মোবাইলে “ক্রিং ক্রিং” টিউন সেট করেছি। টেলিফোন-টেলিফোন ভাব। নরমাল টিউন বাজতে থাকে- একবার পুরোপুরি বাজার আগেই অনেক সময় লাইন কেটে যায়। ক্রিং ক্রিং এর ব্যাপার সেরকম না।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
ফুপুর ফোন আসছে। সাতবার রিং হবার পর ধরলাম।
‘হ্যালো। হিমু স্পিকিং।’
ফুপু ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘রাখ্ তোর হিমু স্পিকিং। খবর বল্। বাদলের কোন খোঁজ পেলি?’
‘আস্তে। শান্ত হও। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ছেলে এনে দেব।’
‘টেনশন লাগে। বুঝিস?”
‘না বুঝার তো কিছু নেই। স্বাভাবিক ব্যাপার। ছেলে হারিয়ে যাবে, মার টেনশন হবে না। এ নিয়ে গানও আছে-।’ আমি বেসুরো গলায় হালকা টান দিলাম-
‘খোকা ফিরবে
ঘরে ফিরবে
কবে ফিরবে?
নাকি ফিরবে না?...’
‘
তুই কি আমার সাথে ফাজলামি করছিস?’
‘ফাজলামির কি আছে? তোমার কিরকম ফিলিংস হচ্ছে সেটা গানের মাধ্যমে বললাম। একটা উদাহরণ দিয়ে সেটা তুলে ধরলাম। এটাকে তুমি সহানুভূতি বলতে পারো। খোকা হারিয়ে যাবে, আমি খোকার মায়ের সাথে মোবাইলে ফাজলামি করব?’
‘কি জানি! তোর কোনকিছু বুঝা যায় না।’
‘বুঝা লাগবে না। জরুরী খবর শোনো... বাদলের দেখা পাওয়া গেছে।’
‘ক্বি? কোথায়? কোথায় ও?’
‘শান্ত হও। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। টেলিফোন আস্তে ধরো।’
ফুপু শান্ত হলেন না। আশান্বিত ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন ‘কোথায় দেখেছিস? ও এখন আছে তোর সাথে ?’ ফুপুর গলায় ছটফটপাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে।
আমি শান্ত স্বরে বললাম, ‘না। এখন সাথে নেই। সাথে রাখার উপায় ছিল না। থাকলে প্রয়োজনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম।’
‘মানে কি?’
‘ওর সাথে মনে মনে দেখা হয়েছে। টেলিপ্যাথি স্টাইলে। কথা না, শুধু দেখা। একতরফা। দেখেছি আমি তারে, দেখেনি সে আমারে- রকম দেখা। কোন যোগাযোগ করার উপায় ছিল না।’
ফুপুর আশার বেলুন চুপসে গেল। হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘হিমু! তুই এমন
কেন?’
***
পরদিন বিকাল। এলোমেলো গলির ভেতর দিয়ে হাঁটছি। ডেসটিনেশন ফুপার অফিস। শর্টকাট রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। অলিগলিতে হাঁটার একটা সুবিধা হল, দূরত্ব তাড়াতাড়ি অতিক্রম করা যায়। বড় রাস্তায় কোন জায়গাকে দেখে অল্পদূর মনে হলেও প্রকৃত দূরত্ব ধরা পড়ে হাঁটতে গিয়ে। রাস্তার প্রস্থের সাথে দৈর্ঘ্যকে জড়িয়ে মস্তিষ্ক ধোঁকা খায়।
অলিগলির ব্যাপার সেরকম না। তবে চোখের দৃষ্টি ব্লক হয়ে যায় সেটা একটা ব্যাপার। দোকান, বাড়িঘর পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘন ঘন মোড় পরিবর্তনের জন্য সামনেও বেশি দৃষ্টি চলে না। উপরে কাক, নীচে ম্যানহোল- এইসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। খোলা ম্যানহোলের ব্যাপারে। ঢাকা শহরে খোলা ম্যানহোলের অভাব নেই। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের কাজই ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করা। ভাল কাজের অভাব আছে। করতে চাইলে খারাপ কাজের অভাব নেই। এই শহরে নেই।
নদী যেমন সাগরে গিয়ে পড়ে, আমাকেও তেমনি বড় রাস্তায় গিয়ে পড়তে হল। এ সময় একটা হালকা দুর্ঘটনা ঘটল। আমি কাঁধে আমার বিখ্যাত ঝোলা নিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ ঢাল দিয়ে একটা রিকশা দ্রূতবেগে এসে ঝোলাটিকে চাকার সাথে পেঁচিয়ে ফেলল। আমার কাঁধ থেকে ছুটে গিয়ে তা চাকার সাথে কিছুদূর অতিক্রম করল।
রিকশাওয়ালা জলদি রিকশা থামাতেই বিশ-একুশ বছরের একটা অপরূপ সুন্দরী মেয়ে মাথা বের করল। কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘ভাই, আপনার লাগে নি তো কোথাও?’
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, ‘জ্বি না।’
মেয়েটা কাঁচু-মাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘দু:খিত।’
‘আপনার দু:খিত হবার কোন কারণ নেই।’
রিকশাওয়ালা ঝোলা হাতে এগিয়ে এসেছে। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব আনন্দের কোন ব্যাপার ঘটেছে। সে খুশি খুশি অবস্থায়ই বলল, ‘ভাইসাব, কিছু মনে নিয়েন না।’
***
অফিসে ঢোকার মুখেই পড়ে গেলাম, মিস্টার পি.এস. এর হাতে। মোবাইলে তার গলার স্বর শুনে মনে হয়েছিল, হ্যাংলা-পাতলা দুর্বল গোছের কোন লোক হবে। বাস্তবে সেরকম দেখা গেল না। মোটাসোটা শরীর। মুখে জাঁদরেল গোঁফ। ভয় পাবার মত চেহারা বলা যেত। হাসি-খুশি ভাবটা এসে মাটি করে দিল।
মিস্টার পি.এস. আনন্দিত ভঙ্গিতে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইসাহেব, আপনার কথা শুনেছি। সামনাসামনি পরিচিত হতে পেরে গর্বিত হলাম।’
আমি হেসে বললাম, ‘আমারও আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আনন্দ অনুভূত হল।’
‘হিমুসাহেব, আপনার ভাল নাম কি?’
‘হিম+আলয়, হিমালয়।’
‘অত্যন্ত সুন্দর নাম। আমার নাম আহমেদ সোলায়মান।’
‘আহমেদ আগে, সোলায়মান পিছে?’
‘জ্বি। আসেন ভাই, কোলাকুলি করি।’
‘এখন তো ঈদ না। কোন বিশেষ উপলক্ষ কি আছে?’
‘আপনাকে দেখতে পারাটাই বিশেষ উপলক্ষ।’ বলেই আমাকে প্রায় পিষে ফেলা হল।
ফুপা আমাকে দেখে রীতিমত খুশি হলেন।- ‘হিমু, তোমাকে দেখে ভাল লাগছে!’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
বলেই তিনি গ্লাসে চুমুক দিলেন। আমি চারপাশে তাকিয়ে বোতলের কোন অস্তিত্ব পেলাম না।
ফুপা বললেন, ‘ ইটস গুড টু সি ইউ। তোমাকে দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। ইটস অলওয়েজ প্লেজার টু সি ইউ।’
ব্যাটা বলে কি!
আমি বললাম, ‘অলওয়েজ প্লেজার হলে এক কাজ করুন। আমার ছবি তুলে টানিয়ে রাখুন। দুইটা টানাবেন। অফিসে একটা, বাড়িতে একটা। অলওয়েজ প্লেজারের উপর থাকবেন।’
ফুপা হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘হিমু। ইউ ফানি বয়।’
‘আই ফানি বয় ঠিক আছে। কিন্তু আমি এখন ফান করতে আসি নি।
সিরিয়াস কথা বলতে এসেছি।’
‘ওয়েট আ সেকেন্ড।’ ফুপা ডেস্কের নীচ থেকে বোতল বের করলেন।
‘ডেইলি মদ খাওয়া ধরেছেন?’
‘হা হা। না।’ ফুপা গ্লাসে তরল ঢালতে শুরু করেছেন। ‘শুধু ইংরেজীতে টি দিয়ে শুরু বারগুলোতে খাই।’
‘টুইসডে আর থার্সডে?’
‘না। এছাড়া টানডে, ট্রাইডে এন্ড ট্যাটারডে।’
বলেই ফুপা হো হো করে মারাত্মক ভঙ্গিতে হেসে উঠলেন। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জোকটা তিনি এইমাত্র ছাড়লেন।
আমি চোখমুখ গম্ভীর করার চেষ্টা করে বললাম, ‘আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।’
‘গুরুত্বপূর্ণ কথা মানে?’
‘ব্রেকিং নিউজ যাকে বলে।’
‘বলো। সংক্ষেপে বলো। ইন ডিটেইল বলার দরকার নেই। কাট শর্ট ইয়োর স্পিচ।’
‘আপনি খাবেন না এখন।’
‘অল্প অল্প খাব। নো প্রবলেম। ইউ সে হট ইউ ওয়ান্ট টু সে।’ ফুপা গ্লাসে চুমুক দিলেন।
আমি কিছু সময় অপেক্ষা করে বললাম, ‘বাদল হারিয়ে গেছে।’
‘হারিয়ে যাবে কেন? সে তার ফ্রেন্ডদের সাথে গেছে। বেড়াতে গেছে কিছুদিনের জন্য। হি উইল বি ব্যাক।’
‘জ্বি না। সেটা আসল ঘটনা না।’
‘আসল ঘটনা কি?’
আমি ফুপাকে আসল ঘটনা বললাম। সময় নিয়ে বিস্তারিত বললাম। কিছূ বাদ না দিয়ে। শুনে তিনি প্রথমে বিস্মিত, পরে ক্ষিপ্ত হলেন।
‘হট দা হেল ইজ গোয়িং অন? আমার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর আমি জানব না!’
আমি নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম, ‘আমার মনে হল, এটা আপনাকে জানানো জরুরী।’
‘অবশ্যই জরুরী। সন হারিয়ে যাবে, ফাদার জানবেও না?’
আমি জোকস্ ফিরিয়ে দিলাম, ‘টি দিয়ে শুরু পাঁচ দিনে ড্রিংক করবে!’
ফুপা হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে গেলেন, ‘সোলায়মান।’
মোটা শরীর নিয়ে সোলায়মান ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকল, ‘জ্বি, বস।’
‘গাড়ি বের করো।’
সোলায়মান এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল যেন ঘাড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যাবে।- ‘ইয়েস বস।
হিমু, তুমি কোথায়?...বাকি পর্বগুলো এখানে ক্রম অনুসারে
(চলবে.........................................)