যে-রকম বোধ আমাকে বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে উৎসাহ দেয়, তার চেয়ে অনেক গুন তীব্র একটা বোধ আমাকে এই রিভিউ ও প্রিভিউ লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। শুরুতেই আমি একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেই, সেটা হচ্ছে রিভিউ ও প্রিভিউ এর মধ্যকার পার্থক্য। রিভিউ হচ্ছে আমাদের মত পাঠকের বা সমালোচকের চোখে বইটির ব্যাবচ্ছেদ আর প্রিভিউ হচ্ছে লেখক বই এর কভার পেজে যা লিখে রেখেছে বই সম্পর্কে। রিভিউতে আমি বা আপনি নিজের মনের মত কথা লিখতে পারব কিন্তু প্রিভিউতে কোন প্রকার বিকৃত করা যাবে না লেখকের লেখা।
আচ্ছা আপনারা যদি একটা বই পড়তে গিয়ে মুভি দেখার স্বাদ পান, তবে কেমন লাগবে? জ্বী আজকে যে বইটি নিয়ে আলোচনা করব, সেটা পড়লে আপনারা মুভি দেখারই স্বাদ পাবেন। অন্য সব লেখকদের থেকে এই বই এর লেখকের এখানেই পার্থক্য। তিনি শুধু আপনাদের গল্প শোনাবেন না, সাথে আপনাকে পুরো ব্যাপারটা কল্পনার চোখে তুলে দিবেন। এখানেই লেখক তার মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আপনার মনে হবে লেখকের সাথে পুরো বই জুড়ে, পুরো ঘটনা জুড়ে লেখকের পাশাপাশি আপনি হাঁটছেন, পুরো ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখতে পারছেন। গুমোট স্বল্পলোকিত ইটপাথরের দালানের শহুরে জীবনের ভেতর থেকে উজ্জ্বল সবুজ দক্ষিণের বাতাসে মাতাল প্রেমের বনভূমিতে নিয়ে আসবে লেখক আপনাকে। অদ্ভুত এক শিহরনে, শিহরিত হবেন আপনি। মুহূর্তেই হারিয়ে যাবেন অন্য ভুবনে।
উপন্যাস এর ঘটনা আজ থেকে ৪৫ বছর আগে লেখকের সাথে ঘটে যাওয়া হৃদয়-স্পর্শী সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। ঘটনা মূলত শুরু হয় ১৯৭১ সাল থেকে, তবে এটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস নয়। এটি নিখাত প্রেমের গল্প। প্রেমের উপন্যাস হলেও মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব ও সহমর্মিতা-বোধ, রক্ত সম্পর্কের বাইরে মা ও সন্তানের স্বর্গীয় ভালবাসা, মানবমনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি এবং তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ উঠে এসেছে এ লেখায়। হারিয়ে যাওয়া একটা সময় কে খুঁজে পাবেন এই লেখায়। লেখক বইটি রচনা করেন ২০০৯-২০১০ এর দিকে আর প্রকাশ করেন ২০১১ সালে। ১৯৭১ থেকে ২০০৯ তে হয় ৩৮ বছর, এই ৩৮ বছর ধরে বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার ঝর্ণাধারায় ভাসিয়ে দিয়েছেন ধূসর সাদা খসখসে বইয়ের পাতা আর সাথে পাঠকদের গল্পের পৃথিবী ও স্বপ্নলোক। উপন্যাস এর প্রধান পাত্র-পাত্রী এর ভালবাসার অভিনব আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হবেন সকল পাঠক-পাঠিকা।
বইয়ের নামঃ স্বপ্ন বাসর
লেখকের নামঃ আবু হেনা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
ঘরানাঃ আত্মজৈবনিক
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৭.৫/১০
প্রকাশনীঃ কেয়া পাবলিশার্স
প্রচ্ছদ ডিজাইনঃ মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর ২০১১
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১২
অধ্যায়ঃ ১৫
মূল্যঃ ১২০ টাকা
প্রাপ্তিস্থানঃ বইটির প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যাওয়ায় আপনাদের দ্বিতীয় সংস্করণ এর জন্য আগামী বই মেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক পরিচিতিঃ লেখক আমাদের সকলের সুপরিচিত, ব্লগের নিয়মিত মুখ, ছোট গল্প লেখক, চির সবুজ আবু হেনা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ভাই। তিনি পহেলা মার্চ, ১৯৫৫ সালে রাজশাহী জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্পূর্ণ করেন। পেশা জীবনে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে দীর্ঘ দিন চাকরী করার পর ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। স্ত্রী, দুই পুত্র সন্তান এবং পুত্র বধূ নিয়ে তার ব্যক্তিগত সংসার জীবন।
প্রচ্ছদঃ পুরো বই এর ভেতরে আমার খারাপ লাগার জায়গা এই একটাই। লেখক হয়ত গল্পের সাথে মিল রেখে প্রচ্ছদ ডিজাইন করিয়েছেন, তবে আমার কাছে মূল ঘটনার সাথে এবং গল্পের পাত্র-পাত্রী সাথে প্রচ্ছদ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়নি। গল্পের প্লট মূলত দু'টি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ের ভালোবাসার গল্প, যা গ্রামের আবহাওয়া এর ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। আর প্রচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে শহরের কোন যুবক-যুবতীর ভালোবাসার গল্প।
বাঁধাই ও পৃষ্ঠা মানঃ বই এর বাঁধাই ও পৃষ্ঠা এর কাগজের মান আমার কাছে খুব বেশি উচ্চমানের বলে মনে হয়নি, তবে এর একটা যুক্তিসংগত কারণও আছে। লেখক চেয়েছেন দামটা সকলের নাগালের মধ্য থাকুক, তাই তাকে বাধ্য হয়ে মানের ব্যাপারে একটু ছাড় দিতে হয়েছে। লেখক বইটি ব্যবসা করার বা নিজের খ্যাতির জন্য লেখেননি, তিনি শুধু তার মধ্যকার ৪২ বছর ধরে জমে থাকা পাহাড়-সম সুখ-দুঃখ, ভালোবাসাকে নিংড়ে দিতে চেয়েছেন।।
ফন্টঃ বইটিতে পাবেন একদম ঝকঝকে সুন্দর ফন্ট। আমার কাছে মনে হয়েছে ১১ ফন্টে লেখা এটি। লেখক চেষ্টা করেছেন বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠার জায়গার পরিপূর্ণ ব্যাবহার, এই ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ সফল। জায়গা একদমই অপচয় হয়নি, তিনি বইতে হাফ ইঞ্চি করে মার্জিন রেখেছেন।
বানান ও ভাষা শৈলীঃ একটি বইয়ের এমন উদ্দেশ্য হওয়া উচিত যাতে সকল শ্রেণীর পাঠক সহজে বুঝতে এবং অনুধাবন করতে পারে। লেখক এই ব্যাপারে প্রচুর সতর্ক ছিলেন, তিনি সকল শ্রেণীর পাঠক এর কথা মাথায় রেখে সহজ-সরল, প্রাঞ্জল এবং বোধগম্য কথ্য ভাষায় উপন্যাসটি রচনা করেছেন। যে কোনো শ্রেণীর পাঠক একদম সহজেই উপন্যাস এর গভীরে হারিয়ে যেতে পারবেন। একটি বই পড়তে গেলে তাতে বানানের ত্রুটি থাকলে তা পাঠের আনন্দ অনেকটাই নষ্ট করে দেয়। তিনি বানান এর ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন, অল্প সামান্য কিছু চোখে না পড়ার মত ভুল ছাড়া। তাই এই উপন্যাস পাঠের সময় বানান ভুল জনিত বিরক্তির উদ্বেগ হবে না পাঠকের।
এটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। লেখকের নিজের জীবনের টিন-এজ প্রেম কাহিনী। প্রথমে লেখটা তিনি একটা পত্রিকায় গল্প আকারে প্রকাশ করেছিলেন, পরে উপন্যাসের আঙ্গিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। এটি উত্তম পুরুষ জবানীতে লেখা উপন্যাস। উপন্যাস এর মূল বিষয় বহুল প্রচলিত নিষ্কলুষ দু'টি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ের ভালোবাসার গল্প, তবে অন্য সব উপন্যাস থেকে এটার পার্থক্য হচ্ছে এই উপন্যাস বড় বেশি জীবন্ত। এই লেখাতে লেখক তার পুরো আবেগ উজাড় করে দিয়েছেন।
উপন্যাসের প্রচলিত কাঠামো অনুযায়ী একটি অনুচ্ছেদ থেকে আর একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা রাখা হয় অথবা অনুচ্ছেদগুলি নম্বর দিয়ে আলাদা করা হয় তবে এই বইতে লেখক তা করেননি, তিনি অনুচ্ছেদ শুরুর আগে কবিগুরুর কবিতা ও গীতি কবিতার ছত্রবিশেষ ব্যবহার করছেন। যেমন-
“হৃদয়ের কাছাকাছি সেই
প্রেমের প্রথম আনাগোনা
সেই হাতে হাতে ঠেকা সেই আধো চোখে দেখা
চুপি চুপি প্রাণের প্রথম জানাশোনা-”
কবিগুরুর রচিত এমন কিছু অদ্ভুত সুন্দর লাইন দিয়েই শুরু হবে মূল উপন্যাস। প্রথম দিকে তার গ্রাম, গ্রামের বাড়ী এবং উপন্যাসের পাত্র পাত্রীদের পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন লেখক। তারপর সেখানে তার সাথে উপন্যাসের নায়িকা এর সাথে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন। আর এভাবেই দেখা দিবে এক পবিত্র প্রেমের কুঁড়ি, আরও সামনে গেলে দেখতে পাবো কিভাবে সেই কুঁড়ি পরিস্ফুট হয়ে পূর্ণাঙ্গ ফুল হয়ে ফোটে। না, শুধু উপন্যাসের নায়ক নায়িকার প্রেম নয় এখানে আপনি দেখতে পাবেন পেটে না ধরেও কিভাবে একজন নারী (উপন্যাসের ‘চাচী’ চরিত্র) কিভাবে একজন কে ব্যাকুল হয়ে নিজের সন্তানের মত ভালবাসতে পারে, একজন মানুষ (উপন্যাসের ‘দাদা’ চরিত্র) তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার দিয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, (উপন্যাসের ‘বাবা’ চরিত্র) কিভাবে বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সন্তানকে সঠিক আদেশ দিতে পারেন। ‘চাচী’ এর অতি-ভাল নারী চরিত্রের কিছুক্ষণ বাদেই দেখতে পাবেন সৎ চাচীর মত খল নারী চরিত্র। এত সব কিছুর পরেও উপন্যাসটি মূলত প্রবাহিত হয়েছে মূল চরিত্র “আলেয়া”কে কেন্দ্র করে। লেখক উপন্যাস এর নায়িকা আলেয়ার রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
“কাজল পরা চোখ, লালচে-ফর্সা গালে হাল্কা পাউডারের প্রলেপ মেয়েটাকে যেন দুধে আলতায় রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। সুগন্ধি তেল মেখে আঁচড়ানো পুরু গোছার কালো কুচকুচে চুল পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ছড়ানো”
পুরো উপন্যাস জ্বলে ওঠে প্রদীপের মতো, আলো দিতে থাকে পাঠকদের দিকে, আর আমরা সে আলোতে পথ দেখে দেখে লেখকের সাথে পথ হেঁটে আসি। সত্যিই এ বইয়ের দিকে তাকালে একে প্রদীপ না বলে থাকা যায় না। এ প্রদীপের শিখা অনির্বাণ। যা জ্বলছে উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার মনে চিরকালের উদ্দেশে। আমি এর থেকে বেশি কিছু বলতে চাই না, এতে বই পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বই পড়া শেষ হলে, যদি আপনি আমার মত অতি আবেগি হন তবে চোখ দিয়ে এমনিতেই টপটপ করে কিছু অশ্রু নির্গত হবে। আর যদি একটু শক্ত হৃদয়ের অধিকারী হন, তবে অশ্রু বিসর্জন না দিলেও একটা মন খারাপের চাদরে জড়িয়ে যাবেন ঠিকই। বই এর গল্পের সাথে নিজেকে একাকার করে দিতে ইচ্ছে জাগবে আপনার মনে। আপনি মনের অজান্তেই চাইবেন উপন্যাস এর নায়ক-নায়িকার কষ্টের বোঝার ভার নিজে কিছুটা বহন করতে।
প্রিভিউঃ
বিধাতার কাছে ছিল এক ফোঁটা চাওয়া
স্বর্গের সুখ নয়, নয় কোন বর
ওরা শুধু চেয়েছিল এতটুকু পাওয়া
মর্ত্যের কুঁড়ে ঘরে স্বপ্ন বাসর।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর ধর্ষণের মহোৎসবে উঠছে মানুষ নামের একদল হিংস্র জানোয়ার। পাকিস্তানী সৈন্য আর রাজাকার আলবদর নামের এইসব জানোয়ারদের কবল থেকে জীবন বাঁচাতে বিপন্ন অসহায় মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে গ্রামে। সীমান্ত পার হয়ে তারা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছে ভারতে। বেছে নিচ্ছে মানবেতর শরণার্থী জীবন।
ষোলো সতের বছর এক কিশোর তাঁর পরিবারের সাথে শহর থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিলো গ্রামে। দুর্গম ও জনবিরল এই অজ পাড়াগাঁয়ে তের চৌদ্দ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ভালবাসল সে। গোলাপের ফুটন্ত কুঁড়ির মতো প্রাণবন্ত, হরিণীর মতো চঞ্চলা চপলা সেই কিশোরীও ভালবাসল ছেলেটকে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা দু'জনে ঘুরে বেড়ায় এই পল্লী জনপদে। তারা ঘুরে বেড়ায় বনে জঙ্গলে, খালে বিলে, পুকুর পাড়ে, আমবাগানে, বাঁশের ঝাড়ে আর পানের বরজে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেতে আইলের ওপর দিয়ে হাত ধরাধরি করে তারা চলে যায় বহুদূর। বৈশাখী ঝড়ের সাথে সাথে আকাশ ভেঙ্গে নেমে আসা তুমুল বর্ষণে ওরা হারিয়ে যায় ভালোবাসার অজানা দেশে। নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ দু'টি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ের ভালোবাসার গল্প নিয়ে এই উপন্যাস।
সত্য ঘটনা ভিত্তিক লেখকের এই আত্মজৈবনিক উপন্যাস মানব মানবীর চিরন্তন প্রেম ভালোবাসার গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে হারিয়ে যাওয়া সময়ের এক জাদুকরী জগতে। ভালবাসার জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। পড়ুন সেই অবিনশ্বর ভালোবাসার মর্মস্পর্শী কাহিনী।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:১৯