এক শব্দে বলা যায়, সাহিত্য আমার ইউটোপিয়া। শুধু এখানেই আমি অধিকার-বঞ্চিত নই। আমার বই-বন্ধুদের সাথে মিষ্টি, সাবলীল আলাপে ইন্দ্রিয়ের কোনো বাধাই দেয়াল তুলে দাঁড়ায় না। তারা আমার সাথে নির্দ্বিধায়, অসংকোচে কথা বলে। যা কিছু আমি শিখেছি এবং যা কিছু শেখানো হয়েছে আমাকে, ওদের ‘বিশাল ভালোবাসা আর স্বর্গীয় বদান্যতা’-র পাশে হাস্যকর রকমের মামুলি ব’লে মনে হয়।
........................................
আশা করি বই নিয়ে লেখা আগের অধ্যায় দেখে পাঠকেরা ধ’রে নেবেন না যে কেবল পড়াশোনাতেই আমার একমাত্র আনন্দ। আমার আনন্দ আর বিনোদনের উপাদান অনেক এবং বৈচিত্র্যময়।
গল্পে আমি বহুবার গ্রাম আর বাইরে খেলাধুলার উল্লেখ করেছি। ছেলেবেলায় নৌকা বাইতে আর সাঁতার কাটতে শিখেছিলাম। আর গ্রীষ্মে ম্যাসাচুসেট্স্-এর রেনহ্যামে যখন আসি, সারাটা সময় আমার নৌকাতেই কাটে। আমার বন্ধুরা যখন দেখা করতে আসে, তাদের নিয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়াবার আনন্দের তুলনা নেই। অবশ্য বলা বাহুল্য আমি খুব-একটা নিশানা ঠিক রাখতে পারি না। সচরাচর অন্য কেউ পাছ-গলুই সামলায় আর আমি দাঁড় ফেলি। হামেশা আমি হাল ছাড়াই যাই নৌকা বাইতে। তখন জলডোবা ঘাস, শাপলা আর পাড়ের ঝোপঝাড়ের গন্ধে গন্ধে দিক ঠিক করতে হয়, দারুণ মজার ব্যাপার। আমার দাঁড়গুলায় চামড়ার ব্যান্ড লাগানো আছে, যার কারণে পিছলে যাবার ভয় থাকে না। বৈঠা ঠেলতে কতটা জোর লাগছে তার উপর নির্ভর করে আমি বুঝতে পারি দাঁড় ঠিকমতো পড়ছে কীনা। একইভাবে, স্রোতের বিপরীতে কখন চলেছি তাও টের পাই। বাতাস আর ঢেউয়ের সাথে পাল−া দিতে আমার ভালো লাগে। এমন উদ্দীপক আর কী আছে, যখন তোমার ছোট্ট, টেকসই নৌকাটা, তোমার ইচ্ছা আর পেশীর হুকুমে, দোলায়িত, ঝকঝকে ঢেউ এর উপর দিয়ে পিছলে চলে, আর জলরাশির সবল, প্রবল, তোড় অনুভব করতে করতে তুমি ভেসে যাও!
ডিঙি নৌকায় চ’ড়ে বেড়াতেও ভালো লাগে আমার। আর শুনলে হয়তো হাসবেন আপনারা, চাঁদনি রাতে নৌকা চড়তে সবচেয়ে ভালোবাসি আমি। যদিও চাঁদ যখন পাইন গাছের আড়াল থেকে আলো ছড়াতে ছড়াতে উঠে এসে আলগোছে আকাশ পার হ’য়ে আমাদের জন্য তৈরি ক’রে আলোকিত পথ, তাকে দেখতে পাই না আমি, কিন্তু নৌকায় তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে শুয়ে পানির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কল্পনা করি যেন তার ঝলমলে জামার কাঁপন ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। কখনও কখনও কোনো সাহসী মাছ আমার আঙুলের ফাঁক গ’লে ঢুকে পড়ে, অথবা কোনো লাজুক শাপলার স্পর্শ পাই। প্রায়ই কোনো সরু উপনদী বা খাঁড়ির আশ্রয় ছেড়ে বা’র হবার পর হঠাৎ টের পাই যেন চারপাশের বাতাসটুকু অনেক চওড়া হ’য়ে গেছে। একটা উদ্ভাসিত উষ্ণতা যেন জড়িয়ে ধরে আমাকে। এটি রোদ-তাতা গাছ নাকি পানির থেকে আসছে আমি বুঝতে পারি না। এই অদ্ভুত অনুভূতি একদম শহরের মাঝখানেও আমার হয়েছে। এমনকি শীতের দিন কি ঝড়ের রাতেও কখনও। আমার মুখে কারো উষ্ণ ঠোঁটের চুমুর মতো এই অনুভব।
পালতোলা নৌকায় বেড়ানো আমার সবচেয়ে পছন্দের। ১৯০১ সালের গ্রীষ্মে নোভা স্কশিয়া-তে গিয়েছিলাম আমি, সেইসময়েই সমুদ্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। কয়েকদিন ইভানজেলিনের গ্রামে কাটাবার পর, লংফেলো যাকে নিয়ে জাদুর জাল বুনেছেন তাঁর কবিতায়, মিস সালিভান আর আমি হ্যালিফ্যাক্সে গিয়ে প্রায় পুরোটা গ্রীষ্ম সেখানে কাটিয়ে আসি। বন্দরটা ছিল আমাদের স্বর্গ! কী যে সুখের ছিল সেইসব নৌকা ভ্রমণ - বেডফোর্ড বেসিন, ম্যাকন্যাব’স আইল্যান্ড, ইয়র্ক রিডাউট আর নর্থওয়েস্ট আর্ম! আর ঐসব বিরাট্, নীরব মানোয়ার জাহাজের ছায়ায় আমাদের রাতগুলো ছিল কী যে শান্তিময়। ইস্! কী দারুণ ভালো আর সুন্দর ছিল সব! এই স্মৃতিটুকু সারাজীবন আনন্দ দেবে আমাকে।
বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হ’ল একদিন। নর্থওয়েস্ট আর্মস্-এ একটা নৌকাবাইচ (রেগাটা) হবার কথা ছিল সেদিন যাতে রণতরীর নৌকাগুলি অংশ নেবে। অন্য অনেকের সাথে আমরাও ছোট্ট পালের নৌকা নিয়ে গিয়েছি রেস দেখতে। শ’য়ে শ’য়ে ছোট-ছোট নৌকা দুলছিল আশেপাশে, সমুদ্রও ছিল শান্ত। রেস-শেষে আমরা ঘরমুখী হলাম যখন, দেখা গেল একটা কালো মেঘ ঘন আর বড় হ’তে হ’তে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলছে। জোর বাতাস দিল সাথে সাথে, ঢেউগুলি ফুঁসে উঠে কোনো অদৃশ্য বাঁধ ভেঙে ফেলবার পাঁয়তারা করতে লাগল। আমাদের ছোট্ট নৌকা সাহসের সাথে মোকাবিলা করলো ঝড়ের, তার ছড়ানো পাল আর টানটান দড়িতে সে যেন বাতাসে ভর দিয়ে চলছিল। এই সে ঘুরে গেল ঢেউয়ের তোড়ে, এই আবার চড়ে বসল কোন বিশাল ঢেউয়ের মাথায়, ঠিক তখনই গর্জাতে গর্জাতে আর হিস্ হিস্ করতে করতে ঢেউগুলো তাকে টেনে নামালো নীচে। বড় পালটা খুলে পড়ল ধুঁকতে ধুঁকতে, যখন আমরা দড়িদড়া পাঁকড়াতে পাঁকড়াতে, এদিক ওদিক পিছলে পড়তে পড়তে যুঝছি ঘুর্ণি বাতাসের পাগলা রাগের সঙ্গে। আমাদের হƒৎস্পন্দন দ্রুততর হচ্ছিল আর হাত কাঁপছিল, ভয়ে নয়, উত্তেজনায় । কেননা ভাইকিংদের রক্ত আমাদের শরীরে, আর এও আমরা জানতাম যে আমাদের কাণ্ডারী ছিল তার কাজে সেরা। তার ছিল সমুদ্র-অভিজ্ঞ চোখ আর ঝড়ের কবল থেকে বেরিয়ে এসেছে সে বহুবার। গোলন্দাজ জাহাজ আর বিশাল রণতরীগুলি আমাদের পেরিয়ে যাবার সময় তাদের নাবিকেরা চিৎকার করে বাহ্বা জানাচ্ছিল আর স্যালুট করছিল আমাদের কান্ডারীকে, কারণ আমাদের মতো আর কোনো ছোট পালের নৌকা সেই ঝ’ড়ো সমুদ্রে নামতে সাহস করে নাই। অবশেষে ক্ষুধার্ত, শীতার্ত, ক্লান্ত আমরা ঘাটে ভিড়লাম।
গতবছর গ্রীষ্মকালটা আমার কেটেছে নিউ ইংল্যান্ডের বড় মনোরম একটা গ্রামে। ম্যাসাচুসেট্স্-এর রেনহ্যাম আমার জীবনের প্রায় সবটুকু আনন্দ আর বেদনা জুড়ে আছে। জে.ই.চেমবারলিন এবং তাঁর পরিবারের সাথে কিং ফিলিপস্ পন্ড-এর পাশে, রেড ফার্মে তাঁদের বাড়িতে আমি ছিলাম অনেককাল। আমি গভীর কৃতজ্ঞতায় আমার এই প্রিয় বন্ধুদের আন্তরিকতা আর তাদের সাথে কাটানো সুখের দিনগুলোর কথা স্মরণ করি। তাঁদের সšতানদের মধুর সাহচর্য্য আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। আমরা বনের মধ্যে কিংবা পুকুরে খেলতাম, দুষ্টামি করতাম। আমার বলা হুরপরি-ভূতপ্রেতের গল্পে বাচ্চাগুলোর কিচিরমিচির-আনন্দের কথা মনে করতে এখনও খুব ভালো লাগে আমার। চেমবারলিন সাহেব আমাকে প্রথম গাছ আর বুনোফুলের রহস্য বুঝতে শিখিয়েছিলেন, তারপর ভালোবাসার কানে আমি শুনেছি ওক গাছের শিরায় ব’য়ে যাওয়া রসের স্পন্দন, দেখেছি পাতা থেকে পাতায় লাফিয়ে বেড়ানো রৌদ্রের ছটা। এরকমই সব।
যেমন করে একটা গাছের শেকড় মাটির নীচের অন্ধকারে থেকেও টের পায় তার উপরের অংশের আনন্দ, রোদ আর হাওয়া আর পাখির পরশ, প্রকৃতির অনুগ্রহে আমিও তেমনই দেখেছি অনেক অদেখাকে।
আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এমন একটা ক্ষমতা আছে যার বলে সৃষ্টির আদি থেকে যা কিছু অনুভুতি আর অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে মানুষের মনে তার একটা ধারণা আমরা করতে পারি । প্রতিটা মানুষেরই মনের অতলে রয়ে গেছে সবুজ মাটি আর রিনরিনে পানির স্মৃতি । অন্ধত্ব কিংবা বধিরতা আমাদের পূর্ব পুরুষের দেয়া এই অধিকার লুঠ করে নিতে পারে না । উত্তরাধিকার সুত্রে লব্ধ এই ক্ষমতা অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মত - আত্মার ইন্দ্রিয় যা একই সাথে দেখে, শোনে অনুভব করে ।
.................................
নাহ্ এ কথা ভুললে চলবে না যে আমি গতবছরের গ্রীষ্মকালের কথাই লিখতে চেয়েছিলাম বিশেষ করে । আমার পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই মিস্ স্যালিভান আর আমি তড়িঘড়ি চলে এসেছি এই সবুজ প্রান্তে । এখানে রেনহ্যামের বিখ্যাত তিন ঝিলের একটার পাশে আমাদের কটেজ আছে ছোট । এই দীর্ঘ রৌদ্রজ্জ্বল দিনগুলির মধ্যে থেকে মনে হয় আমার কাজ, কলেজ আর শহুরে কোলাহল অনেক দূরে ফেলে এসেছি । রেনহ্যামে থেকেই বিশ্ব যুদ্ধ, মিত্র দেশ আর সামাজিক উথাল পাথালের কিছু কিছু খবর পাচ্ছিলাম। সমুদ্রের অন্য পারের নৃশংস এবং অদরকারী যুদ্ধের কথা আমরা শুনেছি আর জেনেছি পুঁজি এবং শ্রমের মধ্যকার দ্বন্দের কথা । আমরা জানতাম আমাদের এই স্বর্গোদ্যানের বাইরেই মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইতিহাস তৈরীতে লেগেছে, যে সময়ে তারা আরাম করে ছুটি কাটাতে পারতো । তবে এই নিয়ে ভাবতাম না তেমন । এসবই ক্ষণস্থায়ী । অথচ এখানে ছিল ঝিল আর বন আর ডেইজি ফুলের মাঠ এবং সুগন্ধী প্রান্তর, এরাই টিকে থাকবে চীরকাল ।
যাদের ধারণা শুধু চোখ আর কানের মাধ্যমেই মানুষের সমস্ত বোধ অনুভুত হয়, তারা অবাক হয় শুনলে যে আমার কাছে শহরের রাস্তা আর গ্রামের রাস্তা একেবারেই আলাদা মনে হয় । তারা ভুলে যায় যে আমি আমার সমস্ত শরীর দিয়েই চারপাশকে অনুভব করি । নগরের হৈ হল্লা গোলমাল আমার মুখের স্নায়ুকে বিদ্ধ করে । আর আমি অনুভব করি জনতার এক অনিঃশেষ পদদলন । সেই কর্কশ শোরগোল আমার চেতনাকে বিক্ষুব্ধ করে । শক্ত পিচের রাস্তায় ভারী যানবাহন ঘষটানোর শব্দ আর মেশিনপত্রের একঘেয়ে আওয়াজ আরও বেশী অসহনীয় মনে হয় যদি না একইসাথে চারপাশের দৃশ্যাবলী চোখে পড়ে, যে সুবিধাটুকু চক্ষুষ্মানদের কাছে সবসময়েই থাকে ।
......................
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় হাত হয়তো চোখের চাইতেও স্পষ্ট করে বুঝতে পারে কোন ভাস্কর্যের সৌন্দর্য্য । ওদের ছন্দময় রেখা আর বাঁকগুলি হয়তো চোখের চাইতেও নরম করে অনুভব করা যায় ছুঁয়ে দেখলে । সে যাই হোক না কেন, আমি জানি যে পাথরের দেবদেবীর মুর্তির ভেতর আমি গ্রীসিয় পুর্বপুরুষের হূদস্পন্দন অনুভব করি ।
.......................
আমার শিক্ষিকা সারা সকাল ধরে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন যে একটা মগ আর তার ভেতরে রাখা দুধ, এরা আলাদা বস্তু । কিন্তু আমি বোকার মতন বারেবারে মগ লিখতে দুধ লিখছিলাম, আর দুধ লিখতে মগ । হয়তো শেষমেষ আমার এ ভুল শুধরে দেবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি । শেষ পর্যন্ত তিনি উঠে আমাকে নিয়ে গেলেন বাইরের পাম্প হাউসে । সেখানে কে যেন পানি পাম্প করছিল, যখন সেই ঠান্ডা পানির ধারা উপচে পড়ছিল, শিক্ষিকা আমাকে মগটা রাখতে বললেন নলের নীচে আর বানান করলেন
“পানি”, পানি!
এই একটা শব্দই আমার আত্মাকে নাড়া দিয়ে গেল, আর সে জেগে উঠলো, ভোরের সঞ্জীবনি আর আনন্দমুখর গানে ভরপুর হয়ে । ঐ দিনটা পর্যন্ত আমার মনটা ছিল একটা অন্ধকার কুঠুরির মত, অপেক্ষায় ছিল শব্দেরা ঢুকে বাতি জ্বালাবে...
সেইদিন অনেক শব্দ শিখেছিলাম আমি । এখন মনে নেই কি কি শব্দ, তবে এটুকু মনে আছে যে - মা, বাবা, বোন, শিক্ষিকা তার মধ্যে ছিল । আমার মত আনন্দিত আর একটা শিশুও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হত নিশ্চয়ই, সেইরাতে যখন আমি আমার ছোট্ট বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাস্যজ্জ্বল দিনটার কথা ভাবছিলাম, জীবনে প্রথমবারের মত আমি অপেক্ষায় ছিলাম নতুন একটা দিনের ।
পরদিন সকালে জেগে উঠলাম একরাশ খুশী মনে নিয়ে । যা কিছুই ছুঁয়ে দেখছিলাম, যেন জীবন্ত । কারণ আমি সবকিছুই নতুন পাওয়া অদ্ভুত আর সুন্দর এক দৃষ্টিতে দেখছিলাম । এরপর আর কোনদিন আমার রাগ হতোনা, কারণ আমার বন্ধুরা কি বলছে আমি বুঝতে পারতাম, আর নিজেও শিখছিলাম নতুন সব কিছু ! আমার নতুন পাওয়া স্বাধীনতার প্রথম দিনগুলোতে আমি চুপচাপ থাকতেই পারতাম না । আমি ক্রমাগত বানান করতাম শব্দের আর তাই নিয়েই মেতে উঠতাম । আমি দৌঁড়াতাম, লাফাতাম, ঝাপাতাম, দোল খেতাম যে খানেই যাই না কেন । সবই যেন অঙ্কুরিত হচ্ছিল আর ফুটে উঠছিল । মধুমালতী লতা ঝুলতো মালার মত, মিষ্টি সুগন্ধ নিয়ে, আর গোলাপ যেন কখনোই এত সুন্দর ছিল না । আমার শিক্ষিকা আর আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাইরে বাইরেই কাটাতাম, আমি উল্লসিত ছিলাম ভুলে যাওয়া আলো আর রোদ ফিরে পেয়ে....
...........
সেখানে পৌঁছানোর পরদিন আমি ভোর ভোর উঠলাম । গ্রীষ্মের এক সুন্দর সকাল, সেদিন আমার পরিচয় হবে এক গম্ভীর রহস্যময় বন্ধুর সাথে । আমি তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে দৌড়ে নীচে নামলাম । আমার শিক্ষিকার দেখা পেলাম হলেই আর তাঁকে ধরে বসলাম তখনই সমুদ্রে নিয়ে যাবার জন্য । তিনি হাসতে হাসতে বললেন “আগে নাস্তা করতে হবে তো আমাদের!” নাস্তা শেষ হতেই তাড়াহুড়া করে বেল হলাম । পথে ছোট ছোট বালির পাহাড় পরছিল । মাঝে মাঝেই লম্বা ঘাসে আমার পা জড়িয়ে যাচ্ছিল আর আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম, উষ্ণ চিকচিকে বালির উপরে । সেই সুন্দর উষ্ণ বাতাসে বিশেষ একটা সুগন্ধ ছিল, সমুদ্রের যত কাছে যাচ্ছিলাম, বাতাসটা আরো ঠান্ডা আর মনোরম হয়ে উঠছিল ।
আমরা থামলাম হঠাৎ, আর আমাকে বলে দেবার আগেই বুঝতে পারলাম আমার পায়ের কাছে সমুদ্র । আমি এও বুঝলাম যে সমুদ্র অগাধ, অবাধ, ভয়াল! হঠাৎই যেন দিনটা খানিক ম্লান লাগছিল আমার কাছে । তবে ভয় হয়তো আমি পাই নাই । কারণ কিছুক্ষণ পরেই যখন আমার সাঁতারের পোশাক পরে তীরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর ঢেউগুলি ছুটে এসে চুমু খাচ্ছিল আমার পায়ে, আমি খুশীতে চিৎকার করেছি, আর দ্বিধাহীন দাপাদাপি করেছি ঢেউএর ওপর। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, একটা পাথর আমার পায়ে ধাক্কা দেয়ায় আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম সামনের ঠান্ডা পানিতে ।
তখন একটা অদ্ভুত ভয়ের অনুভুতি আমাকে অবশ করে দিচ্ছিল । সমুদ্রের লোনা পানিতে আমার চোখ ভরে যাচ্ছিল, নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না আমি, আর বিশাল এক ঢেঊ আমাকে যেন ছোট্ট পাথরের নুরির মত ছুড়ে ফেলেছিল তীরে । এরপর বেশ কিছুদিন একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম আমি, অনেক বলে বলেও আমাকে পানির আশেপাশে নেয়া যেতনা । তবে আস্তে আস্তে আবার সাহস ফিরে পেয়েছিলাম । আর সেই গ্রীষ্ম ফুরাবার আগেই ভাবতে শুরু করেছিলাম সমুদ্রের ঢেউএর তোড়ে ভেসে বেড়াবার মত আনন্দের আর কিছুই না...
..........................
গাছের বেড়ে ওঠা দেখতে পাওয়া একটা চমৎকার ব্যাপার, নিজেকে মনে হয় সৃষ্টির অংশীদার । বাইরেটা যখন ঠান্ডা আর সাদা, যখন বনের পশুরা ফিরে গেছে মাটির নীচে তাদের উষ্ণ আশ্রয়ে আর তুষার ঢাকা পত্রহীন গাছের শাখায় ঝুলছে শূণ্য পাখির বাসা, আমার জানালার বাগান হাসে, ঝলমল করে, ভিতরে গ্রীষ্ম রচনা করে বাইরে যখন শীত । তুষার-ঝড়ের মাঝখানে ফুল ফুটতে দেখা কি যে বিস্ময়কর! যখন আমার জানালার কাঁচে তুষারের ঠান্ডা বরফ আঙুল করাঘাত করছিল ঠিক তখনই আমি অনুভব করেছি একটা কলিকে ‘লাজুক সবুজ ঘোমটা তুলে ফুটে উঠতে রেশম কোমল শব্দে’ । কোন গোপন ক্ষমতার কারণে, এই যাদুকরী প্রস্ফুটন? কোন রহস্যময় শক্তি একটা বীজকে, অন্ধকার মাটির ঘেরাটোপ পার করে নিয়ে চলে আলোর কাছে, পাতা, ডাল আর কলির মাধ্যমে একটা সম্পুর্ণ ফুল হয়ে উঠবার পরিপূর্ণতায়? কে স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল ওই অন্ধকার মাটির গর্ভে এত সৌন্দর্য্যরে অবস্থান আর তা ধারণ করেছিল আমাদেরই রোপন করা ছোট্ট একটা বীজ? সুন্দরী ফুল, তুমি আমাকে দৃষ্টির বাইরের গভীরতাকে দেখতে শিখিয়েছো । এখন আমি বুঝতে পারি চারপাশের এই অন্ধকার হয়তো কোন সম্ভাবনা লালন করছে যা এমনকি আমার আশার চেয়েও ভালো ।
(অনুবাদ: লুনা রুশদী)