আগের পর্ব:
পর্ব ১, ২ (Click This Link)
পর্ব ৩, ৪ (Click This Link)
৫
৩৭, ওয়াজী লেনের জীর্ণ-শীর্ণ একটি তিন তলা বাড়ী, চার ইউনিটের ছোট ছোট খুপরীর মতো ঘর প্রত্যেক তলায়। বাইরের দেয়ালের যেটুকু অংশে শ্যাওলা বা জংলা পাতা জন্মায়নি, সেটুকু অংশের পুরো পলেস্তরা খসে গেছে, এমনও হতে পারে আসলে পুরো বাড়িটিরই পলেস্তরা খসে গেছে অথবা কখনও সেটা ছিলোইনা, তবে সেটা নিয়ে ভাববার বা চিন্তিত হবার অবকাশ হাসনাইন বা রাজুর এ মুহূর্তে নেই। এই বাড়ীরই তিনতলার দক্ষিণ-পূর্বকোণের ঘরটিতে থাকে গল্পের বর্তমান আসামী, তথাকথিত ডিটেকটিভ তোজাম্মেল। বাড়ীতে দারোয়ান নেই, বাড়ীর সামনেই লাল লাল ইটবিছানো ভাঙা রাস্তার একপাশে বসে গুল্লি খেলছে কতগুলো বাচ্চা, ন'দশের বেশী বয়েস হবেনা কোনটিরই।
আজ সকাল থেকে বারবার আসা পুলিশের লোকদের অবশ্য এই গলিতে ঢুকতেই কষ্ট হয়েছিলো খুব, মূলতঃ পাবলিকের ভীড়ের কারণে; "পুলিশ এসেছে" এই তথ্যটি এদের মাঝে আলোর বেগের চেয়েও বেশী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো বারবার, এবং হাসনাইনের কলিগদের ভাষ্যমতে তারচেয়েও বেশী বেগে যেন লোকজন সবাই দলবেঁধে এসে গলির মুখে হাজির হয়ে উপচে পড়ছিলো। এসব তথ্য হাতে নিয়েই ওয়াজী লেনের বাসাটির সামনে এসে দাঁড়ায় হাসনাইন আর রাজু, তবে জনগণের অপ্রয়োজনীয় মনোযোগের হাত থেকে তারা বেঁচে যায় শুধুমাত্র ডিবির লোক হবার কারণে; সিভিল ড্রেসের পুলিশে পাবলিকের তেমন রুচি নেই, বুঝতে পারে দু'জনই, তবে এনিয়ে তারা হতাশ না আনন্দিত সেটা বোঝা যায়না।
গুল্লি খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞেস করে জানা যায় যে এবাড়ীর মালিক এখানে থাকেনা বহুদিন, সবাই ভাড়াটিয়া। বাড়ীর চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, এদিক সেদিক, উপর নিচে তাকিয়ে হাসনাইনের এও মনে হলো যে বাড়ীটির সবগুলো ফ্ল্যাটে হয়তো মানুষ থাকেওনা; বেশ কয়েকটি ঘরের জানালায় পর্দা নেই, ভেতর থেকে ছাদ দেয়াল দেখা যায়, নোংরা যদিও। তাছাড়া আশপাশটা কেমন নীরব শুনশান, বাড়ীর চারপাশে গজিয়ে ওঠা জংলা পরিবেশের কোনরকম যত্ন নেয়া হয়নি অনেকদিন, বোঝা যায়। একতলার একটি ফ্ল্যাটের জানালায় দেখা যায় কালোপর্দার এপাশে বেশ কয়েকটি নানান ধরনের সাহেবী টুপি ঝোলানো, একপাশে একটি ছড়ি; কমেন ভুতুড়ে, রহস্যময় একটা আবহ।
তিনতলার দক্ষিণ-পূর্বকোণের তোজাম্মেলের ফ্ল্যাটের জানালায়ও পর্দা একটা ঝুলতে দেখা যায়, এবং একতলা থেকে দেখেও মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে যে কেনার পর আর কখনই ধোয়া হয়নি ওটাকে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁহাতের নখে মৃদু আঘাত করতে করতে হাসনাইন জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা রাজু, হোয়াট ওয়াজ সো রং?'
নড়েচড়ে ওঠে রাজু, বলে, 'স্যার, খুব ক্ষীণ একটা সন্দেহ, তাও মনে হচ্ছে তোজাম্মেল খুনী নাও হতে পারে। প্রথমত দেখুন, তোজাম্মেলের পেটে কোন আঘাত বা কোমরে কোন ব্যথা নেই যেটা ডাক্তার বললেন, আর দ্বিতীয়ত সে সবসময়ই একদম তালগাছের মতো সোজা হয়ে হাঁটে, হাজতে আজ আমি কয়েকবারই খুব খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করেছি।'
হঠাৎ সতর্ক হয়ে যাবার দৃষ্টি হাসনাইনের, রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে, 'বলতে চাচ্ছো যে, সিসিটিভিতে দেখা আসামী যেভাবে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছিলো তাতে অবশ্যই তার পেটের কাছে কোথাও আঘাত থাকার কথা?'
'জ্বি স্যার, হয় আঘাত বা কোন সমস্যা থাকবে, না হয় তার স্বাভাবিক হাঁটার ঢংটাই হবে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা। কিন্তু এর কোনটিই তোজাম্মেলের বেলায় মিলছেনা।'
'হুমম, তোমার পয়েন্টটা ফেলে দেবার মতো না। কিন্তু এমন কি হতে পারেনা যে রেডড্রাগনে তোজাম্মেল ইচ্ছে করেই ওভাবে হেঁটেছে।'
'স্যার, আমি সেখানে পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম, কালো চশমার আড়ালে খুব ভালো করেই হ্যাটপরা লোকটির হেঁটে যাওয়া লক্ষ্য করেছি, চোখে পড়ার মতো হাঁটার ঢং। আমার মোটেও মনে হয়নি যে অভিনয় করে হাঁটছে, যদিও এটাকে কোন প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব না। তাছাড়া ভাবুন স্যার, যে লোক নিজের ট্রেডমার্ক হ্যাট, জুতো, ওভারকোট সব পরে একেবারে নিজেকে মেলে ধরতে এসেছিলো, আর এমনকি আঙুলের ছাপও রেখে গেছে বিষের গ্লাসে, সে শুধু বেছে বেছে নিজের হাঁটার ঢং বদলাবে কি কারণে?'
'হ্যাঁ, তোমার কথাটা ঠিকই আছে,তবে দেখো ভায়া, সব সমস্যাই বা সন্দেহইতো ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্টে এসে আটকে যাচ্ছে! এভাবে খাপেখাপ ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেছে, এখন আমাদের কিন্তু তোজাম্মেলের অপরাধী না হবার সম্ভাবনার চেয়ে অপরাধী হবার সম্ভাবনা যে অনেক বেশী সেটা ধরে নিয়ে সাপোর্টিং তথ্য-প্রমান খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।' খানিকটা দম নিয়ে আবার বলা শুরু করে হাসনাইন, 'আর তাছাড়া পুলিশের ডেটাবেসে আমরা খুঁজে দেখেছি, তোজাম্মেলের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে মোটামুটি মিল আছে এমন আর কেউ আছে কিনা যাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। একজনও পাওয়া যায়নি!'
"হুমম স্যার, সেটাও কথা। তবে স্যার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিন্তু এখন নকল করে বানানো যায়। ন্যাশনাল ট্রেজার মুভিটাতে দেখেছিলেন, মনে আছে?'
'জানি সেটা রাজু, তবে তোমার কি ধারনা সেই প্রযুক্তি এরই মধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছে? আর তাছাড়া তোমার কথা সত্য হলে সেটার মানে দাঁড়াচ্ছে যে তোজাম্মেলকে কেউ ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছে।' যুক্তির ক্রমাগত প্রবাহে হাসনাইন খানিকটা উত্তেজিত, বলে যায়,'অথচ দেখো, তোজাম্মেল এমন কোন শত্রুর নামও বলতে পারছেনা যে কিনা তাকে ফাঁসাতে পারে। বরং যতটুকু খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাতে তোজাম্মেলের গোয়েন্দা ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়েছে খন্দকার সাহেবের এ্যাপয়েন্ট করা লোকটা, নাম কি যেনো, ওহ, মোজাম্মেল, রাইট? লোকটাকে দেখে আসলেও বুদ্ধিমান মনে হয়। তবে সেক্ষেত্রে, ফাঁসালে তো বরং তোজাম্মেলেরই প্রতিশোধ নেবার লক্ষ্যে মোজাম্মেলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করার কথা!" একটানে বলে যায় হাসনাইন, একটু থেমে তারপর কিছুটা নমনীয় গলায় বলে, "তাও তোমার সন্দেহের কারণে এখন তল্লাশীর সময় দেখবো তোমার সন্দেহের পক্ষে কিছু পাওয়া যায় কিনা।"
রাজু আর কিছু বলতে পারেনা, শুধু মনের ভেতরে জন্ম নেয়া সামান্য খটকাটাকে বয়ে নিয়েই হাসনাইনের সাথে এগিয়ে যায় সিঁড়ি বেয়ে। ওয়ালী বক্সের স্ত্রী সিনথিয়া বক্স হত্যার রহস্য উদঘাটনের জন্য রাজুকে স্পেশাল এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে রেডড্রাগনে পাঠানো হয়, অন্ধ পিয়ানিস্ট সেজে সে একসপ্তাহ ধরে রেড ড্রাগনের কাস্টমারদের গতিবিধি লক্ষ্য করেছিলো। অথচ তার চোখের ওপরই এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেলো, সে টেরও পেলোনা, যেজন্য এক ধরনের অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলো গতকাল থেকেই। 'সেজন্য কি হাসনাইন ভাই আমার কথাবার্তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছেনা?' ভাবতে ভাবটে এ সন্দেহটাকেও সে ঠিক বাতিল করে দিতে পারেনা; এনিয়ে কিছুটা মনোক্ষুন্নও সে বটে এমুহূর্তে, তাও কর্তব্যের খাতিরে হাসনাইনকে অনুসরন করা আর সহযোগিতা করা ছাড়া অন্যকোন পথ থাকেনা তার।
'স্যার, কোন কারণে আপনার কি মনে হয় এটা সাইকো কিলিং হতে পারে?' রাজু জিজ্ঞেস করে।
'আরে নাহ! যেখানে দু'বারই ফিমেইল ভিকটিম, সেখানে সাইকো কিলিংয়ে কোন শারীরিক নির্যাতন থাকবেনা সেটা হয়না। আর সাইকো কিলিংয়ে সাধারনত খুনীরা কিছু সাইন ব্যবহার করে, মেসেজ রেখে যায়। যেটা অনেকটা পুলিশের বা ডিবির প্রতি চ্যালেঞ্জের মতো। এখানে তো তেমন কিছু নেইই, বরং তোজাম্মেল তো একদম সেধে সেধেই আমাদের হাতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তুলে দিয়ে রেখেছে। সাইকো কিলাররা অনেক ঘাঘু।'
'তা, ঠিক।'
'আমার ধারনা তোজাম্মেল হিটম্যান হয়ে কাজ করেছে। অনেকদিন ধরেই তার আয় রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে, সে নিজেও স্বীকার করেছে সেটা। চলো দেখা যাক, ফ্ল্যাট তল্লাশি করে কিছু পাওয়া যায় কিনা।' বলতে বলতে কর্তব্যরত পুলিশের গার্ডকে আই.ডি দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় দু'জন।
তোজাম্মেলের ফ্ল্যাটটি পুলিশ সীল করে রেখেছে আগের রাত থেকেই, সেখানে এখনও দু'চারজন পুলিশের গার্ড দায়িত্বে আছেন। প্রতিদিন তিন শিফটে কয়েকজন করে থাকছেন, পুলিশের তল্লাশী শেষ হওয়া পর্যন্ত বেচারাদের এভাবে পালা করে পাহারা দিয়ে যেতে হবে। গতরাতে আর আজ সকালে দুটো ভিন্ন দল দু'দফা তল্লাশী চালিয়েছে, তবে এখনও হত্যাকান্ড দুটোর সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন আলামত তারা উদ্ধার করতে পারেননি। বেশ কিছু গোয়েন্দাগল্প, রহস্য উপন্যাস, সাইকো কিলিংয়ের বই অবশ্য পাওয়া গেছে; ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের দুই জুনিয়র অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বইগুলো পড়ে কোন ক্লু বের করার, তবে এখনও সেগুলোর সাথে রেডড্রাগন ডাবল মার্ডার ঘটনার কোন সাদৃশ্য বা অন্তর্নিহিত সম্পর্ক থাকার আভাস মেলেনি।
৬
৬.
ঘরে ঢুকতেই এক ধরনের ভয়াবহ বোঁটকা গন্ধে প্রায় বমি আসবার জোগাড় হাসনাইন আর রাজু, দুজনেরই। শুধু গন্ধ থেকেই বোঝা যায় যে এটা প্রচন্ড অনিয়মে চলা কোন ব্যাচেলরের বাসা, যে কিনা কোনভাবে জীবনের কোন এক সুসময়ে কেনা ঘরের আসবাবপত্রগুলো নিয়ে টিকে আছে, বা বেঁচে আছে কোনরকমে। মোটামুটি একটা বড় ড্রয়িংরুমের ডানপাশে ছোট্টখুপরীর মতো একটা বেডরুম, বেডরুমের সাথেই ড্রয়িংরূমের একই পাশে কিচেনের মতো একটু জায়গা, তা আবার দরজা দিয়ে আলাদা করাও। ড্রয়িংরুমের বাঁদিকের কিছুটা জায়গা নিয়ে বাথরুম-টয়লেট, দুর্গন্ধে সেদিকে যাওয়ার উপায় নেই।
গম্ভীর মুখে তোজাম্মেলের বসার ঘরের টেবিলের ওপরের জিনিসগুলোকে উল্টে পাল্টে দেখে হাসনাইন। বেশ কয়েকটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বেশীরভাগই স্পোর্টস ম্যাগাজিন। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে সে কয়েকটা, তারিখ দেখে বোঝা যায় অনেক পুরোনো পত্রিকা, বারবার পড়া হয়েছে সেগুলো। স্পোর্টস নিউজ বারবার পড়ার মধ্যে কি আনন্দ আছে তার বোধগম্য হয়না। তবে এতসব পুরোনো কাগজপত্রের ভীড়েও গতকালের খবরের কাগজটিও পাওয়া যায়; নেড়েচেড়ে দেখা যায় পত্রিকার বেশ কয়েকটি জায়গায় আবার তোজাম্মেলের হাতেই সম্ভবত, লাল কালিতে হিজিবিজি দাগ টানা। ক্রাইম রিপোর্টগুলো যে সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে বোঝা যায়। তবে আশপাশের আর কোন পত্রিকা দেখা যায়না, হাসনাইন বোঝে, কোন দোকানদার বা প্রতিবেশী থেকে ধার করে এনে পত্রিকা পড়ে তোজাম্মেল। 'টাকা-পয়সার বেশ টানাটানির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে লোকটা' মনে মনে বলে হাসনাইন।
টেবিলের মাঝামাঝি অংশে একটি টেবিলঘড়িও দেখা যায়, তবে সেটার চলা তো দূরের কথা কাঁটাগুলোর কোনটিও যথাস্থানে নেই! একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে যে এই শখের গোয়েন্দার সেটা বুঝতে হাসনাইনের কষ্ট হয়না, আবারও। এছাড়া অন্ততঃ ছ'সাতটি গ্লাস এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের ওপর, দেখে মনে হচ্ছে কোনটিতে বহুযুগ আগে খাওয়া চায়ের দাগ, কোনটিতে দুধের শেষঅংশটুকু শুকিয়ে সাদা সাদা গুড়োর মতো হয়ে লেগে আছে। টিভির রিমোটকন্ট্রোলারের পেছনের ব্যাটারীর খাপটিকেই শুধু পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে টেবিলেরা পাশে কার্পেটের ওপর, বেশ অযত্নে;এদিক ওদিক মেঝে আর সোফার নিচে হাতড়ে দেখে হাসনাইন, রিমোট কন্ট্রোলারটিকে কোথাও পাওয়া যায়না। কোথায় গেলো রিমোট কন্ট্রোলার? একটু খটকা লাগে হাসনাইনের। সোফার আশপাশ ছেড়ে কিচেনের দিকে এসে খুঁজতে থাকে, কোথাও নেই, শুধু সোফা থেকে একটু দূরে একটা ব্যাটারী পড়ে থাকতে দেখা যায়।
সোফার ওপর তেল চিটচিটে রঙের নানান নকশায় রাঙানো দুটো বালিশ, একটি কাঁথা। কাঁথাটি যথেষ্ট পুরোনো হয়ে গেছে, বেশ কয়েক জায়গায় ছেঁড়া, তবে মেলে ধরে হাসনাইন দেখতে পায় অদ্ভুত সুন্দর সূতোর কারুকাজ এ কাঁথায় ছিলো কোন এক কালে, সোনালী রঙের সূতোয় কতগুলো চিত্রা হরিণ ছুটছে! কে বানিয়ে দিয়েছিলো? সে কি কোন এক তরুণী যে হয়তো নিজেও গোয়েন্দা গল্পের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলো? যে হয়তো ভাবতো তোজাম্মেলের মতো অমন বুদ্ধিমান ছেলে আর দ্বিতিয়টি নেই, যে হয়তো স্বপ্ন দেখতো যে তোজাম্মেল একদিন দেশের সবচেয়ে নামকরা গোয়েন্দা হবে। অথবা কোন মায়ের হাতের করা নক্সা? যিনি কিনা সন্তানের শখের গোয়েন্দাগিরির নামে পাগলামীর কথা মনে করে মিটিমিটি হাসতে হাসতে গড়ে তুলেছেন এরকম সুন্দর কারূকাজ সুদূর কোন অতীতে?হঠাৎ তোজাম্মেল নামের এই লোকটার প্রতি হাসনাইনের একধরনের মায়া হয়, একটু শ্রদ্ধামিশ্রিত অনুভূতিও জন্মায়; লোকটার ঘরদোর নোংরা হলেও ব্যবহৃত জিনিসগুলোর মধ্যে একটা রূচির ছাপ আছে বলতে হবে। তাছাড়া জেরার সময় দেখেছে, কথাবার্তাতেও বেশ সম্ভ্রান্ত একটা ছাপ আছে তোজাম্মেলের। এমন একটা লোক কেন এরকম ধারাবাহিক খুনে জড়িয়ে পড়লো সেটা নিয়ে খানিকটা চিন্তিতও সে হয়ে ওঠে।
টেবিলের এক কোণায় দেখা যায় একটি টেলিফোন সেট, টিএন্ডটিরই সম্ভবতঃ। সোফা আর তার আশপাশের জিনিসগুলোর মধ্যে এই টেলিফোনেই ধুলো সবচেয়ে কম, হাসনাইন খেয়াল করে। বোঝা যায়, অভাবের কারণে বাসায় থাকা অবস্থায় কাউকে ফোন করলে টিএন্ডটি থেকে ফোন করতো তোজাম্মেল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে হাসনাইন, বেশ আধুনিক ফোনসেট, এ্যানসারিং মেশিনও আছে সাথে। খানিকটা আশ্চর্যই হয় সে। হয়তো কোন এককালে পসার ভালো ছিলো, অনেক বিলাসিতাও করতো লোকটি। এই মুহূর্তে তদন্তের কারণে প;রাইভেসীর কেয়ার না করলেও চলে, ফোনের মেসেজ বাটন টিপে মেসেজ শোনার চেষ্টা করে হাসনাইন, কোন ক্লু পাওয়াও যেতে পারে। মোট ছয়টি মেসেজ, এর মধ্যে জনৈকা তসলিমা খাতুনের আহ্লাদী কন্ঠের মেসেজ প্রথমটি যেখানে তিনি তাঁর মুর্গীর ডিম চোরের ধরা পড়ার খবর বেশ উচ্ছাসের সাথে জানাচ্ছেন, এবং একই সাথে খানিকটা অভিমানের সাথে এও বলেছেন যে তোজাম্মেল কাজটা না নেয়ায় তার ওপর তিনি খানিকটা ক্ষুব্ধ; তবে সেই ক্ষোভপ্রকাশের মধ্যে বিরক্তি আবিষ্কার করতে পারেনা হাসনাইন। অবশ্য তসলিমার মেসেজ ঐ একটিই, কারণ পরের পাঁচটি মেসেজই হেড়েগলার বিভিন্ন পাওনাদারদের তাগাদা। কথাবার্তার ঢং আর ভাষা শুনে বোঝা গেল যে পাওনাদাররা সবাই পাড়ার মুদি দোকানদার বা বাজারের ব্যাপারী গোছের লোকজন, এবং আশ্চর্য কারণে এদের সবাই তোজাম্মেলকে "তুজাম্মেল(Tuzammel) বাই" বলে সম্বোধন করছে।
সোফা থেকে ফুট পাঁচেক দূরে সনির ট্রিনিট্রন টিভি, ২৪ ইঞ্চির বিরাট টিভি। আবারও বুঝতে পারে হাসনাইন, একসময় ভালোই পসার ছিলো এই শখের গোয়েন্দার। টিভির সাথে এ্যাটাচড একটি ভিসিআর, তার আশপাশে বেশ কয়েকটি ভিডিও ক্যাসেট ছড়িয়ে আছে, শিরোনামগুলো সব হিন্দি সিনেমার; পুলিশ একবার সার্চ করেছে বোঝা যায়, সন্দেহজনক কিছু পায়নি বলে জব্দ করেনি। ভিডিওগুলো চালিয়ে দেখতে হতে পারে, কাছে থাকা পুলিশের গার্ডকে ক্যাসেটগুলো জব্দ করার নির্দেশ দেয় হাসনাইন।
তোজাম্মেলের বেডরুম তল্লাশীর দায়িত্ব পড়ে রাজুর ওপর, কিন্তু সে যে কিছুটা অনিচ্ছুক এটা তার শারীরিক গতিপ্রকৃতি দেখেই বলে দেয়া যাচ্ছিলো। কারণ এখনও রাজু কিছুতেই তার খটকা থেকে বের হয়ে আসতে পারছেনা। রেড ড্রাগনের খুনীর ওরকম ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটাটা নিয়ে তার সন্দেহ এত সহজে কাটার কথা না, খুনী দ্রুত পায়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছিলো, মনে হচ্ছিলো খুব তাড়া আছে তার। তোজাম্মেলের হাঁটার গতি কচ্ছপের মতো, সোজা লম্বা হয়ে হাঁটা। তারপরও হাসনাইন কেন কনভিন্সড হচ্ছেনা বা অন্য কোন সম্ভাবনার কথা আমলে নিচ্ছেনা, সেটা ভেবে সে খানিকটা বিরক্তই এমুহূর্তে। তাছাড়া কেন তোজাম্মেল খুন করবে সেটাও সে ঠিক ভেবে পাচ্ছেনা; এই মুহূর্তে তার মাথায় অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ খেলছে, কিন্তু কোনটিকেই তেমন যুৎসই মনেও হচ্ছেনা। তাও এ নিয়ে হাসনাইনের মতামত জানা দরকার, তার সাথে কথা বলা দরকার -- এই ভেবে ড্রয়িংরূমের দিকে এগিয়ে যায় সে।
সোফার পাশে রাখা চেয়ারের ওপর বসা হাসনাইনের কাছে এসে কৌতুহলী কন্ঠে বলে, "স্যার? আপনার কি মনে হয়? খুনীর মোটিভ কি?'
'অনেক কিছুই তো হতে পারে, তবে কোন ডেফিনিট কারণ তো এখনও বের করতে পারছিনা।'
'এমনকি হতে পারে যে, মিসেস খন্দকার তোজাম্মেলকে দিয়ে মিসেস বক্সকে খুন করিয়েছে, তারপর ঠিকমতো পয়সা দেয়নি। সেজন্য হয়তো রাগের মাথায় তোজাম্মেল তাঁকেও খুন করেছে।"
'না', নিশ্চিতভঙ্গিতে বলে হাসনাইন, 'মিসেস খন্দকারের ব্যাগে খামের ভেতর লাখখানেক টাকা পাওয়া গেছে, জেনেছো নিশ্চয়ই। তার মানে লেনদেন নিয়ে অন্ততঃ খুনোখুনি হবার কথা না।'
'হুমম, কিন্তু এমনকি হতে পারেনা যে তোজাম্মেল যা ভেবেছিলো তার চেয়ে অনেক কম টাকা নিয়ে এসেছিলেন মিসেস খন্দকার। মানে ধরুন, পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে, কিন্তু খুনের পর হয়তো মিসেস খন্দকার বললেন যে একলাখ টাকার বেশী দেবেননা।'
'উঁহু, সেটিও সম্ভবনা।' বলে হাসনাইন,'এই ঘরে ঢুকে বুঝতেই পারছো যে লোকটা কত অভাবে ছিলো? ফোনের মেসেজ চেক করে দেখো, শুনতে পাবে, পাওনাদার তার কম ছিলোনা। চালের দোকানদার থেকে শুরু করে তরকারীওয়ালা, সবার কাছ থেকে বাকীতে কিনে চলতো। এমন অবস্থায় এক লাখ টাকা পেলে তো তার লুফে নেয়ার কথা!'
'কিন্তু এমন যদি হয় পাঁচ লাখ দেবে বলে ডেকে এনেছে মিসেস খন্দকার, তারপর একলাখের বেশী দেয়া যাবেনা এমন কিছু বলেছে, যেজন্য হঠাৎসে ক্ষেপে গিয়ে খুন করে ফেলেছে তোজাম্মেল?'
হাসনাইন ক্রুর হাসি হাসে, বলে, 'রাজু, তোমার কি মনে হয় তোজাম্মেল রাগের মাথায় মিসেস খন্দকারকে খুন করেছে?'
'হতেও তো পারে স্যার!'
'তুমি খুনীর পুরো প্ল্যানটা দেখতে পাচ্ছোনা এখানে? প্রথমতঃ সায়নাইড বিষ তো সেই টেবিলে সে হঠাৎ পেয়ে যায়নি, আগে থেকেই কিনে পকেটে করে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া দেখো, ডিএনএ টেস্টে দুটো গ্লাসেই শুধু মিসেস খন্দকারের ডিএনএ পাওয়া গেছে গ্লাসে। তার মানে কি?'
'মিসেস খন্দকারই দুটো গ্লাসের মদ খেয়েছেন?'
'তা তো বটেই, আরেকটু ঘুরিয়ে বললে, তোজাম্মেল মদের গ্লাসে একটি চুমুকও দেয়নি! এবং, মজার কথা হলো, সেটাও তার প্ল্যানেরই একটি অংশ। এটা নিশ্চিত যে খুনটি প্ল্যান করে করা হয়েছে। রেডড্রাগনের টেবিলে বসে মিসেস খন্দকার টাকা দিতে অস্বীকার করেছেন বা নামমাত্র একলাখ টাকা সেধেছেন আর তাতে খুনী রেগেমেগে তাঁকে খুন করেছে এমনটা হবার কথা না।'
'হুমম, তা বটে। তারমানে ঘটনা হয়েছে এরকম, বলি?', উত্তেজিত কন্ঠ রাজুর, 'সায়নাইড মেশানো ছিলো কিন্তু খুনীর গ্লাসে, তারমানে খুনী নিজেই গ্লাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একফাঁকে মিশিয়ে ফেলেছে, আর সেজন্যই গ্লাসে চুমুক দেয়া তারপক্ষে সম্ভব হয়নি, তাইনা?'
'হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। মিসেস খন্দকার যে খুব বুদ্ধিমান মহিলা তা খুনী জানতো,যেজন্য সে ভদ্রমহিলার গ্লাসে বিষ ঢেলে দেয়ার রিস্ক নেয়নি। ধরা পড়ার চান্স ছিলো অনেক বেশী। সে এখানে একটা সাইকোলজিকাল গেম খেলেছে।'
'কি রকম?'
'চিন্তা করো, খুনী কিভাবে নিশ্চিত হলো যে মিসেস খন্দকার তাঁর নিজের গ্লাস শেষ হলে খুনীর গ্লাসেও চুমুক দেবে?'
'সেজন্যই তো আপনার ব্যাখ্যাটা মিলছেনা।'
'আরে সবুর করো ভায়া, সেটাইতো সাইকোলজিকাল গেমের অংশ। এজন্যই তো শুরু থেকে আমি ধরে আসছি যে খুনটি পরিকল্পিত, এবং আমার ধারনা খুব উঁচুমানের হিটম্যান দ্বারা খুনটি করা হয়েছে।'
'ঠিক বুঝলামনা স্যার।'
'মানে হলো, মিসেস খন্দকার যে পাগলের মতো হুইস্কী ভালোবাসেন, সেটা খুনী জানতো। যেজন্য সে নিশ্চিত হয়েছে যে, সে যদি গ্লাসে চুমুক না দেয়, তাহলে সে চলে যাবার পর মিসেস খন্দকার তার গ্লাসের মদটুকুও খেয়ে ফেলার লোভ সামলাতে পারবেননা।'
'এত হুইস্কির পাগল ছিলেন?'
'হ্যাঁ, বারটেন্ডার কাবিল খুব ভালো করে জানে। এজন্যই দেখো, গ্লাসে তোজাম্মেলের হাতের ছাপগুলো এসেছে ক্রিসক্রসের মতো। রিপোর্টে দেখবে বলা আছে, একটা জায়গায় অনেকগুলো আঙুলের ছাপ একটি আরেকটির ওপর এলোমেলোভাবে ছড়ানো আছে। আর কিছু জায়গায় আলাদাভাবে একেকটা আঙুলের ছাপ আছে। মানে গ্লাস হাতে নিয়ে সে বারবার নেড়েচেড়ে মিসেস খন্দকারকে বোঝাচ্ছিলো যে সে ড্রিংক করছেনা, শুধু নেড়ে যাচ্ছে। হয়তো মিসেস খন্দকার একদু'বার জিজ্ঞেসও করেছেন যে কেন সে খাচ্ছেনা, কে জানে?'
'চিন্তার কথা!'
'আরো মজার ব্যাপার খেয়াল করো, মিসেস খন্দকার যে হুইস্কী এত ভালোবাসেন সেটা কি হিটম্যানের এমনি এমনি জানার কথা?"
'কাবিলের কাছ থেকে জেনেছে?'
'বারটেন্ডাররা খুব প্রফেশনাল। প্রত্যেক কাস্টমারের অনেক গোপন কথা তারা জানেনা, এর কথা ওকে লাগালে ব্যবসা চালানো টাদের পক্ষে সম্ভব না।'
'ওকে, তাহলে সেটা জানার কথা, দাঁড়ান, হ্যাঁ, জানার কথা মিসেসের কাছের লোকজনের।'
'সেটাই!এক্সাক্টলি! সেজন্যই আমার ধারনা মিসেস খন্দকারকে তাঁর কাছের কেউই হিটম্যান দিয়ে খুন করিয়েছে, আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট বলে দিচ্ছে সেই খুনীটা হলো তোজাম্মেল।'
ব্রেইনস্ট্রমিং থামে কিছুটা সময়ের জন্য। তারপর রাজু আবার শুরু করে, বলে, 'এমনকি হতে পারে স্যার, যে, শহরেরই অন্য কোন অভিজাত ভদ্রমহিলা মিসেস খন্দকার আর মিসেস বক্সের দুজনকেই খুন করিয়েছেন।'
"হতেই পারে", বলতে বলতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে হাসনাইনের, "একটু দাঁড়াও" বলে তার চোখ চলে যায় তোজাম্মেলের কিচেনের দরজার দিকে, হাসনাইনের সাথে সাথে রাজুও তাকিয়ে দেখে যে একটা কিচেন থেকে একটা ইঁদুর বেরিয়ে এসে ছুটে যাচ্ছে এলোমেলোভাবে কোনদিকে। হঠাৎহাসনাইন লাফ দিয়ে ওঠে, কার্পেটের ওপরের রিমোট কন্ট্রোলারের খাপটিকে তুলে নিয়ে সেখান থেকে খানিকটা সামনে মেঝেতে পড়ে থাকা রিমোটকন্ট্রোলারের ব্যাটারী বরারবর একটা সরলরেখা কল্পনা করে এগিয়ে যায়। হাসনাইনের অতিরিক্ততায় খানিকটা বিরক্তবোধ করে রাজু, কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়ে কল্পিত সরলরেখা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে কিচেনের ভেতরে ঢোকে হাসনাইন। সিংকের সামনে একটু থামে, এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে তারপর মুখের হাসি প্রসারিত করে বলে, "তবে এখন আমার মনে হচ্ছে তোজাম্মেলকে আর কোনভাবেই আমাদের হিটম্যান হিসেবে সনদেহ করা যায়না। সামথিং ইজ ডেফিনিটলি রং, রাজু, ইউ ওয়্যার ড্যাম রাইট!"
বলতে বলতে সিংকের দিকে এগিয়ে যায় হাসনাইন, হাসিমুখে সিংকের নীচ থেকে বের করে আনে এমন এক বস্তু যা দেখে রাজুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার মুখজুড়ে ফুটে ওঠে বিজয়ীর হাসি। তার সন্দেহটা যে অমূলক না, এটা অন্ততঃ প্রমাণ হলো -- এই আনন্দে সে রেডড্রাগনে হত্যাকান্ড ঠেকাতে না পারার গ্লানি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেয় নিজেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা হাসনাইনকে দেখেও বোঝা যায় একটা বিশাল বোঝা তার বুক থেকে নেমে যাচ্ছে।
আনন্দে চায়ের তৃষ্ণা পায় রাজুর, তবে এই মুহূর্তে হাসনাইন ভাইকে চা খেতে যাওয়ার কথা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝে উঠতে সে পারেনা।
(চলবে)
*********************************************
সচলায়তন ব্লগে সুহান রিজওয়ানের লেখা গল্প 'ডিটেকটিভ'(http://www.sachalayatan.com/shu77han/26532)র প্লটটির উপর ভিত্তি করে লেখার একটা প্রচেষ্টা ।
বরাবরের মতো এ গল্পটিতেও নানান বিদেশী গল্পের ছায়া পাওয়া যাবে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিচ্ছি।