শ্রম আদালতের স্থগিতাদেশ এবং শ্রম আইনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ছাটাই করেছে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ। গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মুসলেহউদ্দিন ভুট্টো, আহমেদ মিজানুর রহমান, জাহিদুল ইসলাম ও আরিফুল ইসলাম নামের চারজন সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা-কর্মীকে কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণ বিধি লংঘনের কারণ দেখিয়ে চাকুরি থেকে অব্যহতি প্রদান করেছে বাংলালিংক যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও শ্রম অধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন:
প্রথমত, অব্যহতি প্রাপ্ত ব্যাক্তিরা বাংলালিংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সক্রীয় নেতা-কর্মী । এই এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে রেজিস্ট্রিশনের আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১৮৬ অনুসারে রেজিস্ট্রিকরণের দরখাস্ত অনিষ্পন্ন থাকা অবস্থায় চাকুরির শর্ত পরিবর্তন করা যায়না এবং চাকুরির অবসান ঘটানো যায় না।
দ্বিতীয়ত, বাংলালিংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন কর্তৃক শ্রম আইনের ২১৩ ধারা অনুযায়ী - প্রস্তাবিত ট্রেড ইউনিয়নকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এরকম কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা সহ ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তা, সাধারণ সদস্য এবং সাধারণ এমপ্লয়ীদেরকে যেন হয়রানিমূলক টার্মিনেশন, বদলী এবং চাকুরির ক্ষতি করতে না পারে- এই মর্মে একটি মামলা(বি,এল,এ মামলা নং-১২৯/২০১৬) শ্রম আদালতে বিচারাধীন। শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২২৮ অনুযায়ী শ্রম আদালতে কোন কার্যধারা চলাকালে শ্রম আদালতের পূর্ব অনুমোদন ব্যতিরেকে ট্রেড ইউনিয়নের কোন কর্মকর্তাকে ডিসচার্জ, বরখাস্ত অথবা অন্য কোন ভাবে অসদাচরণের জন্য শাস্তি দেয়া যাবে না। অথচ বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ এই মামালা চলাকালীন অবস্থায় অসদাচরণের দায়ে বাংলালিংক এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের চাকুরি থেকে অব্যহতি প্রদান করেছে।
তৃতীয়ত, বাংলালিংক এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম আদালত গত ২৯/০২/২০১৬ তারিখে এক আদেশের মাধ্যমে আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি না হওয়া পর্যন্ত প্রস্তাবিত ইউনিয়নের সকল কর্মকর্তা ও সাধারণ সদস্যদের চাকুরি থেকে টার্মিনেশন, ছাটাই ইত্যাদির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যা এখনও বলবত রয়েছে। বাংলালিংক কর্তৃক কর্মী ছাটাই এই আদেশেরও সুস্পষ্ট লংঘন।
চতুর্থত, আচরণ বিধি লংঘনের যে অভিযোগে তাদেরকে ছাটাই করা হয়েছে তাও তদন্তের মাধ্যমে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় নি। লেটার অব ডিসমিসাল বা অব্যহতি পত্রে কোম্পানির আচরণ বিধি লংঘনের কথা বলা হলেও আচরণ বিধির ঠিক কোন ধারা লংঘনের কারণে তাদেরকে অব্যহতি দেয়া হলো- তা সুনির্দিষ্ট করে উল্ল্যেখও করা হয়নি। শূধু বলা হয়েছে- ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সহ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে নাকি কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানি, আটক, অবরোধ এবং কর্মস্থলে অ্যাবিউজ করার অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বেশিরভাগ অভিযোগই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে পরিস্কার উল্ল্যেখ করা হয়েছে। একমাত্র যে অভিযোগটি(আটক/ঘেরাও) প্রমাণিত হয়েছে বলে দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির একজন সদস্য তার রিপোর্ট লিখেছেন, সেবিষয়ে তদন্ত কমিটির অপর সদস্য লিখিত ভাবে ভিন্নমত জ্ঞাপন করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলালিংক ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা হলো রিস্ট্রাকচারিং বা পুনর্গঠনের নামে বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাটাই। ডিজিটাল রুপান্তরের নামে বিপুল সংখ্যক কর্মীদেরকে অযোগ্য ও অদক্ষ ঘোষণা করে তিন চার মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করে দেয়া। কিন্তু এই ছাটাই কার্যক্রম শুরু করার আগেই বাংলালিংকের কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে ফেললে কিছুটা বিপাকে পড়ে যায় বাংলালিংক ম্যানেজমেন্ট। বলা যায়, পরীক্ষামূলক ভাবে ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত একজন সিনিয়র কর্মীকে ছাটাই করে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে যায় তারা। হুট করে অস্বচ্ছ ভাবে কোন কারণ না দেখিয়ে একজন কর্মী ছাটাইয়ের প্রতিবাদে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলালিংকের প্রধান কার্যালয় টাইগার ডেন এর সামনে কর্মীদের স্বত:স্ফুর্ত বিক্ষোভ করার ঘটনাকে উপলক্ষ করে বেশ কয়েকজন কর্মীকে(যার মধ্যে সদ্য টারমিনেট হওয়া কর্মীরা ছিলেন) শোকজ বা কারণ দর্শাও নোটিশ দেয়া হয়। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জারি করা শোকজ নোটিশ এ তাদেরকে কতগুলো মিথ্যা ও কল্পিত অভিযোগে কেন আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভাঙচুর করা, রায়টের পরিস্থিতি তৈরী ইত্যাদি। সকলেই জানেন, গণমাধ্যমেও এসেছে- ঐ রাতে কি ঘটনা ঘটেছিল। কর্মীরা স্বত:স্ফুর্ত ভাবে বাংলালিংকের প্রধান কার্যালয় টাইগার ডেন এর সামনে জমায়েত হয়ে সেখানে উপস্থিত সিটিও এর কাছে কর্মী ছাটাইয়ের কারণ জানতে চায় এবং না জানা পর্যন্ত স্থান ত্যাগে অস্বীকৃতি জানায়। এই সময় কর্মীরা পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, রায়ট বা দাঙ্গা ও ভাংচুরের মত কোন ঘটনাই সেদিন ঘটেনি।
কর্মীরা এই বিষয়গুলো উল্ল্যেখ করে শোকজ নোটিশের জবাব দিলে, বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে সেই জবাব সন্তোষজনক না হওয়ার কারণ দেখিয়ে গত ১০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে একটি দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্য এবং চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলালিংক ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে জনাব সৈয়দ তৌফিক ওয়াহিদ(যিনি হেড অব অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন অপারেশন) কে নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটর অপর সদস্য হিসেবে বাংলালিংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদকে মনোনিত করা হয়। ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত জনাব সৈয়দ তৌফিক ওয়াহিদের রিপোর্টের সারমর্ম হিসেবে লেখা হয়েছে-
১. অভিযুক্তরা ১১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন- এটা প্রমাণিত হয়েছে।
২. রায়ট বা দাঙ্গা হাঙ্গামা বা ভাঙচুরের কোন ঘটনায় যুক্ত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
৩. সিটিও কিংবা কোম্পানির ডিরেক্টরকে হুমকি প্রদান কিংবা কোন রুমে আটক রাখার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
৪. প্রবেশ পথ আটকে রাখার প্রমাণ ভিডিও ফুটেজ থেকে পাওয়া গেছে।
রিপোর্টে উল্ল্যেখ ছিল, অপর সদস্য বখতিয়ার হোসেনের এই ফাইন্ডিংস বিষয়ে কিছু ভিন্নমত রয়েছে, ফলে তিনি পৃথক ভাবে তার রিপোর্ট প্রদান করবেন। বখতিয়ার হোসেন তার পৃথক রিপোর্টে ৪ নং পয়েন্টের প্রবেশ আটকে রাখার অভিযোগ সম্পর্কে বলেছেন- প্রমাণ হিসেবে সাবমিট করা ভিডিও'র সাথে কোন শব্দ না থাকায় নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই অভিযুক্ত কর্মী আসলেই গাড়ি বা মানুষ চলাচলে বাধা দানের উদ্দেশ্যেই সেখানে হাজির ছিলেন কিনা।
অর্থাৎ খোদ ম্যানেজমেন্টের গঠন করা তদন্ত কমিটির কাছে বেশির অভিযোগ অপ্রমাণিত এবং একটি অভিযোগ বিষয়ে কমিটিতে ভিন্নমত থাকার পরেও- বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ সেই তদন্তের দোহাই দিয়েই চারজন কর্মীকে বেআইনি ভাবে চাকুরিচ্যুত করল।
বাংলাদেশের সংবিধান এবং শ্রম আইন অনুসারে অধিকারের দাবিতে কোথাও জড়ো হওয়া কিংবা বিক্ষোভ প্রদর্শন বেআইনি নয়। অথচ অন্যায়ভাবে সহকর্মীকে ছাটাই করার প্রতিবাদ কর্মসূচীতে হাজির থাকবার ঘটনাকে কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি লংঘনের ঘটনায় পরিণত করে চার জন ট্রেড ইউনিয়নকর্মীকে চাকুরিচ্যুত করলো বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ। বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ তার মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে কর্মীদের মধ্যে আতংক ও ভয়-ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই কাজটি করেছে তা কর্তৃপক্ষের আচরণ, বক্তব্য, মিথ্যা অভিযোগে কারণ দর্শাও নোটিশ ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে কারণে শ্রম আদলত বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে ছাটাইয়ের ব্যাপারে স্থগিতাদেশ জারি করেন, সেই সাথে বাংলালিংক কর্তৃক মামলা খারিজ করার আবেদন খারিজের আদেশে বলেন- “পছন্দ মতো ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার স্বাধীনতা প্রত্যেক শ্রমিকের মৌলিক অধিকার। প্রথম পক্ষের(এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন) ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন আবেদন বিচারিধীন থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় পক্ষ(বাংলালিংক ম্যানেজমেন্ট) প্রথম পক্ষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন মর্মে প্রথম পক্ষ দাবী করেন যাহা অমূলক নয়।”
প্রকৃতপক্ষে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইউনিয়নের চারজন কর্মীকে চাকুরিচ্যুত করার ঘটনাটি কর্মী ছাটাইয়ের বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশ। এই টারমিনেশনের উদ্দেশ্য কর্মীদের মধ্যে এই মর্মে ভীতি প্রতিষ্ঠা করা যে- বাংলালিংক ম্যানেজমেন্ট দেশের শ্রম আইন, শ্রম আদালতের রায় ইত্যাদি সবকিছুকে উপেক্ষা করে যে কোন কিছু করতে সক্ষম। এইরকম অবস্থার প্রতিকার না হলে, বেআইনি ভাবে চাকুরি চ্যুত কর্মীরা চাকুরি ফিরে না পেলে বাংলালিংকের ভীতি ছাড়নোর প্রচেষ্টাই সফল হবে যা সামনে বাংলালিংকের অবশিষ্ট কর্মীদের জন্য আরো ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনবে এবং দেশের শ্রম অধিকার লংঘনের এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ও অন্যান্য কর্পোরেটদেরকেও শ্রম আইন লংঘনে উৎসাহিত করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২১