আগের পর্ব:
পর্ব ১, ২(Click This Link)..পর্ব ৩, ৪ (Click This Link)..পর্ব ৫, ৬(Click This Link)..পর্ব ৭(Click This Link)..পর্ব ৮, ৯ (Click This Link)
১০
হাসনাইনের তড়িঘড়ি করা আচরণের আকস্মিকতায় কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া রাজু, তাও সবসময়ের মতো হাসনাইনের পিছু পিছুই তাকে কাউন্টারের দিকে যেতে হয়, এ এমনই এক অনুসরন যেন এটাই তার চিরন্তন নিয়তি। হিলপরা মেয়েটিও এইমাত্র সেদিকেই গেছে বলে মুহূর্তের জন্য হলেও রাজুর মনে শংকা জাগে, 'হাসনাইন ভাই কি শেষমেষ এই উর্বশীর মাঝে খুনীকে খুঁজে পেলেন!', এবং সঙ্গত কারণেই সে মুহূর্তটুকু সে কিছুটা বিব্রতবোধও করে।
তবে রাজুর অনুমান যে ভুল তা বলাই বাহুল্য! কাউন্টারে গিয়ে কোন ভূমিকা ছাড়াই চ্যাংড়া ছেলেটি, কামালকে হাসনাইন প্রায় নির্দেশের কন্ঠে বলতে থাকে, "তোমার ক্যাফের ম্যানেজারকে ডাকো।"
"স্যার, উনিতো আজ ছুটিতে।" হাসনাইনের উদ্ধত নির্দেশে স্বতঃস্ফূর্ত গোয়ার্তুমি ভর করে ছেলেটির ওপর, কারণ দেখা যায় যে ছেলেটি একথা বলতে না বলতেই ভেতরের অফিসমতোন একটি কামরা থেকে একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে ছেলেটির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তারপর হাসনাইনের দিকে মনোযোগ দেন, বলেন, "বলুন স্যার, কি করতে পারি আপনাদের জন্য। আমিই রেইনবোর ম্যানেজার।"
হসনাইন আর রাজু দু'জনই বিস্ময় আর ক্ষোভমেশানো চোখে তাকায় কামালের দিকে, কামালের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে, তবে সেটা যতটা না এই ভদ্রলোকদ্বয়ের কারণে তার চেয়েও অনেক বেশী পাশেই দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখা ঊর্বশীটির রিনরিনে কন্ঠে 'হি হি হি হি'লয়টুকু বেজে ওঠার কারণে।
"আমি ডিটেকটিভ হাসনাইন, আর উনি আমার কলিগ রাজু" হাসনাইন তার আইডি মেলে ধরে ম্যানেজারের সামনে।
মুহূর্তেই কামালের লজ্জা আতংকে রূপ নেয়, তার মুখ প্রায় ছাইভস্ম হয়ে যায়, রোবটের মতো পেছনে সরে যেতে যেতে হঠাৎকোথায় যেন লাপাত্তা হয়ে পড়ে সে। একই সাথে দেখা যায় পাশে দাঁড়ানো উর্বশীও খানিকটা আলোড়িত হয়ে ওঠেন, কি যেন একটা খোঁজার ভান করে ধীরে ধীরে একপাশে সরে গিয়ে তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজের টেবিলের দিকে "দে ছুট" অবস্থা। দু'দিকে দু'জন মানুষের দুটো সম্পূর্ণ ভিন্নস্বাদের 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'টাইপের কান্ডকারখানা দেখে রাজুর হাসি পায়, তার ইচ্ছে করে হাসনাইনকে বলে, "দেখলেন হাসনাইন ভাই, পুলিশের লগে টাংকি মারতে গিয়া কেমন ডরটা খাইলো, হা হা হা"।
কিন্তু ম্যানেজার আর হাসনাইন -- দুজনেরই সিরিয়াস ভাবের চেহারার সামনে কিছু বলার সাহস বা উৎসাহ হয়না তার।
বেশ আপ্যায়নের ভঙ্গিতেই দুই ডিটেকটিভকে ডেকে নিয়ে ভেতরের অফিসে বসান রেইনবোর ম্যানেজার জনাব খায়রুল বাশার। খানিকটা ভীত কন্ঠেই বলেন, "স্যার কোন অভিযোগ?"
"না না, ভয় পাবেননা। আমরা শুধু আপনার ক্যাফের ক্যাশিং সিস্টেম সম্পর্কে জানার জন্য এসেছি।" হাসনাইন উদার গলায় বলার চেষ্টা করে যাতে ভদ্রলোক কিছুই না লুকায়।
"স্যার, আমরা ভ্যাট ফাঁকি দিইনা, একেবারে হালাল বিজনেস স্যার। প্রত্যেক অর্ডারের জন্য আলাদা রিসিপ্ট দিই আমরা, এমনকি স্যার একই লোক দু'বার জিনিস কিনলে দুটা রিসিপ্ট, দশবার কিনলে দশটা।" খায়রুল বাশারের গলার কাতরতা বৃদ্ধি পায়।
"আহা! আপনি আগেই এত ভয় পাচ্ছেন কেন?" রাজুর বিরক্ত উচ্চারনে খানিকটা সাহস পাবেন নাকি আরো দমে যাবেন বুঝে উঠতে পারেননা খায়রুল বাশার।
হাসনাইন স্মিত চেহারায় বলে,"মিঃ ম্যানেজার, আমরা শুধুই কিছু তথ্য জানতে চাই, এবং নিশ্চিত করছই যে এই তথ্যের জন্য আপনাকে কোনভাবেই কোনরকম আইনি সমস্যায় পড়তে হবেনা। বড়জোর একটা সাক্ষ্য দিতে হতে পারে, অথবা একটা স্টেটমেন্ট। আমি যা জানতে চাচ্ছি, বলি, আপনার ক্যাফের বেচাকেনার হিসেবটা যেমন রিসিপ্টের মাধ্যমে ক্রেতাকে দেয়া হয়, তাইনা?'
'অবশ্যই স্যার, অবশ্যই স্যার। যে কোন বেচাকেনাই হোক রিসিপ্ট দেয়া হবেই!'
খায়রুল বাশারের ওকালতিতে আগ;রহ পায়না হাসনাইন, তার কথার মধ্যেই একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ''তেমনি একটা রেকর্ড তো আপনার কম্পিউটারেও থাকে, তাইনা?'
"জি স্যার, অবশ্যই স্যার। কম্পিউটারে প্রত্যেকটা বেচাকেনার লগ রেকর্ড করা আছে আমাদের নিজেদের ডাটাবেজে।"
"সেই রেকর্ডটা আপনারা কতদিন ধরে রাখেন? মানে গতবছরের হিসেব চাইলেও কি পাওয়া যাবে?"
একটু ভাবেন খায়রুল বাশার, তারপর বলেন, "অবশ্যই যাবে স্যার। অরিয়ন ক্লাবের মেইন সার্ভারে সম্ভবতঃ তিনবছরের রেকর্ড ব্যাক-আপ রাখা হয়।"
"গ্রেট! তিন বছর আমার দরকার নেই, আমার দরকার গত তিনমাসের। আরো খুলে বললে, দু'মাস বিশদিন আগের মানে এপ্রিল ১১'র সন্ধ্যাছ'টা থেকে ন'টা পর্যন্ত সময়টুকুতে রেইনবো ক্যাফে অরিয়নের বেচাকেনার রেকর্ড।" পকেট থেকে মোজাম্মেলের এ্যালিবাইর রিসিপ্টটা বের করতে করে দেখতে দেখতে বলে হাসনাইন।
খায়রুল বাশার আশ্বস্ত হয়, এবার তাঁর সাহস করে বুকভরে দম নিয়ে কথা বলার পালা, তিনি বলেন, "কোন সমস্যাই হবেনা স্যার, আপনি শুধু বলেন কবে লাগবে। আমি পাঠিয়ে দেব। আমার স্যার এক নম্বর ব্যবসা, আমার কোনকিছু লুকোনো লাগেনা!"
"হ্যাঁ, সেটা আমি অস্বীকার করছিনা" হাসতে হাসতে বলে হাসনাইন, "আপনি কি আজই দিতে পারবেন?"
আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের চেয়েও দ্রুত গতিতে মুহূর্তেই চট করে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কোথায় যেন ফোন করেন খায়রুল বাশার, ওপাশে ফোনধরা লোকটি কিছু বলার সুযোগ পাবার আগেই বলতে থাকেন, "সাকিব, এক্ষুণি চলে আসো অফিসে, বিশেষ জরূরী প্রয়োজন। দেরী করা চলবেনা ... না না ... চিন্তা করোনা, একেবারে ঘন্টা মিনিট মেপে ওভারটাইম দেয়া হবে। কিছু ভীষণ জরূরী কাজ করা লাগবে।" তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, 'আরে মিয়া, পুলিশ আসছে!'। যদিও ফিসফিসানিটুকু বুঝতে হাসনাইন বা রাজুর কোন অসুবিধাই হয়না।
ফোন কেটে দিয়ে দুই ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসেন খায়রুল বাশার, বলেন, "আমাদের কোম্পানীর আইটি অফিসার। খুব ভালো ছেলে স্যার, নাম সাকিবুজ্জামান, কাজেকর্মে একদম এক্সপার্ট, গুরু যাকে বলে। আর আমরা স্যার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এসবও ঠিকমতো দেইতো, কেউ কখনও কোন সমস্যা বা অবহেলা করে না কাজে। দেখছেননা বলার সাথে সাথেই রওয়ানা দিয়ে দিলো!"
হাসনাইন আর রাজুর মুখ থেকে মৃদুহাসিটুকু আর সরেনা। একই সময়ে তারা দুজনেই মনে মনে ভাবে, বিএসটিআইর ইন্সপেক্টর হতে পারাটা কত ভাগ্যের! সারাদিন জমিদারের খাতির। এরমধ্যেই চা নাস্তা সহ ম্যানেজারের ঘরে এসে হাজির হয় কামাল, ক্যাশকাউন্টারের ছোকড়াটি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাতের ট্রে প্রায় ফেলে দেবার জোগাড় তার, কোনভাবে হাসনাইনদের সামনের টেবিলে রেখে ট্রে-টুকু রেখে যেন উর্ধশ্বাসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। খায়রুল বাশার বলেন,"নতুন নিয়োগ দিয়েছি তো স্যার, একটু বেয়াদব আছে ছেলেটা, কিছু মনে করবেননা স্যার। ভেবেছিলো পুলিশ ম্যানেজারকে খুঁজতে এসেছে, কি না কি বিপদ, তাই বেশী বুদ্ধিমানের মতো বলে বসেছে ম্যানেজার নেই। আজকালকার ছেলেদের নিয়ে আর পারা গেলোনা!"
রাজুর একবার বলতে ইচ্ছা হয়, "তখনও সে কিন্তু জানতোনা আমরা পুলিশ না বাসকন্ডাকটর।" কিন্তু আর কথা বাড়ায়না সে, ভাবে আবার কত লম্বা কি কৈফিয়ত দেয়া শুরু করে এই খায়রুল বাশার, কে জানে।
রাত ন'টা পঁচিশের দিকে ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয় হাসনাইন আর রাজু। মুখে দুজনেরই বিজয়ের হাসি, সে হাসি আর কিছুতেই সরেনা করো মুখ থেকে। মোটামুটি পুরো কেইসটি গুছিয়ে এনেছে তারা, কাজ আর অল্প কিছুই বাকী, সব মিলে গেলে তারপরই ধরা পড়ে যাবে মোজাম্মেল। সবার আগে যা করতে হবে তা হলো মোজাম্মেলের বাড়ীতে তল্লাশীর ওয়ারেন্ট ইস্যু। রিক্সায় বসে আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা গোয়েন্দা হাসনাইনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে আকাশের তারা গোণার মতো অসাধ্য কাজটি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তারদিকে তাকিয়ে মনে মনে রাজু বলে, "গুরু, ঠিকই বলেছিলেন, ওয়াই ম্যাক্স, সবই ওয়াই ম্যাক্সের খেলা!"
তারপর মুখ খোলে সে, জিজ্ঞেস করে, 'হাসনাইন ভাই, ঐ সুন্দরীকে পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখার সাথে সাথেই আপনি যেভাবে ইউরেকা বলে উঠলেন, আমার তো মনে হয়েছিলো সুন্দরীর মধ্যেই ক্লু পেয়েছেন!'
'অবশ্যই, ঐ সুন্দরী আজ কোমর বাঁকিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের কি উপকার করেছে তুমি জানো!'
'মানে, ঠিক কিভাবে?'
'আগে চিন্তা করো, সুন্দরীকে ওভাবে হাঁটতে হয়েছিলো কেন?'
'ঢং করে হাঁটছিলো তো বটেই, তবে ঐ একফুটি হিল পরলে যে কেউই একবার সামনে একবার পেছনে ঝুঁকে হাঁটতে বাধ্য হবে।'
'ঠিক! হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক!' হাসনাইনের মধ্যে লেকচারার লেকচারার ভাব চলে এলো,'মনে করে দেখো, সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজের লোকটাকে আমরা মোজাম্মেলের সাথে মেলাতে পারছিলামনা মূলতঃ উচ্চতার কারণে। আর তুমি নিজেই বলেছ রেডড্রাগনের সেই খুনী তোজাম্মেলের মতো দৃঢ় ঋজুভঙ্গিতে না হেঁটে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছিলো।'
'মানে বলতে চান খুনী হিল পরে হাঁটছিলো?' উত্তেজিত শোনায় রাজুর কন্ঠ।
'সেটাই!' ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে থাকে হাসনাইন, 'তখনই বুঝলাম খুনটা আসলে মোজাম্মেলই করেছে, নতুন কোন হিটম্যানকে আর সে জড়ায়নি এই কেইসে। কিন্তু তখনই তো সমস্যাটা হয় তার এ্যালিবাই, রাইট? এ্যালিবাই নিয়ে আমি আগেই ভেবে নিয়েছিলাম যে এমন কিছু হয়েছে, রেইনবো ক্যাফের ডেটাবেস হ্যাক করতে পারলে কিছুক্ষণের জন্য সার্ভারের সময় পিছিয়ে দিয়ে, কফির অর্ডার শেষ করে, আবার সার্ভারের সময় ঠিক করে দিলে, এ্যালিবাই হিসেবে দাঁড় করানো যায় এমন রিসিপ্ট হাত করা সম্ভব।'
'তারমানে, খুনের সময় মোজাম্মেল রেডড্রাগনেই ছিলো, এবং সোয়া আটটার দিকে সে রেড ড্রাগন ছেড়ে অরিয়ন ক্লাবে আসে, আসার পথে রেইনবোর সার্ভার হ্যাক করে সময় করে দেয় সাতটা পঞ্চাশ, তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে কফি কিনে সাতটা পঞ্চান্ন'র রিসিপ্ট হাতিয়ে নেয়, রাইট?'
'ঠিক, তারপর সে আবার সার্ভারের টাইম ঠিক করে দেয় যাতে পরে কেউ সমস্যাটা খেয়াল না করে। এজন্যই দেখলেনা, রেইনবোর লগের রেকর্ডে দেখা গেল সেদিন রাত আটটা সতেরোতে একজন কফি কিনেছে, তারপর সাতটা পঞ্চান্নতে মোজাম্মেল কফি কিনছে, তারপর আবার আটটা ঊনত্রিশে একজন কি যেন কিনেছে। মানে মাঝখানের সময়টা মোজাম্মেল হ্যাক করে গড়বড় করেছে।'
'এখন তাহলে মোজাম্মেলের বাসা রেইড করে দেখতে হবে বুটের ভেতরে পরে হিল বানানো যায় এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা।' রাজু নিজেই নিজেকে বলে।
'হ্যাঁ শুধু বাসা না, মোজাম্মেলের ডেরা আর কোথায় কোথায় থাকতে পারে, সে লিস্টটাও করে ফেলতে হবে', হাসনাইন যোগ করে 'আমার ধারনা সিসিটিভি ফুটেজের ওভারকোট, হ্যাট আর বুট -- সবই পাওয়া যাবে। আমাদের এখন যেটা করতে হবে, তা হলো কাউকে জানতে দেয়া যাবেনা যে মোজাম্মেলকে আমরা গুছিয়ে এনেছি। শুধু শাহাদাৎ স্যারকে বলে একটা ওয়ারেন্ট ইস্যু করাতে হবে।'
'শালার ওয়াই ম্যাক্স! রেস্টুরেন্টে বসে বসে ডেটাবেস হ্যাক করে ফেলে! সাহস কত!' গত দু'মাসে জমে থাকা সব রাগ যেন ঝরে পড়ে রাজুর কন্ঠে।
'দাঁড়াওনা, ওয়াই ম্যাক্সের খেলা তো এখনও শেষ হয়নি!' মিটিমিটি হাসে হাসনাইন।
'তাইতো!' রাজুও যোগ দেয় সেই হাসিতে,'জামশেদ ভাইকে কি এখন পাওয়া যাবে?'
'দেখা যাক! জনাব তো আবার তীব্র মোবাইল ফোনবিরোধী! ল্যাবে যাবার আগ পর্যন্ত তো কিছু বোঝার উপায় নেই।'
'হাসনাইন ভাই, আপনি উত্তেজিত। কেন ভুলে যাচ্ছেন যে জামশেদ ভাইয়ের ওখানে যাবার আগে আমাদের যেতে হবে তোজাম্মেলের আস্তানায়।' হাসতে হাসতে বলে রাজু।
হাসনাইনও হাসিতে যোগ দেয়।
পুলিশের সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন ল্যাবের তিনতলায় একমনে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন জামশেদ, কিছু ইমপোস্টর বা জাল বায়োমেট্রিক ডেটা ইন্টারপোলের ডেটাবেস থেকে রিলিজ করা হয়েছে রিসেন্টলি; এসব ডেটাকে কিভাবে জাল হিসেবে প্রমাণ করা যায়, মানে সত্যি সত্যি লিভিং অবজেক্ট বা জীবিত মানুষের ডেটা থেকে আলাদা করা যায় সে নিয়ে এখন কাজ করছে সে। নানান প্রিপ্রসেসিং এ্যালগরিদম প্রয়োগ করে দেখছে, সামান্যতম সন্তুষ্টিজনক ফলাফলও আসছেনা গত দু'সপ্তা ধরে নিরলস কাজ করার পরও। এই মুহূর্তে তিনি শুধু শুধুই মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন, নতুন কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখার কথা আর ভাবতেও ইচ্ছে করছেনা তাঁর।
এমন সময়েই পেছন থেকে হন্তদন্ত পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো, এই আওয়াজ শুধু তার প্রফেসর ড. আবু নাজিমেরই হতে পারে ভাবেন তিনি, তবে শুক্রবার রাতে দুনিয়ার কোন শক্তিই যে আবু নাজিমকে এখানে আনতে পারবেনা তাও জানেন জামশেদ। তাহলে কে আসলো? নিতান্ত অনিচ্ছায় পেছন ফিরে তাকান তিনি। জামশেদ বোঝেন যে তাঁর অনুমান ঠিক, হন্তদন্ত পায়ে নাজিম স্যার আসছেননা। আসছে হাসনাইন আর তার চ্যালাটা, কি যেন নাম, মনে আসছেনা এই মুহূর্তে। শুধু তাই নয়, তৃতীয় আরো একজনকে দেখা যাচ্ছে এদের সাথে। 'আবার কোন অনুরোধে কত বড় ঢেঁকি গিলতে হয় কে জানে!' ভেবে খানিকটা বিরক্ত হন জামশেদ। এর আগে শুধু হাসনাইনের নাছোড়বান্দা অনুরোধের কারণে দুজন বড় বড় বিজনেস ম্যাগনেটে জনাব বক্স আর খন্দকারের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডেটা তিনি "মিসেস খন্দকার এন্ড বক্স" কেইসের খুনীর ডেটার সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। এ খবর উপর মহলে গেলে পারসোনাল ইনফরমেশন মিসহ্যান্ডলিংয়ের দায়ে তাঁর চাকরীও চলে যেতে পারতো, যদিও এসব ধরতে পারার মতো অভিজ্ঞ হতে উপরের মহলের লোকদের আরো দশবার জন্মাতে হবে বলে তার ধারনা, যেকারণে ব্যাপারটা নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি থাকলেও সেটা যতটা না শাস্তির ভয়ে তার চেয়ে অনেক বেশী নৈতিকতার দায়ে।
যাই হোক, হাসনাইন আর রাজুর আবারও এই আচমকা উপস্থিতিকে খুব ভালোভাবে গ্রহন করতে না পারলেও, মুখে একটি ভদ্রতার হাসি ঝুলিয়ে তাদেরকে বসার জায়গা করে দিতে হলো তাঁর। হাসনাইন মরিয়া ভাব করে বললো, 'জামশেদ ভাই, এবার অসম্ভব কোন অনুরোধ নিয়ে আসিনি, আপনি শুধু ঐ কেইসের খুনীর হাতের আঙুলের ছাপের সাথে এই ভদ্রলোকের হাতের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখবেন।'
'আরে! ইনিই কি সেই তোজাম্মেল না? যার সাথে আগে বারবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডেটা ময়াচ করেছিলো?' আশ্চর্য চেহারায় বলে যান জামশেদ।
'জ্বি বড়ভাই, ইনিই সেই ব্যক্তি। তবে এতদিন তো আমরা ম্যাচ করে এসেছি পুলিশের ডেটাবেসে তাঁর নামে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেকর্ড করা আছে সেটার সাথে, আজকে একদম ভদ্রলোকের আঙুলের থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে আবার ম্যাচ করবো।'
'কেন হাসনাইন? একই পরীক্ষা কয়বার করতে হবে তোমার?'
'এটা একই পরীক্ষা না, জামশেদ ভাই! চিন্তা করুন, যদি খুনী পুলিশের ডেটাবেস হ্যাক করতে পারে, তাহলে কিন্তু সে ডেটাবেস থেকে অদলবদল করে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো অন্য কারো নামে রেকর্ড করে ফেলতে পারে।'
'তা ঠিক, তা ঠিক।'
হাসনাইনের অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করেই দেখা যায় যে খুনীর হাতের আঙুলের ছাপের সাথে তোজাম্মেলের আসল আঙুলের ছাপ কোনভাবেই মেলেনা। তারমানে, তোজাম্মেলের নামে এতদিন যে আঙুলের ছাপগুলো পুলিশের ডেটাবেসে রেকর্ড করা ছিলো সেগুলোর কোনটিই তোজাম্মেলের আসল আঙুলের ছাপ না, সেগুলো সব আসলে মিসেস বক্স আর মিসেস খন্দকারের খুনীর আঙুলের ছাপ। কয়েকটি মাত্র ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের ফলাফল দেখে মুহূর্তেই হাসনাইন, রাজু , জামশেদ আর তোজাম্মেলের -- চারজনের কাছেই পুরো রহস্যটি পানির মতো পরিস্কার হয়ে যায়।
যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং শুরু থেকেই পুরো মামলাকে ঘোলাটে করে রেখেছিলো, সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংই আবার মামলাটিকে টলটলে পরিস্কার করে দিলো। এখন শুধু মোজাম্মেলকে ধরে এনে তার হাতের আঙুল থেকে আরকবার সরাসরি ছাপ নিয়ে খুনীর ছাপের সাথে মিলিয়ে দেখলেই হবে -- এবং হাসনাইন নিশ্চিত যে সেটা মিলে যাবে।
হাসনাইনের দলের সাথে সাথে কেন যেন জামশেদেরও খুব ভালো লাগা শুরু করে, অমন নামকরা একটা রহস্যের এত সহজ একটা সমাধান তাঁর কম্পিউটারেই হলো! তীব্র আনন্দে তিনি বাকীদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'এখানকার একতলায় টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ক্যাফেতে অমৃতের মতো চা বানায়, চলো খেয়ে আসি।'
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ:
১
'খুনী মোজাম্মেল পুলিশের ডেটাবেস হ্যাক করে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো তোজাম্মেলের নামে রেকর্ড করে রেখেছিলো' নিজের এই চমৎকার সঠিক অনুমান থেকে হাসনাইন অনুমান করে যে তাহলে নিশ্চয়ই একই সময়ে তোজাম্মেলের আসল ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলোকে মোজাম্মেল তার নিজের নামে রেকর্ড করে রেখেছে। হাসনাইনের সে হিসেব মিললে দেখা যেত যে একটু আগে নতুন করে নেয়া তোজাম্মেলের আসল আঙুলের ছাপের সাথে পুলিশের ডেটাবেসে সাসপেক্ট মোজাম্মেলের নামে রেকর্ড করা আঙুলের ছাপগুলো মিলে গেছে। সেক্ষেত্রে সাসপেক্ট মোজাম্মেলকে আবার ধরে না এনেও বলে দেয়া যেত যে সেই তোজাম্মেলের সাথে নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো অদলবদল করে রেখেছে।
তবে হাসনাইনের এই অনুমানটি ভুল হয়। যতটা কাঁচা সে মোজাম্মেলকে ভেবেছিলো ততটাই ধুরন্ধর সে। অর্থাৎ, পুলিশের ডেটাবেস হ্যাক করে সে শুধু তোজাম্মেল আর নিজের আঙুলের ছাপেরই করেসপন্ডেন্স বদল করেনি, সে এখানে আরো অনেক মজার একটি খেলা খেলেছে। তোজাম্মেলের নামে সে নিজের আঙুলের ছাপ রেকর্ড করে রেখেছে ঠিকই, তবে উল্টোপথে নিজের নামে তোজাম্মেলের আঙুলের ছাপ রেকর্ড করে রাখেনি। তোজাম্মেলের আসল আঙুলের ছাপ সে রেকর্ড করে রেখেছে নুরুন্নবী নামে এক ব্যক্তির ডেটা হিসেবে। পরদিন সকাল ছ'টার সময় নুরুন্নবীকে কিছু বুঝতে না দিয়েই নিয়ে আসা হয় থানায়, সাতটার সময় যখন নুরুন্নবী ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরছিলো তখন সে এটাও জেনে যায় যে তার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো ন্যাশনাল বায়োমেট্রিক ডেটাবেসে গত কয়েকমাস ধরে রেকর্ড করা ছিলো ছ'মাস আগে মারা যাওয়া জনৈক ভদ্রলোক জনাব ওলিউজ্জামানের নামে। ওলিউজ্জামান সাহেবকে যেহেতু আর ধরে এনে হাতের আঙুলের ছাপ নেয়া সম্ভব হয়না, তাই মোজাম্মেলের সৃষ্ট এই জালিয়াতির লাইন আর ট্রেস করা সম্ভব হয়না জামশেদের পক্ষে। কারণ, ওলিউজ্জামান সাহেবের আসল হাতের ছাপ পাওয়া না গেলে বলা যাবেনা যে তাঁর আসল আঙুলের ছাপ এখন কোন ব্যক্তির নামে রেকর্ড করা আছে, এবং সেই ব্যাক্তিকে ট্রেস না করা গেলে এই অদলবদল কতদূর পর্যন্ত ঘটেছে সেটাও বের করা সম্ভব হবেনা।
জামশেদ ধারনা করেন যে, মোজাম্মেল শুধু প্রথম ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ডেটার অদলবদলটা ম্যানুয়ালি করে, যাতে তার নিজের ছাপগুলো ঠিকঠাকমতো তোজাম্মেলের নামে রেকর্ড হয়; বাকী অদলবদলগুলো হ্যাকার মোজাম্মেল করেছে দৈবচয়নে। হতে পারে সে শ'খানেক ডেটা ওলটপালট করেছে, আবার হতে পারে হাজার। এমনকি সব ডেটারও ওলটপালট হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। পরবর্তীতে পরিসংখ্যানিক জরিপ করে দেখা যায় যে প্রায় লাখ দশেক ডেটা সে ওলটপালট করে রেখেছিলো। তারমানে, মোজাম্মেলকে যদি কোনভাবে কেউ সন্দেহের তালিকায় না রাখতো, তাহলে ডেটাবেস কেলেংকারী ধরা পড়লেও সব ওলটপালট ট্রেস করে মূল অপরাধীকে ধরা সম্ভব হতোনা -- এতটাই পরিকল্পিত ছিলো মোজাম্মেলের খুনটি।
'ভাগ্যিস, সেদিন হোটেলে মোজাম্মেল ছিলো! খন্দকারের সেক্রেটারী জিনাতকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হবে।' সব রিপোর্ট পেয়ে মনে মনে ভেবেছিলো হাসনাইন। মামলার রায়ে মোজাম্মেলের কপালে শুধু ডাবল মার্ডারের কারণে না, এরই সাথে নিরপরাধ লিককে ফাঁসানোর অপচেষ্টা আর কয়েকশো কোটি টাকা খরচে তৈরী রাষ্ট্রীয় তথ্যভান্ডার নষ্ট করার শাস্তিও জুটে যায় -- সব মিলিয়ে তিনটি ফাঁসির আদেশের সাথে সাথে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশও দেয় আদালত। নিদেনপক্ষে ওয়ালীবক্স আর নাজমুল খন্দকারের দেয়া বিশ বিশ মোট চল্লিশলাখ টাকা সরকারী কোষাগারে জমা হয়।
২
মোজাম্মেলের বাসা আর অফিস সার্চ করে কিছু পাওয়া না গেলেও, তার গাড়ীর ট্রাংকে বুটের ভেতরে হিলের মতো করে পরার জন্য কাঠের তৈরী বিশেষ বস্তুটি পাওয়া গেলো। যদিও কোথাও ফেলে দেবার প্রস্তুতিতেই গাড়ীর ট্রাংকে রেখেছিলো, তবে মামলার মোড় অভাবনীয় দিকে ঘুরে যাওয়ায় ফেলি ফেলি করেও আর ফেলা হয়নি!
৩
ঘটনার কিছুদিন পরে একদিন অফিস ক্যান্টিনে গলা ছেড়ে দিয়ে পুলিশের আইটি সিকিউরিটির কাজল ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে রাজু বলে, 'বেশী বেশী ডিএনএ ব্যাংক আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডেটাবেস তৈরী করার আগে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের যেটা করা লাগবে সেটা হলো ওয়াইম্যাক্স দিয়ে কেউ যেন যখন তখন সেই ব্যাংক বা ডেটাবেসে না ঢুকে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করা।' জুনিয়রদের সাথে এ নিয়ে হাসতে হাসতে রাজু প্রত্যক্ষ করে ডাইনিংয়ের এক কোণায় করজোড়ে হাসনাইনের হাত ধরে রেখে কৃতজ্ঞতায় গদগদ চেহারায় কি যেন বলছে বদমেজাজী স্পেশাল ফোর্স অফিসার আজগর হোসেন; 'চামে চামে তিনটা মাস খাইস্টা লোকটা ছুটি কাটাইয়া নিলো!' ঊষ্মার সাথে বলতে বলতে আবার আসর মাতিয়ে তোলে রাজু।
৪
মোজাম্মেলের সাথে চাঁদাবাজী বিষয়ক মিথ্যে গল্প ফাঁদার কারণে ধরা পড়ে যান নাজমুল খন্দকার, স্ত্রী হত্যার ইন্ধন যে তিনি জুগিয়েছেন সেটা পরবর্তীতে প্রমাণ হয়ে যায় তাঁর নিজের দেয়া অসংলগ্ন জবানবন্দীতেই, সব স্বীকার করে নেন তিনি; তাঁর পঁচিশ বছরের জেল আর দশ কোটি টাকা জরিমানা (অনাদায়ে আরো ত্রিশ বছরের জেল) হয়। তবে ওয়ালী বক্সকে কোনভাবেই দোষী প্রমাণ করা যায়নি। হাজার জেরা, নির্যাতন, অত্যাচার আর শাস্তি কমানোর লোভের মুখেও সেই কেইসের ইন্ধন নিয়ে সামান্যও মুখ খোলেনি মোজাম্মেল; বারবারই সে বলেছে যে, অবশ্যই সে হিটম্যান হিসেবে খুনটি করেছে, তবে কার নির্দেশে সে খুনটি করেছে তা সে কোনভাবেই বলতে পারবেনা। সে দাবী করে যে, এটা তার প্রফেশনাল এথিক্স, যতই শাস্তি বাড়ুক এখানে সে কম্প্রোমাইজ করবেনা। তবে এই সহযোগিতাটুকু না করার কারণে যে তার শাস্তির পরিমাণ বেড়েছে তাও নয়, তার আগের পাপগুলোই একজীবনে যথেষ্ট শাস্তি পাবার জন্য যথেষ্ট।
৫
তোজাম্মেলকে কেন ফাঁসাতে গেলো মোজাম্মেল -- এই রহস্যের কোন কুল কিনারা করতে পারেনি হাসনাইন বা অন্যেরা অনেকদিনই। এই ব্যাখ্যা সহসা জানাও যায়না, হাসনাইন তা জানতে পারবে আরো বছর দশেক পরে, যখন মৃত্যদন্ডের আগের সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করবে ডাবল মার্ডার আসামী মোজাম্মেল হক।
তবে দশ বছর অনেক লম্বা সময়, আপাততঃ সে মোজাম্মেলের সে গল্প তোলা থাকুক; তার আগে গোয়েন্দা হাসনাইনের আরো অনেক রহস্য সমাধানের গল্প আমরা শুনতে পারবো।
(সমাপ্ত)
সচলায়তন ব্লগে সুহান রিজওয়ানের লেখা গল্প 'ডিটেকটিভ'(http://www.sachalayatan.com/shu77han/26532)র প্লটটির উপর ভিত্তি করে লেখার একটা প্রচেষ্টা ।
বরাবরের মতো এ গল্পটিতেও নানান বিদেশী গল্পের ছায়া পাওয়া যাবে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিচ্ছি।