somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উইড়া চলে একলা পাখি

০৯ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধার অন্ধকারে সাড়ি সাড়ি ল্যাম্পপোষ্টের নিচ দিয়ে হাটতে হাটতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মাহি। অনেক দিন- প্রায় তিন বছর পর নীলাকে নিয়ে হাটতে বেরুলো সে। কথাটা নীলাই মনে করিয়ে দেয়। হয়তো সচেতন ভাবেই। আবার কি জানি, হয়তোবা তারও অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় অসচেতনভাবে বেড়িয়ে আসে কথাটা। নীলা বলছিল, চল আমরা কলেজ মাঠে যাই।
কলেজ মাঠ, সেতো বেশ দূর- বলে মাহি। আর তখনই নীলা মনে করিয়ে দিয়ে বলে- ফার্ষ্ট ইয়ারেতো আমরা কত ঘুরেছি কলেজ মাঠের দিকে। চল আজও যাই।
কথাটা সে অনেকটা জেদের স্বরেই বলে। মাহি কোন প্রতিবাদ করে না। করবে কি? সে তখন হিসাব কষতে ব্যাস্ত ঠিক কতদিন বা কত মাস পর নীলা এরকম জেদের স্বরে তার সাথে কথা বলছে। সে নীলার সাথে হাটছে আর স্মৃতির খোঁজে হৃদয়ের প্রতিটি কোনা খোঁড়তে শুরু করছে। হ্যা, তিন বছর আগে, যখন তারা ফার্ষ্ট ইয়ারে তখন এভাবে ঘুরেছে। ক্যাম্পাসের এমন কোন স্থান নেই যেখানে তাদের পদচিহ্ন পড়েনি। এ এক নেশার মত হয়েছিল। সকাল-দুপুর- সন্ধ্যা, যখন যার ইচ্ছা হত হাটতে বেড়িয়ে পরতো। এইযে কলেজ মাঠের রাস্তা, এ রাস্তায় তাদের পদচিহ্ন অসংখ্যবার চুম্বন করেছে। ল্যাম্পপোষ্টগুলো তিন বছর আগের মতোই স্থির হয়ে কৃত্তিম চঁােদর আলোয় চারদিক আলোকিত করছে। কিন্তু তার পরও আজ সব স্মৃতি হিসাবের পাল্লায় মাপতে হচ্ছে। আজকের হাটায় আর তিন বছর আগের হাটায় যেন তিন বছরের পথ পার্থক্য।
মাহি স্বভাবমতোই মাথা নিচু করে চিন্তিতভাবে হাটছে। নীলাও কোন শব্দ করেনা। দু’জন হাটে নৈঃশব্দের প্রতীক হয়ে। দু’জনের মনেই খেলা করে অতীত দিনের স্মৃতি। যেন দু’জন ভয়ংকর প্রলয়ের পর বেঁচে যাওয়া মানুষ। নীরবতাই এখানে স্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
হঠাৎ মাহি ক্ষীণ স্বরে অনেকটা দ্বিধা অস্বস্তি নিয়ে বলে- নীলা, ঐ দেখ ল্যাম্পপোষ্টটা।
নীলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ল্যাম্পপোষ্টের দিকে। তারপর মাহির মতোই- না, আরো ক্ষীণ স্বরে বলে, তোর কবিতাটা আমার কাছে আছে এখনো। চমৎকার হয়েছিল।
মাহি মনে করার চেষ্টা করে পুরু কবিতাটা। খুব বেশি বড় ছিলনা সেটা। নীলার সাথে প্রথম বন্ধুত্বের দিনই সে কবিতাটা লিখে। তখন মাহি থাকতো হলের গণরুমে। এভাবেই সন্ধ্যায় হাটতে হাটতে নীলা বলেছিল, ঐ দেখ সাদা লাইটের ল্যাম্পপোষ্ট। কেন জানি, আমার এ ল্যাম্পপোষ্টকে অনেক ভাল লাগে। বলে সেদিন সে অনেকক্ষণ ল্যাম্পপোষ্টের নিচে বসে ছিল। সেদিন আড্ডা আর জমে নি। কেন যেন বিষন্ন হয়ে পড়েছিল নীলা। মাহির মনে হচ্ছিল এ ল্যাম্পপোষ্টের দোষ। এর জন্যই সেদিনের আড্ডা জমেনি। কিন্তু মাহি ঐ দিনই তার ভ’ল বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে যে, এ ল্যাম্পপোষ্টটা তাদের বন্ধুত্বকে একদিনে যেন অনেকটা ঘনিষ্ঠ করে দিয়েছে। নীলা ঐ দিন ল্যাম্পপোষ্ট নিয়ে একটি কবিতা লিখার অনুরোধ করেছিল।
আজ তিন বছর পরও মাহি স্পষ্ট বুঝতে পারে, এ কবিতাই তাদের বন্ধুত্বকে এতটা ঘনিষ্ট করতে সাহায্য করেছে। নীলা কবিতাটা পড়ে খুবই উচ্ছসিত হয়েছিল। বলেছিল, মাহি, তুই অনেক বড় মাপের কবি।
মাহি ভাবে কবিতাটার একটা কপি চাইবে নীলার কাছে। তার কাছে এ কবিতার কোন কপি নেই। কবিতাটার কথা মনে হলেই সবার আগে মনে পড়ে কোন কপি না থাকার দুঃখের কথা। সে তাকায় নীলার দিকে। দেখে নীলাও অনেকটা বিষন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে ল্যাম্পপোষ্টের দিকে। তখন তার মনে পরে যে তারা দু’জনই ল্যাম্পপোষ্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মাহি কিছু জিজ্ঞেস করেনা। ভাবতে থাকে, এ ল্যাম্পপোষ্ট কি প্রথম দিনের মতো আজো, দীর্ঘ তিন বছর পরও তাদের কাছাকাছি করে দিচ্ছে? সে নীলার মুখের দিকে তাকায়। সেখানে কেমন যেন দুঃখের ছায়া লোকুচুরি করে। মাহি ভাবে, এখন কি আর এ ল্যাম্পপোষ্ট দু’জনের পূর্বের বন্ধুত্বকে ফিরিয়ে দিতে পারবে?
নাহ্! আপন মনেই ভাবে মাহি। তার বড় জানতে ইচ্ছা করে নীলা কী ভাবছে। তার মনেও কি এ কথাগুলোই খেলা করছে?
নীলা মাহিকে ল্যাম্পপোষ্টের নিচে বসতে বলে। বলে, চল, প্রথম দিনের মতো আজো আবার বসি এখানে কিছুক্ষণ। তারপর বসার আগেই বলে, মাহি, আমরা কি আবার আগের মতো হতে পারিনা?
আগের মতো- বলে মাহি চুপ করে থাকে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে ভাবতে শুরু করে আগের দিনগুলোর কথা। নীলা কীভাবে যে তার এতটা প্রিয় হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। দুই ঘন্টা কথা না বললে মনে হত বুঝিবা অনেক দিন কথা বলা হচ্ছেনা। প্রতিদিন তুচ্ছ সব অজুহাতে, আবার কখনো কোন অজুহাত ছাড়াই দেখা করা। একদিন দেখা না হলে কেমন যেন এক অভিমান, তা থেকে কষ্ট.. ..এইতো আগের দিন!!
এ আগের দিনে ফিরে যাওয়া কি আর মুখের কথা! মাঝে যে দীর্ঘ দিনের শূণ্যতা, এ পূরণ হবে কি দিয়ে। সেদিন প্রথম নীলাই বলেছিল, দেখ মাহি, আমার মনে হচ্ছে আমাদের বন্ধুত্বটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সবকিছু যেন একটু বেশি বেশি।
মাহি হাসতে হাসতে বলেছিল, তো এখন কি করতে হবে নী? মাহি মাঝে মাঝেই নীলাকে সংক্ষিপ্ত করে নী বলে ডাকতো। জবাবে নীলা যা বলেছিল মাহির আজো তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আজো মনে হয় এ যেন এক দুঃস্বপ্ন। যে কোন সময় দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু কোন কারনে আজো ভাঙ্গছে না। নীলা বলেছিল, আমি চাই আজ থেকে আমরা শুধু একজন ক্লাশমেট। আর দশজন ক্লাশমেট যেমন বন্ধু হয়, আমরাও তেমনি। এর বেশি আশা যেন কেউ কারো কাছে না করি।
পরের কিছুই মাহির আর মনে পড়েনা। সে কি বলেছিল, কি আচরণ করেছিল কিছুই না। শুধু এতটুকুই মনে পড়ে, রুমে এসে দরজা বন্ধ করে সে অঝোরে কেঁদেছিলো।
আগের মতো হওয়া মাহিরও কি খুব ইচ্ছা না? সে তো সব সময় একটি স্বপ্নই দেখছে, যে দুঃস্বপ্ন চলছে তার অবসান। কিন্তু আগের মতো হওয়ার পেছনে কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না অঝোরে কান্ন? মাহি বুঝতে পারে নীলা তার জবাবের অপেক্ষায়। কিন্তু সে কি জবাব দিবে তা ভাবতে পারছে না। মস্তিস্ক জবাব তৈরি না করে আগের দিনে ফিরে যেতে পছন্দ করছে। তার মনে পড়ছে, নীলার এমন কথা শুনে সে বাড়ি চলে যায়। বহু কষ্টে একেকটি দিন কাটে তার। গভীর ঘুমে থাকা অবস্থায় হঠাৎই যেন নীলার কল আসতো। ঘুম উধাও হয়ে যেত সাথে সাথে। জানতো, সবই অবচেতন মনের ফাঁকি। তার পরও মোবাইল হাতে নিয়ে কল লিষ্ট, রিসিভ লিষ্ট চেক করতো। এমনকি স্বপ্নে অনেকদিন নীলার এসএমএস পড়ে ঘুম থেকে উঠতো মোবাইল হাতে নিয়ে। এভাবে কাটে অনেক দিন। কষ্টের প্রাথমিক রেশটা কাটলে আবার চলে আসে ক্যাম্পাসে। তারপর আজ পর্যন্ত তার চলছে চোর পুলিশ খেলা। যথাসময়ে ক্লাশে এসে ক্লাশ শেষ হতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হলে চলে আসা। সব ধরনের আড্ডা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। এমনকি কোন অনুষ্টানেও উপস্থিত না হওয়া। সবই চলতো শুধু নীলার মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার ভয়ে। এভাবে ক্রমে মাস গেল, বছর গেল..।।
এত এত শুন্যতাকে ডিঙ্গিয়ে আগের মতো হয়ে যাওয়া কি সম্ভব? মাহি ভাবে, তারওতো সাধ হয় নীলার সাথে আগের বন্ধুত্ব তৈরি হুক। কিন্তু এটা কি সম্ভব হবে?
না। মাহি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, নীলা চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি। নীলাও কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর খালি এক রিক্সা পেয়ে উঠে বসে বলে, তোর আর কষ্ট করে এগিয়ে দিতে হবেনা। হলে চলে যা।
মাহি ভাবে, হ্যা, তাই ভাল। অনেক দিনের তৈরি হওয়া শূণ্যতা পূরনের মতো মানসিক সাহস তার নেই। সুতরাং যেমন আছি তেমনই ভাল। সে মনে মনে কৃতজ্ঞ হয় নীলার প্রতি যে, নীলা কোন চাপাচাপি করে কিছু তার উপর চাপিয়ে দিতে চায়নি। সে শেষ বারের মতো ল্যাম্পপোষ্টের নিচে দাঁড়ায়। তারপর কাজটা ভাল হল না মন্দ হল এমন দোলাচলের এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হাটতে থাকে নিজ হলের দিকে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×