"একবাফের একহুতকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই হয়" -- এই ব্রত নিয়েই বাবা-মা শশব্যস্ত থাকার কারণে আশপাশের আর দশটা ছেলেমেয়ের চেয়ে অনেক আরামে বড় হয়েছি আমি, এটা স্বীকার করতে কোন আপত্তি আমি কখনো করিনি। পড়াশোনা করে গাড়ী-ঘোড়া চড়তে হবে এমন কথাও কখনও শুনতে হয়নি, আবার করল্লাভাজি বা কাঁকরোলের ঝোল খেতে আপত্তি জানালে বকাবাদ্য/চড়থাপ্পড় বা ভেজিটেবলের গুনাগুনের উপর ছোটখাট লেকচার -- কোনটাই হজম করতে হয়নি; এমনকি পাশের বাসার ছেলেটাকে ল্যাং মেরে সাঁই করে সিঁড়ি টপকে বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ার পরও বোনদের সবাই যখন বুঝতে পারত 'বদমাশটা আবার একটা কুকর্ম বাঁধিয়ে এসেছে' তখনও বাবা-মা'র হাতে ধোলাই বা বকা তো দূরের কথা, চোখরাঙানিটাও দেখতে হয়নি। সেই আমার জন্য পরীক্ষার রেজাল্ট যে কোন সমস্যাই ছিলনা, সেটা বলাই বাহুল্য। ওটা একটা হলেই হলো!
এটুকু পড়ে অনেকে ভাবতেই পারেন যে ছোটবেলায় আমি খুব আদরে আহ্লাদে ছিলাম, তবে ব্যাপারটা আসলে ঠিক পুরোপুরি তা না। ব্যাপারটা এমন না যে দুধের সরটুকু বা মুরগীর রানটা সবসময় আমাকেই দেয়া হতো, বা পরীক্ষায় ভাল করলে বাবা-মা যতটা খুশী হতেন, আমার বোনদের বেলায় ততটা খুশী হতেননা। ব্যাপারটা বরং এরকম যে, আমি যে সূস্থ্য হয়ে বেঁচে আছি, এটা দেখতে পেরেই বাবা-মা খুশী ছিলেন। সেজন্যই, আমি মারামারি করে বখে গেছি, বা বোকাসোকা বলে অংক বুঝিনা -- এসব ছোটখাট ব্যাপারগুলো তাদের কাছে কোন বিবেচনার বিষয়ই ছিলনা। সেটা টের পেয়েই হোক, অথবা কাকতালীয়ভাবেই হোক, সেসুযোগ আমি হাড়ে হাড়ে ব্যবহার করেছি। আর আমাকে এসুযোগ ব্যবহারে সবসময়েই পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে আমার ভীষন উদার বাবার আস্কারা। তবে এই আস্কারাটা ঠি ওয়ান-ওয়ে ছিলনা, আমিও খুব বাবা-ন্যাওটা ছেলে ছিলাম।
তখন অফিসটাইম ছিল দুপুর দুটা পর্যন্ত, মা বারোটার দিকে গোসল করিয়ে চুল আঁচড়ে দিতেন। আপুরা সাধারণত স্কুল থেকে ফিরে রেডিও শুনত বা বাড়ির কাজ করত, আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম কখন বাবা আসবে। বারান্দার রেলিং ছিল উঁচু, এমনি দাঁড়িয়ে বাইরে দেখা যেতনা; তবে রেলিঙে ফাঁকা ঘরের মতো তিন সারি খোপ ছিল, সেগুলোরই সবচেয়ে নিচের খোপে পা রেখে বারান্দায় ঝুলে ঝুলে অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাবা আসবে। বাবার এক পা খোঁড়া, তিনি সবসময়েই সামনের দিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে হাঁটেন, কাজেই অনেক দূর থেকেও তাঁকে চিনে নিতে কষ্ট হতনা। মনে আছে বাবা যখন হাঁটতে হাঁটতে কলোনীর গেট দিয়ে ঢুকতেন, আমার অদ্ভুত ভাল লাগত; একলাফে রেলিং থেকে নেমে 'আব্বা আসছে, আব্বা আসছে' বলতে বলতে দরজার দিকে ছুটে যেতাম, দরজা খুলে দিতাম। উপরের ছিটকিনি আটকানো থাকলে আম্মাকে এসে টানাটানি শুরু করে দিতাম। তারপর বাবা যখন বাসায় এসে ঢুকতেন, আমি অকারণেই তাঁর আশপাশে খালি ঘুরঘুর করতাম।
আজও জানিনা দুপুরে বাবার ফিরে আসার ব্যাপারটা এত এক্সাইটিং ছিল কি কারণে। একটা হতে যে অন্যদের তুলনায় তাঁকে কম সময় দেখতে পেতাম। আবার আরেকটা হতে পারে এমন যে, বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন প্রায়ই। যে জায়গাগুলোকে খুব দূরের মনে হতো, আমি ভাবতাম একা একা কখনও সেখানে যাওয়া যায়না বা যাবেনা, যেমন কমলাপুর রেলস্টেশন, তারপাশের রেস্ট হাউজ, নটরডেম কলেজ, ফকিরেরপুল বাজার, সেসব জায়গায় যেতাম বাবার হাত ধরে। বাবা সাধারণত দুটো বিস্কুট কিনে দিতেন, সারাপথ হেঁটেও দুটো বিস্কুট ফুরোতনা। এখন মাঝেমাঝে ভাবি, যে ব্যাস্তসময় কাটে অফিসে, একটাদিনও কি পাব নিজের সন্তানকে এমন একান্ত আপন করে একহাতে ছোট দুটো বিস্কুট ভরে, আরেক ছোট্টহাতকে অনেক অনেক ভালবাসায় গ্রিপ করে কিছুক্ষণ হাঁটতে? আমার সন্তান কি নিয়ে তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করবে? তার শৈশবের প্লেস্টেশনের গেমগুলো বা আইপডের নস্টালজিক সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে? বাবাকে দেখলেই ফিক করে হেসে দিতাম বা তার আশপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করতাম, একারণেই হোক অথবা আমি তার সন্তান একারণেই হোক, ১২/১৩ বছর বয়েস পর্যন্ত বাবা আমাকে কোনদিন মারেননি, বা বকেননি। আমি জানিনা সেটা আমাকে কতটুকু উপকার করেছে বা অপকার করেছে, তবে এখনকার আমার জন্য ভীষনরকমের একটা সুখস্মৃতি হয়ে রয়েছে।
ক্লাস টুতে থাকতে মনে আছে, ইংলিশ ম্যাডামকে দুই চোখে দেখতে পারতামনা। কারণটা খুব সহজ, ইংলিশ পড়তে বিরক্তই লাগত, আর তার ওপর ম্যাডামও একগাদা করে হোমওয়ার্ক/ক্লাসওয়ার্ক করাতেন প্রতিদিন। শুধু তাইনা, আমরা পড়া না পারলে এই ভদ্রমহিলা আমাদের কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন বেঞ্চের ওপর। সেকারণেই সম্ভবতঃ, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকাদের মধ্যে শুধু উনার চেহারাই আমার স্পষ্টই মনে আছে, যদিও সেটা জানতে পেরে তাঁর খুশী হবার কোন কারণ নেই। তো, গরমের ছুটি শুরু হবার আগের দিনের কথা। এর আগের পাঁচ-ছয়দিন টানা "কান-ধরে-দাঁড়ানো" শাস্তি পেয়ে আমি যারপরনাই ক্লান্ত, কোনভাবেই ইংলিশ ম্যাডামের মুখ আজ দেখতে চাচ্ছিনা। অথচ প্রথম পিরিয়ডেই হলো ইংলিশ ক্লাস। অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে স্কুলের গেট পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু তারপর আর পা বাড়াতে পারলামনা, ফিরে আসতে হলো। এদিকে, এখন বাসায়ওতো ফিরে যাওয়া যাবেনা! কি মুশকিল! কি করা যায়! সেই বয়সে অত গভীরভাবে ভাবার অবস্থা ছিলনা, তাই স্কুলগেটের একটু দূরে থাকা বটগাছের নিচে একপাশে লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্তটাই নিলাম। প্ল্যান ছিল স্কুল ছুটি হওয়া পর্যন্ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব -- বোকাসোকা ছিলাম, আগেই বলেছি।
এদিকে ঝামেলা একটা ঠিকই বেঁধে গেল। আইডিয়াল স্কুলের পাশেই যে মসজিদ, সেখানে হুজুররা (আমরা বলতাম ওস্তাদজী, ঈমাম হলেন বড় ওস্তাদজী, মুয়াজ্জিন মেঝ ওস্তাদজী আর বাকীরা সবাই র্যান্ডমলি ছোট ওস্তাদজী ) বাচ্চাদের আরবী পড়াতেন বিনা পয়সায়। সকালে ছেলেদের, দুপুরে মেয়েদের। তো, ঝামেলা বাঁধালো এই ওস্তাদজীর ছাত্রেরা, মানে কলোনীর বড় ভায়েরা। তারা হয়ত তখন সিক্স-সেভেন-এইটে পড়ে, সকালে আরবী শিখে মসজিদ থেকে ফিরছিল। আমি গাছের আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে দেখছি, হঠাৎই শিল্পী ভাই দেখে ফেলল আমাকে। স্কুলপালানো ছেলে পয়েছে হাতের মুঠোয় -- এই সুযোগ কে ছাড়ে! কিন্তু অনেক বুঝিয়েও যখন আমাকে সেখান থেকে নড়াতে পারলনা, তখন তারা হাল ছেড়ে চলে গেল; আমি খুব অনুনয়-বিনয় করে বললাম, বাসায় যাতে কিছু না বলে। তারাও আস্বস্ত করে গেলেন কিছু বলা হবেনা।
পাঁচ মিনিটও যায়নি, দেখি বাবা আসছে, ঠিক আমার বটগাছটাকে লক্ষ্য করেই। আত্না শুকিয়ে গেল -- আজকে বোধহয় আর রক্ষে নেই, মার এবার খেতে হবেই! এর আগ পর্যন্ত আমি কোনকিছু খারাপ করলে, যেমন কারো সাথে মারামারি করে বাসায় ফিরলে, যদি সেটা বাবার কানে যেত তাহলে তিনি একটা অদ্ভুত শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেন। যেটার মানে ছিল, 'ছিঃ, তোমার কাছে তো এটা আশা করিনি।' টাইপের কিছু। কিন্তু সেদিন বাবাকে আসতে দেখে আমার মনে হলো, আজ শুধু শীতল দৃষ্টিতে পার পাবনা, মনের মধ্যে কুডাক দেয়া শুরু করলো। আমি মনেমনে দুরুদ পরা শুরু করলাম, 'আল্লাহ বাঁচাও, আল্লাহ তুমি ছাড়া আর কে বাঁচাবে?'।
বাবা আসলেন, আমি ভয়েভয়ে তাকালাম, তিনি ফিক করে হেসে দিলেন।
বাসায় যাবার পথে আবার আজিজভাইর দোকান থেকে আমার পছন্দের পাউরুটিও কিনে নিয়ে গেলেনল; শুধু তাইনা, সেদিন অফিস ছুটি নিলেন, পরদিন আমাদের সবার বাড়ি যাবার কথা, বাড়ী যাওয়া উপলক্ষে আমাকে সাথে নিয়ে দুটো জামাও কিনে আনলেন। দুঘন্টার মধ্যে আমি নিজেই ভুলে গেলাম যে আমি আজ স্কুল পালিয়েছি। আজ অনেকদিন পর ভাবতে বসে মনে হচ্ছে, সেদিন স্কুল পালানোর জন্য মার খেলে সেটা হয়ত আমার নেশা হয়ে যেত। আমি নিশ্চয়ই পরেরবার বটগাছের পেছনের চেয়ে আরো ভালো পালানোর জায়গা আবিষ্কার করতাম!
তবে বাবার কারিশমা আরও চমৎকারভাবে বুঝলাম আরো পরে, ক্লাস সিক্সে। ক্লাসফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য পাগলের মতো খেটে, গোটা বিশেক মডেল টেস্ট দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছি। তখন আইডিয়াল আর সেন্ট্রাল গভঃ এর মধ্যে বৃত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো মতিঝিল থানায়, সেন্ট্রাল গভঃ সরকারী বলে একটা পার্শিয়াল্টি আছে এমন একটা কথা আইডিয়ালের পুঁজিবাদী স্যাররা পোলাপানের মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন, ফলে আমাদের নাকেমুখে পড়াশোনা করতে হতো। তো বাইবেলের বাণীর মতো সত্য যেটা হয়ে গিয়েছিল তা হলো, বৃত্তি পেতে হলে অংকে ১০০ পেতেই হবে, কারণ এটায় একটু ভুল হলেই গেল, পুরোটাই গেল! অংক নিয়ে তাই টানটান উত্তেজনা; পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রথমে পুরো প্রশ্নে চোখ বুলিয়ে যখন দেখলাম, নাহ্ সব অংকই করা আছে, উত্তেজনা কমল, মাথা ঠান্ডা করে পরীক্ষা দিয়ে আসলাম। বের হতেই দেখি গেটে বাবা দাঁড়িয়ে, অফিস থেকে সরাসরি চলে এসেছেন, হাতে আমার অতি অতি পছন্দের সিঙাড়া। আমি সিঙাড়া খাচ্ছি আর বাবার সাথে কি কি যেন বলছি। বাবা একবার জিজ্ঞেসও করেননি কোন অংকের উত্তর কত, শুধু বের হবার পর জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'কেমন হয়েছে', আমি বলেছি 'খুব ভাল'। বাপে ছেলেতে হেঁটে হেঁটে স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে আসব, এমন সময় পাশের আরেক বাবা-সন্তান জোড়ার কথোপকথন থেকে শুনলাম, ছেলে বাবাকে বলছে, 'ছয় নাম্বার অংকের রেজাল্ট ৩৯।' আমার মাথায় বাজ পড়ল! বলে কি!! তবে, বাজটা আরো ভয়াবহ মনে হলো যখন শুনলাম ছেলেটার বাবা বলছেন, 'রাইট'। আমি তড়িৎগতিতে প্রশ্ন বের করে দেখি, ব্যাটারা বইয়ের অংকই তুলে দিয়েছে, তবে কাবিলাতি করে একটা জায়গায় সংখ্যা একটু বদলে দিয়েছে। আমি বাবার হাত শক্ত করে ধরে ফেললাম, যেন আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে এমন চেহারা করে বললাম নিজের ভুলের কথা। বাবা পাঁচসেকেন্ডের মতো চুপচাপ ছিলেন, তারপর আবার সেই মুখভরা মনজুড়িয়ে দেয়া স্মিতহাসি। বললেন, 'কিছু হবেনা। তুমি স্কলারশীপ পাবেই।' তারপর একটু থেমে আবার বললেন, 'তুমি শুধু আর কাউকে বোলনা যে তোমার অংক ভুল হয়েছে, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে সবগুলো অংক হয়েছে।'
আমি জানিনা কি হলো, আমি ভালবোধ করতে লাগলাম। বাসায় এসে সবাইকে বললাম সব অংক হয়েছে, বিকেলে খেলতে গিয়েও মাঠে সবাইকে বললাম সব অংক হয়েছে, পরীক্ষা শেষে যেখানে যেখানে বেড়াতে গেলাম সবাই বৃত্তি পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করে, আমি বলি খুব ভাল হয়েছে, সব অংক হয়েছে। মাসখানেকের মাথায় আমি ভুলেই গেলাম যে আমার একটা অংক ভুল ছিল, গোয়েবলসীয় ইফেক্টের পাল্লায় পড়লাম।
যেদিন বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল, আমার মহা আনন্দ। আমি বৃত্তি পাব আশা করলেও ট্যালেন্টপুল আশা করিনি, কারণ স্কুলেই আমার চেয়ে ভাল করত অন্ততঃ দশজন। সেখানে ট্যালেন্টপুলে আমাদের স্কুলে বৃত্তি পেয়েছিল মাত্র ২ জন। আমি আনন্দে নাচছি, যাকে সামনে পাচ্ছি তাকেই বলছি, 'জানেন, জানেন, আমি বৃত্তি পাইছি'।
তখন ছিলো রোজার মাস, ইফতারে বাবা বড় বড় জিলিপি নিয়ে আসলেন। তারপর সেই জিলিপিতে কামড় বসাটে বসাতে রসিয়ে রসিয়ে বাসার সবার কাছে ফাঁস করে দিলেন সেই সত্যটা, যেটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবার বয়েস এখন ৬৮। এই বয়েসে মানুষ মূলতঃ তাদের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ করেন, কারো সাথে কথা বলতে গেলে অজান্টেই নিজের জীবনের অমূল্য স্মৃতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। আজও যখন দেশে যাই, মাঝেমাঝে দেখি বাবা মহাউৎসাহে কাউকে শোনাচ্ছেন সেই গল্প। হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেন।
সেই অশ্রুতে আমি অকারণেই সোনারোদের ঝিলিক দেখি, আমার মনে হয়, জন্মেছি, কোন ভুল করিনি, একদম ঠিক করেছি।