গত ডিসেম্বরের ASIAN STUDIES জার্নালে ‘leadership: emerging voice-where?’ শিরোনামে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। নব্বইর দশকের পর থেকে বাংলাদেশে তরুন নেতৃত্বের গতিপথ বিশ্লেষণই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। বলেছিলাম, একটার পর একটা ভিশনকে সামনে রেখে তৎকালিন যে তরুন নেতৃত্ব ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশসেবায় সর্বোচ্চ মেধাশ্রম ঢেলে দিয়ে, সে নেতৃত্ব আজ বয়স্ক গাভীর বহু চর্বিত জাবর কাটা ঘাস বৈ কিছুই নয়। তাদের হাত ধরে, তাদেরই মত করে উঠে আসা কোন নেতৃত্ব যখন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটা ভূসীমায় একেবারেই অনুপস্থিত, তখন ব্যর্থতার বলির পাঠা বৃদ্ধ গাভীদের স্কন্ধে তুলে দিলে আর যাই হোক অন্যায় হবে না মোটেও। বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, তাজউদ্দীনদের উন্মাদনা নিয়ে একটা জাতি ক’বছরইবা টিকে থাকতে পারে!
বাঘা বাঘা কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমার এ মতের বিরোধীতা করে ‘উগ্র তারুন্যের ভ্রান্ত চিন্তা’ বলে মত দিয়েছেন। ড. নাসিম আখতার হোসাইন, যিনি বাম ঘরানার রাজনৈতিকদের তাত্ত্বিক গুরু, একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, দেশের সামনে স্পেসিফিক কোন ভিশন নেই বলে আজকের এ তরুন নেতৃত্ব শূন্যতা। যেমনটা ছিল ৪৮ থেকে ভাষাকে নিয়ে, ৫৪সালে নির্বাচনকে সামনে রেখে, ৫৬ তে সংবিধান প্রশ্নে, ৫৮র সামরিক শাসন বিরোধীতায়, ৬৪-র মৌলিক গনতন্ত্রের আজব তত্ত্বকে সামনে রেখে, ৭০ নির্বাচন নিয়ে, সর্বোপরি একটা শোসিত- নির্যাতিত জাতির ক্রমে গজিয়ে ওঠা জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে আবশ্যম্ভাবি বিপ্লব-বিদ্রোহ, যা তরুনদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে অনেকটা বাধ্য করেছে।
হাসতে হাসতে ম্যামকে বলেছিলাম, স্বাধীন একটা দেশের ভিশন ৪০ বছরে দিন দিন কমে একেবারে শূণ্যের কোটায় চলে এল, তাহলেতো স্বাধীনতাই এ জাতির সবচেয়ে বড় ভুল।
নেতৃত্বের প্রশ্নে তারুন্যের ‘জিরো পারটিসিপেশন’ নিয়ে অনেকে অনেক বিশ্লেষন- তত্ত্ব দিয়ে থাকেন। তবে তারুন্যের অনীহাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। অবশ্য, সাথে সাথেই এ অনীহার কারণ বিশ্লেষণ অতীব জরুরীভাবে আবশ্যক। যেখানে প্রথম পয়েন্টেই চলে আসেন এক সময়ের প্রতাপশালী তরুন নেতৃত্বের কর্ণধার; বর্তমানের জাবরকাটা বৃদ্ধ গরুর দলের নাম।
বিজ্ঞান বলে, ৪০ হল মস্তিস্কের চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। আর ৬৫ থেকে ক্রমে নিম্নগতি। সব দেশেই তাই ৬৫ বছরের পর চাকুরি থেকে অবসরের বিধান। ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মুহাম্মদও নবীত্ব পেয়েছেন ৪০ বছরে। আর ৬৩ তে আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন।
আমাদের দেশেই কেবল বয়স একটা সংখ্যা! পয়ষট্টি পাড় না করলে এখানে রাজনীতিক হওয়া যায় না। মন্ত্রীত্ব বলুন আর নেতৃত্ব বলুন, বয়স নিম্নগতির কোটায় না গেলে যোগ্যতা পূরণ হয় না। হাঁটবে কারো স্কন্ধে ভর করে, বসবে মাতালের ঝিমুনিতে, কথা বলবে খেই হারানো স্বরে, চিন্তায় থাকবে শিশুর অপরিনত ভাবনার ছাপ। তাই না হলে কি আর রানা প্লাজা ধ্বসের পর ধাক্কা থিউরি দেয়া যেত??
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংবিধান তাদের তারুন্যকে সর্বাধিক ব্যবহারের নিশ্চয়তার জন্য অনেক ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। কেনিয়ার মত দেশ, যাদেরকে কোন ভাবেই মডেল হিসাবে দেখানোর সুযোগ নেই, তাদের সংবিধান যুবসমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ন্যাশনাল এসেম্বলি ও সিনেটে যুব প্রতিনিধি (উভয় লিঙ্গের সমান) রেখেছে।
এত আলোচনার মূলে যে বিষয়, সে তরুন নেতৃত্ব বাংলাদেশে শুণ্যের ঘরের দিকেই পেন্ডুলামের মত দোলছে। ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক অনাচার, সামাজিক অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নিজস্বতা হারানোর হাহাকার, ধর্মীয় মৌলবাদের রক্তরাঙ্গা চোখ- এত কিছুও তরুন সমাজকে হাল ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাতে পারছে না। তাদের চোখে ‘ভিশন’ জিনিসটা আসলে কী হবে, তা আজো বোধগম্য হলনা।
১০ম সংসদে তরুন নেতৃত্ব নিয়ে এখনও কোন গবেষণা নজরে আসেনি। নিজে করার মত সক্ষমতা এমুহুর্তে একেবারেই নেই। গবেষণা ছাড়া সাদা চোখে কয়েকজন তরুনের উপস্থিতি সংসদ ভবনে দেখা যায় বটে। তবে তাদের তারুন্যের উর্দির নিচে একটু নজর দিলেই বার্ধক্যের জীর্ণ কঙ্কাল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সত্যিকারের নেতা হয়ে ওঠার বাসনা তাদের মাঝে দেখা যায় না। পারিবারিক ঐতিহ্যের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে নির্বাচনের পথ পাড়ি দেওয়া এসব বয়সে তরুনেরা মোটেও ‘তারুন্যের নেতৃত্ব’ নয়।
নেতৃত্বের সাথে গলা জড়িয়ে আছে ‘প্রেম’। দেশের প্রেম, দশের প্রেম। প্রেমই যদি না থাকে হৃদয়ে, যতই জাগরিত করার ভান করা হোক, ফলাফল অবশ্যই শূণ্য। এ প্রেম হবে ন্যাচারাল। আমি নেতা হব, তাই মানুষকে ভালবাসব-এমন নয়। আমি মানুষ, মানুষকে ভালবাসব- চিন্তা হবে এমন। অবশ্য এ ভাবনাটাই হতে হবে ন্যাচারাল বা প্রকৃতিগত। দেশে এ ভাবনার অভাবটাই তীব্র। এতটাই তীব্র যে, জাতীয় নেতৃত্বে সরাসরি ‘প্রেমিক নেতা’ আমরা এখন প্রত্যাশাও করার স্পর্ধা পাইনা।
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, দেশে একটা বিপ্লব দরকার। নেতৃত্বের বিপ্লব। অথর্ব বয়স্ক গরু দিয়ে ভরা গোয়াল খালি করার বিপ্লব। ড. খুরশীদা বেগম, প্রকাশক, সত্যান্বেষণ, আমার অতি প্রিয় শিক্ষক। তিনি প্রায়ই বলেন, তোমরা একটা ‘রেঁনেসা’ শুরু কর। বাংলাদেশে এখনই ‘রেঁনেসা’র যথার্থ সময়। এ রেঁনেসা হবে একটি শুদ্ধি অভিযান। দেশ মাতৃকার মৃত্তিকা থেকে আগাছা পরিস্কারের অভিযান। এ রেঁনেসা হবে শুধুই তারুন্যের। চীনের বিপ্লব, রুশ বিপ্লব কিংবা ইউরোপীয় রেঁনেসাগুলোকেও হার মানানো এক তারুন্যের রেঁনেসার প্রত্যাশায় আমরা ..।
ম্যামের এক গল্প গ্রন্থ ‘কত নক্ষত্র তলে বহুদূরে, বহূ..’তে তিনি বহুবার বলা কথাটা গল্পের আবরনে বার বার বলেছেন, ‘এ একবিংশ শতকে একটি রেঁনেসা-এর দর্পনে প্রতিবিম্বিত হোক বাংলা মা আমার’।
তারুন্য এগিয়ে আসুক একটা রেঁনেসার দিকে। শুরুটা কোথা থেকে হবে? তত্ত্ব এখানে থামে। হাজারটা বিশ্লেষনের জন্য সময় নেয়। বিপ্লবও থামে। এ থেমে থাকা আর গতি ফিরে পায় না। তথ্যের ভারে তত্ত্ব পথ হারায়। গজায় অনেক নতুন ডালপালা। একসময় শাখা প্রশাখার ভারে নুয়ে পরে সব। বিপ্লবও।
তাই তারুণ্য তত্ত্বকেও আপাতত নির্বাসনে পাটাক।
তত্ত্বকে নির্বাসনে দিয়ে আসা যাক এবার আসল প্রসঙ্গে। সব সময়ই চিন্তা ছিল, শুরু হোক স্থানীয় অঞ্চল থেকে। স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসনের সুযোগ নিয়ে একদল তরুন এগিয়ে আসুক দেশসেবায়। রুট লেভেল থেকে উঠে আসুক নেতৃত্ব হাজারে হাজারে। দেশে রেঁনেসা এতেই হবে।
কাল হঠাৎই দেখলাম নিউজটা। আনন্দে নেচে উঠল আমার মন। মনে হল রেঁনেসার পথে এ জাতি এগুতে পারে এবার। অরিন্দম চৌধুরী অপু, আমার প্রিয় অপু দা, উপজেলা নির্বাচন করছেন।
যে প্রেমের ন্যাচারাল রূপ দেশসেবায় প্রয়োজন, অপুদা-র মাঝে সেটাই আছে। এ একটা জিনিসই আমাকে নিঃসংশয় করে তুলছে। আমি কোন ভাবনা ছাড়াই বলে দিতে পারি, দেশসেবার জন্য অপুদা-দের প্রয়োজন বাংলাদেশে আরো ২৫ বছর আগেই ছিল।
নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলী- শব্দগুচ্ছ আমার কাছে স্পষ্ট হল সেদিনমাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিরও পর। তখনই মাথায় আসে, ও বুঝেছি। অপুদা আরকি! সহজাত গুনাবলীর উদাহরণ হিসেবে অপুদার নামটিই আমার কাছে যথার্থ ছিল।
তখন অনেক ছোট, মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছি। ক্রিকেট খেলার একটা ক্লাব ছিল অপুদার। ইয়ং ফ্রেন্ডস। একই ক্লাসের কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে অপুদার সাথে পরিচয়। ক্রমে ঘনিষ্টতা। বয়সের পার্থক্য এখানে কোন বাঁধা ছিল না। বলা যায়, বয়স অপুদাদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না কখনোই। এমনই তাঁদের আকর্ষণ!
অপুদার একটা দোকান ছিল বাজারে। দোকানের নামে মূলত আড্ডাবাজী হত। সকল বয়সী মানুষের ভীর সবসময় লেগেই থাকত। যেন এক মৌচাক, যার আশেপাশে ভীর করত হরেক রকমের মৌমাছি।
অপুদার নেতৃত্ব গুণ প্রথম অনুভব করি ক্রিকেট মাঠে। ভাল খেলা পারতাম না কখনোই। তারপরও বুঝতাম, যতটুকুই পারি তার সবটুকু অপুদা নিংড়ে নিচ্ছেন। এ এক অদ্ভুত নেতৃত্ব। অপু দা মাঠে থাকলে সবাই ভাল খেলোয়ার এমনিতেই হয়ে যেত!!
জীবনের প্রয়োজনে অপুদা চলে গেল যুক্তরাজ্যে, আর আমি ঢাকায়। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগের দিন ঢাকায় দেখা হয়েছিল। খুব বাজছিল বুকে যে, দেশের আদর্শ তরুনেরা এভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে! আমি ধরেই নিয়েছিলাম, অপুদা আর দেশে ফিরবে না।
তারপর আর কোন যোগাযোগ নেই। কবে দেশে ফিরলেন, কবেই বা নির্বাচনে প্রার্থী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিছুই জানা ছিলনা। যখন জানলাম, বুকটা ভরে গেল আনন্দে। নেতৃত্বের সহজাত গুনাবলীর মানুষেরা দেশের হাল ধরুক, সমাজের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসুক- জাতি এখন এটাই চায়।
অপুদা, পথ চলা মাত্র শুরু। সামনে এখনও বিস্তর মরু। তবে ভয় নেই, আমরা আছি তোমার সাথে, একেবারে কাছাকাছি!!