শওকত সাহেব ঘুম-ঘুম চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটা একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনভাবে যেন কোন কারণে হঠাৎ কথা থামালে স্পিড ছবির মত বোম্ব ফাটার সম্ভাবনা আছে।
তার সামনে কয়েকহাত দূরত্বে লোকটা বসে আছে। সহজে চলে যাবে, এইরকমও মনে হচ্ছে না।
দুপুরবেলা অসময়েই কেন যেন তার খুব ঘুম পাচ্ছে। সামনে বসা লোকটিকে বলতে ইচ্ছা করছে- ‘ভাই, আমার খুব ঘুম এসেছে, আপনি যান। আপনার সাথে পরে কথা বলব।’
ভদ্রতার খাতিরে সেইরকম বলা যাচ্ছে না। তবে কথাটা বলা না গেলেও সিগনাল দিতে সমস্যা নেই। তিনি কিছুক্ষণ পরপর মস্ত বড় বড় হাই তুলছেন। হাইগুলো অত বড় করে আসছে না, তবুও তুলছেন। লোকটা এরপরও থামছে না। অভদ্রতার তো একটা সীমা আছে!
লোকটার নাম জালালুদ্দীন তালুকদার।
তিনি বলছেন, তিনি স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার। ভদ্রলোক দাবি করছেন, তিনি গোল্ডমেডেলপ্রাপ্ত।
শওকত সাহেব মনে মনে বললেন, গোল্ড মেডেল হয়েছেন, ভাল কথা, আমাকে বলছেন কেন! আপনার গোল্ড মেডেল গলিয়ে কি আমাকে সোনার চেইন বানিয়ে দেবেন!
লোকটার বেশি অহংকার। অহংকারী লোক তিনি পছন্দ করেন না। এই লোকটাকেও পছন্দ করতে পারছেন না। পছন্দ করতে পারছেন না বলেই তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না। অপছন্দের মানুষের কোন কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা যায় না।
অন্য সময় হলে তিনি লোকটাকে হয়তো কিছু কথা বলতেন। কিন্তু এখন ঘুম পাচ্ছে বলেই মূলত তিনি হুঁ-হাঁ করে চালিয়ে নিচ্ছেন। এইরকম লোকের সাথে বেশি কতা বলঅর মানেও হয় না।
হেড-মাস্টার বলেই হয়তো তিনি শিক্ষকদের মত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। ভঙ্গিটা যথেষ্ট বিরক্তিকর। তার মত একজন লোকের সাথে এইভাবে কথা বলবে কেন? ঘুমের ঘোরে আছেন বলে আপাতত শওকত সাহেব ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নিজেও একরকম ছাত্র-ছাত্র ভঙ্গিতে উত্তর দিচ্ছেন।
জালালুদ্দীন তালুকদার বলে যাচ্ছেন, ‘একটা শিশুকে মানুষ করে তুলতে অবদান থাকে তিন ধরনের ব্যক্তির। পিতা-মাতা-নির্মাতা। শিক্ষক হল সেই নির্মাতা। অর্থাৎ পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের সন্তান।’
‘জ্বি।’
‘বৃহৎ পরিমাপে, শিক্ষক হল গোটা জাতির নির্মাতা। চিন্তা করে দেখেন, একজন আদর্শ শিক্ষকই পারে সুচারুরূপে দেশটাকে গড়ে তুলতে।’
শওকত সাহেব চিন্তা না করেই জবাব দিলেন, ‘জ্বি, অবশ্যই।’
‘আফসোসের বিষয় হল, সেই শিক্ষকদেরই আজ মান-মর্যাদা নাই। শিক্ষকতাকে দেখা হচ্ছে, অপমানজনক পেশা হিসেবে। অন্য কিছু করতে না পারলে তবেই মানুষ এই পেশায় আসছে। শিক্ষকদের প্রতি যে জাতির মনোভাব এইরকম, সে জাতির হবেটা কি বলেন?’
‘কিচ্ছু হবে না।’
‘এরকম একটা জাতি কোন অতলে তলিয়ে যাবেন, বুঝতে পারছেন?’
‘বুড়িগঙ্গার নিচে। আন্ডার দা রিভার বুড়িগঙ্গা।’
‘বিষয়টা আপনি ধরতে পেরেছেন। সবাই যে ধরতে পারে তা না। সবার ধরতে পারা অবশ্য দরকারও নাই। আপনার মত লোকেরই জিনিসটা বোঝা দরকার। আপনারা যদি আমাদের দিকে না তাকান, তাহলে কে তাকাবে বলেন?’
‘তা তো বটেই।’
‘তা ভাইসাহেব, আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?’
শওকত সাহেব প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। হঠাৎ করে ই কথা কিভাবে আসল! তার ছেলেমেয়ে কয়জন তা দিয়ে এই লোকের কি দরকার! তিনি তো আদমশুমারি করতে আসেন নি।
তিনি মনে মনে বললেন, ছেলে-মেয়ে এক ডজন। ছয়টা ছেলে, ছয়টা মেয়ে। দুইটা ভলিবল টিম্।তোর কোন অসুবিধা আছে?
মুখে বললেন, ‘দুই মেয়ে।’
জালালুদ্দীন তালুকদার হাত কচলে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ্। আলহামদুলিল্লাহ। তাদের সাথে তো পরিচয় হল না।’
শওকত সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘জান্নাত, এই জান্নাত। শাহানা।’
জান্নাত সম্ভবত আশেপাশেই ছিল।
সে কাছে এসে দাঁড়াল।
শওকত সাহেব বললেন, ‘শাহানা কই?’
‘কোথায় যেন গেছে।’
‘কোথায় যেন গেছে মানে? কোথায় গেছে?’
‘জানি না।’
‘আহারে, দারুণ একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হতে পাল না। যাই হোক, তোর সাথে পরিজয় করিয়ে দেই- ইনি হচ্ছেন আলমনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জালালুদ্দীন তালুকদার।’
টক শো-র অনুষ্ঠানে উপস্থাপক কাউকে পরিচয় করিয়ে দিলে সেই ব্যক্তি যেভাবে মাথা দোলায় জালালুদ্দীন তালুকদার সেভাবে মাথা দোলালেন।
শওকত সাহেব মেয়েকে বললেন, ‘বুঝলি মা, বিরাট হৃদয়ের মানুষ। গোল্ডমেডেলপ্রাপ্ত। গোল্ড মেডেল কিন্তু মা, সহজ জিনিস না। সালাম কর্।’
‘আস্সালামু আলাইকুম।’
জালালুদ্দীন তালুকদার তরল গলায় বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। মা, তোমার নাম কি?’
শওকত সাহেব মনে মনে দারুণ বিরক্ত হলেন, নাম তো একটু আগেই শুনতে পেলি, এখন আবার জিজ্ঞাস করিন কেন?
‘জান্নাত।’ জান্নাত জবাব দিল।
‘খুব সুন্দর নাম। জান্নাত শব্দের অর্থ জানো?’
‘জ্বি। বাগান, উদ্যান।’
‘ঠিক বলেছো।’ জালালুদ্দীন তালুকদার বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসলেন। ‘তা মা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’
জালালুদ্দীন তালুকদারের চোখের দৃষ্টিটা ভাল না।
শওকত সাহেব তাড়াতাড়ি করে বললেন, ‘এবার এইচ.এস.সি দিল।’ বলেই জান্নাতের দিকে ফিরে বললেন- ‘ঠিক আছে, মা। এবার তুই যা।’
জালালুদ্দীন তালুকদার পুরোনো কথায় ফিরে গেলেন- ‘জাতির গঠনে একজন শিক্ষকই পারে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে। ইংরেজীতে বলা হচ্ছে- এডুকেশন ইজ দা ব্যাকবোন অফ এ ন্যাশন।... সেই কথা অনুযায়ী শিক্ষকরা হচ্ছে ব্যাকবোন-বিল্ডার্স। কথা ঠিক আছে কিনা, ভাইসাহেব?’
‘জ্বি। কথা তো ঠিকই বলেছেন।’
‘শিক্ষকরা যেহেতু জাতিকে গড়ে তুলবে সেহেতু তাদের হতে হবে মহান চরিত্রের লোক। শিক্ষকতা পেশাটাই মহান একটা পেশা। কারণ শিক্ষাই হল দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র ব্যাপার। কুরআন মাজীদের প্রথম বাক্যই হচ্ছে- পড়ো। মসজিদে যাও কিন্তু প্রথম বাক্য না।’
শওকত সাহেব মাথা নেড়ে সায় জানানোর মত একটা ভঙ্গি করলেন।
‘আফসোসের ব্যাপার কি জানেন? এই মহান পেশার মানুষদেরকে জনসাধারণ অপমান করছে মাত্র দুই-একজন হীন চরিত্রের লোকের কারণে। এরা সংখ্যায় খুব কম। কিন্তু পুরো শিক্ষকতা পেশায় এরা কলংক লাগাচ্ছে।
এরা হল এক্সসেপশন। বাংলায় বললে- ব্যতিক্রম। দু:খের বিষয় হল, পাবলিক আর কারো দিকে তাকায় না, পাবলিক তাকায় শুধু ব্যতিক্রমের দিকে।... আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?’
‘না, না। ঘুমিয়ে পড়ব কেন? আপনার কথাগুলো একটু চোখ বুজে অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলান।’
‘যা বলছিলাম... মাত্র কয়েকজনের জন্য সারাদেশের শিক্ষকদের অপমান হবে, এইটা কেমন কথা?’
‘তাই তো, এটা কেমন কথা!’
এই বিষয়ে বক্তৃতা শেষ করেও জালালুদ্দীন সাহেব থামলেন না। এপর তিনি বলতে লাগলেন শিক্ষার অভাবে কি কি সর্বনাশ ঘটতে পারে তা সম্পর্কে। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন- সমাজের বিভিন্ন ধরনের অপরাধ- চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি- এসবের মূল কারণ শিক্ষার অভাব। তিনি আরও জানালেন যে, মাদকাসক্তি ও এ ধরনের ব্যাপারগুলোও উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে সংঘটিত হয়।
‘...বুঝলেন ভাইসাহেব, বলতে বুকের ভিতর আঘাত লাগে- এই এলাকার কিছু তরুণ, বয়সী লোকও আছে সন্ধ্যার পর এরা গাঁজার আসর বসায়। আমার কথা হল- খাওয়ার মত এত কিছু থাকতে তোরা গাঁজা ক্যান খাবি? কত ধরনের খাবার আছে। রুটি-কলা খা, বিস্কুট-চানাচুর খা, মদ-গাঁজা এইগুলা খাবি ক্যান?’
এই প্রসঙ্গে যাওয়ার পর তিনি দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা শুরু করলেন।
‘...এই যে, দেশের আজকে এই অবস্থা, এর কারণ কি? কারণ দুর্নীতি। দুর্নীতি কি? দুর্নীতি মারাত্মক অভিশাপ। দুর্নীতি যদি শুধু না থাকত বাংলাদেশ তাহলে আজকে অনেক আপার পজিশনে থাকত।’
‘জ্বি। কথা তো ঠিক বলেছেন।’ শওকত সাহেব একমত হলেন।
‘দেশের প্রতিটা কাঁঠালপাতা যদি একটা করে একশো ডলারের নোট হয়ে যায়, তাহলেও দেশের কোন উন্নতি হবে না। দুর্নীতিবাজ কিছু লোকই সব লুটে-পুটে খাবে।’
‘জিনিসটা ধরতে পেরেছেন।’
হেডমাস্টার সাহেব আরও কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর উঠলেন। যাওয়ার আগে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না, এই বলে আফসোস করলেন।
তিনি চলে যাবার পর শওকত সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ‘শালা, দুর্নীতি নিয়ে তো ভালই লেকচার দিলি, তুই নিজে কি? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।’
তিনি হাই তুললেন।
ঘুমাতে হবে। প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে।
***
আরিফ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। ঠিক কি করবে বুঝতে পারছে না। পান্থ ভুয়াপুর যাওয়ার আগে.....
পর্ব ১-৯ এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে..................................................................................)