নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এদেশের সৌন্দর্যে তাই যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের হলেও বিদ্যমান পর্যটন আকর্ষণে যে বৈচিত্রতা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। এদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত- কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্রে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল-সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা-কুয়াকাটা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি- সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা- চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প উন্নয়নের সম্ভাবণা অপরিসীম। পর্যটন শিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মডেল হতে পারে।
পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকান্ড হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে ১ জন বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটন পেশার সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশের মানুষের ঘরকুনো বলে বদনাম দীর্ঘদিনের। তবে বর্তমানে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অনেকে এখন ছুটি গ্রামে না কাটিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্য কোথাও বেড়াতে যান। গত তিন-চার বছর ধরে ঈদের ছুটির সময়ে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি বা বান্দরবানের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টগুলো পরিপূর্ণ বলে পত্রিকাগুলোতে খবর বেরুচ্ছে। এমনও শোনা গেছে, হোটেলে জায়গা না পেয়ে অনেককে গাড়িতেই রাত কাটাতে হয়েছে। বেড়ানোর এই চিত্র কিছুকাল আগেও ভাবা যেত না।
আগে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ইত্যাদি নামকরা জায়গার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল। কিন্তু অনেকেই এখন অপরিচিত সুন্দর কোনো জায়গা, নদীর ধারে কাশফুলের মাঠ কিংবা স্রেফ গ্রাম দেখতেও বেরিয়ে পড়ে। ঢাকা শহরের মানুষ আজকাল এমনকি মাওয়া ফেরিঘাটও দেখতে যায়, একদিনের ছুটি পেলে চলে যায় মানিকগঞ্জের পুরনো মসজিদ বা মন্দির দেখতে কিংবা ঘুরে আসে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প দিন দিন দ্রুত হারে জনপ্রিয় হচ্ছে। যার প্রমাণ, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দশ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের বিশাল সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও তা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এক কথায়, পর্যটনশিল্প বিকাশের সম্ভাবনার মধ্যে আমরা হিমালয় সমান সমস্যা নিয়ে বসে আছি।
এসব সমস্যা বহুমুখী। যার মধ্যে অবকাঠামোগত অসুবিধা তো আছেই, নিরাপত্তা নিয়েও পর্যটকরা উদ্বিগ্ন থাকেন। কক্সবাজারের মতো এলাকায় পর্যটকরা ছিনতাইসহ নানা রকমের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সমুদ্রতীরে চাঁদের আলোয় হেঁটে বেড়াতে কার না ভালো লাগবে! কিন্তু ছিনতাইকারী বা বখাটেদের উৎপাতে সেটি হবার জো নেই। বিশেষত নারী ও বিদেশি পর্যটকরা যে রাতে একটু নিরুদ্বিগ্নভাবে ঘুরে বেড়াবে, সেটি সব সময় সম্ভব হয় না। দিনের বেলায় ফেরিওয়ালাদের উৎপাত, পর্যটন স্পটে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য ইত্যাদি কারণে পর্যটকেরা অনুৎসাহিত হন। একটি আধা-লিটার পানির সর্বোচ্চ খুচরা দাম যেখানে ১২ টাকা, পর্যটন স্পটে সেটি কেন ২৫ টাকা হবে? কেন পর্যটকদের কাছ থেকে কোরাল মাছের দাম নিয়ে অন্য সামুদ্রিক মাছ খেতে দেয়া হবে?
একসময় কক্সবাজারের পাহাড়গুলো বনসম্পদে ভরপুর ছিল। সৈকতের পাশাপাশি এসব পাহাড় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে এসব বৃক্ষরাজি চোখেই পড়েনা।
বর্তমানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলো দূষণের শিকার। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থা না থাকায় ভ্রমণকালে পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কক্সবাজারের পৌর এলাকায় প্রতি দিন শহরে ৩০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এসব বর্জ্য নালা কিংবা সমুদে ফেলা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে ময়লার গন্ধে থাকা যাবে না। সমুদ্র ভরে যাচ্ছে ময়লা-বর্জ্য। আমরা নিজহাতে কক্সবাজারের পর্যটনের সম্ভাবনা নষ্ট করছি।
প্রকৃতি আমাদের দু’হাত ভরে দিলেও আমরা তার অতি অল্পই ব্যবহার করতে পারছি। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত আমাদের দেশে হলেও আমরা এখনো সৈকতের ১২০ কিলোমিটার ব্যবহার করতে পারিনি। ৪৩ বছর ধরে মাত্র তিন কিলোমিটার সৈকত ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড় বাঁধা। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বিদেশি পর্যটকেরা যেমন এদেশে আসতে উৎসাহ পান না তেমনি দেশীয় ভ্রমণপিপাসুরাও নিরাপদ বোধ করেন না। অথচ, নেপালের মত ছোট দেশে পর্যটকের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
নেপালে পর্যটকদের সুবিধার্থে অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা করলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে অণ্যতম এক প্রতিবন্ধতকা। প্রতিটি পর্যটন স্পটের মাঝে প্রশস্ত রাস্তা ও ট্রেন ব্যবস্থা থাকলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিরম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারণ এবং রেললাইনের ভিত্তিপ্রস্তর করা হলেও তহবিল জটিলতায় কাজ হচ্ছে না।
অনেক সময় স্থানীয় জনগণ পর্যটকদের সাথে সহযোগীতামূলক আচরণ করেন না। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে এরকমটি হয়। পর্যটকরা আদিবাসী তথা স্থানীয় ঐতিহ্য দেখে অবজ্ঞা করে। একমাত্র সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ সমস্যা কাটানো সম্ভব।
পর্যটন শিল্পে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশানুরুপভাবে অগ্রগতি করতে পারছে না। সকল সমস্যা চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করে পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশের অপরিসীম সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভ’মিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও ৪ শতাংশ বাড়ার কথা। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সে হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন- পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরা, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যে কোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থান ১৪২তম।
বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। ইতোমধ্যে পর্যটন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎ্স পর্যটন শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সারাবিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে।
ওপরের এই ছোট আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটন শিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে।
সরকার ২০১০ সালে একটি পর্যটন নীতিমালা করেছে, সেখানে বহুমাত্রিক পর্যটনের কথা বলা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ টুরিজম থাকবে।
আশার বিষয় হল, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে কক্সবাজারে রাজধানী নগরী ঢাকা থেকেও বেশি হোটেল/ মোটেল গড়ে উঠেছে। সকল পর্যটন কেন্দ্রেই বেসরকারি উদ্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
সুতরাং, বাংলাদেশকে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এ শিল্পকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা জরুরি। আর এ লক্ষ্যে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ২০ লাখ পর্যটক আগমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাক্সিক্ষত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি, পর্যটন আকর্ষণের বহুমুখীতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান এবং পর্যটন বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যা বাস্তবায়িত হলে দিগন্ত রাঙিয়ে ভোরের নতুন সূর্যের আভায় অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ- ‘রূপময় বাংলাদেশ’!
উপসংহার ঃ-
বাংলাদেশের পর্যটনে প্রচলিত চিন্তাচেতনার বাইরে একটু দেশীয় ছোঁয়া দিতে পারলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশই এমন, একটু চেষ্টা করলে সারা দেশটাকেই পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা অনেকেই যেখানে জন্মেছি, তার পাশের উপজেলা বা জেলাতে যাইনি; কিন্তু একটা পর্যটন স্পট থাকলে সহজেই মানুষ আশেপাশের জেলাগুলোতে বেড়াতে যেতে পারতো। অনেক বেসরকারি ট্যুর অপারেটর এসব ক্ষেত্রে কাজ শুরু করলেও নানা মাত্রায় পর্যটন শিল্পের সার্বিক ভাবনা ও বিকাশে বাংলাদশ পর্যটন কর্পোরেশনকেই এগিয়ে আসতে হবে।