দৈনিক কালের কন্ঠে আজ প্রকাশিত খবরটি দেখে সকালবেলা মন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছে। এমন মানুষও আছে দেশে? শুধু পাঠ করে নয়। আমাদের এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকার শ্যামলী ২ নম্বর রোডে কাজী অফিসের পাশের বস্তির সামনে গতকাল বুধবার সাতসকালেই ভিড়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, স্থানীয় লোকজন, দূর-দূরান্তের দর্শনার্থী ভরা। সবাই এসেছেন এ বস্তির বাসিন্দা বৃদ্ধা রমিজা খাতুনকে একনজর দেখতে। পুলিশও এসেছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অসুস্থ রমিজাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাতে। পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীও ফোন করেছেন পুলিশকে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল (আজ) সকালে রমিজাকে তাঁর কার্যালয়ে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন।
কিন্তু যাঁর জন্য এত আয়োজন, এত মানুষের অপেক্ষা, সেই রমিজা খাতুন কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রতিদিনের মতো তিনি বেরিয়েছেন ভিক্ষা করতে।
এই রমিজা হলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের প্রয়াত হাসমত আলীর স্ত্রী। হাসমত আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অন্ধভক্ত। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে হাসমত বাড়িঘর ফেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। পরে রিকশা-ভ্যান চালিয়ে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে নিজের গ্রামে এক খণ্ড জমি কেনেন শেখ হাসিনার নামে। তিনি বলতেন, 'শেখ হাসিনা আমার মেয়ে। মেয়েটা এখন এতিম।' গুরুতর অসুস্থ হয়েও তিনি এ জমি বেচতে দেননি। বছরখানেক পর উন্নত চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান। তাঁর স্ত্রী রমিজা এখন ঢাকায় ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
গতকাল কালের কণ্ঠে এ ঘটনা নিয়ে 'বিরল ভালোবাসা' শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে হৈচৈ পড়ে যায়। রমিজা খাতুনের সন্ধানে সারা দিন ফোন আসে কালের কণ্ঠ অফিসে। সকাল থেকে ভিড় লেগে যায় তাঁর বস্তিঘরের সামনে।
গতকাল সকালে প্রথমেই বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও পরে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী-২ সেলিমা খাতুনের ফোন পেয়ে শ্যামলীর ওই বস্তিতে গিয়ে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো আজও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন রমিজা। সকালে পান্তা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ভিক্ষা করতে। কারণ মাস শেষ, ঘর ভাড়ার টাকা এখনো পুরোপুরি জোগাড় হয়নি। শ্বেতী রোগী হওয়ায় রোদের মধ্যে তিনি ভিক্ষা করতে পারেন না। তাই ধানমণ্ডি লেকের আশপাশে গাছের ছায়ায় বসে প্রতিদিন ভিক্ষা করেন।
পত্রিকায় প্রতিবেদনটি পড়ে রমিজাকে একনজর দেখতে এসেছেন মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড থেকে ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান। তিনি সকাল ১১টায় এসে রমিজাকে বাড়িতে না পেয়ে অপেক্ষা করেন কাজী অফিসের সামনে। তিনি বলেন, 'এমন ঘটনা আমার জীবনে এই প্রথম শুনেছি। যাঁর কিছুই নেই, সে কি না একজনকে ভালোবেসে জমি কিনেছেন। তাঁর স্ত্রীকে দেখার জন্যই অপেক্ষা করছি।' ৪১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি শহিদুল আলম খান কাজল এসেছেন রমিজাকে দেখতে। তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগের আমরা যাঁরা নেতা-কর্মী, তাঁদের জন্য এটি একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আমাদের খাই খাই ভাব ছেড়ে দেশের জন্য কিছু একটা করা শিখতে হবে।' জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলিয়াস হোসেনও ছুটে এসেছেন। তিনি বলেন, 'লুটপাটের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা হাসমত আলীর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।'
জানা গেল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রমিজাকে চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য শেরে বাংলানগর থানার পুলিশ এসে কয়েকবার খোঁজ করে ফিরে গেছে।
রমিজা সে সময় ধানমণ্ডির আট নম্বর ব্রিজের এক পাশে গাছের নিচে বসে ভিক্ষা করছিলেন। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কিছুই তাঁর জানা নেই। তখন রাস্তা দিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক যাওয়ার সময় রমিজাকে দেখে বলেন, 'আরে! আপনাকে নিয়ে আজ পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। আপনার স্বামীর নাম তো হাসমত আলী।' এ কথা শুনেই রমিজা কোমরে গোঁজা এ প্রতিবেদকের ভিজিটিং কার্ড বের করে একটি ফোন করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। লোকটি যখন ফোন করেন, তখন বিকেল সাড়ে ৩টা। ওপার থেকে রমিজার কণ্ঠ শুনেই তাঁকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে বলা হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘামে ভেজা রমিজা চলে আসেন শ্যামলীর বস্তিতে। পরনে শত ছিন্ন শাড়ি। তাঁর ঘরের সামনে লোকজনের সমাগম দেখে আঁতকে উঠে বলেন, 'কী হইছে? এত লোকজন কেন?'
প্রতিবেশী যুবক সেলিম মিয়া বলেন, 'বুড়ি, তোমারে নিয়া অনেক বড় রিপোর্ট হইছে। তোমারে দেখতে অনেক লোক আসছে। ভয় পাওয়ার কিছু নাই।' ছাত্রলীগ নেতা কাজল দৌড়ে গিয়ে একটা নতুন শাড়ি কিনে এনে রমিজাকে দেন।
'প্রধানমন্ত্রী আপনার খোঁজ নিতে বলেছেন। তিনি আপনার সঙ্গে আগামীকাল দেখা করতে চান'_এ কথা বলতেই রমিজা অবাক হয়ে বলেন, 'আমি ভিক্ষা কইরা খাই। আমার লগে প্রধানমন্ত্রী দেহা করব! ও বাবা, তোমরা আমার লগে মশকরা করতাছ না তো?'
তখন তাঁকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা হয়। জানানো হলো, আপনাকে আগামীকাল (আজ) সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে যেতে বলেছেন।
এবার রমিজার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। কোনো কথা বলতে পারেন না। অনেকক্ষণ নীরব থাকেন। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, 'আজ যদি আমার স্বামী বেঁচে থাকতেন, অনেক খুশি হতেন। তিনি দেখে যেতেন, তাঁর এতিম মেয়েটা (শেখ হাসিনা) আমার মতো একজন ভিক্ষুককে ডেকে পাঠিয়েছেন।'
শেরে বাংলানগর থানার সহকারী উপপরিদর্শক মো. মিজান রমিজাকে তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার কথা বলতেই রমিজা বলেন, 'ও বাবা, আমি আবার কী করছি? আমারে থানায় নিয়া যাইবেন কেন?' মিজান তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, 'আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।'
অনেক বুঝিয়ে বিকেল ৫টায় রমিজাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পিএস-২ সেলিমা খাতুন হাসপাতালের উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তকে রমিজার চিকিৎসার কথা জানান। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল মজিদ ভুঁইয়া রমিজাকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান। উন্নত খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার তত্ত্বাবধানেই রমিজার চিকিৎসা হবে। সি ব্লকের চর্ম রোগ বিভাগের অধীনে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে।'
শ্যামলীর বাসিন্দা দুলাল হোসেন, এরশাদ আলী, জয়নব আলী বলেন, রমিজার কপাল খুলছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর খোঁজ নিচ্ছেন। রমিজাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না।
এদিকে পত্রিকায় প্রতিবেদন পড়ার পর ছুটে আসেন রমিজা ও হাসমত আলীর একমাত্র সন্তান আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, 'ওই জমিতে ঘর তুলতে গিয়ে জেল খেটেছি। মিথ্যা মামলায় রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ অনেক মারধর করেছে। সেই কষ্ট থেকে মাকে বকাঝকা করেছি।' তিনি ওই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মায়ের পা ধরে মাফ চান।
ঢাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি নুর মোহাম্মদ জানান, কষ্ট এবার দূর হবে রমিজার। ওই জমিতে হাসমত আলীর নামে একটা স্কুল কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে। আর রমিজাকে ভালোভাবে পুনর্বাসন করতে পারলে খুবই ভালো হবে। সূত্র ঃ দৈনিক কালের কন্ঠ ০৩-০৬-২০১০