- দেখিস আবার ভান করতে করতে আসলেই খাইয়া ফেলতে পারোস।
খালাম্মা বললো।
আমরা শুক্রবারের সকাল বেলায় বসার ঘরে বসে ছিলাম। মানে আমি, আম্মা, ছোট মামা, রাজু ভাই, খালাম্মা আর দাদী। আব্বা নিজের ঘরে কাজে। রিমা আর লিমা পাড়ার মাঠে। ওদের ততদিনে অনেক বন্ধু হয়েছে । স্কুলের দিন প্রতি বিকালে খেলতে যায় আর ছুটির দিন সকাল বিকাল।
রাজু ভাই কোত্থেকে যেন কাগজের টুকরায় করে কাকের গু ধরে নিয়ে আসছে। এখন জনে জনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ভান করছে সেই জিনিষ খাওয়ার। এইবার মোটামুটি সারা বসার ঘর রাউন্ড দেয়ার পর ছোটমামার সামনে দাঁড়ালো। ছোটমামা আর রাজু ভাই প্রায় এক বয়সী, দুইজনই কলেজে পড়ে তখন। রাজুভাই মাথা নিচু করে জিভ বের করে ঢং আরম্ভের সাথে সাথেই মামা হঠাৎ রাজুভাইয়ের কাগজ ধরা হাত ধরে উপরে তুলে দিল। সাথে সাথে কাগজের জিনিষ মুখে ট্রান্সফার। আমরা কিছুক্ষণ হতভম্ব থাকার পরে হাসতে হাসতে শেষ । বেচারা রাজু ভাই তখন প্রবল আক্রোশে মামার কর্ডের প্যান্টে জিভ মুছছে আর আ আ জাতীয় শব্দ করছে। মামা পরম আদরে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছে
- কেমন লাগে বাপধন? মা-বাবার কথা সাথে সাথে ফলে!
এমন সময় কলিংবেল। এক মিনিটের মধ্যেই তিনবার বাজাতে বুঝলাম নিশ্চয়ই রিমা-লিমা ফিরলো। আম্মার সাথে সাথে আমিও উঠে গেলাম। দরজার ওপাশ থেকেই কি নিয়ে যেন ওদের বেশ উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। দুইজন একইসাথে কথা বলছিল বলে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। আম্মা দরজা খুলতেই তার দুইহাতের তল দিয়ে দুজন ঢুকে দৌড় লাগালো আব্বার পড়ার ঘরে।
- অ্যাই কি হইছে? তোর আব্বার ঘরে এখন ঢুকলে কিন্তু রাগ করবে!
বলতে বলতে আম্মা ওদের পিছন পিছন গেল। আর তার পিছন পিছন আমি। প্রায় একই সাথে চারজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে আব্বা মুখ তুলে আম্মার দিকে তাকালো। আম্মা একটা বেচারা বেচারা আধা হাসি শুরু করতে করতেই আব্বা বললো
- তুমি এইরকম কুইচা মুরগির মতন সবসময় ছানাপোনা সঙ্গে নিয়ে ঘুরঘুর কর কেন, কি সমস্যা?
- আরে ওরাই তো তোমার ঘরে আসলো মাঠ থিকা আইসাই। আমি দেখতে আসলাম কি হইছে।
আম্মার প্রম্পট পাওয়ার সাথে সাথেই দুইজন একসাথে মুখ খুললো।
আব্বা বললো - আরে আরে থামো থামো। একজন একজন করে .. হুম বল রিমা।
- আচ্ছা আব্বা একমন তুলার ওজন বেশী না একমন লোহার ওজন বেশী?
- আব্বা লোহার ওজন বেশী না? আমি রিমারে বললাম যে লোহা বেশী ভারী! কিন্তু গাধাটা দৌড়াইয়া বাসায় আসছে। এতক্ষণে ওরা বোধহয় নিয়া গেল।
- কি নিয়া গেল?
আমি বললাম।
- দিদাস ভাই একটা মাটির হাতি বানাইছে। ওইটা..
- দিদাস ভাই কে?
আব্বার প্রশ্ন।
- ওইযে আসছে না? লাল বিল্ডিংয়ের ছবি আঁকতেছে।
লাল বিল্ডিং মানে ইংরেজ আমলের একটা বাংলো বাড়ী লাল ইটের । দোতলা। পাড়ার এক কোনায়। একসময় ইউনিভার্সিটির এককেয়ারটেকার থাকতো পরিবার সহ। শুধু একটা ঘর নিয়ে। বাকী ঘরগুলি ব্যাবহার যোগ্য না। নীচতলায় বড় একটা হলঘরের ভিতর থেকে ঘোরানো সিড়ি উঠে গেছে, তার মাঝখানে মাঝখানে আবার ভাঙা। এখন আর কেউ থাকে না। দেয়াল ভেদ করে বটগাছের শিকড় নেমেছে।
- লাল বিল্ডিং আঁকতেছে কেন?
আমি বললাম।
- কি জানি। আর্টিষ্ট তো।
আম্মা বললো - তো এর সাথে লোহা আর তুলার কি সম্পর্ক?
- আমরা দোলনার কাছে গেছিলাম লুকাইতে। তখন দেখি দিদাস ভাই ছবি আঁকতেছে। আমাদের সবারই ছবিটা দেখতে ইচ্ছা হইতেছিল কিন্তু বেশী কাছে যাইতে ভয় পাইতেছিলাম। তখন উনিই ডাইকা ছবি দেখাইলো। খুবই ভালো উনি। এখনো পুরাটা আঁকে নাই, কিন্তু খুবই সুন্দর হইতেছে!
- হ্যাঁ, আমাদের সাথে অনেক কথাও বললো। ওই সময় মাটির হাতিটা দেখাইলো। উনার পাঞ্জাবীর পকেটে ছিল। একদম ছোট্ট হাতিটা, কালো রঙের। উপরে আবার সোনালী কাজ করা। সব উনি নিজে বানাইছে!
লিমা দম নেয়ার জন্য থামলে রিমা শুরু করলো
- আমাদের সবারই খুব ইচ্ছা হইলো হাতিটা নেয়ার। তখনই ধাঁধাঁটা দিল দিদাস ভাই। সবাই শুধু একবার উত্তর দিতে পারবে। যে সবচেয়ে আগে বলতে পারবে, তারে দিবে হাতি। তাড়াতাড়ি বলো আব্বা!
- উত্তর তো প্রশ্নের মধ্যেই আছে। আব্বা বললো হাসতে হাসতে।
ওদের দুইজনকেই মাথা চুলকাতে দেখে আমার দিকে তাকালো আব্বা - রিনা, তোমার তো পারার কথা। ক্লাস ফাইভে উঠছো, বড় মেয়ে তো তুমি ।
এতক্ষণ প্রশ্নটা নিয়ে আমিও দিশাহারা ছিলাম একটু। কিন্তু আব্বার কথাতেই মাথা খুলে গেল। তাই তো! - দুইটারই সমান ওজন। দুইটাই এক মন।
- বাহ্! আমার মেয়েটার অনেক বুদ্ধি!
উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে আবার দৌড় লাগালো ওরা। একই ভাবে ওদের পিছনে আম্মা আর তার পিছনে আমি।
মামা আর রাজু ভাই বাইরে গেছে। খালাম্মা আর কল্পনা রান্নাঘরে, আম্মাও সেদিকে গেল। আমি বসার ঘর পার হয়ে সামনের বারান্দায় চলে আসলাম। দাদী বেশীর ভাগ সময়েই এই বারান্দায় বসে থাকে। সামনে ফুলার রোড আর তার ওইপাশে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল। আজকে ছুটি, কিন্তু ছায়ানটে ক্লাস হচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তার রিক্সা, গাড়ী, মানুষের শব্দ ছাপিয়েও গানের সুর ভেসে আসছে।
- কি করেন বুবু?
আমি জিজ্ঞেস করলাম দাদীকে।
- মানু দেহি। কত মানু যাইতেয়াছে রাস্তা দিয়া।
- সব সময়েই তো যায়
- একই মানু তো আর সব সময়ে যায় না।
দিদাস নাম টা যেন কেমন। আমার মনে হলো। দাস কি তার পদবী? তাহলে হিন্দু। মানে তার নাম শুধু ‘দি’? এইটা কেমন আবার। ঞযব-দাস! হি হি। দাস মানে তো চাকর। মানে একমাত্র চাকর।
ঞযব-দাস!
কৃতদাস!
কি চাস.
কই যাস?
কাছে আস। হি হি হি।
আমারও একবার গিয়ে ছবি আঁকা দেখে আসতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু একা একা যেতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে।
এই পাড়ায় মেয়েদের তিনটা দল হয়ে গেছে। একদম কচিকাঁচা থেকে ক্লাস থ্রি/ফোর পর্যন্ত এক দল। ফোর/ফাইভ থেকে নাইন/টেন আরেকটা দল আর কলেজ ইউনিভার্সিটির মেয়েরা মিলে আরেকটা।
ছোটমেয়েদের দলটা বেশীর ভাগ সময় খেলে পাড়ার এক প্রান্তে করা পার্কে - মুখে মুখে যার নাম হয়েছে ‘দোলনা’। অথচ কোন দোলনা নাই সেখানে। একসময় ছিল, দুইটা। এখন স্মৃতি হিসাবে লোহার শিকলটুকু রয়ে গেছে। তবে অন্য অনেক কিছু আছে - দুইটা স্লিপার, দুইটা ঢেকি, একটা তালগাছ আর একটা বাঁদর ঝোলা। এরমধ্যেই সারাদিন ব্যস্ত থাকার অনেক মালমশলা জুটে যায়।
মেয়েদের দুই নম্বর দলটা খেলে পাড়ার মাঝখানের খেলার মাঠে। মাঠের অর্ধেকটা মেয়েদের দখলে আর অর্ধেকটা ছেলেদের। গরমকালে ইচ্ছা মতোন যা খুশী খেলা, শীতকালে কোর্ট কেটে ব্যাডমিনটন। মাঠের কোন ঘেসে ঘেসে ছোট ছোট ফুলের কেয়ারী - দোপাটি, ডালিয়া, কসমস আরো কি কি যেন।
কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েদের দল খেলে না। ওরা মাঠের চারপাশ ঘিরে পাকা রা¯তায় দল বেঁধে হাঁটে আর অনেক গল্প করে, হাসে। মাঝে মাঝে কোন বাড়ীর সামনে রিকশা বা গাড়ী থামলে জায়গা করে দেয়ার জন্য সবাই একপাশে সরে দাঁড়ায়।
পাড়ায় খেলে ছেলেদের একটাই দল। বেশীর ভাগ সময় দৌড়াদৌড়ি ধরনের খেলা থাকে ওদের। মাঝে মাঝে অন্য পাড়ার ছেলেরাও আসে খেলতে। তবে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেরা সাধারণত পাড়ায় থাকে না বেশীর ভাগ সময়। ওদেরকে শুধু যেতে-আসতে দেখি।
এই অলিখিত নিয়ম অনুসারে আমার থাকার কথা ছিল মাঝারী মেয়েদের দলে। কিন্তু কেন যেন আমার সাথে কেউ খেলতে চাইতো না। আরেকটু ছোটবেলায় যখন রিমা-লিমার তেমন বন্ধু হয় নাই পাড়ায়, আমরা তিনজন একসাথে ঘুরতাম মাঠে। ‘দোলনা’য় খেলতাম। সেইসময় লালবিল্ডিংয়ে রোমেল-সোহেলরা থাকতো। লালবিল্ডিংয়ের গাড়ী বারান্দা ছিল একটা, তার সামনে থেকেই দোলনার শুরু। সেই গাড়ী বারান্দার দুই ইটের থাম জড়িয়ে বাগান বিলাসের ঝোপ উঠে গেছে অযতেœ। জংলা ঝোপ একদম। উপরে উঠতে উঠতে বিল্ডিংয়ের খানিকটা আড়াল করে ফেলেছে। তাতে কাগজের মতন গোলাপী গোলাপী বাগান বিলাস ফুটতো, দেখতাম।
রোমেল ছিল পাগল। সে গাড়ীবারান্দার এপাশ ওপাশ পায়চারী করতো আর নিজের মনে বিড়বিড় করে কি সব বলতো। একটা হাত সবসময় উঠতো-নামতো যেন অদৃশ্য বল নিয়ে খেলছে। মাঝে মাঝে একা একাই হাসতো। সবাই ভয় পেতাম আমরা, কেউ লালবিল্ডিংয়ের খুব কাছে যেতামনা তাই। মানুষের মুখে মুখে রটে গিয়েছিল রোমেলকে জ্বিনে ধরেছে। তার থেকে আমার ধারণা হলো ‘দোলনা’র মাটির তলায় নিশ্চয়ই আলাদ্বীনের আশ্চর্য্য প্রদীপ আছে। আমরা তিনজন সুযোগ পেলেই দোলনার মাটি খুঁড়তাম। আমার ইচ্ছা ছিল মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে যে মাটি পাওয়া যাবে, তা দিয়ে দোলনার পাশেই একটা ঘর বানিয়ে আমি একা একা থাকবো। আম্মা মাঝে মাঝে খুব বকাবকি করে, একা থাকলে এইসব আর সহ্য করতে হবে না।
তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই রিমা-লিমা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। যমজ বোন হওয়ার কারণে দুই-জন এক ক্লাসে। তারমধ্যে ওদের স্কুলের কয়েকজন ব›ধু আমাদের পাড়াতেই থাকে। তাই এখানের দলে জমে যেতেও কোন সমস্যা হয় নাই। আমি কিছুদিন ওদের দলের সাথে সাথে ঘুরেছি, কিন্তু সবাই আমাকে আপা বলে। আর এদের মধ্যে নিজেকে কেমন বেখাপ্পা লাগায় আস্তে আস্তে ছেড়ে এসেছি। রিমা-লিমা খেলাধুলাতেও খুব ভালো। যে কোন কম্পিটিশানে কিছু না কিছু একটা প্লেস তো থাকেই ওদের। আবার লিমা তো ক্লাস ওয়ানের বছরই ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ কবিতাটা নির্ভুল আবৃত্তি করতে পারতো! তাই পাড়ায় ওদের ভক্ত অনেক। আমি আবার বাসার ভিতরে যে রকম ডাকাত সর্দারের মতোন চলতে পারি, বাসার বাইরে সেইরকমই লাজুক আর বোকা-বোকা।
এর আগের বছর শীতের সময় মাঠের মাঝখানে কাটা চারটা ব্যাডমিন্টন কোর্টের একটাতে বিপাশা, মিথিলা, কামিনী আপা আর লিপি আপা খেলছিল। আমি আমাদের তিনতলার বারান্দার গ্রীলের আড়াল থেকে খেলতে দেখতাম ওদের, রোজ। শুধু ওরা চারজনই না, নয়-দশজন মেয়ে সব মিলে। চারজন করে খেলতো, বাকীরা কোর্টের পাশে বসে গল্প করতো অথবা ‘বি কুইক’ কিংবা ‘বন্ধুগণ’ খেলতো। প্রতিদিনই ওদের দলে ঢুকতে ইচ্ছা হতো আমার, কিন্তু সেরকম সাহস করে উঠতে পারতাম না। সেদিন অসীম সাহস সঞ্চয় করে মাঠে গেলাম আম্মাকে বলে। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নামলেও কোর্টের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চলার গতি ধীর হলো। অনেক ইতস্তত করে দাঁড়ালাম নেট বাঁধা বাঁশের পাশে। কি বলবো কি বলবো ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ মুখ থেকে বের হয়ে গেল
- আমারে তোমরা খেলায় নিবা?
তখনও ঘরে আর বাইরে দুইরকম করে কথা বলা আয়ত্ত করতে পারিনি। নিতান্তই গাঁইয়া উচ্চারণে কথা শুনে ওরা চারজনই খেলা থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর মিথিলা গান গাওয়ার মতন সুর করে বললো - না আ আ আ । বলতে বলতেই হাসিতে গড়িয়ে পড়লো। কোর্টের মাঝখানেই বসে পড়লো হাসতে হাসতে। ওর হাসি দেখে অন্য সবাইও হাসতে থাকলো। আমার চোখের কোন অবধি পানি চলে আসলেও মনে মনে বললাম কিছুতেই কাঁদা যাবে না। আমি জানি বারান্দায় গ্রীলের ওপাশ থেকে আম্মা ঠিকই নজর রাখছে আমার দিকে। আমার এমন ভাব করতে হবে যেন ওদের সাথে আমিও হাসছি। আমার সেই কাঁদো কাঁদো মুখে হাসির অভিনয় খুব অনবদ্য হয়েছিল কিনা কে বলবে, আমি ছাড়া দর্শকও তো ছিল না আর কোন।
এরপরে আর চেষ্টা করিনি। আম্মা অবশ্য করেছিল। একবার পাড়ার আমার বয়সী মেয়েদেরকে বিকালের নাস্তা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। এসেছিল সবাই। কেক, পেস্ট্রি, চানাচুর, গ্লুকোজ বিস্কুট, সাগর কলা ইত্যাদি অনেক মজার মজার খাবার খেতে খেতে আমার সাথে গল্পও করেছে টুকটাক। ওরা চলে যাওয়ার সময় আম্মা অনুরোধ করেছিল বিকাল বেলায় আমাকেও যাতে খেলতে ডাকে। এরপর কয়েকদিন আমার বাসার সামনেও - রিইইইনাাাা, রিইইইনাাাা করে ডাকতো কয়েকজন। আর ওদের কন্ঠস্বরে নিজের নাম বাতাসে মিশে যেতে শুনতে শুনতে খুশীতে ডগমগ করতে করতে আমি নীচে নেমে যেতাম খেলতে। কিন্তু এক বিকালের চানাচুর-বিস্কুট আর কতদিন পেটে থাকে। একসময় ডাক থেমে গেল। আমিও আবার আগের মতোই।
- রিনা মা, দরজাটা একটু বন্ধ কইরা দাও তো, আমি ডিপার্টমেন্টে যাই।
- দাঁড়াও আব্বা, আমিও দোলনায় যাই একটু? লালবিল্ডিংয়ের ছবি আঁকা দেইখা আসি।
- আইচ্ছা চল। স্যান্ডেল পড়।... কইগো রিনার মা, দরজাটা লাগাইয়া দেও।
আব্বার সাথে বের হয়ে গেলাম। দোতলায় দেখি বিভার আম্মা কলাওয়ালার সাথে দরদাম করছে। - এটা কি কলা নাকি? কলার বাচ্চা! এতো দাম চাও কেন?
আমাদের দেখে লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললেন। তাঁর সাথে সালাম বিনিময় করে নীচে নেমে এলাম আমরা। আব্বার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলাম -
- আচ্ছা আব্বা রাজাকার মানে কি?
- কই শুনলা এই শব্দ?
- সেইদিন রাজুভাই আর ছোটমামা কার কথা জানি বলতেছিল। তার বাবা নাকি রাজাকার ছিল। আমি ভাবলাম রাজা হওয়া তো ভালো কথা, কিন্তু ওরা ওই বন্ধুরে পছন্দ করে না।
- রাজাকার শব্দের আক্ষরিক অর্থ খারাপ না। আরবী থেকে এসেছে, এখন উর্দুতেও ব্যবহার করা হয়। ‘রাজা’ শব্দের অর্থ খুশী, যে খুশী করে সে রাজাকার। কিন্তু বাংলাদেশে এর অন্য অর্থ।
- কি অর্থ?
- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেইসব বাংলাদেশী পাকিস্তানের হয়ে কাজ করেছিল, তাদের নাম ছিল রাজাকার। তাই এইটা গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন কাউকে যদি বেঈমান বল..
- বা মীরজাফর বল..
- হ্যাঁ, ওইরকমই রাজাকারও। শব্দ বা নামের তো কোন দোষ নাই। মীরজাফর নাম টা কি খারাপ? কোন শব্দ বা নামের সাথে ইতিহাস থাকে, তাতেই সে ভালো হয় বা খারাপ হয়।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম মনীষা আসছে । আমরা এক ক্লাসে পড়ি। মাঝে মাঝে একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা করি। মনীষাও পাড়ার কারো সাথে তেমন মেশে না। যদিও ওর না মেশা টা আমার মতন না। আমাকে তো কেউ খেলতে নেয় না, তাই। ওর ভাবটা রাজকীয়, যেন সবাইকে ও বন্ধুত্বের যোগ্য মনে করে না। আমার ওর সাথে কথা বলতে অনেক ভালো লাগে। আব্বাকে বিদায় দিয়ে ওর কাছে গেলাম -
- মনীষা জানো, একজন আর্টিস্ট নাকি লাল বিল্ডিংয়ের ছবি আঁকছে। দেখতে যাবা?
- তাই নাকি? চলো।
দোলনার সামনে গিয়ে দেখি পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়া দাড়ীওয়ালা একটা লোক তুলি হাতে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাল বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে দাড়ি চুলকাচ্ছে। আমি সামনে যেতে একটু ইতস্তত করছিলাম, মনীষা আমার হাত ধরে বেশ দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল।
- আপনি নাকি লাল বিল্ডিংয়ের ছবি আঁকছেন? দেখতে আসলাম
- খুব খুশীর সংবাদ, দেখ!
দিদাস ভাই হাসি মুখে বলে ক্যানভাস থেকে কয়েক পা পিছিয়ে আসলেন।
- আপনি লাল বিল্ডিংয়ের ছবি আঁকতেছেন কেন?
আমি জানতে চাইলাম।
- অনেক আগের বিল্ডিং, শুনেছি ইংরেজ আমলে এক জজসাহেব থাকতেন এখানে। মাঝেমাঝে জানতে ইচ্ছা করে সেই সময় এই বিল্ডিংটা কেমন লাগতো দেখতে। তখন হয়তো বাগান ছিল, মালি ছিল, বাসার ভিতর অনেক মানুষের ভিড় ছিল, এখন কেমন একলা। একসময় হয়তো থাকবেই না, অথচ কত রকম দিনের স্ক্ষাী দালানটা...
দিদাস ভাই বিভোর হয়ে কথা বলছিলেন, হয়তো আমাদের উপ¯িথতিও ভুলে গিয়েছিলেন খানিকক্ষণের জন্য।
- কয়দিন ধরে আঁকছেন?
মনীষার প্রশ্ন।
- আজকে নিয়ে তিনদিন আসলাম এখানে। কিছু কিছু কাজ অবশ্য বিল্ডিংয়ের সামনে না দাঁড়িয়েও করেছি। ছবিটা শুরু করেছি প্রায় দুই সপ্তাহের মতন।
আমি ছবি দেখে বেশ মুগ্ধই হয়ে গেলাম। সত্যিকারের বিল্ডিংটার চেয়েও অনেক সুন্দর লাগছে ছবিতে। একদম গাঢ় লাল ইটের বাড়ির সামনে, পিছনে, চারদিকে অনেক রকমের সবুজ - ঘন, হালকা, কোনটা আবার হলুদের কাছাকাছি, কোন পাতার রং গাঢ় হতে হতে প্রায় মেরুন।
লাল বিল্ডিংয়ের একদিকে, দোলনার পাশেই একটা জংলা মত জায়গা আছে। সেখানে একটা পানির ট্যাপ আছে আর তার পাশেই ড্রেন। ট্যাপের জায়গাটা শ্যাওলা জমা, পিচ্ছিল। মাঝে মাঝে বাসার ট্যাপে পানি না থাকলে আমরা এখান থেকে পানি নিয়ে যাই, মানে পাড়ার সবাই। ওই জায়গাতে এমনিতে কারো আসতে ইচ্ছা করেনা, নোংরা, ড্রেনের গন্ধ। কিন্তু ছবিতে কি সুন্দর লাগছে। যেন রূপকথার ছোট্ট বন। আবার ছবিতে ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে হলুদ সাদা ফুল আঁকা। আর গাড়ীবারান্দার বাগান বিলাসটাকে কি রূপসী লাগছে ছবিতে! সবুজ লতাপাতার মধ্যে কি সুন্দর থোকায় থোকায় ফুটেছে ফুলগুলি।
দিদাস ভাই তুলিতে রঙ মাখতে মাখতে আমাদের সাথে কথা বলছেন আর সামনেই ঝাড়–দারের দুই মেয়ে পাতা জড়ো করছে ঝাড়– দিয়ে দিয়ে। আমাদের বয়সীই দুইজন। ময়লা প্রিন্টের জামা পরা।
- আপনি ছবি আঁকেন, আমরা দেখি।
আমি বললাম।
দিদাস ভাই ক্যানভাসের জঙ্গলের মধ্যে তুলি দিয়ে কয়েকটা আঁক দিতেই ম্যাজিকের মতোন ফুটে উঠলো ছাপা শাড়ী গাছকোমর করে পরে দুটি মেয়ে ঝাড়– দিচ্ছে। মেয়েগুলিকে দেখাচ্ছে ছদ্মবেশী রাজকন্যার মতো। ওদের শাড়ীর রঙে চারদিকটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
- আপনি ওই মেয়েগুলিকে আঁকলেন এখন, তাইনা?
- হ্যাঁ।
- কিন্তু ওরা তো শাড়ি পরে নাই, জামা পরা।
- সব কিছু যেমন আছে ঠিক তেমনি আঁকলে আর আমার ছবিটা আমার হবে কি করে? আমি তো আমি যে ভাবে দেখছি, অথবা দেখতে চাইছি, তাই আঁকছি। খানিকটা কল্পনা, খানিকটা সত্যি।
- আচ্ছা, আপনি যে একটা মাটির হাতি বানাইছিলেন, ওইটা কাকে দিলেন?
- নাদিয়া পেল, ওই সবচেয়ে আগে আমার ধাঁধাঁর উত্তর দিয়েছিল তো।
মনীষা বললো - এই ছবিটা আবার কাউকে দিয়ে দিয়েন না যেন!
- দিতে মানা করছো?
দিদাস ভাই কৌতুক মেশানো হাসি হাসলেন।
- এতো কষ্ট করে ছবি এঁকে দিয়ে দিবেন কেন? আপনি রেখে দেন।
এমনভাবে বললো মনীষা যেন দিদাস ভাইকে ছবিটা রেখে দেওয়ার পারমিশান দিল ও।
আর কেউ কিছু বলার আগেই ধুপধাপ শব্দে নাদিয়াদের বাসা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো ওরা কয়েকজন। কে কার আগে দিদাস ভাইয়ের সামনে পৌঁছাতে পারে তার কম্পিটিশান। রিমা-লিমাও আছে সাথে।
সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে নীলা বললো -
- জানেন দিদাস ভাই, আমাদের পাড়ায় না ফাংশান হবে!! আমরা নাচবো।
- আল্লাহ তাই!
আমি উৎসাহ চাপতে না পেরে প্রশ্ন করি।
- হ্যাঁ! স্বাধীনতা দিবস আর পহেলা বৈশাখ মিলায়া একটা ফাংশান হবে!
লিমা বললো।
- দারুন মজার ব্যাপার। তোমরা কে কি করছো ফাংশানে?
- এখনো জানি না, তবে আমি আর রিমা তো টুইন, আমাদেরকে নাকি একসাথে একটা নাচ দিবে, কল্যাণী আপা শিখাবে। উনি তো সার্কেও নাচছিল, জানেন?
- বাহ!
- হ্যাঁ, আপনি আসবেন কিন্তু দিদাস ভাই, পাড়ার মাঝখানে স্টেজ বানাবে। কালকে বিকালের মিটিং হবে, তখন ঠিক করবে কে কি করবে ।
- তোমরা আমাকে তারিখ বলে দিও, আসবো।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর বাসায় ফিরে আসলাম আমরা। বসার ঘরে মামা, রাজু ভাই আর উপর তলার রেহানা, সোহানা আপারাও আছে। দেখলাম ফাংশানের খবর ওদের জানা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ওই নিয়েই কথা চলছে।
- আসেন না আমরা প্রস্তাব দেই সিরাজোদ্দৌলা যাত্রা করবো। পাড়ায় তো যাত্রা হয় নাই কখনো, নতুন ব্যাপার হবে।
রেহানা আপা বললো।
মামা বললো - ঠিক হ্যায়, আমি রাজি। কিন্তু আমাকে সিরাজোদ্দৌলা বানাতে হবে। আনোয়ার হোসেন এর মতন ‘অভাগা দেশ’ বলে ঘুমায়ে পরার আমার বহুতদিনের খায়েশ। তবে তুমি তাহলে লুতফা বেগম সাজবা আর সোহানা আলেয়া!
- ইস মামু! একজন লুতফা, একজন আলেয়া! অন্যদের কে থাকবে তাইলে?
রাজু ভাই বললো।
- কেন বাবা মীরজাফর, তোমার ভাগ্যে ঘষিটি খালাম্মা আছে তো।
- আহারে ঘষিটির মতন একটা নাম নিয়ে ভদ্রমহিলার ভিলেন হওয়া ছাড়া গতি ছিল নাকি? তার নাম যদি হইত ‘জেবুন্নেসা’ বা ‘মেহজাবিন’ আর তারপরেও স্পাইগিরি করতো তাইলে নাহয় কথা ছিল।
ঘরের সবাই হেসে উঠলো রাজু ভাইয়ের কথায়।
পরদিন বড়দের মিটিংয়ের পর ঠিক হলো ছোটদের একটা নাটক থাকবে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে, বিভার আব্বা বাংলার প্রফেসার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, উনি নাকি এরমধ্যেই নাটক লিখেও ফেলেছেন। কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা মিলে সিরাজোদ্দৌলা যাত্রা করবে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে থাকবে ঋতুরঙ্গ। কোরাসে গান গাইবে কয়েকজন মিলে আর ছোট মেয়েরা নাচবে। আরও থাকবে কিছু আবৃত্তি, গান এইসব।
এরপরের কয়েকদিন সারা পাড়া জুড়েই বেশ ব্যস্ত সময় কাটলো। একেকজনের বাড়ীতে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে রিহার্সেল। সিরাজোদ্দৌলার দল আমাদের বাসায়, নাচের দল কল্যাণী আপার বাসায়, কোরাস গানের দল তপু ভাবীর বাসায় এইরকম। ছোটদের নাটকের দলটার কোন স্থায়ী নিবাস নেই, যে যখন জায়গা দেয় আরকি। এরমধ্যে রিমা-লিমাকে নাচের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে। ওরা দুইজন হেমন্তের নাচ করবে - ‘হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে..’। মনীষা কবিতা আবৃত্তি করবে। আমাকে যেহেতু কেউ তেমন চেনে না, তাই কোরাসের দলে যাওয়া আসা করছি ।
সেইদিন তপু ভাবীর বাসায় পৌঁছে দেখি নাটকের দলও সেখানেই, অর্থাৎ - জিয়া ভাই, নিপু ভাই, রণক, বিভা, কামিনী আপা আর শায়লা। জিয়া ভাই ক্লাস এইটে পড়তো তখন, আমার হিরো। সবসময় হাসিখুশী, ভীষণ ফরসা, চোখে চশমা। পাড়ার সবাই তাকে চেনে, সবার বাসাতেই অবাধ যাওয়া আসা। অন্য কেউ যা করলে লোকে ভাবে পাগলামী, জিয়া ভাই করলে সবাই মেনে নেয়। কারণ তাকে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়। যেমন পাড়ায় ছেলেদের খেলার দলে বস্তির কয়েকটা ছেলেও আসে খেলতে কারণ ওরা জিয়া ভাইয়ের বন্ধু। মাঝেমাঝেই তাকে দেখা যায় কাজের বুয়া সুফিয়ার দুই বছরের ছেলেকে কাঁধে নিয়ে ঘুরছে। আবার গত বছর মুকুল ভাই যখন একদম বেঁকে বসেছিল এ্সএসসি পরীক্ষা দেবে না বলে, আর বাসার কেউ তাকে বোঝাতে পারছিল না, তখনও জিয়া ভাইয়ের ডাক পরেছিল, জিয়া ভাই ঠিকই রাজী করালো তাকে শেষমেষ। আমার খুব ইচ্ছা ছিল নাটকের দলে থাকার, কিন্তু নিজের থেকে বলার সাহস হয় নাই।
নিপু ভাইকেও আমি ভালো চিনি। আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকে। মাঝে মাঝে মাঠ থেকে ফেরার সময় আমার ছোট বাইসাইকেলটা উপরে তুলে দেয়। আর রণক ও আমার মতন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তবে অন্য স্কুলে। ওর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়, একদিন কাঁঠালি চাপা ফুল তুলে দিয়েছিল।
আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই জিয়া ভাই বলে উঠলো - কি খবর রিনা?
আমি বললাম - মোটামুটি
- হা হা মোটামুটি! আমি মোটা আর ও মুটি হো হো হো!
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, যেন জিয়া ভাইয়ের এই ছোট্ট একটু ঠাট্টাতেই আমি দলের একজন হয়ে গেছি।
নাটকের রিহার্সাল হচ্ছিল। সবাই বসে বসেই নিজেদের লাইন বলছে স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে। সবার ফুলের নামে নাম। ছেলেদের - গোলাপ, টগর আর রঙ্গন। মেয়েদের - কামিনী, বেলী আর শিউলি। জিয়া ভাই আমাকে ডেকে তার পাশে বসিয়েছে। তার স্ক্রিপ্টও আমার হাতে, আমি প্রম্পট করে দিচ্ছি আর ও ডায়ালগ বলছে। হঠাৎ বললো - তুমি নাটক করবা?
- আমাকে তো কেউ বলে নাই করতে।
- তাই কি হলো? আমি বললাম। অ্যাই বিভা, রিনাও নাটক করবে। চাচাকে বলবা ওর জন্যও ডায়ালগ লিখে দিতে।
আমি খুশীতে বাকবাকুম করতে করতে বাসায় ফিরলাম সেদিন। আমার জন্যও একটা চরিত্র ঠিক হলো। আমার নাম চাঁপা। দুইটা ডায়ালগ আছে সর্বমোট। আর জিয়াভাই, মানে রঙ্গন যখন যুদ্ধে আহত হয়ে ফিরে আসবে, তখন বেলী আমাকে বলবে পানি এনে দিতে, আমি পানি এনে দিব। বাসায় সারাদিন পানি আনার প্র্যাকটিস শুরু করলাম। আব্বা - আম্মাকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে অতিষ্ট করে ফেললাম।
এদিকে ঠিক হলো, সব দল একসাথে হয়ে রিহার্সাল করতে হবে। কিন্তু কারো বাসায় এতো জায়গা নাই। তাই বড়রা মিলে ঠিক করলো, রিহার্সালের উদ্দেশ্যে লাল বিল্ডিংটা ঝাড়ামোছা করে দেয়া হবে আর কিছু বাল্বও লাগানো হবে, সন্ধ্যায় রিহার্সালের সুবিধার জন্য।
যে কথা সেই কাজ। সেদিন সন্ধ্যায় লাল বিল্ডিয়ে রিহার্সাল। জিয়া ভাই আর নিপু ভাই আসলো আমাকে ডাকতে। আম্মা আব্বা সাধারণত সন্ধ্যার পরে আমাদেরকে একা কোথাও যেতে দেয় না, কিন্তু আজকে সানন্দে রাজী হয়ে গেল । অবশ্য ছোটমামা আর রাজুভাইও বাইরে থেকে সরাসরি লাল বিল্ডিংয়েই চলে যাবে। আমরা তিনজন হেঁটে যাওয়ার সময় মাঠের কোনার লাইটপোষ্টের আলোতে আমাদের ছায়া দেখা যাচ্ছিল, লম্বা লম্বা। নিজেকে কত বড় বড় লাগছিল যে তখন!
পৌঁছে দেখি বড় হল ঘরটার একদিকে পোস্টার আঁকছে তনু ভাই আর তাঁর আর্ট কলেজের বন্ধুরা, দিদাস ভাইও আছে সেখানে। ওরা নাকি মঞ্চও সাজাবে। আমরা অন্য পাশে নাটকের দলের মাঝখানে বসে পড়লাম। আরেক দিকে তনু ভাইয়ের বোন, তরু আপা গান করছে - ‘ আমি পথ মঞ্জরী ফুটেছি আধার রাতে’, ইস কি সুন্দর গলা, আর তার গলার স্বর সারা হলঘরে ছড়িয়ে পড়ে উঁচু সিলিং পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, আবার ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে নীচে। ‘দেবতা চাহে না মোরে, গাঁথে না মালার ডোরে’, এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে ঘুরে ঘুরে ফিরছে সুরটা। ঘরভর্তি মানুষের জমজমাট হট্টোগোলের মধ্যেও কেমন রিনরিন করে দুঃখের মতো মনে বেঁধে।যেন আমরা চলে গেলেও গানটা সুরটা এখানেই ঘুরে ঘুরে ভারাক্্রান্ত করবে ঘরটাকে।
মামা, রাজু ভাই, রেহানা-সোহানা আপা আর সিরাজোদ্দৌলার বাকী দলবল বসেছে অন্য পাশে। মামা আব্বার পুরানো সাদা সেরোয়ানীটাতে জরী লাগাতে লাগাতে গুনগুন করছে - মোর পিয়া হবে সেরোয়ানী...’ হঠাৎ গুনগুন থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললো - আলেয়া!
- জাঁহাপনা
- চা বানা!
সবাই হেসে উঠলো একসাথে। হাসির শব্দও একই ভাবে ঘুরতে লাগলো ঘরের ভেতর, ঠিক যেখানে যেখানে সুরটা পৌঁচেছে সেখানে সেখানে, গানের সুরের দুঃখকে আড়াল করা পর্দার মতন, তবু হাসির আড়ালেই সেই সুরটাও আছে আমরা জানি।
এমন সময় পাশের ঘরের নাচের রিহার্সাল থেকে কল্যাণী আপা বললো, এই তোমাদের কারো আম্মার কাছে ছাই রঙের শাড়ী আছে। আমি ভাবছি, বৈশাখের জন্য নীলাকে ছাই রঙের শাড়ী পরাবো। কালবৈশাখী সিম্বলাইজ করবে।
আমি বললাম - আপা আমার আম্মার আছে। ছাইরঙের, লাল পাড়, হবে?
- নিয়ে আসতে পারবা এখন? তাহলে বোঝা যেত চলবে কিনা।
- জ্বী পারবো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
রাজু ভাই বললো - রিনা তুমি একলা ভয় পাইতে পার। রুমা একটু ওর সাথে যাবা প্লিজ।
যাত্রার দলের থেকে রুমা আপা উঠে এলো।
বাইরে গাড়ীবারান্দা তে আসতে রুমা আপা বললো - একটু দাঁড়াতে পারবা? আমি বাসায় এই বাটিটা রেখে আসি।
- আচ্ছা
ওদের বাসা লালবিল্ডিংয়ের পাশেই। রুমা আপা স্যান্ডেলে শব্দ তুলে বাসার দিকে গেল।
আমি গাড়ীবারান্দার দুই থামের মাঝখানের ইটের ছোট দেয়ালের উপর উঠে বসলাম। ঘরের ভেতরের আলো আর বাইরের বাগান বিলাসের ছায়া মিলেমিশে আজব চিকরিমিকরি প্যাটার্ন হয়েছে মাটিতে, অনেকটা আমার দাদীর বানানো চালের গুড়ির পাপড়ের মতোন। যখন ঘরের ভেতরের কেউ নড়ছে, এ ঘর ওঘর করছে, তখন বাইরের ছায়াটাও দুলে দুলে উঠছে। একই সাথে, গান, হাসি, হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। সব শোনা যাচ্ছে এখান থেকে, তবু মনে হচ্ছে কত দূরে এসব ঘটে চলেছে, যেন আরেকটা জীবনের অংশ এসব।
একটা বাতাস দিল হঠাৎ, বাগান-বিলাসের লতাগুলিকে কাঁপিয়ে দিয়ে বয়ে গেল। যেন বাড়িটা গাঢ় নিঃশ্বাস নিয়ে জেগে উঠছে, আড়মোড়া ভাঙছে। যেন এতদিন গভীর ঘুমের অন্ধকারে তলিয়ে ছিল রূপকথার হারিয়ে যাওয়া রাজত্বের মতো। দেয়াল বেয়ে নেমে যাওয়া বটগাছের শিকরগুলি দোল খাচ্ছে বাতাসে। আমি ফিরে তাকিয়ে দেখলাম বাড়িটাকে ভালো করে। সিঁড়ি ঘরের ভাঙা জানালাটা গলে আলো উপচে আসছে। ভিতরের উজ্জল আলোতে, হইচই, গানে কি মানিয়েছে বাড়িটাকে। সুন্দর লাগছে খুব, দিদাস ভাইয়ের ছবিটার চেয়েও!