ট্রেড ইউনিয়ন করার অপরাধে গার্মেন্টস শ্রমিক ছাটাই এর খবর প্রায়ই শোনা যায়। ছাটাই এর প্রতিবাদে, মজুরির দাবীতে কিংবা ম্যানেজমেন্টের নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রায়সই শোনা যায় অমুক গার্মেন্টস এর শ্রমিকরা মালিকপক্ষকে ঘেরাও করেছে, পড়ে পুলিশ বা র্যাব গিয়ে তাদের উদ্ধার করেছে। বাংলালিংকের কর্মীরা হয়তে কখনও ভাবেনি তাদেরকেও এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কিন্তু পুঁজিপতি মালিকপক্ষের চরিত্রটাই এমন- মুনাফার জন্য পারে না এমন কোন কাজ নেই- হোক তা দেশীয় গার্মেন্টস মালিক বা বহুজাতিক কর্পোরেশন।
বহুজাতিক বাংলালিংক এতদিন আদর করে তার কর্মীদের ‘টাইগার’ বলে সম্বোধন করে এসেছে- যেকারণে গুলশানে বাংলালিংক এর হেড অফিসের নাম দেয়া হয়েছে- ‘টাইগার ডেন’। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে সেই টাইগার ডেনের সামনে দেখা গেল অভাবনীয় দৃশ্য- কোম্পানির চিফ টেকনিক্যাল অফিসার মিশরীয় নাগরিক পেরিহান এলহামি টাইগার ডেন থেকে বের হতে চাচ্ছেন কিন্তু কয়েকশা কর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
কারণ ঐদিন সন্ধ্যায় বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ একজন সিনিয়র টাইগারকে হঠাৎ ছাটাই করেছে- আদরের টাইগারকে কুকুরের মতো বের করে দিয়েছে। তাকে ডেকে টার্মিনেশন লেটার ধরিয়ে দিয়েছে, তার অফিসিয়াল ল্যাপটপ সিজ করে নিয়েছে, এমনকি তাকে তার ব্যাক্তিগত সামগ্রী নেয়ার জন্য পর্যন্ত তার ডেস্কে ফিরতে দেয়া হয়নি- অন্য একজন সহকর্মীর মাধ্যমে তাকে তা সংগ্রহ করতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ছাটাই করে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল- হঠাৎ করে ছাটাই এর কারণে কর্মীরা তাৎক্ষণিক কিছু করতে পারবেনা, শুক্র শনিবার বন্ধ থাকায় তাৎক্ষণিক উত্তেজনা রবিবার নাগাদ থিতু হয়ে আসবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সাথে যুক্ত কর্মীদেরকে বেশ একটা ভয়-ভীতির মধ্যে ফেলে দেয়া যাবে। কিন্তু বাংলালিংকের কর্মীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এক অভাবনীয় সংহতির দৃষ্টান্ত তৈরী করে- তারা সকল ভয়ভীতি অতিক্রম করে বিদেশী সিটিও কে ঘেরাও করে এই ছাটাই বাতিল করার দাবী করতে থাকে। কর্মীরা বুঝতে পারে, গার্মেন্টস এর মতোই ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করার কাজে যুক্ত থাকার কারণে শরীফ হোসেনকে ছাটাই করেছে বহুজাতিক ভিম্পেলকমের বাংলাদেশি সাবসিডিয়ারি বাংলালিংক।
বাংলালিংকে বেশ কিছুদিন ধরেই কর্মী ছাটাইয়ের কথা বার্তা শোনা যাচ্ছিল। নেটওয়ার্ক এক্সপানসন মোটামুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় কোম্পানি এখন আর আগের পুরনো বিশ্বস্ত কর্মীদের দরকার মনে করছে না, তারা এখন কোম্পানির দায়ভার- মুনাফার সর্বোচ্চ করণের জন্য এখন তাদেরকে ছাটাই করাই কোম্পানির জন্য লাভজনক। এক পর্যায়ে নতুন সিইও এরিক অস ‘টাউন হল’ সেশনের(এক ধরণের ঘরোয়া কর্মী সভা) মাধ্যমে ছাটাইয়ের কথা ঘোষণা করে- যদিও কত জন কর্মী কি কারণে ছাটাই করা হবে, তাদের কম্পেনসেশন কি হবে এইসব কোন কিছুই পরিস্কার করেনি। অবশ্য সিই্ও এর এই স্বীকারোক্তির আগেই কর্মীরা সংগঠিত হয়ে ট্রেড ইউনিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশানের আবেদন সম্পন্ন করে ফেলে। শ্রম আইনের ধারা ১৮৬ অনুসারে, ট্রেড ইউনিয়নের দরখাস্ত অনিস্পন্ন থাকা অবস্থায় মালিক পক্ষ কোন শ্রমিক বা কর্মীকে চাকুরি থেকে ছাটাই করতে পারবে না। কিন্তু তারপরও অবৈধ ভাবে কর্মী ছাটাই করে গার্মেন্টস মালিকের মতোই আচরণ করল বহুজাতিক কর্পোরেট বাংলালিংক।
এদিকে চিফ টেকনিক্যাল অফিসার পেরিহান এলহামিকে উদ্ধার করার জন্য ম্যানেজমেন্টের কেউ আসেনা। পেরিহানের বক্তব্য হলো, এই সিদ্ধান্ত আরো উপর থেকে এসেছে, তার কিছুই করার নাই। আরো উপর অর্থাৎ সিইও এবং মূল কোম্পানি বহুজাতিক ভিম্পলকম। কর্মীরা জানে এটা একা কারো সিদ্ধান্ত নয়, হেড কোয়ার্টারের সিদ্ধান্ত ও অনুমোদন ছাড়া এরকম এগ্রেসিভ আচরণ লোকাল ম্যানেজমেন্টের করতে পারার কথা না। তারা পেরিহানের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে বার্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। এদিকে মিডিয়াকে নানা ভাবে যুক্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে- এক পর্যায়ে কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া এসে হাজির হয়, নিউজ স্ক্রলে ঘেরাও এর খবর চলে আসে, যদিও প্রিন্টমিডিয়ার অনলাইন ভার্সন ও পরদিনের ছাপা কাগজে বোধগম্য কারণেই এর কোন চিহ্ন দেখা যাবে না। খবর পেয়ে আন্দোলনকারী বাংলালিংক কর্মীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে আসে গ্রামীণ ফোন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন।
দুই গাড়ি পুলিশ সন্ধ্যা থেকেই উপস্থিত ছিল। গভীর রাতে এক পর্যায়ে এসে হাজির হয় র্যাব। সম্ভবত পেরিহানের দেশ মিশরের দূতাবাসের সাথে সরকারি যোগাযোগের ফলাফল স্বরুপ ঘটনাটা ঘটেছে- হাজার হলেও বিদেশী বিনিয়োগের নিরাপত্তা বলে কথা!
শিল্পপুলিশ যেমন শ্রমিকদের ঘেরাও থেকে গার্মেন্টস মালিকদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়, র্যাব তেমনি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে পেরিহান এলহামি কে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। বাংলালিংকের কর্মীরা কোন বাধা দেয় নি- তারা শুধু বলেছে- র্যাব দিয়ে সিটিও কে সাময়িক উদ্ধার করা গেলেও কোম্পানি তো আর র্যব দিয়ে চালানো যাবে না! রবিবার থেকে তারা আবার আন্দোলনে যাবে- প্রয়োজনে লাগাতার কর্ম বিরতির মাধ্যমে কর্মী ছাটাইয়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪৪