somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ এক জোড়া রেশমি মোজা

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারস একদিন পনেরো ডলারের একজন আকস্মিক মালিক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করল। তাঁর কাছে এই পনেরো ডলারই একটা মোটা অঙ্কের টাকা মনে হল। আর টাকাটা তাঁর পুরনো জীর্ণ পার্সটাকে যেভাবে ঠেসে স্ফীত করে তুলেছিল, সেটা দেখে সে এক ধরনের গৌরব অনুভব করল, যে অনুভূতি সে বহু বছর উপভোগ করেনি।

বিনিয়োগের চিন্তাটা তাঁর মনকে প্রবলভাবে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছিল। পুরো এক অথবা দুই দিন সে আপাতদৃষ্টিতে একটা স্বপ্নের জগতে হাঁটাচলা করেছিল, সে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিল জল্পনায় আর হিসাব- নিকাশে। তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ কোন কিছু করে ফেলার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, সে এমন কিছু করতে চায়নি যার জন্যে পরে তাঁকে অনুশোচনায় ভোগতে হবে। কিন্তু মধ্যরাতের স্তব্দ সময় গুলোতে সে শুয়ে জেগে থাকতো। জেগে জেগে মনের মধ্যে আবর্তিত অভিসন্ধি আঁটত আর তাঁর মনে হত এই সব পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সে টাকাটার সঠিক এবং সুদূরদর্শী ব্যবহারের একটা পরিষ্কার পথ দেখতে পেয়েছিল।

সধারনত যে দামে জেনির জন্যে জুতো কেনা হয় তাঁর সাথে দু-এক ডলার যোগ করলে আরও স্থায়ী টেকসই এক জোড়া জুতো পাওয়া যাবে। সে অবশ্যই কিনবে এবং সে তাঁর ছেলে, জেনি আর ম্যাগের জামার জন্যে বেশ কয়েক গজ কাপড়ও কিনবে। সে মনস্থ করল পুরনো জামা গুলোকে দক্ষ হাতে তালি দিয়ে দিবে। ম্যাগের জন্যে আরেকটা গাউন কেনা দরকার। সে দোকানের জানালায় কিছু সুলভ মূল্যের সুন্দর কাপড়ের নকশা দেখেছে। ছেলে মেয়েদের জামা বানানোর পরেও নতুন মোজার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় রয়ে যাবে — আলাদা দুই জোড়া — আর কত গুলো রিফুকর্ম যে বেঁচে যাবে! সে ছেলেদের জন্যে কয়েকটা মাথার ক্যাপ কিনবে আর মেয়েদের জন্যে কিনবে সেইলর-হ্যাট। তাঁর ছোট্ট এই পরিবারটাকে জীবনে একবারের জন্যে অভিনব, পরিচ্ছন্ন আর নতুন জকজকা অবস্থায় দেখার কল্পিত দৃশ্যটা তাঁকে উত্তেজিত আর অস্থির করে তুলল, তাঁকে জাগিয়ে তুলল প্রত্যাশায়।

প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই নির্দিষ্ট একটা “ভালো সময়” এর কথা বলত, যা মিসেস সমারস মি. সমারসকে বিয়ে করার চিন্তাটা মাথায় আসার আগে থেকেই জানত। সে এমন ধরনের কোন অসুস্থ অতীত চিন্তায় নিজেকে প্রশ্রয় দিল না। অতীতের চিন্তায় নষ্ট করার মত কোন সময় তাঁর ছিল না, তাঁর হাতে একটা সেকেন্ডও ছিল না। বর্তমানের প্রয়োজন গুলো তাঁর মস্তিষ্কের প্রতিটা অনুষদকে আত্মিভুত করে রেখেছিল। কল্পিত ভবিষ্যৎ দৃশ্যের একটা ক্ষীণ, আবছা দৈত্যমানব মাঝে মাঝে তাঁকে আতঙ্কিত করে তুলত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই পরের দিনের সকালটা আর কখনই আসত না।

দর কষাকষির যে কি মূল্য তা মিসেস সমারসের চেয়ে ভালো আর কেউ জানত না; যে কিনা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটাকে সর্ব নিম্ন দরে কেনার পথে এগিয়ে যেতে পারত। সে প্রয়োজনে কনুই দিয়ে ঠেলে তাঁর নিজের রাস্তা বের করে নিত; সে শিখেছিল কিভাবে একটা পণ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। সে অধ্যবসায় আর দৃঢ় সংকল্পের সাথে পণ্যটার পিছনে লেগে থাকত যতক্ষণ না দোকানী ঘুরে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতো। এতে ঠিক কত সময় লাগত সে ব্যাপারে তাঁর কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।

কিন্তু সেদিন সে একটু দুর্বল আর ক্লান্ত অনুভব করছিল। মধ্যাহ্নভোজনে সে খুবই হালকা খাবার খেয়েছে— না! মধ্যাহ্নভোজের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে পড়ল, বাচ্চাদের খাওয়ানো আর সবকিছু ঠিকঠাক করা আর নিজেকে কেনাকাটার যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে গিয়ে সে দুপুরে খাওয়ার কথা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল!

সে তুলনামূলক জনশূন্য একটা কাউনটারের সামনের একটা ঘূর্ণায়মান টুলের উপর বসে পড়ল। সেখানে বসে সে কাপড়ের দোকানের ভিড়টাকে ঠেলে নিজে অবস্থান নেওয়ার শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল। হঠাৎ একটা নিস্তেজ শিথিল অনুভূতি তাঁর পুরো শরীরে বয়ে গেল এবং সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাঁর হাত দুটো ফেলে রাখল কাউনটারের উপর। তাঁর হাতে কোন দস্তানা ছিল না। ধীরে কিছুক্ষণ পর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার অনুভূতিতে সে টের পেল তাঁর হাত দুটো খুব শীতল এবং ছুতে খুব আরাম এমন কিছু একটাকে স্পর্শ করল। সে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল হাত দুটো রেশমি মোজার একটা স্তূপের উপর শায়িত। পাশেই একটা প্ল্যাকার্ড দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মোজা গুলো বিশেষ ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে — দাম কমে দুই ডলার পঞ্চাশ সেন্ট থেকে এক ডলার আটানব্বই সেন্টে নেমে এসেছে; এবং কাউনটারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন যুবতী তাঁর কাছে জানতে চাইল সে তাদের রেশমি হোসিয়ারির সারিটা যাচাই করে দেখতে চায় কিনা। সে মুচকি হাসল, এমন ভাবে হাসল যেন তাঁকে কেউ একটা হীরার মুকুট শেষবারের জন্যে পরিদর্শন করতে বলছে যেহেতু এটা কেনার জন্য সে ইতিমধ্যেই বদ্ধ পরিকর। কিন্তু সে কোন দিকে না গিয়ে দুই হাত দিয়ে উজ্জ্বল বিলাসবহুল পণ্য গুলোর নরম অনুভূতিটা উপভোগ করতে লাগলো, চোখের কাছে তুলে ধরে দেখতে লাগলো তাঁদের চিকচিকে রঙটা, উপভোগ করতে লাগলো তাঁর আঙ্গুলের চিপা দিয়ে সাপের মত তাঁদের পিছলে পড়ার অনুভূতিটা।

তাঁর বিবর্ণ গাল দুটো হঠাৎ করেই একটা অস্বাভাবিক লাল বর্ণ ধারণ করল। সে মেয়েটার দিকে তাকাল।

“এগুলোর মধ্যে সাড়ে আট সাইজের কোন মোজা হবে?”

সাড়ে আট সাইজের অনেক গুলোই ছিল। আসলে, অন্য যে কোন সাইজের চেয়ে সাড়ে আট সাইজটাই বরং বেশী ছিল। এখানে ছিল হালকা নীল রঙ্গের একটা জোড়া; ওখানে ছিল কিছু ল্যাভেন্ডার রঙ্গের, কিছু ছিল পুরোপুরি কালো আর কিছু ছিল তামাটে আর ধূসর রঙ্গের মাত্রা ওয়ালা। মিসেস সমারস একটা কালো জোড়া বেছে নিল এবং জোড়াটার দিকে সে দীর্ঘক্ষণ মনযোগের সহিত তাকিয়ে রইল। সে মোজার বুননটা পরখ করে দেখার ভান করছিল, আর দোকানের কর্মচারী নিশ্চিত করল যে তাঁর হাতেরটা উন্নতমানের।

“এক ডলার আটানব্বই সেন্ট।“ সে ঘোরের মধ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো। “আচ্ছা, আমি এই জোড়াটা নিব।“ সে মেয়েটাকে পাঁচ ডলারের একটা বিল ধরিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট খুচরা টাকা আর পার্সেলের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। পার্সেলটা কত ছোট ছিল! মনে হল এটা তাঁর পুরনো জীর্ণ শপিং ব্যাগের গভীরতায় একবারে হারিয়ে গেল।

এরপর মিসেস সমারস বিক্রয় কাউনটারের দিকে আর গেল না। সে একটা এলিভেটরে উঠে পড়ল। এলিভেটরটা তাঁকে উপরে তলায় মহিলাদের ওয়েটিং রুম এলাকায় নিয়ে গেল। এখানে, একটা নির্জন কোনায়, সে কটনের মোজা গুলো খুলে সদ্য কেনা নতুন রেশমি মোজা জোড়া পড়ে নিল। তাঁর মানসিক কার্যধারায় কোন সূক্ষ্ম বোধশক্তি কাজ করছিল না, অথবা সে নিজের উপর কোন প্রকার যুক্তিও প্রয়োগ করছিল না, নিজের সন্তুষ্টির জন্যে সে যা করছে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যাখ্যাও সে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল না। সে একবারেই কিছু ভাবছিল না। মনে হল সে কিছু সময়ের জন্যে তাঁর শ্রমশীল, অবসাদময় সকল কাজকর্ম থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল, আর একটা যান্ত্রিক ঝোঁকের তাড়নায় সে তাঁর সকল দায়দায়িত্ব থেকে একটু ছুটি নিয়েছিল।

তাঁর শরীরের চামড়ায় কাঁচা রেশমের স্পর্শের অনুভূতিটা কত ভালো লেগেছিল! মনে হচ্ছিল সে একটা নরম গদিতে শুয়ে আছে এবং কিছু সময়ের জন্যে এই বিলাসিতাটা সে উপভোগ করল। এটা সে খুব অল্প সময়ের জন্যে করল। তারপর সে তাঁর জুতো পরিবর্তন করল এবং কটনের মোজা গুলো পেঁচিয়ে তাঁর ব্যাগের ভিতরে ছুড়ে মারল। তারপর সোজা চলে গেল জুতোর ডিপার্টমেন্টে, একটা সিটে বসে পড়ল পা মেপে জুতা কেনার জন্যে।

সে ছিল খুব খুতখুতে। দোকানের কর্মচারী কিছুতেই তাঁর মোজার সাথে মিলিয়ে জুতা বের করে দিতে পারল না, সে খুব সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার মত মহিলা নয়। সে তাঁর স্কার্ট তুলে ধরেই রাখল এবং একদিকে তাঁর পা ঘুরিয়ে আর অন্যদিকে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে রাখল। তাঁর নজর পড়ল পালিশ করা, সুরু মাথা ওয়ালা বুট গুলোর দিকে। তাঁর পা আর গোড়ালিটাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। সে বুঝতেই পারছিল না যে এই পা দুটো তাঁর নিজের এবং তাঁরা তাঁর শরীরের একটা অংশ। সে উন্নতমানের জাঁকাল ফিটিং এর এক জোড়া জুতা চায়, যে যুবক তাঁকে জুতা দেখাচ্ছিল তাঁকে সে বলল এবং সে এও বলল যে দুই এক ডলার বেশী লাগলেও জুতো জোড়া কিনতে তাঁর আপত্তি নেই, যদি সে গুলো তাঁর মনের মত হয়।

অনেক দিন হয়ে গিয়েছিল মিসেস সমারস শেষ কোন জুতসই দস্তানা হাতে পড়েছিল। দুর্লভ কোন উপলক্ষে যখনই সে কোন দস্তানা কিনেছে তাঁরা সবসময়ে ছিল দর কষাকষিতে কেনা, আর এতই সস্তা দরের ছিল যে তাঁরা হাতে ফিট হবে এমন চিন্তা করাটা ছিল পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।

এখন সে দস্তানার কাউনটারে একটা গদির উপর তাঁর কনুই দুটোকে বিশ্রাম দিচ্ছিল, আর একটা সুন্দর, মনোরম ছোট্ট প্রাণী, কমনীয় আর স্পর্শকাতর, একটা লম্বা হাতের “বাচ্চা”কে টেনে মিসেস সমারসের উপর নিয়ে আসলো। সে কব্জির উপরে হাত বুলিয়ে দিল এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে তাঁর বোতাম লাগিয়ে দিল। দুজনেই এক অথবা দুই সেকেন্ডের জন্যে ছোট্ট সুসঙ্গত দস্তানা পরিহিত হাতের প্রশংসার গভীর ধ্যানে হারিয়ে গিয়েছিল। কন্তু টাকা খরচ করার তো আরও অনেক জায়গা ছিল।

রাস্তা থেকে কয়েক কদম নিচে একটা দোকানের জানালায় বেশ কিছু বই আর ম্যাগাজিন স্তূপ করে রাখা ছিল। মিসেস সমারস সেখান থেকে চড়া মূল্যের দুটো ম্যাগাজিন কিনে ফেলল, যেন সে তাঁর অবসর দিন গুলিতে অন্যান্য আনন্দদায়ক জিনিসের পাশাপাশি ম্যাগাজিন পড়তেও অভ্যস্ত। কোন মোড়ক ছাড়াই সে ম্যাগাজিন দুটো বহন করছিল। পাশাপাশি সে রাস্তার ক্রসিং এ নিজের স্কার্ট তুলে ধরে রাখছিল। তাঁর সদ্য কেনা মোজা, বুট জুতা আর হাতের সুসঙ্গত দস্তানা যেন তাঁর মনের বিয়ারিং এর মারভেল হিসেবে কাজ করল — তাঁরা তাঁর মধ্যে এক ধরনের নিশ্চয়তার অনুভূতি জাগ্রত করল, সে নিজেকে সুবেশী মানুষের ভিড়ের অন্তর্ভুক্ত একজন মনে করল।

সে ছিল খুব ক্ষুধার্ত। অন্য সময় হলে বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ক্ষুধাটা সে চেপে ধরে রাখত। বাড়ি পৌঁছে নিজের জন্যে এক কাপ চা বানাত আর খাবার যা কিছু আছে তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। কিন্তু এখন যে ঝোঁক তাঁকে চালিত করছিল, তা তাঁর মাথায় এ ধরনের কোন চিন্তাই প্রশ্রয় দিল না।

পাশের কর্নারেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। সে কখনই দরজা দিয়ে এর ভিতরে প্রবেশ করেনি; বাইরে থেকে মাঝে মাঝে সে আবছা ভাবে দেখত কিছু দাগহীন রেশমি কারুকাজ, উজ্জ্বল কাচের ঝলকানি আর মৃদু পায়ে ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করছে কেতাদুরস্থ মানুষদের।

যখন সে ভিতরে প্রবেশ করল, তাঁর উপস্থিতি কোন চমক সৃষ্টি করল না, কেউই তাঁর দিকে কোন মনযোগও দিল না, সে কিছুটা ভঁয় পেয়ে গেল। সে একটা ছোট্ট টেবিলে একা বসে পড়ল এবং একজন ভদ্র ওয়েটার এসে অর্ডার নিতে চাইল। সে অতি প্রাচুর্যের কিছু চাইল না; ব্যাকুল ভাবে শুধু একটা সুন্দর ও মাজাদার খাবার চাইল — এক ডজন ব্লু-পয়েন্ট, শাকের সাথে একটা প্লাম চপ, মিষ্টি কিছু একটা — আইসক্রিম জাতীয় কিছু, যেমন, এক গ্লাস রাইন ওয়াইন, এবং সর্বোপরি এক গ্লাস ছোট ব্ল্যাক কফি।

যখন খাবার পরিবেশনের জন্যে অপেক্ষা করছিল, তখন সে হাতের দস্তানা গুলো অলস ভাবে খুলে পাশে রেখে দিল। সে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা গুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো, তাঁর ছুরির ভোতা প্রান্ত দিয়ে ম্যগাজিনের পাতা গুলো কাটতে লাগলো। জায়গাটা ছিল খুব মনোরম। রেশমের কারুকাজ গুলো একটু বেশীই পরিষ্কার ছিল যতটা না জানালা দিয়ে দেখা যেত, আর কাচ গুলো ছিল আরও ঝলমলে। সেখানে বেশ কয়েকজন নম্র ভদ্র পুরুষ ও মহিলা ছিল, যারা তাঁকে খেয়াল করেনি, সে নিজের মত করে একটা ছোট্ট টেবিলে বসে লাঞ্চ করছিল। একটা মৃদু, মনোমুগ্ধকর মিউজিকের সুর কানে আসছিল, আর জানালা দিয়ে একটা মৃদু মন্দ বাতাস বইছিল। সে খাবারে একটা কামড় বসাল, ম্যাগাজিনের একটা অথবা দুটো শব্দ পড়ল, ওয়াইনের গ্লাসে একটা চুমুক দিল এবং তাঁর নতুন রেশমি মোজার ভিতরে পায়ের আঙ্গুল গুলো নাড়ল। খাবার দামটা কোন পার্থক্য তৈরি করল না। সে টাকাটা গুনে ওয়েটারের হাতে দিল, একটা অতিরিক্ত কয়েন ট্রেতে রেখে দিল, ফলস্বরূপ ওয়েটার তাঁর সামনে এমন ভাবে মাথা নোয়াল যেন সে রাজবংশীয় কোন রাজকুমারী।

তাঁর পার্সে তখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট রয়ে গেল এবং তাঁর পরবর্তী প্রলোভনটা একটা ম্যাটিনি-শো এর পোস্টারের রূপে তাঁর মনে উদিত হল।

যখন সে থিয়েটারে প্রবেশ করল তখন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, নাটক ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আর পুরো ঘরটা তাঁর কাছে বস্তাবন্দী মনে হল। কিন্তু এখানে সেখানে খালি সিট পড়েছিল, তাঁদের মধ্য থেকে কোন একটায় সে বসে পড়ল, তাঁর দু’পাশে ছিল অতি সুন্দর পোশাক পরিহিত মহিলারা, যারা সেখানে গিয়েছিল সময় কাটাতে, ক্যান্ডি খেতে আর তাঁদের জাঁকালো রুচিহীন বেশভূষা দেখাতে। আরও অনেকে ছিল যারা শুধুই নাটক আর অভিনয় উপভোগ করতে গিয়েছিল। এটা নিরাপদে বলা যায় সেখানে এমন কেউ উপস্থিত ছিল না যে মিসেস সমারসের অঙ্গভঙ্গিকে পুরোপুরি সহ্য করতে পেরেছিল। সে পুরো জায়গাটা — অভিনেতা, মঞ্চ, আর মানুষজন সবাইকে একটা গভীর আবেগে জড়িয়ে ফেলল, ডুবে গেল এবং উপভোগ করল। সে হাসির দৃশ্যে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো এবং কাঁদল— সে আর রুচিহীন মহিলাটা দুঃখের দৃশ্যে কেঁদে উঠেছিল। বিষয়টা নিয়ে তাঁরা একটু আধটু কথাও বলেছিল। রুচিহীন মহিলাটা তাঁর চোখ মুছল এবং একটা চারকোণা লেসে নাকের সর্দি মুছল, ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারসকে তাঁর ক্যান্ডি বক্সটা এগিয়ে দিল।

নাটক শেষ হয়ে গেল, মিউজিক থেমে গেল, মানুষজন সব বেরিয়ে গেল। যেন একটা স্বপ্নের সমাপ্তি হল। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। মিসেস সমারস এক কোনায় গিয়ে দাঁড়াল এবং গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

গাড়িতে তাঁর বিপরীতে একটা তীক্ষ্ণ চোখের অধিকারী লোক বসেছিল। মনে হল লোকটার কাছে তাঁর ছোট্ট, বিবর্ণ মুখটা ভালো লেগেছে। লোকটা তাঁর মুখে কি দেখেছিল সে অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বেচারা বিমুঢ় হয়ে পড়ল। সত্যিকার অর্থে, সে আসলে কিছুই দেখেনি — যতক্ষণ না সে মায়াবী ইন্দ্রজালটা কাটিয়ে নিজের ভিতরের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটিত করল। লোকটা তীব্র ভাবে চাইল, এই গাড়িটা যেন আর কক্ষনো কোথাও না থামে, যেন চলতেই থাকে, তাঁকে নিয়ে অনন্তকাল।

মূলঃ এ পেয়ার অব সিল্ক স্টকিংস — কেইট শোপেন
অনুবাদঃ শরিফুল ইসলাম (শরীফ আজাদ)
এপ্রিল ২৭, ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×