এলার্ম আসলেই তাদের ছুটতে হয়- পাওয়ার এলার্ম, ফায়ার এলার্ম, হাই টেম্পারেচার, লো ভোল্টেজ ইত্যাদি যেসব এলার্ম বা বিপদ সংকেত মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার বা বিটিএস এর জন্য বিপদজনক, সেসব এলার্ম আসলে যে মানুষগুলো সবার প্রথমে ছুটে যায় টাওয়ার থেকে টাওয়ারে তারা বাংলালিংকের নীচু তলার কর্মী, টেকনিশিয়ান। দিন রাত যে কোন সময়, শীত বর্ষা বন্যা ঝড় যাই থাকুক তাদেরকে ছুটতে হয়। তারা বিটিএস রুমের মেইন ডিস্ট্রিবিউশান বোর্ডের ইলেক্ট্রিক্যাল মেনটেনেন্স, বিটিএস থেকে বিটিএস এ ঘুরে ঘুরে জেনারেটর চালানো, জেনারেটর সার্ভিসিং, ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্যবার সিড়ি বেয়ে বহুতল ভবনের ছাদে উঠা থেকে শুরু করে কয়েকশ ফুট উচু টাওয়ারে উঠে মাইক্রোওয়েভ এন্টেনার ট্রাবলশুটিং ইত্যাদি সকল বিপদজনক,দূরহ, ঝুকিপূর্ণ কাজগুলো মূলত তারাই করে। এদেরকে বিএসএস অফিসার, এনএসএস অফিসার ইত্যাদি গালভরা ডেসিগনেশান বা পদবী দেয়া হলেও বাংলালিংকের কর্পোরেট জগতে কিন্তু তাদের স্থান নেই- তারা অস্থায়ী কর্মী, তাদের চাকুরি কন্ট্রাক্টচুয়াল বা চুক্তি ভিত্তিক। কন্ট্রাক্টচুয়াল হিসেবে রেখে দিয়ে বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে প্রাপ্য সমস্ত অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, তাদেরকে পার্মানেন্ট করা হয় না। কারণ পার্মামেন্ট করা হলেই এদেরকে ‘বাড়তি’ বেতন দিতে হবে, নানান সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে- যার ফলে কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফা কমে যাবে।
তাদের চাকুরির কোন নিশ্চয়তা নাই, মুখের কথায় কারো চাকুরি চলে যেতে পারে। ছয় মাস বা একবছর পর পর তাদের কন্ট্রাক্ট নবায়ণ করা হয়- অবশ্য যদি মুখ বুজে যা করতে বলা হয় তাই করে, কোন আপত্তি বা গাইগুই না করে তবেই। ফলে জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তাদের কাটে না। বাংলালিংকের একজন পার্মামেন্ট বা স্থায়ী কর্মী যে অধিকার গুলো পায় তার সব কিছু থেকেই তারা বঞ্চিত: তাদের কোন বার্ষিক ছুটি নাই, ইনক্রিমেন্ট নাই, স্থাস্থ্য বীমা বা স্বাস্থ্য সেবা নাই, প্রভিডেন্ড ফান্ড নাই, প্রমোশন নাই, স্থায়ী কর্মীর তুলনায় বেতন অনেক কম - মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকা। বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করতে হয় মাসে এমনকি ১০০ ঘন্টারও বেশি অথচ বেতন দেয়ার সময় ৪০ ঘন্টার চেয়ে বেশি ওভার টাইমের টাকা দেয়া হয় না। এমনও অনেক কর্মী আছেন যারা ৭ বছরেরও বেশি সময় বাংলালিংকে কাজ করলেও তাদেরকে স্থায়ী করা হচ্ছে না। স্থায়ী করার কথা তুললেই হুমকী দেয়া হয় চুক্তি নবায়ণ না করার, বলা হয় কাগজ পত্র অনুযায়ী তোমাদের চাকুরির মেয়াদ ছয় মাস বা এক বছরের বেশী না। এই জালিয়াতিটি করবার জন্য কন্ট্রাক্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কয়েকদিন গ্যাপ দিয়ে তারপর নতুন করে কন্ট্রাক্ট করা হয় যেন কেউ বলতে না পারে সে টানা ৫/৭ বছর ধরে কাজ করছে!
এরকম একটা পরিস্থিতিতেই বাংলালিংকের ৭৬ জন অস্থায়ী কর্মী তাদের চাকুরি স্থায়ী করার দাবীতে শ্রম আদালতে গত ৪ অগাষ্ট পৃথক ভাবে ৭৬টি মামলা রজ্জু করেছে। আদালত তাদের মামলা গ্রহণ করে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষকে ১৫ দিনের মধ্যে জাবাবদিহি করার জন্য নোটিশ দিয়েছে, নোটিশটি বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের কাছে ১৯ আগষ্ট পৌছেছে।
ছবি:শ্রম আদালত থেকে পাঠানো বাংলালিংককে পাঠানো রুল(নিরাপত্তার সার্থে মামলাকারীর নাম মুছে দেয়া হলো)
এত দিন পার হয়ে গেল, অথচ এটা নিয়ে পত্রপত্রিকাতে কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কোন সংবাদ প্রচারিত হলো না। লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদেরকে কিনে রেখেছে বাংলালিংকের মতো কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। সরকার বা শ্রম মন্ত্রণালয়েরও এ বিষয়ে কোন তদারকি নেই যদিও শ্রম আইন ভঙ্গ করেই কোম্পানিগুলো এই কাজ গুলো করছে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুসারে:
“কোন শ্রমিককে সাময়িক শ্রমিক বলা হইবে যদি কোন প্রতিষ্ঠানে তাহার নিয়োগ সাময়িক হয়।”
“কোন শ্রমিককে অস্থায়ী শ্রমিক বলা হইবে যদি কোন প্রতিষ্ঠানে তাহার নিয়োগ এমন কোন কাজের জন্য হয় যা একান্ত ভাবে অস্থায়ী ধরণের এবং যাহা সীমিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
(সূত্র: শ্রম আইন ২০০৬, ধারা ৪(৪), ৪(৫))
বাংলালিংকের এই কর্মীদের নামের সাথে অফিসার কথাটি যুক্ত থাকলেও এরা ম্যানেজারিয়েল কাজ করেনা, এদেরকে গায়ে গতরে পরিশ্রমই করতে হয়, এরা বস্তুত দক্ষ শ্রমিক। এদের কাজটি সাময়িক নয় কারণ বছরের পর বছর ধরে তারা এই কাজ করছে। এদের কাজকে অস্থায়ীও বলা যাবে না কারণ এরা যে অপারেশন ও মেনটেনেন্সের কাজগুলো করে সে কাজগুলো অস্থায়ী ধরণের নয় কিংবা সীমিত সময়ের জন্যও নয়; যতদিন মোবাইল কোম্পানি সার্ভিস দিবে, ততদিনই এই কাজগুলো করতে হবে। বাংলালিংকের এইচআর পলিসি অনুসারেও এই ধরণের রুটিন কাজ সম্পন্নকারীদেরকে অস্থায়ী বা সাময়িক শ্রমিক বলা যাবে না।
ছবি: বাংলালিংকের এইচ আর পলিসি অনুসারেও এই কর্মীদেরকে
ফলে এই দক্ষ শ্রমিক বা কর্মীদেরকে আইনগত ভাবে এভাবে অস্থায়ী বা টেমপরারি হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে শ্রম শোষণ করা বৈধ নয়। কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কোন তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ আমাদের চোখে পড়ে না।
শুধু বাংলালিংক নয়, গ্রামীণ ,এক্টেল, এয়ারটেল সহ সকল দেশি বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানিতেই এই মডেলের শ্রম শোষণ প্রত্যক্ষ করা যায়। মুনাফা সর্বোচ্চ করণের জন্য এরা দক্ষ শ্রমিকদের কন্ট্রাক্টচুয়াল করে রাখে, অদক্ষ বা আধা দক্ষ শ্রমিকদেরকে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টির কাছ থেকে নিয়োগ দেয়। যেমন: টিবয়, পিয়ন, ক্লিনার, ড্রাইভার, সিকিউরিটি ইত্যাদি পেশার শত শত কর্মীকে অতি সস্তায় কোন ধরণের সুযোগ সুবিধা ছাড়াই স্বল্প বেতনে সেন্ট্রিসিকিউরিটি, ক্লিনকো, হার্জ ইত্যাদি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে খরচ কমায়, মুনাফা সর্বোচ্চ করে। অথচ বিদেশী কিংবা কর্পোরেট বিনিয়োগের পক্ষে প্রধান যুক্তিই দেয়া হয় এই বলে যে এরা বিপুল মুনাফা দেশের বাইরে পাচার করলেও এরা ভালো বেতনের কর্মসংস্থান তৈরী করে। বাস্তবতা হলো, এরা গুটিকয়েক স্থায়ী কর্মীকে তুলনামূলক ভালো বেতন প্রদান করলেও বেশির ভাগ কর্মীকে সাব স্ট্যান্ডার্ড বেতন দেয় এবং শ্রম আইন লংঘন করে বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখে আর রাষ্ট্রের শাসকরা বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশের নামে কমিশনের ধান্দায় এসব দেখেও না দেখার ভান করে।
এই রকম একটা অসহনীয় পরিস্থিতিতেই বাংলালিংকের অস্থায়ী কর্মীরা বাংলালিংকের শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে একযোগে মামলা করেছেন। কর্পোরেট শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে তাদের এই লড়াইয়ের সাথে সংহতি জানানো, তাদের পাশে দাড়ানো, তাদের দাবী মেনে নিতে কোম্পানিকে বাধ্য করা সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দ্বায়িত্ব।