জান্নাত তার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সকালের ঝকঝকে আলোয় তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
আরিফের মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্নদৃশ্য দেখছে।
জান্নাত তো আগে থেকেই সুন্দর ছিল। কিন্তু আগে কোনবার তো তাকে এত অপূর্ব লাগে নি।
আরিফ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। কয়েকটা মুহূর্ত সে জান্নাতের অপরূপ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েকটা মুহূর্ত।
‘আরিফ ভাইয়া, ভাল আছেন?’ কথাটা শোনার সাথে সাথে সে সম্বিত ফিরে পেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
সে মনে করেছিল কথা বলতে গিয়ে হয়তো আটকে যাবে কিন্তু কিছুটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সে বেশ সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে।
‘ভাল আছি, তুমি ভাল আছো?’
‘জ্বি। আব্বু আপনাকে একটু খুঁজছিলেন। তিনি বারান্দায় আছেন। আপনি যান। আমি জগটা ভরে নিয়ে আসছি।’
আরিফ এতক্ষণ খেয়াল করে নি, এখন দেখল, জান্নাতের হাতে একটা জগ। সে বলল, ‘দাও, আমি ভরে দেই।’
‘না, না। আমি ভরছি। আপনি যান।’
ঘরের সামনে বারান্দামত একটা জায়গায় শওকত সাহেব বসে বসে নারিকেল-চিড়া খাচ্ছিলেন। এই জিনিস তিনি অনেকদিন হল খান না। আজকে অনেকদিন পর খেয়ে ভাল লাগছে।
আরিফকে দেখে তিনি ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘আরিফ, আসো, আসো, বাবা।’
আরিফ সামনে এসে দাঁড়াল। ‘ফুপা, স্লামালিকুম। ভাল আছেন?’
‘আছি আর কি কোনরকম। বেশি একটা ভাল না। বোঝই তো, সচিব মানুষ।চারদিকে নানান ঝামেলা ট্যাকল করতে হয়।... তা, তুমি ভাল আছো তো?’
‘জ্বি, এই তো।’
‘তুমি যেন কোন কলেজে পড়ো? জানতাম... এখন মনে আসছে না, কত কিছূ মাথায় রাখবো, বলো?’
আরিফ বলল, ‘ঢাকা কলেজে। পড়তাম, এখন এইচ.এস.সি দিয়ে দিয়েছি।’
‘এইচ.এস.সি-ও দিয়ে দিয়েছো?’
‘জ্বি।’
‘তুমি তো তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছো।’
আরিফ কিছু বলল না।
‘রেজাল্ট দিয়েছে?’
‘জ্বি না।’
‘ওহ্, এখনও তো এস.এস.সি-র রেজাল্ট-ই দেয় নি। ইন্টারের দিবে কিভাবে? পরীক্ষা ভাল হয়েছে তো?’
‘জ্বি। মোটামুটি ভাল হয়েছে।’
‘কি মনে হয়, এ-প্লাস আসবে?’
‘ইনশাল্লাহ্, আসবে।’
‘সুন্দর জবাব দিয়েছো। ইনশাল্লাহ্। ইনশাল্লাহ্ শব্দের বাংলা কি হয় জানো তো?’
‘জ্বি। আল্লাহ যদি সহায় হোন।’
‘কারেক্ট। অত্যন্ত সুন্দর একটা কথা। ভবিষ্যতের কোন ইতিবাচক কথা বলার সময় ইনশাল্লাহ্ বলা ভাল। জান্নাতের পরীক্ষা যখন শেষ হল... এস.এস.সি পরীক্ষা... ও এবার এস.এসসি দিয়েছে, জানো নিশ্চয়ই?’
‘জ্বি।’
‘তো পরীক্ষা শেষ হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম- গোল্ডেন থাকবে তো? সে বলল, মনে তো হয় না থাকবে। কি নেগেটিভ কথা-বার্তা! শুনলে ইচ্ছা করে চড়ায়ে চাপার দাঁত ছুটিয়ে দেই।’
আরিফ কি বলবে বুঝতে পারল না।
শওকত সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ‘কবে যেন রেজাল্ট দিবে! তারিখটা মনে আসছে না।... আচ্ছা, আরিফ, ধরো গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে গেল। তখন কোন কলেজে ভর্তি করলে ভাল হয়?’
আরিফ এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘ভিকারূন-নিসা আছে। হলি-ক্রস আছে। ভিকারুন-নিসাই ভাল।’
‘সবার কাছ থেকে শুনছি... তা, তোমার বাবা ভাল আছেন তো?’
‘জ্বি। ভাল আছেন।’
‘তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা ছিল। অনেক দিন দেখা হয় না।... ঠিক আছে, তাহলে। তোমার সাথে কথা বলে ভাল লাগল।’
আরিফ চলে যেতে নিচ্ছিল, শওকত সাহেব পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘ইয়ে, আরিফ, দাঁড়াও, নারিকেল-চিড়া খেয়ে যাও। টেস্ট আছে।’
আরিফ শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘জ্বি, ফুপা, পরে খাব। হাতমুখ ধুই নি।’
‘হাতমুখ ধুয়ে আসো... আর জান্নাতকে দেখলে এদিকে আসতে বলো।’
‘জ্বি।’
***
পান্থ টুথ-পাউডারের কৌটা এনে আশে-পাশে আরিফকে দেখতে পেল না। জান্নাতকে দেখা যাচ্ছে টিউবওয়েল চেপে জগে পানি ভরছে। পান্থ সেদিকে ছুটে গেল।
‘আরে, করো কি?’
‘কি করি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’
পান্থ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তোমাকে পানি ভরতে কে বলেছে? সরো, সরো। ভরে দিচ্ছি আমি।’
‘না, না, অসুবিধা নেই।’
‘মাইর খাবে একটা। সরো। বলেই পান্থ জগটা জান্নাতের হাত থেকে এক প্রকার কেড়ে নিল। তারপর টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল ধরে এত জোরে চাপানো শুরু করল জান্নাতের ভয় হল, হ্যান্ডেলসুদ্ধ না খুলে যায়।
দুই চাপ দিতেই জগটা ভরে গেল।
‘নিয়ে যাও। নেক্সট টাইম এসব কাজে আমাকে বলবে? আমি আছি কি জন্য? কাজ করার জন্যই তো আছি। গায়ে বাতাস লাগানোর জন্য তো আমি নেই।’
পান্থ জগটা জান্নাতের হাতে দিতে যাচ্ছিল এমন সময় পানির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওহ্ শিট! ময়লা কিভাবে পড়ল?’
সে জগটা কাত করে পুরো পানি ফেলে দিয়ে আবার ভরতে লাগল।
গুন-গুন করে সে কি যেন একটা গান-ও গাচ্ছে। হিন্দী কোন গান। জান্নাত লাইনগুলো বুঝতে পারছে না। বুঝতে না পারলেও তার খুবই ভাল লাগছে।
পর্ব- ১, ২, ৩, ৪, ৫ এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে.....................................................................)