শাল্লা! একটি নাম। একটি স্মৃতি। শাল্লা আমার জন্মভুমি নয়, কিন্তু তার চেয়ে কম কিসে? এখানেই আমার ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। জীবন শব্দের মর্মার্থ এখানেই যে শিখেছি।
সুনামগঞ্জ জেলার অতি ক্ষুদ্র একটি উপজেলা শাল্লা। বিচিত্র রুপের সমাহারে গঠিত এই শাল্লা আজ আমার কাছে অনেক কিছু। এতদিন শাল্লা শব্দটা যেমন মনে হত, আজ আর তেমনটি মনে হয়না। এতদিন মনে হত শাল্লা একঘেয়েমি পরিবেশ, ক্ষুদ্র সংকির্ণ এক ভাবাবেগহীন পল্লী এলাকা। কিন্তু এখন আর তা মনে হয়না। বরং মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর জায়গা বুঝি আর কোথাও নেই। বর্ষায় শাল্লার বুকে স্থান পাওয়া অথৈ পানিতে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ কত সুন্দর! গাছে গাছে কদম ফুলের সমাহার এবং তার মিষ্টি মধুর গন্ধ কত সুন্দর! এসবই আমার কাছে এখন স্বর্গের মতো সুন্দর মনে হয়। মনে তীব্র আকাঙ্কা, কেন কিছু দিন আগে এমন সৌন্দর্য অনুভব করতে পারি নি। এখন শেষ সময় এসে কেন এত সুন্দর মনে হয় রুপ রসহীন এই শাল্লাকে?
শেষ সময়? হ্যাঁ! আমি আমার শেষ সময়ের কথাই বলছি। শাল্লা থেকে যখন চলে যেতে হবে, কৃপন শাল্লার বুকে যখন আর আমার জায়গা নেই, তখন এ শেষ সময় নয়তো কি? দীর্ঘদিন লেখাপড়া করেছি আর চেষ্টা করেছি ভাল ফলাফলের জন্য। কারণ ভাল ফলাফল ছাড়া উন্নত মানের কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রায় অসম্ভব। করেছিও তাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে জিপিএ ৫ পেয়ে আমার এবং অন্য সবার আশাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এতদিন আমি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি যে, ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি মানে শাল্লা হতে বিদায় হওয়া। আজ বিদায়ের পূর্ব মুহুর্তে আমি বুঝতে পারলাম বিদায় জিনিসটা আসলে কি!
শাল্লার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজ আমার কাছে স্মৃতি। আজ মনে পড়ছে সেই আনন্দঘন মুহুর্তগুলি। মনে পড়েÑ হেমন্তের বিকেলে নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখা; সেখানেই প্রকৃতির সবুজ গালিচায় নামাজ আদায় করা। ক্ষেতের সংকীর্ণ আঁকা বাঁকা আইলে মিলে মিশে হৈ হুল্লোর করা। দখিনা বাতাসে ধানের শীষের সবুজ ঢেউ দেখা। নদীর কোনও বিশেষ স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে বক পাখির এক পাঁ তুলে দাঁড়িয়ে শিকারের দৃশ্য দেখা। জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য অবলোকন করা। সবশেষ নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে সাতার কাটার মতো আনন্দময় দৃশ্যগুলো।
আর কি পারব এমন আনন্দ করতে? পারব কি নদীর বুকে ঝাপিয়ে সাতার কাটতে? পারব কি বর্ষার অথৈ পানিতে নৌকা নিয়ে দূরে কোথাও আমরা ক’জন হারিয়ে যেতে? পারব কি আজ অতীতকে সামনে নিয়ে আসতে?
আহ! এনে বড় আশাÑ যদি এভাবে আনন্দ করে চিরদিন কাটানো যেত! যদি বন্ধুদের হারাতে না হত! কিন্তু তা কি সম্ভব? শ্রেষ্ট জীব মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছি তখনতো আর যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চলা যাবে না। ভবিষ্যত বলেতো একটা কিছু আছে! আর হ্যা, এ ভবিষ্যতের জন্যেই আজ চলে যেতে হবে মায়াবি এ শাল্লা ছেড়ে। যে শাল্লায় আমার মন পড়ে আছে, যে শাল্লায় আমার বন্ধুরা আছে, যে শাল্লায় আমার শত শত স্মৃতি পড়ে আছে, যে শাল্লার বুকে আমার আমার সকল সুখ দুঃখ পড়ে আছে..।।
এতদিন শাল্লার মর্যাদা বুঝিনি। বন্ধুদের মর্যাদা বুঝি নি। শাল্লার সৌন্দর্যে অভিভ’ত হইনি। বন্ধুদের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইনি। সুখের সময় হাসিনি, বরং বলেছি এ আর এমন কি? আহ, আফসোস! কেন বুঝলাম না? কেন সবাইকে দুঃখ দিলাম? কেন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম না? কেন আনন্দে হাসলাম না?
আবার যদি পেতাম আমার অতীতকে তবে সব ভ’লের সংশোধন করতাম। সব ভ’লের জন্য ক্ষমা চাইতাম। হয়তোবা এখনও ক্ষমা চাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার এখন আর কি দরকার? এখন ক্ষমা চেয়ে বরং বন্ধুদের মানহানি করা, বন্ধুদের হেয় করা, তাদেরকে লজ্জিত করা, শাল্লার গর্বে বাঁধা দেয়া......