মাঝ রাতে ঘুমোতে যাই,
কিছু দিন ধরেই নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখি,
ব্যাখ্যাহীন কিছু দুঃস্বপ্ন,
রাত গভীর হয়, আমি ঘুমিয়ে পরি।
কিছু বৃদ্ধকে সাথে নিয়ে শুরু হয় আমার দুঃস্বপ্ন-
বৃদ্ধগুলো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে,
পরক্ষনেই একসাথে কেঁদে ওঠে সবাই।
অজস্র বৃদ্ধের কান্নার আওয়াজ ছন্দ তোলে বাতাসে,
অদ্ভুত এক ট্রাম্পেটের সুর কানে বাজে,
এই সুর বেয়ে গড়িয়ে পরছে রক্ত।
বৃদ্ধের চোখে অগ্নি অশ্রু।
ভয় হয়! আমি ভাবী এরাই আমার শত্রু।
পরক্ষনে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, লাফিয়ে উঠি।
শেষ হয় স্বপ্নের প্রথম কিস্তি।
আমি ভাবী এগুলো দুঃস্বপ্ন।
মনকে শান্ত করে আবার ঘুমিয়ে যাই।
এবার বৃদ্ধগুলো আসে নিঃশব্দে,
আমি তাকিয়ে দেখি ওদের কারো চোখ নেই,
কারো হাত নেই, আবার কারো বুকে বুলেটের ক্ষত।
তাজা রক্তই গড়িয়ে পরছিল অবিরত,
ওদের অসহায় দেহ জুড়ে করুন আর্তি,
কি যেন চায় ওরা আমার কাছে!
আমার দেহ কঠিন হয়ে যায়,
বৃদ্ধগুলো আমায় স্পর্শ করে-
সাথে সাথে কান্নার তীক্ষ্ণ সুরে কান ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, লাফিয়ে উঠি।
আমি ভাবী এটি দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় কিস্তি, আবার ঘুমিয়ে যাই।
আবারো অসভ্য বৃদ্ধের পায়চারী!
ওদের কারো হাতে স্টেনগান,
আবার কারো হাতে কলম,
মুহূর্তেই কলমগুলো স্টেনগান হয়ে যায়,
আর স্টেনগানগুলো হয়ে যায় কলম,
ওরা দূর হতে আমাকে ডাকে,
আমি সাহস করে এগিয়ে যাই।
এক বৃদ্ধ আমার হাত ধরে এগিয়ে চলে বিদ্যুৎ গতিতে।
থেমে দেখি এক কর্দমাক্ত প্রান্তর, প্রান্তরে ছোপ ছোপ রক্ত।
চারপাশে ছড়িয়ে আছে অজস্র বীভৎস লাশ।
আমি চিনতে পাড়ি, এইতো ওই বৃদ্ধগুলোর লাশ!!
কিন্তু লাশগুলো তাদের যৌবনের।
আরে ওইতো শহিদুল্লাহ কায়সার,
ওইতো পড়ে আছে মুনির চৌধুরী নিথর দেহ
বুকের রক্ত দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন রক্তাক্ত প্রান্তর।
ডিসেম্বরের শীতল হওয়া আমার গায়ে লাগে,
দূরে ওই রাস্তা দিয়ে একটি মিলিটারি জীপ চলে যায়।
ভাল করে তাকিয়ে দেখি প্রান্তরটি আমার পরিচিত,
এটা বধ্যভূমি, আমার বাসা থেকে খুব কাছে
আমার বেলকোনি থেকে দৃষ্টিদূরত্ব।
কিছু বুঝে উঠার আগেই বৃদ্ধগুলো আমায় ঘিরে ফেলে,
একজন এগিয়ে এসে আমার কানে কানে বলে-
আর কতটা বৃদ্ধ হওয়ার পর দেশ স্বাধীন হবে?
আমি বলি-
আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে অনেক আগেই।
আমারা এখন স্বাধীন।
আমার কথা শুনে বৃদ্ধগুলো কান্না জুড়ে দেয়,
চোখ থেকে রক্ত ঝরে, সে রক্তে আগুন জ্বলে।
বৃদ্ধগুলোর গলাফাটা চিৎকারে আমি ভীত হয়ে যাই।
তীব্র কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়, আমি লাফিয়ে উঠি।
স্বপ্নের তৃতীয় কিস্তি শেষ হয়।
সিগারেট জ্বালিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজি।
সকাল হয়ে যায়, বেলকনিতে গিয়ে দাড়াই,
দূরে ওই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে অনেক লোকের জমায়েত।
ও হ্যাঁ ! আজ ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
দূর থেকে আমি ফুল দেয়া দেখি,
গন্ধহীন গাঁদা ফুলের সমাহার, গোলাপগুলো বিষণ্ণ।
আমারও ফুল দিতে ইচ্ছা জাগে।
বিকেলে আমার গাছের সুগন্ধি গোলাপ নিয়ে যাই,
বধ্যভূমিতে ফুলটি রেখে দাড়িয়ে থাকি নিশ্চুপ।
গোধূলির আলো এসে পরে আমার গোলাপে,
গোলাপের রঙ হয়ে ওঠে বৃদ্ধের রক্তের ন্যায়।
আমি চমকে উঠি! তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি।
ব্যস্ততা শেষ করে ঘুমোতে যাই,
শুয়ে শুয়ে প্রার্থনা করি-
বৃদ্ধের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাবার জন্য।
তারপর ঘুমিয়ে যাই- বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশে।