পান্থ ব্যস্ত ভঙ্গিতে একটা লিস্ট করছে। ভুয়াপুর থেকে কি কি আনতে হবে তার লিস্ট। এমনিতে সারাক্ষণই মনে হয়, এটা আনতে হবে ওটা আনতে হবে, কিন্তু কোন এক আশ্চর্য কারণে লিস্ট করার সময় কোন সেসব মাথায় আসে না। দারুণ মুসিবত!
লিস্টে যে কয়েকটা জিনিস স্থান পেয়েছে তার মধ্যে আছে-
১. ঘড়ি (ঘড়ি যেটা ছিল সেটার বেল্টের এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। হাতে পড়া যায় না। সময় অবশ্য ঠিক আছে। কিন্তু ঘড়ি হল হাতে দেওয়ার জন্য। পকেটে রেখে দেওয়ার জন্য তো না। পকেটে রেখে দেওয়ার জন্য মোবাইল আছে।)
২. দুই প্যাকেট সিগারেট (এক প্যাকেট বেনসন, আরেক প্যাকেট মার্লবোরো)
৩. টর্চলাইট (এই জিনিসটা গুরুত্বর্পূর্ণ। রাতে হাঁটাহাঁটির সময় খুব কাজে লাগে। আগের একটা ছিল, বাল্ব ফিউজ হয়ে গেছে- নতুন একটা কেনা আশু প্রয়োজন।)
আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস আছে। এগুলো গেল নিজের জন্য। এবার জানতে হবে আর কার কার কি কি আনতে হবে। জানার পর আইটেমগুলো লিস্টে এনলিস্ট করতে হবে।
সে লিস্টটা পকেটে রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। আর কার কি কি লাগবে তা জানতে হবে, সে ছাড়া এসব কাজ করার আছেটা কে? সবাই আছে নিজের তালে।
মুজতবা বললেন, গরুর মাংসের কথা। ছোটমামী প্রতিবাদ করলেন- খাসির মাংস আনা হোক। গরুর মাংস অনেকে খায় না।
এই নিয়ে দু’জনের মাঝে কিছুক্ষণ বাক-বিতন্ডা হল। শওকত সাহেব মধ্যস্থতা করে বললেন, ‘ঠিক আছে। দুইটাই আনা হোক। টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
মুজতবা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘দুলাভাই, আপনি মেহমান মানুষ। আপনি টাকা দিবেন কোন হিসাবে?’ এ নিয়েও কিছুক্ষণ কথা হল।
বলার মত আর যে জিনিস লিস্টে ইনক্লুড করা হল- নানীজানের ওষুধ। আর কয়েকদিন পরে আনলেও হত, তবে আগে থেকে এনে রাখাটাই ভাল।
পান্থ নিজের জন্য আরেকটা জিনিস লিস্টে ইনসার্ট করল- খাতা-কলম। খাতা-কলম হল লেখালেখির জন্য। কবিতা, গল্প মনে যা চায়। চারপাশে সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে লিখতে ইচ্ছা করে। সে অবশ্য লিখতে পারে না। কলম হাতে নেওয়া পর্যন্তই- একটা অক্ষরও আসে না। তারপরও খাতা-কলম এনে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে সুন্দর অনুভূতি হয় তখন লেখতে না পারলেও খাতা-কলম সামনে রেখে ‘লেখলাম-লেখলাম’ এরকম একটা ভাব নেওয়া যাবে।
***
‘জান্নাত, কন্ডিশন কি? কি অবস্থা?’
জান্নাত একা একা আনমনে পায়চারি করছিল। হঠাৎ করে পান্থর গলা শুনে চমকে উঠল।
পান্থ ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাবেন। অবশ্য তিনি কোন সময়ই স্থির থাকেন না। সারাক্ষণই লাটিমের মত ঘুরে বেড়ান।
জান্নাত মৃদু গলায় বলল- ‘কোথাও যাবেন?’
‘হ্যাঁ। ভুয়াপুর যাচ্ছি। আজকে কিন্তু জরুরি কাজ আছে। তুমি না করলেও শুনব না। হা হা হা।’
জান্নাত কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। যদিও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
‘বুঝলে জান্নাত, আমার হয়েছে আর কি, মাথার ঘায়ে কুত্তা-পাগল-টাইপ অবস্থা। চারপাশের যত কাজ সব আমাকেই করতে হয়। অবশ্য ঠিকই আছে। আমি ছাড়া আর কে একটা কাজ ঠিকমত করতে পারে বলো। একটা এক্সাম্পল তুমি দাও।’
জান্নাত চুপ করে রইল। কোন ‘এক্সাম্পল’ দিল না।
যেন বিদেশ যাচ্ছে এরকম একটা ভঙ্গি করে পান' বলল, ‘তোমার জন্য কি নিয়ে আসব বলো।’
জান্নাত আস্তে করে বলল, ‘আমার জন্য কিছু আনতে হবে না।’
‘কিছু আনতে হবে না বললে চলবে কি করে? অবশ্যই আনতে হবে। একটা কিছু তো বলো।’
‘যা আনতে বলব- তাই আনবেন?’
‘অবশ্যই আনব। প্রমিজ। জিনিসটা কি তা শুধু বলো।’
জান্নাত বলল, ‘না, কিছু আনা লাগবে না।’
পান্থ বলল, ‘ঠিক আছে। তাহলে এখন যাই। সারাক্ষণই এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে আছি আর কি দৌড়ের উপর।’
জান্নাতের বলতে ইচ্ছা করছিল, এত দৌড়ের উপর থাকেন কেন? স্থির হয়ে থাকতে পারেন না?
কিন্তু সে কিছু বলল না।
***
পান্থ সাইকেলটা নিয়ে বের হল। সাইকেলে করে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভাল লাগে। এখন সে যাবে মনু মিয়া কে ডাকতে।
মনু মিয়া গ্রামেই থাকে। পড়াশোনা অবশ্য ভালই করেছে কিন্তু বলার মত কোন কাজ পাচ্ছে না। লাইন ধরার অপেক্ষায় আছে। লাইন ধরে কোন একটা চাকরিতে ঢুকে পড়তে হবে। একবার কোন একটা চাকরিতে সেটল হতে পারলে শান্তি।
মনু মিয়াকে তাদের বাড়ির উঠানেই পাওয়া গেল। তার হাতে সাদামত কি একটা জিনিস। দানাদার পদার্থ। পানির সাথে মিশিয়ে গরুকে খাওয়াচ্ছে।
গরুটা সম্ভবত উৎসাহ বোধ করছে না। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিচ্ছে। গরুর চোখ সাধারণত শান্ত-শিষ্ট এবং স্থির দেখায়, কখনো বিরক্ত দেখায় না- এই গরুর চোখ বিরক্ত দেখাচ্ছে।
পান্থ সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘মনু মিয়া, করছোটা কি?’
মনু মিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলল, ‘আর বলো না, গরুটার অসুখ।’
‘তো কি, কীটনাশক খাওয়াইতেছো নাকি?’
‘বাইচলামি কইরো না। ক্যাচালের মধ্যে আছি।’
পান্থ গরুটার দিকে একনজন চোখ বুলিয়ে বলল, ‘দেখে তো সুস্থই মনে হয়। শরীরও মাশাল্লা।’
মনু মিয়া বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘একটু চুপ থাকো। আগে জিনিসটা খাওয়ায় নেই।’
পান্থ গরুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খাইস্ না! খাইস্ না! মরবি। বিষ দিছে, বিষ। বিষ বুঝিস? ব-য় ই-কার, মূর্ধন্য ষ।’
মনু মিয়া পান্থর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পারলে একটু মাথাটা চাইপ্পা ধরো, জ্বালাতন করিও না।’
পান্থ গরুর মাথা শক্ত করে চেপে ধরলে মনু মিয়া হাতের মধ্যে পানিতে ভেজানো সেই জিনিসটার কিছু পরিমাণ গরুটার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়।
পান্থ পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ‘থু কর। ওয়াক থু। বিষ দিছে। অ্যন্টি-কাউ। খাইলেই মরবি।’
মনু মিয়া একইভাবে আরেকবার জিনিসটা খাইয়ে দিতে যাচ্ছিল তখন গরুটা চটকা মেরে পান্থর হাত থেকে মাথা ছুটিয়ে নেয়।
মনু মিয়া বিরক্ত গলায় বলে, ‘আরে খাস্ না রে বাপ! তোর ভালর জন্যই তো! খালি উজানি!’
এই কাজে কিছুটা সময় ব্যয় হয়। কাজ শেষ হলে মনু মিয়া পান'র দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি কিন্তু মিয়া তোমার সাথে কোথাও যাইতেছি না।’
কথাটা সে আগেই বলল, কারণ সে জানে পান্থ এখন তাকে নিয়ে কোথাও যেতে চাইবে। ছেলেটার এইরকমই স্বভাব। সারাদিন দৌড়াদৌড়ির উপর আছে। এত দৌড়াদৌড়ি করে লাভটা কি?
পান্থ তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ঝটিতি রেডি হয়ে নাও। ভুয়াপুর যেতে হবে। জরুরি কাজ আছে। আর্জেন্ট টাস্ক।’
মনু মিয়া অবশ্য প্রথমে কথনোই তার সাথে যেতে রাজি হয় না। সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। পাকিস্তানের ফিল্ডারদের মত এক জায়গায় স্থির থাকতে পছন্দ করে।
তবে তাকে টানাটানি করতে হয়। টানাটানি করতে থাকলে এক পর্যায়ে সে রাজি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত না করতে পারে না। পান্থ কোথাও তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, মনু মিয়া যায় নি- এরকম কখনো হয় নি।
এবারও যথারীতি প্রতিবাদ করে মনু মিয়া বলল, ‘ভুয়াপুর তো যেতে পারব না। অসুবিধা আছে।’
পর্ব ১-৭ এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে............................................................)