মনু মিয়া অবশ্য প্রথমে কথনোই তার সাথে যেতে রাজি হয় না। সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। পাকিস্তানের ফিল্ডারদের মত এক জায়গায় স্থির থাকতে পছন্দ করে।
তবে তাকে টানাটানি করতে হয়। টানাটানি করতে থাকলে এক পর্যায়ে সে রাজি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত না করতে পারে না। পান্থ কোথাও তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, মনু মিয়া যায় নি- এরকম কখনো হয় নি।
এবারও যথারীতি প্রতিবাদ করে মনু মিয়া বলল, ‘ভুয়াপুর তো যেতে পারব না। অসুবিধা আছে।’
‘কিসের অসুবিধা?’
‘নানান ধরনের অসুবিধা। অসুবিধা তো আর একটা না। মনো করো যে তোমার, অনেকগুলাই আছে।’
‘দু-একটা শুনি।’
‘প্রথম কথা, শরীরটা ভাল লাগতেছে না। কেমুন জানি ম্যজ-ম্যাজ করতেছে। এই শরীর নিয়ে তো যেতে পারব
না।’
‘বাইরে বেরোলে হাওয়া-বাতাস লেগে ভাল লাগবে। ঘরের মধ্যে বসে থাকলে তো ম্যাজ-ম্যাজ করবেই। চলো, যাই।’
‘জ্বালাইয়ো না, পান্থ। অসুবিধা আছে বইলাই যাইতেছি না। শরীর ভাল থাকলে অবিশ্যি যাইতাম। মাজাটাও ব্যথা করতেছে।’
‘তোমার মাজা সারাজীবনই ব্যথা থাকব, মিয়া।’
‘বললাম তো। অসুস্থ শরীর নিয়া যাইতে পারব না।’
‘একটু আগে তোমার গরুরে কি খাওয়াইলা, নিয়া আসো। তোমারেও এক ডোজ খাওয়ায় দেই। অসুখ ভাল হয়ে যাক। হা হা হা।’
মনু মিয়া কিছু বলল না।
পান্থ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘এত করে বললাম, তাও আসলে না। কি আর করা! একাই যাচ্ছি। দু’জন একসাথে গেলে মজা হত!’
পান্থ চলে যাচ্ছে দেখে মনু মিয়া ইতস্তত করে বলল, ‘একটু দাঁড়াও। আমি আসতেছি।’
পান্থহেসে ফেলল।
***
উঠানের একপাশে রান্নাঘর। জাহানারা বেগম তার মা-র সাথে কিছু একটা রান্না করতে করতে গল্প করছিলেন।
এমন সময় হঠাৎ করে শাহানা সেখানে উপস্থি'ত হয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উৎসাহিত গলায় বলল, ‘মা, কি করছো?’
জাহানারা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, শাহানাকে আজ বেশ হাসি-খুশি লাগছে।
শওকত সাহেব জান্নাতকে নিয়ে আগেই চলে এসেছিল, তিনি শাহানাকে নিয়ে যোগ দিয়েছেন- তিন-চার দিন হল। এই তিন-চারদিন শাহানা খুব মন খারাপ করে ছিল। দেশের বাড়িতে নাকি তার ভাল লাগে না। অথচ আজ ওকে খুব হাসি-খুশি লাগছে। জাহানারা বেগমের বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল। সন্তানের মন-খারাপ করা মুখ দেখতে কোন মায়ের ভাল লাগে?
তিনি মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলেও উপরে-উপরে বিরক্তি-বিরক্তি একটা ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস, রান্না করছি।’
শাহানা তার মা-কে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে বসল, ‘আমিও রান্না করব।’
‘তুই তো রান্না করতে পারিস না।’
‘ন শিখিয়ে দিলে পারব কিভাবে? শিখিয়ে দেবে।’
‘আগেও তো কত শেখাতে চেয়েছি, তোর তো কোনদিন আগ্রহ দেখি নি।’
‘আজ আগ্রহ আছে।’
‘আগ্রহের কারন কি?’
‘কোন কারণ নেই, এমনি।’
শাহানার নানী পাশ থেকে বলল, ‘রান্না-বান্না শিখনের দরকার আছে। দুইদিন পর শ্বশুরবাড়িতে যাবি!’
‘উফ! চুপ করো তো নানী! খালি উল্টা-পাল্টা কথা!’
‘ঠিক কথাই বলছি। রান্না করতে না জানলে বিয়ের পর স্বামীরে খাওয়াবি কি?’
‘কোনদিন বিয়েই করব না আমি!’
‘ছেড়ীর কথা শোনো!’
জাহানারা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মা, চুপ থাকো তো। এখন এসব কথা বলার দরকারটা কি?’
নানী চুপ করে গেলেন।
শাহানা রান্না করা দেখতে লাগল এবং একসময় বলল, ‘মা, এবার তুমি একটু সরো। আমি একটু রান্না করি।’
জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘যা তো। বিরক্ত করিস না।’
চলে যেতে বললেও তিনি মনে মনে খুব করে চাইছেন মেয়েটা তার সাথে এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকুক। তাকে জ্বালাতন করুক।’
শাহানা গেল না। মাটির চুলায় লাকড়ি-শলা এসব দিয়ে অহেতুকই খোঁচাখুঁচি করতে লাগল।
দেখতে এত ভাল লাগছে!
জাহানারার চোখে পানি আসার উপক্রম হল।
***
শওকত সাহেব ঘুম-ঘুম চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটা একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনভাবে যেন কোন কারণে হঠাৎ কথা থামালে স্পিড ছবির মত বোম্ব ফাটার সম্ভাবনা আছে।
তার সামনে কয়েকহাত দূরত্বে লোকটা বসে আছে। সহজে চলে যাবে, এইরকমও মনে হচ্ছে না.......
পর্ব ১-৮ এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে.................................................................।)