতে তাদের সমর্থক থাকলেও তারা নেই। বরং তারা ক্ষমতায় ছিল একবছর আগে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিএনপির সঙ্গে মিলে দেশ শাসন করে চলে গেছে। শহীদ মিনারে গেছে, স্মৃতিসৌধে গেছে। তখন না রাজপথ না ঘরে কাউকেই আজকের মতো তীব্র প্রতিরোধ গড়তে দেখা যায়নি। আজ বিশ্বাসই হয় না। এত মুক্তিযোদ্ধার দেশেও স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ একবারই জিতেছিল ১৯৭১ সালে। তারপর পরজিত হতে হতে আজ এমন এক অবস্থায় এসে পড়েছে যে জনগণের বড় অংশ একমত হলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার করা যাচ্ছে না। কারণ ক্ষমতা শোকেসে জামাত না থাকলেও ক্ষমতার পেছনে তারা আছে। তারা এদেশে বড় কি অ্যান্ড কুইন মেকার। তারা ৩৬ বছর ধরে রাজনীতি করছে। অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা হামলা করেছে। ধর্ম হাতে নিয়ে আক্রমণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটকে তারা ধ্বংস করার সব আয়োজন সেরে ফেলেছে। জামাতের অস্ত্র আজ জঙ্গীদের হাতে জিহাদের ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তারা কোনো রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অস্ত্র ধরেনি। সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে দখলে নেয়নি। তারা স্রেফ নিজেদের আখের গুছিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটকে ভুলে গিয়ে/ ভুলিয়ে দিয়েছে। শেখ মুজিবের পর আর কোনো নেতা জাতির সামনে নতুন কোনো কর্মসূচী ঘোষণা করতে পারেননি। ফলে, জামাত আজ শক্তিশালী, প্রায় অপ্রতিরোধ্য। আমারা তাদের বিচারের তুলছি এমন এক সরকারের কাছে, যে সরকারটি একটা প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় ক্ষমতায় আছে। যেটি গণতান্ত্রিক নয়, যার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাদের কাছে দাবি করে করে আমরা প্রতিদিন তাদের বৈধতা ও ন্যায্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করছি। কারণ কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি জামাতের বিচার করতে পারে একথা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু কোনো অনির্বাচিত শক্তি জামাতের বিচার করবে এই বিশ্বাস এত সহজে আমাদের কি করে হয়?
তারপরও ধরা যাক যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হলো। তাতে কি জামাত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? জামাত দল হিসেবে শেষ হয়ে যাবে? জামাতের রাজনীতির স্পিরিট ধ্বংস হয়ে যাবে? আমার বিচারে, না। গুটিকয় জামাত নেতার ফাঁসি দিলে জামাত শেষ হবে না। জামাতের মতো শক্তিশালী সংগঠন তাতে পুরাতন অপরাধ থেকে রেহাই পেয়ে নতুন নেতৃত্বের অধীনে তাদের বিধ্বংসী রাজনীতিকে নতুন গতি দেবে। নতুন একটি একাত্তরের জন্ম দেবে। এই শক্তিকে শুধু দাবি তুলে ধ্বংস করা যাবে না। রাজনীতি করতে হবে। সে বড় দমের কাজ।
তাহলে কি জামাত নিষিদ্ধ করা এখনকার দাবি হবে? কীভাবে? সেটা ঘটাতে হলে তো আরও বড় যুদ্ধের দরকার। সে যুদ্ধের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি কি?
জামাত ও ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করলে আমাদের রক্ষাকবচ কী হবে?
এই প্রশ্নগুলো উঠলে ভেতরে একটা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা জাগে। আহা এত দাবি, এত সৈন্য অথচ একটি দুটি দাবির বাইরে আমাদের আর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী নেই। দাবি উত্থাপন করে আমরা এই সরকারের মুখের দিকে চেয়ে আছি।
মাঝে মাঝে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ বোধহয়, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তির জন্য হয়নি, হয়েছে স্রেফ যুদ্ধাপরাধী আর স্বাধীনতা বিরোধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য। তা না হলে, দেশের মানুষে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকটে, দ্রব্যমূল্যের সীমা ছড়ানো উর্ধ্বগতিতে, সারের সংকটে, কৃষি, শিল্প, বিনিয়োগের সংকটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সঙ্গে আর একটা দাবিও কেন যুক্ত হয় না। যখন গণতন্ত্র সুদূরে তখন নিদেনপক্ষে গণতন্ত্রের দাবিও ওঠে না কেন?
কিছু রাজাকার আলবদরের শাস্তি হলে আমাদের ৭১ পরবর্তী ভুলের প্রতিবিধান হয়। শহীদের আত্মার শান্তি হয়। কিন্তু নতুন একাত্তরে নতুন রাজাকার আলবদরের শাস্তি বিধান কি তাতে হবে। যারা নতুন করে আমাদের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জনগণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে সেই নতুন যুদ্ধের কথা আমরা কেউ বলিনি। পুরো বছরটা চলে গেছে।