আম্মি,
বহুদিন পর তোমাকে লিখতে বসলাম। মা দিবস তো, কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কত কথা যে মনে পড়ছে! কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। কী দিয়ে শুরু করি বল তো? আচ্ছা, প্রথম মা দিবস উদযাপন দিয়ে শুরু করলাম ।
মিশনারি স্কুলের ক্লাস টুতে পড়ি তখন। ঘন্টা বাজার কিছুক্ষণ আগে হীরাম্যাম বলল; 'আগামীকাল মাদার 'স ডে। তোমরা সবাই কালকে মাকে "আই লাভ ইউ" বলে উঈশ করবে। পারলে একটা গিফট দিও। ঠিক আছে?'
আমি আমার জমানো টাকা দিয়ে তোমার জন্য একটা হেয়ার ক্লিপ কিনলাম। মনে মনে প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম, সকালে কীভাবে উঈশ করব তোমাকে। কথাগুলো আওরে নিয়েছিলাম কয়েকবার।
কিন্তু লজ্জায় বলতে পারিনি,
" মা , তোমায় ভালোবাসি! "
বলব কিভাবে? কখনো বলেছি নাকি!
গিফট পেয়ে তুমি মিষ্টি করে একটু হেসে কানটা মলে দিলে। বললে; "টাকা পেলি কই?"
বললাম; "জমিয়েছি"
তুমি বললে; "মাকে আবার গিফট দিতে হয় নাকি? পাগলী মেয়ে!"
কী যে ভালো লেগেছে আমার!
তোমার মনে আছে, চাচী তোমার ওই হেয়ারক্লিপটা ভেঙ্গে ফেলেছিল বলে কি রাগ করেছিলে তুমি চাচীর উপর? চাচী তো অবাক! সস্তা একটা হেয়ারক্লিপের জন্য এত রাগ করার কী আছে?
আমি বলেছিলাম; "মন খারাপ করো না তো আম্মি! এইরকম আরেক টা কিনে দেব তোমাকে।"
"ওরে পাকনী" বলে তুমি নকল রাগ দেখিয়ে তেড়ে ধরতে এলে আমায়। আমি কি আর থাকি ধারেকাছে? দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
আমি সারাদিন খালি পড়ে যেতাম। সমান জায়গায় হোচট খেয়ে পড়ে যেতাম। শুকনো জায়গায় পিছলে পড়ে যেতাম। বৃষ্টির দিনে যখন আমাদের বাসার সামনের উঠানে কারো পড়ে যাবার শব্দ তোমার কানে যেত, তুমি না দেখেই বলতে, "কে আর পড়বে? আমার বোকা মেয়েটাই পড়ে গেছে!"
কী? হাসছো?
বলতে না, বলো?
তুমি তো ভাবতে তোমার মেয়েটা কাজের কাজ কিচ্ছু পারে না! আর কিছু পারি আর না পারি, তোমার ছেলেটাকে কিন্তু ঠিকই সামলে রেখেছি। হুম!
একবার কেন যেন খুব মারলে আমাকে। শলারমুঠি দিয়ে। পুরো শরীরে শলার দাগ পড়ে গেছিল । কিছু কিছু জায়গায় ছড়েও গেছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুমি মলম নিয়ে এলে আমাকে লাগিয়ে দিতে। আর তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়েই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কিন্তু চোখ খুললাম না। আমি জানি তুমি দেখিয়ে আদর করতে পছন্দ করো না। তাই আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর আদর দেখাচ্ছো। তোমার আদর পেয়ে আমি খুশি হলাম না। বরং প্রচন্ড রাগ হলো। তখন মেরে টেরে এখন খুব আদর দেখানো হচ্ছে!
কিন্তু একটু পর যখন আমার হাতের উপর ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণ পানির স্পর্শ পাচ্ছিলাম, তখন আর রাগ করে থাকতে পারিনি জানো? তোমার চোখের পানিতে আমার অভিমান সব ভেসে গিয়েছিল ।
কী খুব অবাক হচ্ছো? ভাবছ, আমি এইসব জানি আর তুমি কিছুই বোঝনি? দেখেছো, আমি কমনসেন্সলেস নই! তুমিতো সবসময়ই তাইই বলতে।
আরেকবার, আমার উপর খুব মন খারাপ হলো তোমার। থ্রিতে পড়ি। মিশন স্কুলে ওইটাই আমার শেষ বছর। কিন্তু আমি এই স্কুলে চার -চারটি বছর পড়াশোনা করেও কখনো কোন কিছুতেই প্রাইজ পাইনি। পুরস্কার বিতরনীর দিন তুমি তাই মন মরা হয়ে বসে আছো। আগেই জানতে আমি কোন পুরস্কার পাব না। তোমার মনখারাপ দেখে আমিও চুপচাপ তোমার পাশে বসে রইলাম।
কিন্তু ওই স্কুলে কেউ অংক অথবা ইংরেজীতে ১০০ পেলে প্রাইজ দেওয়া হত। সেবার ইংরেজীতে ১০০ পাওয়ার কারনে আমিও একটা প্রাইজ পেয়েছিলাম । তাই দেখে তোমার কী খুশি!
আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আম্মু! তুমি খুশি হয়েছো?" তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললে, "হ্যাঁ মা। আমি খুব খুশি হয়েছি!"
মনে আছে তো?
সাধারনত, প্রতিদিন ভোরে তুমি আধঘন্টা যাবত ডাকাডাকি করে আমার ঘুম
ভাঙাতে। কিন্তু সবসময় আমার বার্থডেতে অতি আদুরে গলায়, মৃদুস্বরে, মাথায় বিলি কাটতে কাটতে জাগিয়ে বলতে, "মা উঠো! আজকে না তোমার জন্মদিন?
হ্যাপি বার্থডে!"
প্রতিদিন যেই আমি তোমার ঝাড়ি না খেয়ে ঘুম থেকে উঠতে পারতাম না, সেই আমি তোমার এই মোলায়েম কন্ঠের একটা আদুরে ডাকেই জেগে উঠতাম! কারন তখন আমার বিছানার এককোনে থাকতো ওই দিনকার প্রথম গিফটবক্সটা।
আমার মাঝে মাঝে কিছু উদ্ভট সাইকোলজিকাল প্রবলেম দেখা দেয়। একবার, কোন একটা বার্থডের আগের দিন ঘুম থেকে উঠেই আমার মনে হলো, আমি তার পরদিনই মানে ২০তারিখেই মরে যাবো। কারন কিছু কিছু বিখ্যাত লোকের জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হয়েছে। যদিও আমি বিখ্যাত কেউ নই, আমার এমনটা মনে হতেই থাকলো, হতেই থাকলো।
আর যতবারই কথাটা মনে হচ্ছিলো, ততোবার আমি কেবল কেঁদেই যাচ্ছিলাম। এমন একটা অদ্ভুত কারণে কান্নাকাটি করার জন্য আব্বু আমাকে খুব বকাঝকা করেছিলো। কিন্তু তুমি সেদিন আমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে বের হলে। শুধু আমাকে নিয়ে। বাবুকেও সাথে নাওনি। যেটা তুমি কখনোই করতে না। (বরাবরই আমার ধারনা ছিল তুমি আমাকে আদর
কর না, কেবল আমার ভাইকেই আদর কর) আমরা দুজন একসাথে ঘুরলাম, বেড়ালাম, শপিং করলাম এবং তারপর
দুজনে একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে রাতে বাসায় ফিরলাম। আমার মনটা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছিলো তখন।
জানো? তুমি যেদিন রাতে মরে গেলে, আমি তোমার কাছ থেকে ৩০০ মাইল দূরে ছিলাম। জানতামও না তুমি মরে যাচ্ছো। জানলে তোমাকে কিছুতেই মরতে দিতাম না। ওইরাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি । পারার কথা? তুমিই বলো?
তুমি মরে যাওয়ার চারদিনের দিন কি হলো জানো? আমি ছাদ থেকে পড়ে গেলাম পা ফস্কে। কোমরে ব্যথা পেলাম সেই মাপের। একে তো তুমি নেই, সব এলোমেলো। তার উপর আমি আহত হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছি। গ্রামের মহিলাগুলো কি বলতে শুরু করলো, জানো? বলল, এটাকে নাকি "মা দশা" বলে। মায়েরা নাকি মরে গেলে তার সন্তানদের তার কাছে নিয়ে যেতে চায়! তুমি নাকি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যেতে চাইছো; তাই আমি ছাদ থেকে পড়ে গেছি! কি হাস্যকর চিন্তা ভাবনা!
অবশ্য ব্যাপারটা সত্যি হলে খারাপ হতো না। আমি আর তুমি উপরে বসে বাবা আর বাবুকে দেখতাম! মজা হত না বলো?
তোমার ছেলেটা কেমন জানি হয়ে গেছে। জানো? প্রতিবছরই ইসলামী সংগীত গেয়ে পুরস্কার পায় ও স্কুল থেকে। কিন্তু পুরস্কার পেয়ে কোন উচ্ছ্বাস দেখায় না। চুপচাপ নিজের সেলফে এনে রেখে দেয়। কাওকে কিছু বলেও না।
এবার কি গেয়েছিল ও জানো?
"মা , মা তুমি আমার আগে যেও না গো মরে …"
কেমন জানি কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওর গলাটা। কেঁদেছিল কিনা , ঠিক বুঝতে পারিনি। তোমার ছেলেটা খুব শক্ত হবে। সহজে কাঁদে না।
তুমি যখন ছিলে আমি কখনোই রাত জাগতাম না। ১০ থেকে ৫ টা, সারারাত ঘুমাতাম। ফজর পড়ে পড়তে বসতাম। তোমার সাজানো নিয়মে।
তুমি যখন চলে গেলে;ল, আমার তখন পরীক্ষা। অভ্যাস বদলে গেল। নিয়ম বদলে গেল। সারারাত পড়াশোনা করে সকালে ঘুমাতাম তখন। ফজর পড়ে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম এসে যেত। এবং অবধারিত ভাবেই তোমাকে স্বপ্নে দেখতাম। মাঝেমাঝে তোমাকে দেখার জন্যই ভোরবেলায় ঘুমাতাম। চলে গেছো ঠিক, কিন্তু তারপরও প্রতি রাতে এসে আমার সাথে দেখা করে যেতে। তোমার ওই নীল শাড়িটা পরে। শাড়ি পরলে কী যে সুন্দর লাগে তোমায়!
স্বপ্নে কত কথা বলতাম আমি তোমার সাথে! আব্বুর নামে বিচার দিতাম। বাবু কী কী দুষ্টামি করেছে, সেসব বলতাম। তুমি শুধু হাসতে। একটা কথাও বলতে না। সবসময় চুপচাপ।
প্রথম প্রথম ভাবতাম, এগুলো হয়তো শুধুই স্বপ্ন, আর কিছুই নয়। কিন্তু তুমি যে সত্যিই আসো এটার প্রমাণ পেলাম সেদিনই, যেদিন আমি আর তানভী আপু একই স্বপ্ন দেখলাম! প্রতিদিনই আসতে তুমি।
একসময় তুমি স্বপ্নে আসা বন্ধ করে দিলে। শেষ কবে এসেছিলে, মনে পড়ে না। ধীরে ধীরে তোমার স্মৃতি গুলো ম্লান হতে থাকল।
তোমার ওই নীল শাড়িটা খুঁজে পাই না মা। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! এখন আর বাইরে বেরুলে তোমার প্রিয় চকবার আইসক্রিমটাও খাই না। খেতে পারি না।
তুমি চলে গেছো আজকে সাত বছর হলো। আমি বলব না, এই সাত বছরের প্রত্যেকটা মূহুর্ত তোমাকে মিস করেছি। কিন্তু এই সাত বছরে তোমার অভাব হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি। তোমার অনুপস্থিতিতে জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে আমার। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করা এই আমি ছন্নছাড়া হয়ে গেছি। জীবনের সব আশা
হারিয়ে গেছে। বিগড়ে গেছি আমি। নষ্ট
হয়ে গেছি। তোমার মনমত হতে পারিনি . . . তোমার কোন স্বপ্ন পূরণ করিনি। আশাহীন হয়ে জীবনযাপন করছি …
আজকাল যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি; তখন তোমাকে খুব মিস করি, জানো? খুব অসহায় লাগে। জানতেই তো, আমি একদম কমনসেন্সলেস। তোমাকে ছাড়া ঠিকমতো চলতে পারব না। জানতে না এইসব? তবুও কেন গেলে? কেন?
লোকে যখন বলে; "মেয়েটা মায়ের মত হলো না!" তখন খুব কষ্ট লাগে , জানো? চলেই যখন যাবে, সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলে না কেন? কেন তোমার মত বানিয়ে দিয়ে গেলে না?
চিন্তা ভাবনা গুলো কি স্বার্থপর হয়ে গেছে , তাই না? সম্পর্ক গুলো , অনুভূতি গুলো ও স্বার্থপর হয়ে গেছে। তবুও চোখ থেকে একুয়াস হিউমার নিঃস্বরিত হয়। সেই সাথে মাথা ব্যথার প্রকোপও বেড়ে যায়। এক্স ব্র্যান্ডের ইউনিভার্সাল অয়েল মেখে চোখ বুজে পড়ে থাকি বিছানায়। বন্ধ চোখের কিনার ঘেষে অশ্রু ঝরে তখনো।
তোমার বেঁধে দেওয়া নিয়ম ভেঙ্গে সারারাত জেগে থাকি এখন। ল্যাপটপ অথবা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রাত পার হয়ে যায়। কখনো কখনো ল্যাপটপ খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। তাই এখন আর স্বপ্নে তুমি আসো না, তাই না? আমি জানি, অভিমান করে আসো না তুমি …
শামসুর রহমানের একটা কবিতা পড়েছিলাম, "একটি ফটোগ্রাফ"। ওতে বলা হয়েছিলো, দুই বছরের
মাথায় লেখক তার মৃত ছেলের কথা ভুলে গেছেন।
ভেবেছিলাম আমিও ভুলে যাবো। বিশ্বাস করো মা, আমি পারিনি। এখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তোমার কথা মনে করে বালিশ ভিজাই! তোমার ঝাড়ি, তোমার চোখ রাঙানী আর আমাকে না বুঝতে দিয়ে করা তোমার
আদরটুকু খুব মিস করি! ভীষণ মিস করি!
জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে, জানো? তুমি থাকলে গোছানোই থাকত। আমার আর ভালো লাগেনা, মা! সবকিছু খুব অসহ্য লাগে এখন। কী করব বলে দাও!
মা! তোমাকে খুউব দেখতে ইচ্ছে করছে। কবে আসবে তুমি? এসে আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখো। অনেকদিন তোমার স্পর্শ পাই না। আজ খুব চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করছে ,
"মা! তোমায় ভালোবাসি! "
- তোমার মেয়ে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ রাত ২:৪১