‘দেশের প্রতিটা কাঁঠালপাতা যদি একটা করে একশো ডলারের নোট হয়ে যায়, তাহলেও দেশের কোন উন্নতি হবে না। দুর্নীতিবাজ কিছু লোকই সব লুটে-পুটে খাবে।’
‘জিনিসটা ধরতে পেরেছেন।’
হেডমাস্টার সাহেব আরও কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর উঠলেন। যাওয়ার আগে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না, এই বলে আফসোস করলেন।
তিনি চলে যাবার পর শওকত সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ‘শালা, দুর্নীতি নিয়ে তো ভালই লেকচার দিলি, তুই নিজে কি? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।’
তিনি হাই তুললেন।
ঘুমাতে হবে। প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে।
***
আরিফ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। ঠিক কি করবে বুঝতে পারছে না। পান্থ ভুয়াপুর যাওয়ার আগে তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছে যে সে যেতে চায় কিনা। সে না করেছে। এখন মনে হচ্ছে তার সাথে যাওয়াটাই ভাল ছিল। এখানে সে করার মত কিছু পাচ্ছে না।
শাহানা সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। আরিফকে দেখে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘আরে, আরিফ যে! কখন আসলে!’
‘জ্বি, কাল সন্ধ্যায় এসেছি।’
‘আল্লা! তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছো, প্রথমে চিনতেই পারি নি। ভাল আছো তো?’
‘জ্বি, আপু। ভাল আছেন?’
‘এই তো আছি।’
জান্নাত সম্ভবত শাহানাকে খুঁজছিল। গোল্ডমেডেলপ্রাপ্ত লোকটার গল্প আপুকে বলতে ইচ্ছা করছে।
শাহানা জান্নাতকে দেখে বলল, ‘জান্নাত, আরিফকে চিনতে পারছিস? কত বড় হয়ে গেছে!’
জান্নাত কোন উত্তর দিল না। আরিফের কেন যেন মনে হল জান্নাত কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। নাকি তার মনের ভুল!
শাহানা বলল, ‘অনেক লম্বা হয়েছো।’
আরিফ বিব্রত বোধ করল। কি বলবে বুঝতে পারল না।
জান্নাত তাড়াতাড়ি করে বলল, ‘আরিফ ভাইয়া তো আগের থেকেই লম্বা।’
দুই বোন নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আরিফ সেখান থেকে সরে আসল। তার কানে জান্নাতের কথাটা বাজছে।
কেমন যেন লাগছে তার!
***
আরিফ, সাইকেল চালাতে পারো?
আরিফ ঘুরে তাকিয়ে দেখল পান্থ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভুয়াপুর থেকে উনি কখন আসলেন তা আরিফ বুঝতে পারছে না। এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না।
‘জ্বি। পারি।’ আরিফ জবাব দিল।
পান্থ উৎসাহী গলায় বলল, ‘না পারলে চলো শিখিয়ে দেই।’
‘সাইকেল তো চালাতে পারি।’
‘ভালভাবে শিখিয়ে দেই, চলো।’
‘ভালভাবেই চালাতে পারি।’
‘আরিফ, তুমি কি জানো যে আমি চোখ বুজেও সাইকেল চালাতে পারি। দেখবে?’
‘এখন ইচ্ছা করছে না।’
‘চোখ বুজে সাইকেল চালানোর ব্যাপারটা শুনে যতটা কঠিন মনে হয় ততটা কঠিন কিন' না।’
আরিফ কিছু বলল না।
পান্থ হঠাৎ বলল, ‘ব্যাপার কি! তোমার মন খারাপ নাকি?’
‘না। মন খারাপ না।’
‘মন খারাপ থাকলে বলো- ক্যারাম খেলতে যাই। দুইটা রেড দিয়ে খেলব। দুই রেড দিয়ে কখনো ক্যারাম খেলেছো? হেবি মজা।’
‘খেলি নি ওরকম।’
‘মজা আছে। চলো যাই।’
‘থাক আজ।’
পান্থ বলল, ‘তাহলে চলো, গোসল করে ফেলি। তারপর ভাবব কি করা যায়। নাকি গোসল করতেও ইচ্ছা করছে না।... ভাল কথা, আরিফ, সাঁতার জানো তো?’
‘ভালভাবে জানি না।’
‘ভালভাবে জানি না - মানেটা কি?’
‘সাঁতার তেমন একটা পারি না। অনেকদিন আগে একটু-একটু শিখেছিলাম। এখন পারব কিনা বুঝতে পারছি না।’
‘সাঁতার তো ভালভাবে শিখতে হবে! চলো, শিখিয়ে দেই। বেশি না, এক ঘন্টার মামলা। এক ঘন্টায় সহজ সাঁতার শিক্ষা। ডুবসাঁতার পারো?’
‘নরমাল সাঁতারই ঠিকমত পারি না।’
‘ঠিকমত পারো না- মানে কি? ডিটেইলসে বলো।’
‘শুধু সামনের দিকে যেতে পারি, অন্য কোন দিকে যেতে পারি না। ভেসে থাকতে পারি কিন্তু দিক চেঞ্জ করতে পারি না নিজে নিজে।’
‘দিক চেঞ্জ করতে না পারলে চলবে কি করে? ধরো, যমুনায় বেড়াতে গিয়েছো। চড়লে নৌকায়। নৌকা তোমাকে নিয়ে কাত হয়ে গেল। তুমি পড়লে নদীর দিকে মুখ করে। এপাড় কাছেই, ওপাড় অনেক দূর। এখন তুমি কি করবে? সাঁতরে সারা যমুনা পার হবে?
’
পান্থর বলার ভঙ্গিতে আরিফ হেসে ফেলল।
‘সুতরাং ভালভাবে সাঁতার শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
‘তা ঠিক।’
‘তাহলে আসো। শিখিয়ে দেই। সাঁতার হল পানির মত সহজ একটা কাজ্ বড়জোর দুইঘন্টা লাগবে। এক ঘন্টা-এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা। কমপ্লিট সাঁতার শিখিয়ে দিব। তখন অভিজ্ঞতা থেকে নিজেই বই লেখতে পারবে-
দুই দিনে সহজ সাঁতার-শিক্ষা
মো: আরিফুল ইসলাম
... ফুটপাতে এই বই পনেরো-বিশ টাকায় বিক্রি হবে। এই ধরনের বইয়ের যে চাহিদা নেই তা কিন্তু না। চাহিদা আছে। গল্প-উপন্যাসের চেয়ে এ ধরনের বইয়ের চাহিদা বেশি।... দেরি না করে চলো, যাই। সাঁতার জিনিসটা আরো আগেই ভালমত শেখা উচিত ছিল।’
‘আসলে সেইরকম সুযোগ হয়ে ওঠে নি।’
‘দেশের বাড়িতে তো আসো না। সুযোগ হবে কি করে? ঢাকায় তো আর সাঁতার কাটার মত জায়গা নেই। জলাশয়ই নেই ভাল, ঝিল-গারা এইসবে ভর্তি।’
আরিফ তার সাথে একমত হল।
‘চলো, রেডি হয়ে নাও। সুন্দর একটা পুকুর আছে- সেখানে যাব।’
‘চলুন।’
পরবর্তী দেড় ঘন্টা ধরে পান্থ আরিফকে সাঁতারের বিভিন্ন কৌশল শেখাল। এত অল্প সময়ে যে এত কিছু শেখা যায় তা আরিফ নিজে উপলব্ধি না করলে বিশ্বাস করত না। সাঁতার জিনিসটা আগে তার কাছে এত কঠিন লাগত আর এখন মোটেও কঠিন লাগছে না। ইন্টারেস্টিং একটা বিষয়।
একসময় আরিফ বলল, ‘একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। আজকের মত উঠি না হয়।’
পান্থ খুশি-খুশি গলায় বলল, ‘উঁহু, আগেই না। আগে যথেষ্ট যে হয়েছে তার প্রমাণ দাও।’
‘প্রমাণ মানে?’
‘প্রমাণ মানে প্রুফ।’
‘কি প্রমাণ?’
‘যেটা করতে হবে সেটা হল এপাশ থেকে পুরো পুকুরটা পার হয়ে ওপাশে যাবে। খবরদার, মাটি টাচ করবে না। শরীরটাকে ওয়ান এইটি ডিগ্রী ঘুরিয়ে আবার এপাশে আসবে। এখানে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকব। আমাকে ছোঁবে। ছুঁতে পারলেই শেষ। তুমি পাশ।’
‘ওপাশে যেতে হবে? ওপাশ তো অনেক দূর।’
‘মোটেও দূর না। ছোট পুকুর।’
‘পারব না তো।’
‘মাইর খাবে একটা। চেষ্টা না করে কোন কথা বলবে না। আগে চেষ্টা তো করে দেখো।’
‘কাজটা কঠিন।’
‘মোটেও কঠিন না। আজকে প্রথম দিন বলে তোমাকে সহজ টাস্ক দিলাম কালকে আরো কঠিন টাস্ক দেব। হা হা।’
আরিফ বলল, ‘মাঝখানে কোন সমস্যা হলে কিন' আমাকে গিয়ে ধরবেন।’
‘সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না। এখন তুমি যাও। রেডি সেট গো।’
আরিফ একনজন পুকুরটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর লম্বা করে একটা দম নিয়ে শুরু করল। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটছে সে। পুকুরটা যে খুব ছোট তা না- ওপামে পৌঁছতে সময় লাগবে। সে সামনে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে আর কতটা পথ বাকি আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। সাঁতার কাটার সময় কোনকিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না।
অবশেষে তার মনে হল প্রায় ওপাশে পোঁছে গেছে। এবারের কাজটা কঠিন। থেমে উল্টোদিকে মোচড় নিতে হবে। পান্থ ভাইয়া গ্রাউন্ড টাচ করতে মানা করেছেন। আরিফ থেমে ভেসে থাকার চেষ্টা করল। তারপর সহজেই ঘুরতে পারল। ক্লান্ত লাগছে তার। সামনে এগোনো শুরু করল।
অবশেষে সে এপাশে এসে পোঁছালো। এখন পান্থ ভাইয়াকে ছোঁয়ার কথা।
কিন্তু পান্থ ভাইয়া কই?
আরিফ চারপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না।
সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল।
‘পান্থ ভাইয়া!’ ডাকল সে একবার।
কোন সাড়া আসল না।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ পেছনে শব্দ হল। পান্থ আরিফের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আরে, আরিফ! আমি এখানে। তুমি তো মনে হচ্ছে, ভয় পেয়ে গেছো। ভয় পাওয়ার কি আছে?’
আরিফ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি ছিলেন কোথায়?’
‘নিচে।’
‘নিচে মানে?’
‘নিচে মানে নিচে। আন্ডার দা ওয়াটার। হা হা হা।’
পান্থ অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
***
জান্নাত মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটা বই পড়ছে। বইয়ের নাম রুহান রুহান। খুব সুন্দর বই। নায়কের নাম রুহান।
সে যতই পড়ছে ততই.....
পর্ব ১-১০ এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে...........................................................)