শওকত সাহেব উস-খুস করেছিলেন। তার এই উস-খুসের কারণ সিগারেট। রাতে খাওয়ার পর সিগারেটা না টেনে তিনি থাকত পারেন না।
তার স্ত্রী জাহানারা বেগম সিগারেটের ধোঁয়া একবারেই সহ্য করতে পারে না। হাতের কাছে কোন সিগারেটের প্যাকেট পেলেই তিনি সেটা ফেলে দেন।
এবারও নিশ্চয়ই সেরকম হয়েছে। এই পরশুদিনও তিনি একটা বেনসন এন্ড হেজেসের প্যাকেট হাটখোলার কাছে একটা দোকান থেকে কিনেছিলেন। মাত্র চারটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে।
শওকত সাহেব ঠিক করলেন তার স্ত্রীকে ডেকে কড়া করে একটা ধমক দেবেন। আস্ত সিগারেটের প্যাকেট ফেলে দেবে, এইটা কেমন কথা!
তিনি খক-খক করে গলা পরিষ্কার করে ডাকলেন, ‘জান্নাত, এই জান্নাত।’
জান্নাত বাবার সামনে এসে দাঁড়াল, ‘জ্বি, আব্বু।’
‘তোর মা কই?’
‘ঐ ঘরে।’
‘ডাক্। তোর মা-কে ডাক।’
জান্নাত চলে যাচ্ছিল এই সময় শওকত সাহেব পিছূ ডেকে বললেন, ‘আর শোন, আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যা।’
জান্নাত পানি দিয়ে তার মা-কে ডেকে আনতে গেল।
শওকত সাহেব ঢক-ঢক শব্দ করে পানি খেলেন। গলা পরিষ্কার করার একটা চেষ্টা। মনে মনে কি বলা যায় ভাবতে লাগলেন।
জাহানারা বেগম এসে কড়া গলায় বললেন, ‘কেন ডেকেছো?’
শওকত সাহেবের হঠাৎ করেই মনে পড়ল, এই মহিলাকে তিনি কিছুটা ভয় পান। তিনি কড়া করে যা বলবেন বলে ভাবছিলেন তা গুলিয়ে ফেললেন।’
‘প্যাকেট...’
‘প্যাকেট? প্যাকেট কি? কিসের প্যাকেট?’
‘সিগারেটের প্যাকেট?’
‘সিগারেটের প্যাকেট বুঝলাম- কি হয়েছে?’
‘ফেলে দিয়েছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন ফেললে?’
‘ইচ্ছা হয়েছে তা-ই।’
‘বেনসনের প্যাকেট ছিল। এর তো দাম আছে। টাকাগুলো অপচয় করলে। কাজটা কি ঠিক হল?’
জাহানারা বেগম অত্যন্ত কড়া গলায় বললেন, ‘তাতে কি অসুবিধা হচ্ছে তোমার কোন?’
শওকত সাহেব হাসির মত একটা ভঙ্গি করে বললেন, ‘হা হা। না। না। কিসের অসুবিধা। কোন অসুবিধা নেই। এভরিথিং ইজ ফাইন।’
‘সিগারেট কেনা মানেই টাকা অপচয়। আর কখনো সিগারেট খাবে না।’ জাহানারা বেগম আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গি করলেন।
‘অবশ্যই খাব না।’
‘প্রতিজ্ঞা করো।’
শওকত সাহেব ডানহাত মুঠো করে সামনে এগিয়ে শপথ নেওয়ার মত ভঙ্গি করে বললেন, ‘আই সোয়্যার বাই দা নেম অব গড।’
‘সিগারেট যেহেতু খাবে না, সুতরাং সিগারেটের প্যাকেটেরও আর দরকার নেই।’
‘দরকার থাকার প্রশ্নও আসে না।’
‘তো, সিগারেটের প্যাকেট ফেলে দেওয়ায় কোন অসুবিধা হয় নি। কথা বুঝতে পারছো?’
‘অবশ্যই বুঝতে পারছি। উচিত কাজ করেছো। আমিই তোমাকে বলতাম, আশে-পাশে কোন সিগারেটের প্যাকেট দেখলে ফেলে দিতে। আজে-বাজে জিনিস সাজিয়ে রাখার কোন মানে হয় না।’
***
পান্থ অস্বস্তি নিয়ে ঘোরা-ফেরা করছে। অস্বস্তির কারণ চিতল মাছ। চিতল মাছ সে একবারেই খেতে পারে না। বাড়াবাড়ি করে কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে। একটা খাওয়া শেষ করার পর মুজতবা মামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাছ কেমন লাগল, ফাটাফাটি না?’
সে তখন জবাব দিয়েছে, ‘শুধু ফাটাফাটি বললে ভুল হবে। অত্যন্ত ফাটাফাটি। এইরকম ডেলিসিয়াস ফুড অনেকদিন পরে খেলাম।’
এতটা এভাবে বলা ঠিক হয় নি। ফলাফলস্বরুপ, তাকে দ্বিতীয় আরেক টুকরো মাছ খেতে হয়েছে। এক টুকরাই সে খেতে পারে না, সেখানে দুই টুকরা। ডাবল-ট্রাবল।
খাওয়ার পর থেকেই মুখটা বিস্বাদ হয়ে আছে। এ তো দারুণ যন্ত্রণা হল দেখা যাচ্ছে। মুখ ভাল করার উপায় কি? কিছু তো মাথায় আসছে না।
পান্থ কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে।
‘পান্থ, এই পান্থ’ হঠাৎ ডাকটা শুনে সে চমকে গেল।
ঘুরে তাকিয়ে দেখল, শওকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ হাসি হাসি। পান্থকে দেখে খুশি গলায় বললেন, ‘পান্থ, বাবা, একটা কাজ করতে পারবে।’
পান্থ হঠাৎ সাংঘাতিক ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘কেন পারব না, খালুজান? অবশ্যই পারব। কি কাজ তাই বলেন।’
‘বড্ড সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। একটু এনে দিতে পারবে? যে কোন একটা হলেই হবে। বেনসন হলে ভাল হয়।’
‘বেনসন’, পান্থ শব্দটা ধরল। ‘বেনসন লাগবে, না? পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করেন। যাব আর আসব।’
‘বেনসন মনে হয় পাওয়া যাবে না কাছাকাছি। দূরে যেও না আবার। যেটা পাও নিয়ে এসো। স্টার ছাড়া। স্টারে একটু অসুবিধা।’
‘বেনসনই এনে দিচ্ছি। পাওয়া যাবে না মানে? অবশ্যই পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলে প্রয়োজনে ফলদা যাব। খালুজান আমাকে একটা কাজ করতে বলেছেন, আর আমি সেটা ঠিকমত করব না, এইটা কেমন কথা? আপনি জাস্ট তিন মিনিট ওয়েট করেন।’
শওকত সাহেব সন্তুষ্ট হলেন। কেউ একটা কাজ আগ্রহ নিয়ে করছে- দেখতেও ভাল লাগে।
পান্থ বেরিয়ে পড়ল। কাছেই একটা দোকান আছে। সমস্যা হল যে, দোকানটা খোলা আছে কিনা কে জানে! না থাকার একটা সম্ভাবনা। গ্রামদেশে এই এক সমস্যা। অন্ধকার হতে না হতেই সবাই ঘুম। কথা!
রাস্তায় বেশ ঠান্ডা বাতাস। হাঁটতে ভালই লাগছে। একটু একটু বৃষ্টি পড়লে আরও ভাল হত। গরমটা কমত।
মোড়ের কাছে এসে সে দেখল, দোকানটা সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে গেছে। এখর আরও খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। খারাপ না। ভাল। খোলা বাতাসে হাঁটতে খারাপ লাগছে না।
পরবর্তী দোকানটা খোলা পাওয়া গেল। দোকানদার জানালেন, বেনসন এখানে বিক্রি হয় না বলে তিনি রাখেন না। তবে তিনি নিজে বেনসন খান। কমদামী সিগারেট খেলে তার কাশ হয়।
তার কাছে চারটা বেনসন ছিল। পান্থ চারটাই নিয়ে আসল। দশ টাকার চারটা নোট সে দোকানদারকে ধরিয়ে দিল।
***
পান্থ সিগারেট তিনটা শওকত সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল।
‘খালুজান, আপনার সিগারেট। প্যাকেট পাওয়া গেল না। এই তিনটাই ছিল।’
শওকত সাহেব সন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘গুড। এতেই চলবে।’
‘কালকে দেখি ভুয়াপুর যাব। তখন নিয়ে আসব।’
‘ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই... পান্থ, তুমি কি সিগারেট খাও?’
‘কি যে বলেন খালু! আমি সিগারেট খাব কেন?’
‘যদি খাও তো লজ্জা করো না, একটা ধরাতে পারো।’
‘না, না, খালু। আমি সিগারেট খাই না। আমাকে দেখে তাই মনে হয়?’
শওকত সাহেব খানিকটা বিব্রত হয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করো না। এমনি বললাম।
তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে শুরু করলেন। পান্থ সেখান থেকে সরে আসল।
একটু দূরে গিয়ে পান্থ চতুর্থ সিগারেটটা বের করল। বেনসন আনাটা ভুল হয়েছে। টানাটানির মধ্য দিয়ে দশ টাকা বাতাসে উড়ে যায়, কোন নেশা হয় না।
***
পরদিন সকালে আরিফের খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল। রাতে খেয়েদেয়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। টানা ঘুম হওয়ায় শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। সে বিছানা থেকে উঠে পড়ল।
পান্থ তাকে উঠে পড়তে দেখে খুশি-খুশি গলায় বলল, ‘উঠে পড়লে, ভালই হল। চলো, বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি।’
আরিফ পোশাক পরিবর্তন করে বাইরে বেরিয়ে এল। চমৎকার সকাল। সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে এসে গায়ে লাগছে। খুব সুন্দর অনুভূতি।
আরিফ সজীব প্রাণবন্ত বাতাস বুকে টেনে নিল। চনমনে বাতাস ফুসফুসে টেনে নেওয়ার সাথে সাথেই মনটা এক ধরনের নির্মল আনন্দে ভরে যায়। মন ভাল হওয়ার জন্য আলাদা কোন কারণ লাগে না।
পান্থ এক জায়গায় আরিফকে দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, ‘একটু ওয়েট করো। আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি। এক সেকেন্ড একটু দাঁড়াও।’
আরিফ পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করল। পরিষ্কার করে রুমালটা পকেটে রাখল। চশমাটা চোখে লাগিয়ে সামনে তাকাল এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে পেল।
পর্ব- ১, ২, ৩, ৪ ক্রম অনুসারে এখানে
(চলবে.................................................................)