নদী পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল অনেক জেলে ইলিশ মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত। মনে খুব লোভ হচ্ছিল টাটকা ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্য। হয়তো কপালে নাই তাই হলনা। নদীর একপাশে টিন শেড দিয়ে তৈরী করা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। গরীব ভূমিহীনদের জন্য সরকারের এই পদপে দেখে বেশ ভালই লাগল। অনেক গুলো পরিবার মিলে তৈরী হয়েছে একটি মহল্লার। ঠিক যেন বনানির আবাসিক এলাকা। পার্থক্য শুধু ধনী আর গরীবের। ঢাকা শহরের তামাম ভিুকদের নিয়ে সরকার যদি এমন একটা প্রজেক্ট তৈরী করত তাহলে বেশ ভালই হতো।
একঘন্টার মধ্যে চলে এলাম মোংলা সমূদ্র বন্দর। নদীর পানি ছিল শান্ত, নির্মল বাতস দুপুরের খা খা রোদকে উপো করতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে ত্রিমূহনা পার হলাম যেখানে মিলেছে তিন নদীর মুখ। একটা এসেছে বঙ্গোপসাগর থেকে একটা গেছে রামপাল বাগেরহাটের দিকে ও অন্যটা খুলনার দিকে। সামনে চোখে পড়ল বিশাল আকৃতির এক মালবাহি জাহাজ। নদীর পাড় ঘেঁষে অনেকদুর পর্যন্ত ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর চোখে পড়ল। জানতে পারলাম এটাই সেই বিখ্যাত পতিতালয়।
সুন্দরবনের শুরুটা মূলত মোংলা থেকে সামান্য দুর হতেই।
আমাদের নৌকা বনের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। সিডার ও আইলার সেই ভয়াল থাবা সুন্দরবনকে থুড়থুড়ে বুড়ি বানিয়ে দিয়ে গেছে। একদিন যে বুড়ি ছিল ঐশরিয়া, মাধুরিদের মতো। যার ভরাট যৌবন আকৃষ্ট করত পর্যাটকদের হৃদয়। ব্যাগ থেকে ষ্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা বেশ আগেই বের করেছি। চারিদিকের অবারিত সবুজের সমোরাহ ক্যামেরা বন্দি করতে করতে চলে এলাম করমজল।
ঘাটে নৌকা ভিড়াতেই দুইজন পুরুষ এগিয়ে এলো।
- আপনারা মোট কয়জন ?
- দশ জন
- কোন বিদেশি আছে নাকি ?
- আমাদের চেহারা দেখেকি বিদেশি মনে হয় ?
- না; মানে অনেকে আছে বিদেশ থাকে যারা ওই দেশেরও নাগরিক আবার এই দেশেরও নাগরিক।
- না ভাই আমরা রামপালা থেকে এসেছি, আপনাদের এন্ট্রি ফি কত করে ?
- দশ টাকা আর ভিডিও ক্যামেরার জন্য ১১০ টাকা যদি বিদেশি থাকে তার জন্য ২২০ টাকা।
- বলেন কি ! ভিডিও ক্যামেরার জন্য টাকা দিতে হবে কেন ? এমনতো কোথাও দেখি নাই;
- এটা সরকারের রেট, আপনার সরকারের ঘরে টাকা দিবেন; আমাদেরতো আর দিচ্ছেন না;
- আচ্ছা ঠিক আছে; টিকিট বা কোন টোকেন থাকলে দেন।
- টিকিট তো অবশ্যই আছে, তয় আপনারা যাওয়ার সময় নিয়ে যেয়েন, আমরাতো সন্ধা পর্যন্ত এখানেই আছি।
- কেন ? যাবার সময় কেন? এখন দিলে সমস্যা কি ?
- টিকিট শেষ হয়ে গেছে। আনতে হলে অনেক দুরে যেতে হবে। অসুবিধা নেই আপনারা যাবার সময় নিয়ে যেয়েন।
দুপুর রোদে তর্ক না করে দুইশ দশ টাকা বের করে হাতে দিলাম এবং বললাম টিকিট কিন্তু অবশ্যই দিতে হবে। তবে ওদের আচার ব্যবহারে সন্দেহর জন্ম দিল।
ভিতরে প্রবেশ করে হাতের ডানদিকে খাঁচা বন্দি অবস্থায় বেশ কয়েকটি হরিণ চোখে পড়ল।
তার পাশেই রয়েছে বানরের খাঁচা। কোন জনমের পাপের শাস্তি ভোগ করছি সে প্রশ্ন হয়তো বানরগুলোর মনের মধ্যে তোলপাড় করেই চলেছে। কারণ বনের মধ্যে যারা অবাধ চলাচল করছে তাদের এখানে বসেই ওরা দেখতে পায় ! কয়েক কদম সামনে এগোতেই চোখে পড়ল বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। বেশ কিছু ছোট ছোট কুমিরের বাচ্চাও মাথা উঁচু করে নির্বাক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। এই কেন্দ্রে পিছনেই রয়েছে কাঠের তৈরী তিন তলা সমান উচ্চতার টাওয়ার। যেখনে উঠলে বেশ কিছু দুর পর্যন্ত পর্যবেন করা যায়। হাতের ডানদিকে দেখার মতো আর তেমন কিছু চোখে পড়ল না। আমাদের গাইড জানিয়ে দিল বাম পাশে নদীর পাড় ঘেঁষে কাঠের পুল তৈরী করা আছে যার দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারের কম নয়।
কাঠের পুলে প্রবেশ করার মুখেই রয়েছে গোটা সুন্দরবনের ম্যাপ এবং একটা বাঘের কংকাল।
খাবার দাবারের জন্য একটা মাত্র দোকান। গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে চমৎকার কাঠের পুল। দু’পাশে রেলিং দিয়ে তৈরী করা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। সামনে যতই হাটবেন নির্জনতা আপনাকে পেয়ে বসবে।
গহীন জঙ্গলে একা হাটার মধ্যে যে ভয় এবং শংকা কাজ করে তা সুন্দরবনে না গেলে আপনার অনুভূতিতে আসবে না। যদিও এটা অভয়ারণ্য, চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। একটু সামনে যেতেই দেখা যাবে বানরের তান্ডব, এক গাছ থেকে আর এক গাছের ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে চলার দৃশ্য সত্যই আপনাকে মুগ্ধ না করে ছাড়বে না। কাঠের পুল সোজা চলে গেছে বনের মধ্যে বহমান অসংখ্য খালের মধ্যে একটির কিনারে। এর পরেই হাতের ডান দিকে মাটির রাস্তা, দু’পাশে ঘন জঙ্গল আর মধ্যে ছোট্ট একটি রাস্তা আপনাকে রোমাঞ্চিত করবেই। মনে হবে এই বুঝি ঝোপের আড়াল থেকে হুংকার দিয়ে বেরিয়ে এল বিশাল আকৃতির এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
ভয় পাবেন না, এমনটি হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ১০ ভাগ। আপনি স্বাধ নিতে পারেন গহীন জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ানোর। যদিও আমরা জানি এটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দ্বারা ঘেরা তবুও আমি চ্যলেঞ্জ করছি আপনি একাকি এক কিলোমিটার গহীনে যেতে সাহস পাবেন না। গা ছম ছম করা নিরাবতাই আপনার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিবে। তবে জুতা খুলে কাদার মধ্যে একা একা ঘোরার স্বাধ থেকে বঞ্চিত হবেন না।
ফেরার পথ ধরতে হল খুব তাড়াতাড়ি কারণ ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে। দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম যেখান থেকে শুরু করেছি। কিন্তু হায়, এ কি ! কোথায় গেল সেই টিকিট বিক্রেতা। আশপাশে তারতো কোন টিকিও দেখছি না! বুঝতে বাকি রইলনা সরকারের পয়সা লুটে পুটে খাওয়ার জন্য এমন নির্জন জায়গা আর হয়তো দ্বিতীয়টি নাই। এদেরকে দ্রুত চাকরিচ্যুত করে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সরকরা কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হতে বঞ্চিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। উন্নায়নের ছোঁয়া লাগবেনা পর্যটন কর্পোরেশনে। শুনেছিলাম একটি বিদেশী কোম্পানী সুন্দরবনকে সাফারী পার্ক বানানোর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। হয়তো সরকারের সে রকম কোন সদিচ্ছা নাই। যদি তাই হতো তাহলে বিশ্ব পর্যাটন মানচিত্রে সুন্দরবনের অবস্থান প্রথম সারিতেই থাকতো।
এই অসৎ কর্মচারীদের গালি দিতে দিতে ফিরে এলাম রামপাল। নদীর ঘাটে দেখা পেলাম টাটকা ইলিশ বিক্রেতাদের। বরফ ছাড়া এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে মাত্র আড়াইশত টাকা। যেখানে ঢাকা চারশত টাকায়ও এক কেজি সাইজের ইলিশ পাওয়া যায় না। এতো দুর থেকে ইলিশ বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব ঝামেলার তাই লোভকে সংবরন করে সন্ধার মধ্যে ফিরে এলাম বাগেরহাট। সেই সাথে মনের কোনে ধারন করে নিলাম সুন্দরবনের কিছু ছবি যা সারা জীবন জ্বল জ্বল করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪০