আচ্ছা আমি কি প্রতিদিন একটাই একটা শালিক দেখি? মানে যাকে দেখি তিনি কে একই ব্যক্তি? অফিস যাবার পথে বাসস্টপে বসে ছিলাম, রোজ যেমন থাকি। আর প্রথমেই এই কথা মনে হলো। এখন যদিও গরমকাল চলছে, আজ ঠান্ডা ছিল। সকালে আমার বিছানার পাশের জানালাটা খোলা ছিল আর ঠিক তার বাইরে ক্যাবেজ ট্রির মাথা দেখছিলাম। কেমন হালকা কুয়াশার গন্ধ ছিল, বেশ শীতের বাতাস ঢুকে পড়ছিল ঘরে। সাথে একটু একটু রোদ।
যদিও অলস লাগছিল, তবুও উঠলাম। বিড়ালকে খুঁজলাম চারপাশে, সে অনেক আগেই ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। মনে হয় সজারুর গর্তের কাছে। সেই গর্তে যে তার কি আকর্ষণ কে জানে! ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে।
বাসস্টপে বেশীদূর হেঁটে আসতে হয়না। এক মিনিট লাগে বাসা থেকে। আমার বাড়ীটা কয়েকটা বাড়ীর পেছনে একটাই ব্লকে। অনেক পাখি ডাকছিল আর ডেক এর উপরে সূর্যের আলো। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল বসে বসে চা খেতে খেতে বই পড়ি, অথবা কিছুই না করি, বসে থাকি শুধু। আরো বসে থাকলে হয়তো কিছুক্ষণ পর ওই হাঁস পরিবারটা - একটা মা হাঁস আর পেছন পেছন পাঁচটা পিচ্চি হাঁস চলে এসেছে বাগানে। একটা পাম ট্রি আছে আমার বাগানটায়, হাঁসেরা মাঝেমাঝেই সেখানে বসে ঝিমায়। আমার বিড়ালটা বেশ ভদ্র ব্যবহারই করে তাদের সাথে। মানে সাধারণত তো পাখি দেখলেই খেয়ে ফেলার মতলবে থাকে, হাস গুলাকে কোনই পাত্তা দেয়না। হাঁসেরা গাছের তলায় আর সে ডেকের উপরে শান্তিময় সহাবস্থান। আমার আজ আফসোস হচ্ছিল যে এসব কিছুই দেখা হবে না!
রাস্তায় গাছের ছায়া আর রোদ মিলেমিশে বেশ চিকরিমিকরি ধরণের ছিল, দেখতে ভালো লাগে। ওই দেখতে দেখতেই পৌঁছালাম বাসস্টপে, প্রথমে একা ছিলাম, তারপরে শালিকটা। সেই ছোটবেলার থেকেই আমি একটা শালিক দেখলেই সারা দুনিয়া দুইনাম্বার শালিক খুঁজতে থাকি। সেই one for sorrow, two for joy মনে পড়ে যে! কিন্তু মনে হলো এই শালিকটাকে আমি গতকালও দেখেছি, তার আগেও। একটু গুন্ডা টাইপ পাখি। রাস্তায় লাফায়ে বেড়াচ্ছে। অন্য শালিকের চেয়ে লম্বা লাগছে দেখতে। গাড়ি টাড়ি তেমন একটা পাত্তা দিতেছে না। এর কি সঙ্গী সাথী নাই নাকি? মনে হয় শালিক রাজ্যের কবি, অথবা দার্শনিক, বা পাগল। অথবা তার সঙ্গী হয়তো অলস খুব, আরামে ঘুম দিতেছে আর এই ব্যাটাকে পাঠাইছে কাজকর্ম সামলাতে। হতেই তো পারে।
পাশে সেই আজব মহিলা এসে বসলো। ইনি থাকেন বাসস্টপের ঠিক সামনের বাসায়। বাসাটা মহা জংলা (ছিল, এখন নাই, তবে সেই বিষয়ে পরে আসছি) । এর সাথে প্রথম কথা বলার ঘটনা অদ্ভুত। সেইদিন আমি অন্য একটা বাসস্টপে অপেক্ষা করছিলাম বাসায় ফেরার সময়। মানে সাধারণত সেখানে আমার যেতে হয়না, সেইদিন বাস বদল করতে হচ্ছিল। কয়েক বছর আগের ঘটনা এটা।
তো আমি বসে বসে Da Vinci Code পড়ছি, এমন সময় মহিলার আবির্ভাব। আমার মুখের উপর থেকে বই সরিয়ে দিয়ে বলে যে
- খবরদার! এই বই পড়বা না, একদম রাবিশ!
আমি বললাম - কেন, কি সমস্যা?
- অনেক ভুল ভাল লিখছে বইয়ে, এগুলি কিছুই সত্যি না ।
- সত্যি তা তো দাবি করে নাই, এটা তো গল্প!
- যাই হোক, তুমি পড়বা না এই বই!
আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম দেখি । কোথাকার কে, আমাকে এসে বই পড়তে মানা করতেসে!
- ঠিক আছে আপাতত পড়বো না, কিন্তু আপনি তাহলে আমাকে এখন বইয়ের চেয়েও ইন্টারেস্টিং কিছু শোনান!
সে তারপরে বিড়বিড় করে কি বলছিল আমার কিছু মনে নাই। তার কারণ হলো অর্ধেক কথাই বুঝি নাই। এত আস্তে কথা বলে যে ধরে ঝাঁকি দিতে ইচ্ছা হয়! তারপরেও হাসিমুখে তার দিকে তাকায়ে ছিলাম অনেকক্ষণ! তো এই হলো পরিচয় কাহিনী।
তারপরে বাসস্টপে প্রায়ই দেখা হতো, হয়।
একদিন ভোর পাঁচটার সময় আমি যাচ্ছিলাম। দেখি মহিলাও আছে। সামনেই তার বাড়ি (যদিও তখনও জানতাম না এই বাড়িই তার। ) আমি বাড়িটার দিকে অনেকক্ষন চেয়ে দেখছিলাম।
বাড়ির সামনে সাধারণ বেড়ার বদলে একটা বাঁশঝাড়। ঝাড় বললে অবশ্য বাগান বাগান একটা ভাব আসে মনে, ওইরকম কিছু না, একদমই জঙ্গল। আর তার ফাঁকে ফাঁকে ভিতরের ঘাস দেখা যাচ্ছে, বিশাল গাছ সাইজের ঘাস। আল্লাহ জানে কতদিন কাটা হয় নাই। বাড়িতে টিনের চাল, রং চটা আর ঘরের কাঠের রং ও জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। কেমন একটা পোড়ো বাড়ির মত ভাব। আমি কখনোই ওই বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখি নাই। জানলাগুলিও একদম ছোট ছোট। চারপাশের অন্ধকার মনে হচ্ছিল বাড়িটার সামনে এসে আরো গাঢ় হয়েছে। আমি হঠাৎ নিজের মনেই বললাম -
- কে জানে ওখানে কেউ থাকে কিনা!
মহিলা বললো, কি বলো? আমি থাকি ওইখানে!
আমার দিকে একটা রাগ রাগ, অবাক অবাক চোখে তাকালো।
আল্লাহর দরবারে হাজার শুকরিয়া যে এরচেয়ে বেশী কিছু বলি নাই। একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলাম যে ওই বাড়িতে ভূত থাকা বিচিত্র কিছু না। তারপরে সেই বাড়ি, বাড়ির বাঁশ, ঘাস, এই সবকিছুর অনেক প্রশংসা করলো । তার বাগানে কত রকমের পাখি আসে সব ফিরিস্তি দিল, আমি শুনলাম।
আর আজকে আবার দেখা হলো। লক্ষ্য করলাম আর বাঁশের জঙ্গল নাই। জানতে চাইলে যা বললো সে এক বিরাট রোমহর্ষক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। আজকের লেখাটা এমনিই বড় হয়ে গেল। বাকিটুকু কাল বলবো!